ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৩৮

0
618

ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৩৮
লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।

শায়েরী নক্ষত্রের পাশে সিঁড়িতে বসল। তারপর নক্ষত্রের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাটাকাটা গলায় বলল, “আমি এখন আর সেই ছোটটি নেই যে আমার সকল বিষয়ে সবাইকে হস্তক্ষেপ করতে দিব। ছেলেবেলায় তোমার কথায় উঠতাম আর বসতাম বলে আজও যে তোমার কথায় এখানে বসে থাকব সেটা মনে করো না। আমি আমাদের ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়েই থাকব।”
নক্ষত্র শায়েরীর দিকে ঘুরে বসে বলল, “আমি কি ফুফুকে বিষয়টা জানাব?”
শায়েরীর আঁতকে উঠে বলল, “না কখনও না।”
নক্ষত্র মেঘ গুড়গুড় কণ্ঠে বলল, “শুনো শায়েরী এই মুহূর্তে আমি যদি ফুফুকে সবটা খুলে বলি এরপর কি কি হতে পারে একবার ভেবে দেখো তো। চোখ বন্ধ করে ভাবো।”
নক্ষত্র কথা বলতে বলতে নিজের হাত দিয়ে শায়েরীর চোখজোড়া চেপে ধরল। তারপর উৎসাহী কণ্ঠে বলল, “প্রথমত ফুফু তোমাকে বাড়ি ডেকে নিয়ে যাবে। তারপর বিছানা ঝাড়ু দিয়ে একটানা মারবে। মারের চোটে ফুফু নিজেই হয়রান হয়ে পড়বে। তারপর খানিক জিড়িয়ে আবার মারতে শুরু করব। হাতের কাছে হাত পাখা পেলে তোমাকে মারতে মারতে হাত পাখাটাও ভাঙবে। তারপর তোমার পড়াশুনা চিরতরে বন্ধ করে তোমাকে টাকাওয়ালা মাথায় টাক পড়া মাঝবয়সী কোনো লোকের কাছে বিয়ে দিবে। কিংবা তোমাদের গাঁয়ের কোনো এক মাতব্বরের মেট্রিক ফেইল ছেলের কাছে গছিয়ে দিবে তোমায়। এরপর আর কি? এরপর তুমি বসে বসে সংসার করবে, বাচ্চাকাচ্চা পালবে।”
শায়েরী বিরক্তমুখে নক্ষত্রের হাতটা সরিয়ে বলল, “আম্মাকে একদম বলবে না এসব।”
নক্ষত্র মুখখানা গম্ভীর করে বলল, “আমার কথা শুনলে অবশ্যই বলব না। আর না শুনলে অবশ্যই বলব। মনে রেখো এতদিনে তুমি ঐ কাউছারের ঘরনী থাকতে। আমার জন্যই তো ফুফু তোমায় বিয়ে দিলো না। যত কান্ডকারখানা করে তোমায় বাঁচিয়েছিলাম আজ তত কান্ড কারখানা করেই তোমায় আবার অন্য কোথায় বিয়ে দিব। বরখানা কেমন খুঁজব জানো? ভুড়িওয়ালা, বদমেজাজি, গন্ডমূর্খ একটা বর। দারুণ হবে না?”
শায়েরী অনেক কষ্টে রাগটা সামলাল। কারণ সে জানে নক্ষত্র যা বলে তার আম্মা ঠিক সেটাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস এবং কার্যকর দুটো’ই করে ফেলে। শায়েরী মাথা ঠাণ্ডা রাখল। তারপর নরম সুরে বলল, “ভাই তোমার বন্ধুদের মাঝে কেউ এমন করলে তুমি কি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতে? বিপাশা আপুর কথাই ধরো। আপু এমন কিছু করলে তুমি কি আপুর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে না আর?”
নক্ষত্র শায়েরীকে খেঁক দিয়ে বলল, “আরেকটা চড় খাবা আজু। বিপুকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবার সাহস কে দিলো তোমায়?”
শায়েরী ধরে আসা গলায় বলল, “মারলে মারো। এ আর নতুন কি? তোমার চড় থাপ্পর খেতে খেতেই তো বড় হলাম। একটু আগেও তো মারলে।মারতে মারতে আমায় তুমি বেহায়া বানিয়ে ফেলেছ। এখন আর তুমি মারলেও গায়ে লাগে না। কিন্তু আমার বান্ধবীকে নিয়ে কিছু বললে আমি সহ্য করব না।”
নক্ষত্র এবার খানিক নরম হলো। নরম গলায় বলল, “শুনো শায়েরী আমি তোমার ভালো চাই তাই শাসন করি। দূরের মানুষ শাসন করতে আসবে না। কাছের মানুষরাই শাসন করে। তোমাকে যা বলছি তাই করো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বান্ধবীর বিষয়টা আমি নিজে সামলাব। তার বদলে তুমি আমায় কথা দাও তুমি আর সে বাসায় থাকবে না।”
শায়েরী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্লিজ আমি ওদের ছাড়া থাকতে পারব না।”
নক্ষত্র এবার কঠোর হলো। বলল, “তোমার আর কোনো অপশন নেই।”
শায়েরী কাঁদবে কাঁদবে করেও শেষ পর্যন্ত কাঁদল না। নক্ষত্র ভাইয়ের সামনে কেঁদেকেটে কোনো লাভ হয়না। শুধু শুধু নিজের চোখের জল বিসর্জন দিয়ে কি লাভ তাহলে? শায়েরী আকুতিভরা চাহনী নিয়ে শেষ বারের মতন চেষ্টা করে বলল, “এই মাসটা অন্তত সেখানে থাকি? তোমাদের বাসায় থাকতে পারব না আমি। মামী আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। তারচেয়ে বরং হোস্টেল ঠিক করার পর নাহয় ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিব? তোমার জন্য তো হলেও থাকতে পারি না। হলে থাকলে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ব হেনতেন আরও কত কি যে আম্মাকে বুঝিয়েছ!”
নক্ষত্রের মায়ের কথা মনেই ছিল না। আসলেই তো মা জানতে পারলে নক্ষত্রকেও বাড়ি থেকে বের করে দিবে। নক্ষত্র অনেক অনেকক্ষণ বসে ভাবতে লাগল। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুদ্ধি পেয়েও গেল। শায়েরীকে আদেশের সুরে বলল, “সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।তুমি বরং এখনই ওদের কল দিয়ে বলো জামাকাপড় গুছিয়ে রাখতে। নাহয় আরেকটা কাজ করা যায়।আমিই তোমাকে নিয়ে যাই চলো। ওরা তো আর তোমার সবকিছু গুছিয়ে দিতে পারবে না।”
শায়েরী নিরাশ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো।”
নক্ষত্র তড়িৎ উঠে দাঁড়াল তারপর তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গ্যারেজে গেল। বাইকটা নিতে গিয়েও নিলো না। বাইকে গেলে সর্বনাশ। বাইকে তো এই মেয়ের মাথা ঘুরায়। ভয়ে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যে নক্ষত্রেরও মাথা ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করে। এই রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই কোনো। নক্ষত্র গাড়িতে উঠে বসল। শায়েরী এলো বেশ হেলেদুলে। তার কোনো তাড়া নেই, সে বেশ নিরুৎসাহী।
.
মৌন আর আদুরী দুজনেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত ছিল। শায়েরী নক্ষত্রকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসতে দিয়ে ভেতরে গেল। তারপর একে একে সব গুছাতে লাগল। মৌন আর আদুরী জানতই না যে নক্ষত্র ড্রয়িংরুমে বসা। মৌন কি একটা কাজে ড্রয়িংরুমের দিকে যাচ্ছিল শায়েরী থমথমে মুখে মৌনকে ডেকে বলল, “ওড়না চড়া গায়ে। ড্রয়িংরুমে খেচর ভাই।”
মৌন এতক্ষণে খেয়াল করল শায়েরী ব্যাগ গুছাচ্ছে। সে চমকে গিয়ে বলল, “উনি এই মুহূর্তে এখানে? আর তুই লাগেজ গুছাচ্ছিস কেন?”
শায়েরী জবাবে কিছু বলল না। মৌনর উপর তার ভয়ানক রাগ হচ্ছে। আস্ত চিবিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে তাকে। মৌনর জন্যই তো সব বলতে গেল। আদুরীও পাশ থেকে বলল, “আসলেই তো কই যাচ্ছিস? বাড়ি যাবি নাকি? আঙ্কেল ঠিক আছেন তো?”
শায়েরী আদুরীর কথারও কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ লাগেজ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। একটা লাগেজে বইপত্র আরেকটায় জামাকাপড় সব। বই গোছাতে দেখে মৌন আর আদুরী পুরোপুরিভাবে হতভম্ব হয়ে গেল। অনেকবার প্রশ্নও করল কিন্তু শায়েরীর কাছে থেকে কোনো উত্তর পেল না। অবশেষে মৌন আর আদুরী শায়েরীর পেছন পেছন ড্রয়িংরুমে গেল। নক্ষত্র সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হয়ে গেছে?”
শায়েরী হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল, মুখে কিছু বলল না। নক্ষত্র লাগেজ দুটো টেনে ধরে বলল, “আমি নিচ্ছি।”
শায়েরী দিরুক্তি করল না। মৌন আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রশ্ন করল, “ভাইয়া শায়েরী কোথায় যাচ্ছে?”
নক্ষত্র মৌনের প্রশ্নের জবাব দিবে তো দূরের কথা মৌনর দিকে ফিরেও তাকাল না। লাগেজ আর তার দুইমাত্র বোন নিয়ে নিঃসঙ্কোচে চলে গেল। সে ঠিক করেছে যতদিন না শায়েরীর কোনো থাকার জায়গা ঠিক হয় তার আগ পর্যন্ত শায়েরীকে বিপাশার কাছে রাখবে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here