#ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৪০

0
384

#ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৪০
লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।

নক্ষত্র এসেছিল অষ্টম শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে। সামনে বিশাল ছুটি। তাই মায়ের কাছে কেঁদেকেটে ফুফুর বাড়িতে চলে আসা তার। নক্ষত্রকে দেখে সেই প্রথম শায়েরীর মন খারাপ হলো, রাগ হলো তার আম্মার উপর। মুখে মুখে আম্মা ডাকলেও মনে মনে শায়েরী ডাইনী বলে ডাকতে লাগলো। খেতে বসলে নায়লা নক্ষত্রকে লুকমা তুলে খাইয়ে দিতো, মাছের মাথাটা, মুরগীর কলিজাটা, দুধের সরটুকু সব নক্ষত্রের ভাগে পড়ত। আর শায়েরীকে খাইয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, সারাদিন খেলো কিনা তার খবরও নিতো না। একদিন আব্বাকে শায়েরী বলেই ফেলল, “আব্বা, আম্মা শুধু তার ভাইয়ের ছেলেকে আদর করে। আমি তো তার চোখের বালি।”
আব্বা দারুন বুদ্ধিমানের মতন কথা ঘুরিয়ে শায়েরীকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “বাব্বাহ্ তুমি এত ভালো বাগধারা শিখে গেছো জানতাম না তো! তুমি তো ভীষণ ভালো স্টুডেন্ট।”
শায়েরী অভিমানী চোখে তাকিয়েছিল শুধু, একটুও কাঁদেনি। অথচ, কান্নায় তার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। আব্বা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “মেহমান তো তাই একটু বেশি যত্নআত্তি করে।”
শায়েরী তখন আব্বাকেও মনে মনে বলল, “তুমিও আমায় ভালোবাসো না আব্বা।”
পরদিন শায়েরী ঘরের ইঁদুর মারবার বিষ কিনে নিয়ে এলো দোকান থেকে। উদ্দেশ্য দুধের সাথে মিশিয়ে নক্ষত্রকে খাওয়াবে। শায়েরীর নানী কেমন করে যেন টের পেয়ে গেলেন। শায়েরীকে ডেকে নিয়ে বললেন, “ইঁন্দুরের বিষ তোর শ্বশুরবাড়ি গিয়া তোর সোয়ামীরে খাওয়াইছ। সৎ মায়ের ঘরে থাইকা হের চোখের মণিরে বিষ খাওয়াইব! সাহস কত মাইয়ার! নাদান মাইয়া! এহন তো দুইডা ভাত পাস, এই কাম করলে সৎ মায়ে চুলের মুঠি ধইরা সোজা বাড়ি থেইকা বাইর কইরা দিব।”
শায়েরী মেঝের দিকে তাকিয়ে আঙুলে ওড়না প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, “এই বিষে কেউ মরে না, পেট খারাপ হয় শুধু। আমি ওই খেচরটার পেট খারাপ করে ফেলব। যেন টয়লেটেই থাকে সারাদিন। আমার মায়ের আঁচলে ওর এত কি! ওর কি মা নেই?”
নানী শায়েরীকে দিলো কষে এক চড়। সেই চড়ই শায়েরীর নানীর হাতের শেষ পরশ। নানী মারা গেলেন খানিক বাদেই। শায়েরী তখন গাল ফুলিয়ে পুকুরঘাটে বসেছিল। বাঁধাই করা ঘাঁট, পাশেই শিমুল গাছ। গাছের ছায়াটায় বিকালের মৃদু হাওয়ায় শায়েরী পানিতে পা ভিজিয়ে বসেছিল। হঠাৎ দেখল নক্ষত্র এদিকেই হেঁটে আসছে। নক্ষত্রকে দেখে শায়েরী বিড়বিড় করে বলল, “ও নাকি শহরের ছেলে! এমন আলুথালু আর খেচর কি করে যে শহরের ছেলে হয় কে জানে!”
নক্ষত্র আরও কাছে এগিয়ে আসতেই শায়েরী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। এই ছেলেকে দেখলেই শায়েরীর খুনী হতে ইচ্ছে করে। এই যেমন তখন ইচ্ছে করছিল নক্ষত্রের হাত- পা বেঁধে নক্ষত্রকে পুকুরে ফেলে দিতে। নক্ষত্র এসে চুপচাপ শায়েরীর পাশে বসল। বলল, “শায়েরী মানুষ কি সবসময় একা থাকতে পারে?”
শায়েরী ভ্রু কুঁচকে নক্ষত্রের দিকে তাকাল। তারপর বলল, “মানে?”
নক্ষত্র বলল, “তোমাকে একটা গল্প শুনাই চলো।”
শায়েরী এবার খানিক উৎসুক হলো। প্রশ্ন করল, “কি গল্প?”
“এক দেশে এক রাজকন্যা ছিল। ভীষণ আদুরে রাজকন্যা। রাজকন্যা তার মায়ের চোখের মণি। রাণী সেই চোখের মণির বিয়ে দিলেন এক রাজপুত্রের সাথে। তারপর নিজে একা হয়ে গেলেন। সেই রাজকন্যার আবার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। রাজকন্যার মা একা থাকবে বলে রাজকন্যা নিজের মেয়েকে তার মায়ের কাছে রাখলো। অনেক অনেক বছর! তারপর সেই মেয়েটা যখন বড় হলো তখন রাণী বলল, “আমার মেয়েটা ভীষণ একা। তুই তো বড় হয়ে গেছিস, এখন তুই একা থাকতে পারবি। আমি কতদিন আমার মেয়েটাকে দুচোখ ভরে দেখিনা। বড্ড মায়া হয়। আমি যদি এখন তার কাছে যাই তুই কি আমার উপর রাগ করবি?”
এটুকু বলে নক্ষত্র থামল। তারপর হাত বাড়িয়ে পুকুরের পানি ছিটিয়ে শায়েরীকে ভিজিয়ে দিয়ে বলল, “বলো তো ছোট রাজকন্যার কি এখন কান্নাকাটি করে স্বার্থপর হওয়া উচিত নাকি রাণীমাতাকে নিজের মেয়ের কাছে যেতে দেওয়া উচিত?”
শায়েরী পানির ঝাপটা সামলাতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর বলল, “অবশ্যই যেতে দেওয়া উচিত।”
নক্ষত্র খপ করে শায়েরীর হাতখানা ধরে ফেলল। শায়েরী বিস্ময়ে চোখ খুলে তাকাতেই নক্ষত্র বলল, “নানী মারা গেছে শায়েরী।”
শায়েরী নিষম্প চোখে তাকিয়ে রইল নক্ষত্রের চোখের দিকে। কাঁদল না একটুও শুধু ঢলে পড়ল। নক্ষত্র শক্ত হাতে শায়েরীকে ধরে অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর শায়েরীর চোখে মুখে পুকুরের পানি ছিটালো। শায়েরীর জ্ঞান ফেরবার পর শায়েরী গগনবিদারী একটা চিৎকার দিলো। নক্ষত্রকে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল, “নানী, ও নানী আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমাকে এখন কে ভালোবাসবে আর? কে ভালোবাসবে? আমি তো তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না নানী। তুমি বুকের মাঝে না নিলে আমার তো ঘুম আসে না নানী।”
নক্ষত্র সুতীব্র মায়ার জালে শায়েরীকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি আছি তো শায়েরী। কেঁদো না প্লিজ। নানী তোমার মায়ের কাছে চলে গেছে।”
শায়েরী নক্ষত্রকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল, “তুমি মিথ্যে বলছ আমাকে। আমার সাথে দুষ্টুমি করছ তাইনা ভাই?”
নক্ষত্রের চোখজোড়া ভিজে উঠল। শায়েরী দৌড়ে ঘাট থেকে বাড়ি ফিরল। নানীর ঘরে মানুষ গিজগিজ করছে। শায়েরী গিয়ে নানীর লাশের উপর লুটিয়ে পড়ল। নানীর বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে বলল, “তুমি ছাড়া আমাকে তো আর কেউ ভালোবাসে না নানী। তুমি কথা বলো না কেন নানী? কথা বলো প্লিজ। আমাকে এখন এত সুন্দর করে বেণুনী করে দিবে কে? তেল দিয়ে দিবে কে? শাসন করবে কে আমায়? বলো না নানী। তোমার গায়ের ঘ্রাণ আমি তো আর কোথাও পাব না। কোথাও পাব না। কেন পাব না? আল্লাহ্ আল্লাহ্ ও আল্লাহ্ আমাকে আমার নানীর কাছে নিয়ে যাও।”
শায়েরীর চিৎকার আর মরাকান্না পুকুরপাড়েও শোনা যাচ্ছিলো। নক্ষত্র সেখানে বসে টের পেল নক্ষত্রের চোখ, গাল, চিবুক, গলা ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কার জন্য কাঁদছিল সে? শায়েরীর নানীর জন্য? নাকি শায়েরীর জন্য? সে জানতো না। সে শুধু জানতো তার হাত -পা অনবরত কাঁপছিল। মাথার মাঝে শতশত পোকা কিলবিল করছিল। মাথা ধরে গিয়েছিল তার। ভীষণ অস্হির লাগছিল যেন বুকের মাঝে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এক অসহনীয় সহানুভূতি ধীরে ধীরে তাকে একটা নতুন অনুভূতির মাঝে ডুবিয়ে ফেলছিল। ক্রমশ গভীর থেকে গভীরে, বুকের গহীন থেকে গহীনে।
নক্ষত্র ভরা সন্ধ্যায় পানিতে নামলো। তারপর অনেক অনেকক্ষণ সাঁতার কাটলো। সাঁতার কেটে যখন পানি থেকে উঠল তখন এশার আজান পড়ছে। শায়েরী তখনও একটানা চিৎকার করে চলেছে। সে চিৎকারে আকাশ কাঁচ ভাঙার মতন টুকরোটুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল নক্ষত্রের বুকে। সেই টুকরোগুলো নক্ষত্রের হৃদপিণ্ডে শক্তিশালী হয়ে গেঁথে বসে শায়েরীর নাম পাকাপোক্তভাবে খোদাই করে ক্রমশ অবশ করে দিতে লাগলো নক্ষত্রকে, নক্ষত্রের পুরো বাম পাশকে আর নক্ষত্রের পুরো জীবন, জনম, জগত, অস্তিত্বকে। নক্ষত্র ভেজা চপচপে গায়ে শিমুলগাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিড়বিড় করে বলল, “আমি ভালোবাসব তোমায় শায়েরী, আমি ভালোবাসব। আমার পুরো জনম জুড়ে আমি শুধুই তোমায় ভালোবাসব।”
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here