#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২৩

0
355

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২৩.
#Lamyea_Chowdhury

শায়েরীকে দেখে আদুরী ভূত দেখার মতন চমকে গেল। বারকয়েক ঢোক গিলে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু ঠিকই আতঙ্কের ছাপ তার চেহারাবন্দি হয়ে তাকে উৎকণ্ঠিত করে তুলল। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জিহ্ব দিয়ে ভিজিয়ে নিলো কয়েকবার। তারপর অনেক কষ্টে বলল, “শায়ু! কখন এসেছিস?”
শায়েরীও নিজের সাথে, নিজের মনের সাথে, বিবশ শরীরের সাথে লড়াই করছিল এতক্ষণ। আদুরীর কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে হঠাৎ করে তার বুকের ভিতর হুহু করে উঠল। চোখের কোল ভিজে উঠল এক অপার্থিব বন্ধুর। যে বন্ধু প্রয়োজনে বন্ধুত্ব হারাতে রাজি কিন্তু নিজের পরমপ্রিয় বন্ধুকে হারাতে সে নারাজ। সে তার বন্ধুকে কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে দিবে না, কক্ষনো না! আদুরী তার বোন। প্রহর যেমন তার বোন, আদুরী আর মৌনও তার বোন। হয়তো রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু এ সম্পর্ক আত্মার, এ সম্পর্ক কান্নার, এসম্পর্ক হাসির, সুখের- দুঃখের। শায়েরীর যদি কখনো নিজের কোনো অঙ্গও আদুরীকে দিতে বলা হয়, তবে সে বিনা সংশয়ে মুহূর্তকালের আগেই আদুরীর পায়ের তলা নিজেকে সপে দিবে সে। আদুরী তার জন্য অনেক অনেক করেছে। যে ঋণ সে নিজের শরীরের চামড়া নিয়ে আদুরীকে জুতা তৈরী করে দিয়েও শোধ করতে পারবে না। আদুরী তাকে সবসময় নিজের ছায়ায়, মায়ায় তাকে আগলে রেখেছে। দিনের পর দিন নানান উপায়ে তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। শায়েরীর কষ্টের ভার সইতে না পেরে রাতের পর রাত কেঁদেছে সে। এমন বন্ধু কজনই’বা পায়?

নিজেকে যতটা সম্ভব গুছিয়ে নিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিলো শায়েরী। তারপর চোখ মেলে ঠোঁটের কোণায় বহুকষ্টে হাসি ফুটিয়ে বলল, “বিয়ে করেছিস কবে তোরা? আমি তো ভেবেছিলাম তোদের বিয়েতে হৈ-হুল্লোড়, নাচ -গান করতে না পারলেও অন্ততপক্ষে বিয়ের স্বাক্ষী হিসেবে আমি আর মৌন থাকবই থাকব।”
আদুরী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই পাহাড়ি ঝর্ণার মতন কান্নায় ভেঙে পড়ল। তারপর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “বিয়ে করিনি।”
শায়েরী প্রথমে কথাটা বুঝতেই পারেনি। সে ভেবেছে আদুরীর কান্নার দমকে সে ভুলভাল কিছু শুনেছে। শায়েরী অবুঝের মতন আবার প্রশ্ন করল, “কি বললি দোস্ত?”
আদুরী এবার আর যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আবার থপ করে কোথাও বসেও যেতে পারলো না। সে উঁচু কোনো স্হান থেকে পাখির পালকের পড়ার মতন করে একটু একটু করে শায়েরীর দিকে এগিয়ে এলো। তারপর খুব ধীরে ধীরেই শায়েরীর পায়ের কাছটায় বসল। কিন্তু এরপর সে হয়ে গেল দুর্নিবার ঝড়। শায়েরীর চোখের পলকে আদুরী ঝড়ের গতিতে দু’হাতে শায়েরী পা জোড়া চেপে ধরল। কণ্ঠে রাজ্যের অসহায়ত্ব আর আকুতি ঢেলে বলল, “প্লিজ আব্বুকে কিছু বলিস না বোন। আব্বুকে বলিস না। আব্বু জানলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। কেটে কুচিকুচি করে কর্ণফুলীর পানিতে ভাসিয়ে দিবে। বোন আমার, দয়া কর আমায়। তোর পায়ে পড়ি বোন, তোর পায়ে পড়ি। সারাজীবন তোর চাকরানী হয়ে থাকব, তুই যা বলবি, যেমন করে বলবি তাই করব। তারপরেও…”
আদুরী আর কথা বলতে পারলো না। তার দমবন্ধ হয়ে আসলো। এবার যেন একদম সে শায়েরীর পায়ে লুটিয়ে পড়ল। কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে গেছে তার। কিন্তু শক্তহাতে শায়েরীর পা জোড়া আঁকড়ে ধরে অনবরত চোখের জল খোয়াচ্ছে সে।

শায়েরী একদম স্হির, এবার আর তার কান্না এলো না, চোখ জ্বালা করে উঠল না, বুকের মাঝে ঝড়ও উঠল না।
কিন্তু, শায়েরী কাঁপছে। থেকে থেকে কেঁপে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবে তার চোখজোড়া কেমন নিষ্কম্প, স্হির আর ঘেলাটে। সে চেয়ে আছে আদুরীর চুলের দিকে। সে কি কিছু ভাবছে? হয়তো ভাবছে, হয়তো ভাবছে না। কিন্তু আদুরীকে কাঁদতে দেখে ভীষণ ভীষণ মায়া হলো তার।আদুরীর চুলের মাঝে হাত গলিয়ে আদুরীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত, স্হির, দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “কাউকে বলব না।”
আদুরী খানিক আশ্বস্ত হলো। কিন্তু তারপরও শায়েরীর পা ছেড়ে উঠল না। শায়েরীই আবার বলল, “আমার টিউশনির সময় হয়ে গেছে। আমাকে এখন যেতে হবে।”
আদুরী জানে শায়েরীর কাছে এই ছোট ছোট টিউশনিগুলো জীবনের সকল সুখ-দুঃখ থেকেও বড়। শায়েরীর জীবন এই টিউশনিগুলোতেই আটকে আছে। একটা টিউশনি হাতছাড়া হয়ে গেলেই সে মাসে শায়েরীর বাবার ঔষধের টাকা হবে না, শায়েরীর ছোট ভাই শিকুর স্কুলের বেতন দেওয়া হবে না, এমনকি শায়েরীর বাড়িতে যে বাকি তিনটে মানুষ আছে তারা পড়ে থাকবে অর্ধাহারে এমনকি অনাহারেও। শায়েরী তিনবেলা ভাত খেতে ভুলে যেতে পারে, তার নাম যে শায়েরী সেটাও ভুলে যেতে পারে, এমনকি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যেতে পারে। কিন্তু টিউশনীতে যাওয়ার কথা ভুলেও ভুলতে পারে না। এই মেয়েটা তাদের বয়সী আর পাঁচটা মানুষের মতন হেয়ালী না, আহ্লাদী না, আমোদে না। সে বরং বয়সের চেয়েও অনেক অনেক বড়। ভারি গোছালো, দায়িত্বশীল আর ছায়াদানকারী।
সত্যিকার অর্থে সে একজন সন্তান, একজন বোন। শায়েরীর নিজের বলতে কোনো পরিচয় নেই। সে শুধু শাহআলম সাহেব আর নায়লা হোসেনের মেয়ে। শিকুর বড় বোন। সত্যিকার অর্থে এ জীবন শায়েরীর হওয়ার কথা না। কিন্তু সবই অদৃষ্টের লিখন। যেখানে মৌন এতিম হয়েও সুখরাজ্যে তার বসবাস অথচ, শায়েরী সেখানে পরিবার নিয়ে তটস্থ এবং বিপর্যস্ত।
আদুরী না চাইতেও চুপ করে শায়েরীর পা ছেড়ে সরে বসল। শায়েরী আর একটা মুহূর্তও দেরি করল না। ব্যাগ হাতে নিয়েই হুড়মুড় করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল সে। এখন কি করবে সে? আসলে তার কি করা উচিত এখন? তার কি আদৌ কিছু করণীয় আছে! সে এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু জানে আপাতত তাকে নক্ষত্র ভাইয়ের কাছে যেতে হবে। এই মানুষটার কাছে সবসময় সবধরনের সমস্যার সমাধান থাকে। আজও নিশ্চয় আছে! সে কি যাবে নক্ষত্র ভাইয়ের কাছে? কিন্তু গিয়েই বা কি লাভ? ছেলেবেলার মতন এখনও নক্ষত্র ভাইয়ের কাছে সব সমস্যার, সব কৌতূহলের, সব ঝামেলার সমাধান থাকলেও মানুষটার কাছে এখন আর হৃদয় নেই। সে এখন বড় লোক মায়ের বিশাল প্রকাণ্ড চিড়িয়াখানার বন্দি এবং হতবুদ্ধ পশু।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here