#ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৩৯

0
379

লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।

নক্ষত্রের এমন ড্যাম কেয়ার আচরণ দেখে আদুরী কণ্ঠে সন্দেহ মিশিয়ে বলল, “ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজন বিয়ে করে ফেলেছে। দেখলি না খেচরটা কেমন সুড়সুড় করে ওকে নিয়ে গেল। লাগে জানি ওর বউ। আর মেয়েও তো দিব্যি ওই খেচরের হাত ধরে চলে গেল।”
মৌন বিরক্তভাবে বলল, “হাত ধরে নিয়ে যায়নি, লাগেজ ধরে নিয়ে গেছে। সব জিনিস বাড়িয়ে বলা তোর অভ্যাস।”
আদুরী রিনরিনে গলায় বলল, “আমার কথা মিলিয়ে নিস তুই। আমার সত্যি মনে হচ্ছে দুইটা মিলে বিয়ে করে ফেলেছে। আমাদের ছাড়া! ভাবা যায় এগুলা?”
আদুরীর কান্না পেয়ে যাচ্ছে। শায়েরীটা শেষ পর্যন্ত তাদের না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলল? আদুরীর কত শখ ছিল শায়েরীর বিয়ে নিয়ে। বিয়েতে সে কালো রঙের একটা সাউথ কাতান শাড়ি পরবে। তারপর নিজেকে মেকআপ প্যালেট বানিয়ে শায়েরীর পাশে স্টেজে বসবে। শায়েরীর বরের বন্ধুরা সব আদুরীকে দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তৈমুর সেসব দেখে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। আদুরীর স্বপ্নভঙ্গ হলো।
মৌন ভাবছে অন্য কথা। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে নক্ষত্র আদুরীর বিষয়টা শোনবার পর’ই হয়তো ক্ষেপে গেছে। হাজার হোক পরিবারের লোক। পরিবার কখনও এমন বন্ধুদের সাথে চলাফেরা মেনে নিতে চায় না। আদুরীকে সে বিষয়টা বলতেও পারছে না। বললে রোষানলে জ্বলে উঠবে।

নক্ষত্র শায়েরীকে বিপাশার কাছে রেখে গেছে। বিপাশার বাসায় বিপাশা আর তার মা থাকে শুধু। বিপাশার বাবা দেশের বাইরে থাকেন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগেই। এখন সে শ্বশুরবাড়িতে। তাই শায়েরীর এখানে থাকলে কোনো সমস্যাই হবে না। বিপাশাকে টাকা দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া, টাকা দিলেও নিবে না সে। উল্টো মার লাগাবে। তবে নক্ষত্র ভেবে দেখেছে এখন তার কিছু একটা করার দরকার। যদিও টিউশনি করায় মায়ের বিধি নিষেধ আছে তবুও সে টিউশনি করবে। লুকিয়ে হলেও করবে। সে তো চাইলেই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারেও পড়াতে পারে। তাছাড়া, গ্রাফিক্স এর কাজও পারে। শখের বসে শিখেছিল সে। কিন্তু কথা হচ্ছে মা তাকে কিছুই করতে দেয় না পাছে পড়াশুনার ক্ষতি হয়। তাই বলে কি শায়েরী তাকে মা – বাবার টাকায় বাহাদুরি করে বলবে? সে সামনের মাস থেকেই কিছু একটা করবে, অবশ্যই করবে, আলবত করবে। তবে বিপাশার কাছে শায়েরী সুরক্ষিত হলেও, নক্ষত্রের অনুভূতিগুলো সুরক্ষিত নয়। কখন না আবার শায়েরীকে নক্ষত্রের ভালোবাসার কথা বলে বসে! এমনিতেই আসার সময় নক্ষত্রের কানের কাছে ফিঁসফিঁস করে বলেছে, “তোর গারোয়ান নিয়ে চিন্তা করিস না।”
তারপর ফিঁক করে হেসে দিয়েছে। রাগে নক্ষত্রের ইচ্ছে হয়েছে বিপাশার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে তার কপালখানা আঘাত করে করে চৌচির করে ফেলতে। এই মেয়ে কেন জেনে গেল নক্ষত্রের মনের খবর! কেন?
.
শায়েরী বিপাশাদের বাসায় দরজা আটকে শুয়ে আছে। রাত আসি আসি করছে। সন্ধ্যা ঢলে পড়ছে রাতের গায়ে। নক্ষত্র ভাই চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। শায়েরী তারপর থেকে যে বিছানায় লেপ্টে আছে আর ওঠেনি। বালিশের কাছে মোবাইলটা ক্রমাগতভাবে বেজে চলেছে। কে এত ফোন করছে? মৌন আর আদুরীই হয়তো হবে। তাই ওঠে ফোন ধরছে না। শায়েরী কারো সাথে কথা বলবে না, কারো সাথে না। কথা বললেই কান্না এসে যাবে ওর। ওদের ছাড়া থাকবে কি করে সে? একদম ভালো লাগছে না তার, একদম না! সে একবার ভাবল সে বাইক চালানো শিখবে। তারপর নক্ষত্রকে বাইকের নীচে ফেলে পিষে ফেলবে। এই ছেলেটাকে তার একদম সহ্য হয়না। সবকিছুতে মাতব্বরি। শায়েরী সাধারণত বিচ্ছিরি ধরনের গালিগুলো দেয় না। তবে আজ একটা জঘন্য, বিচ্ছিরি আর ভয়ানক কুৎসিত গালি দিলো নক্ষত্রকে। তারপর ওঠে বসে হিজাব খুলল। চুলের খোপাটাও খুলল। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল আম্মা ফোন করেছে। শায়েরীর কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠল। কুটনা বুড়া নক্ষত্রটা কিছু বলে ফেলেনি তো আম্মাকে? ভয়ে ভয়ে মোবাইলটা ধরল। ওপাশ থেকে শায়েরীর মা নায়লা বললেন, “কিরে কখন থেকে ফোন দিচ্ছি? ধরছিস না কেন?”
শায়েরী ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আম্মা ঘুমিয়ে ছিলাম।”
নায়লা বললেন, “পরীক্ষা কেমন দিলি?”
শায়েরী বলল, “ভালোই মোটামুটি।”
নায়লা রুক্ষস্বরে বললেন, “শিকুটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। ওকে ঠিক হয়ে যেতে বল। নয়তো ওকে আমি মেরে ফেলব বলে দিলাম। সারাক্ষণ পড়া নেই, কিছু নেই। আছে শুধু টইটই করে ঘুরা আর ক্রিকেট খেলা। ওর ক্রিকেট ব্যাট আমি ওর পিঠে ভাঙব।”
শায়েরী আঁতকে উঠে বলল, “তুমি ওকে মেরেছ আম্মা?”
নায়লা তেঁতে উঠে বললেন, “না সোহাগ করব তোমার ভাইকে।”
নায়লা খট করে কল কেটে দিলেন। শায়েরী এক আকাশ মন খারাপ নিয়ে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাল। আধুনিক সাজে সজ্জিত বেশ বড় ঘর। চারিদিকে রুচিশীলতার ছোঁয়া। শায়েরী বাতি নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। এতক্ষণ তার মন খারাপ ছিল এক কারণে, এখন মন খারাপ অন্য কারণে। আম্মা এমন কেন? কখনো আদর করে ডাক দেয় না, মাথায় হাত বোলায় না, বুকের মাঝে নেয় না। সবসময় কেমন খিটখিটে আর ভারিক্কি মেজাজ নিয়ে থাকে। আম্মা তার আপন মা নয়, জন্মদাত্রী মা নয়। কিন্তু তারপরেও মা বলতে এই আম্মাকেই চিনে শায়েরী। শায়েরীর মা মারা গেছে শায়েরীর জন্মের সময়। শায়েরীর নানী তখন শায়েরীরদের বাড়ি থেকে শায়েরীকে দেখাশুনা করতেন। আব্বা চাকরী করত ঢাকায়। খারাপ যাচ্ছিল না দিনকাল। আব্বা প্রতিমাসের শেষে বাড়িতে এসে শায়েরীকে দেখে যেত। আসার সময় এত এত খেলনা আর মজার মজার এটাসেটা নিয়ে আসত। তারপর সারারাত শায়েরীকে নিয়ে নৌকায় করে বিল দেখতে যেত। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো! শায়েরী অপেক্ষায় থাকত মাস কখন শেষ হবে আর আব্বা কখন আসবে? আব্বা এলেই শুধু আনন্দ আর আনন্দ। একদিন আব্বা মাসের শেষে না এসে, এলো মাসের মাঝামাঝি সময়ে। সাথে এক সুন্দরী আন্টি। আব্বা বলল, “এটা তোমার নতুন আম্মা।”
শায়েরী ছোট থেকে বয়সের তুলনায় বেশ বুঝদার ছিল। বুঝেছিল সৎ মাকে মায়ের মতন ভাবতে না পারলে আব্বাকেও হারাবে। আব্বাই তো সব তার। মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্হায়ই নিজে সব দায়িত্ব নিয়ে নতুন আম্মাকে ঘরে তুলল। নিজের স্কুলের বান্ধবীদের ডেকে এনে সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এটা আমার আম্মা।”
নায়লা অবশ্য শায়েরীর প্রতি আগ্রহী ছিল না। অবহেলার দৃষ্টিতেই তাকাত। শায়েরী বুঝতো সব কিন্তু আব্বার কাছে কিছুই বলত না। সে নিজেও খুব একটা আদরের আশায় বসে ছিল না। সৎ মায়েদের ধাত তার জানা ছিল! শুধু চাইত কোনোভাবে অত্যাচার না করলেই হয়। আব্বা নতুন আম্মাকে রেখে চলে গেল। আম্মা বেশ কঠোর আর কর্কশ। ঘরের কাজ কিচ্ছু করত না। সারাক্ষণ এলোকেশে ঘরের এ কোণ সেকোণ হাঁটাহাঁটি করত। গুমড়া হয়ে থাকত। মাঝে মাঝে শায়েরীকে বকাঝকা করত। ফোনে আব্বার সাথেও এটাসেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করত। এমনকি শায়েরীর নানীকে পর্যন্ত অপছন্দ করত, অবজ্ঞা করত। করত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য! শায়েরী শুধু চোখ বুলিয়ে সব দেখত। শায়েরীর নানী শিখিয়েছে বোবার কোনো শত্রু নেই। শায়েরী সেটা মেনেই চলত। দিন চলে যাচ্ছিল। এর মাঝে আব্বা পরের মাসে বাড়ি এলো। আবারও একা এলো না। সাথে শায়েরীর সমবয়সী এক ছেলেকে নিয়ে এলো। সেই ছেলেকে দেখে আম্মা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। হাঁটু মুড়ে বসে একদম বুকের মাঝে নিয়ে শত শত চুমু খেলো সেই ছেলের। ছেলের নাম নক্ষত্র। আব্বা আবার শায়েরীকে ডেকে বলল, “এটা তোমার ভাইয়া। তোমার আম্মার ভাইয়ের ছেলে। আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছে।”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here