#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ৩১

0
366

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ৩১
#Lamyea_Chowdhury

মৌনর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বলল, “কাপড় কেঁচেছিস মানে? কার কাপড় কেঁচেছিস?”
শায়েরী মুখ ভার করে বলল, “খেচরের কাপড় কেঁচেছি।”
মৌনর মুখখানা কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল। মৌন বিস্মিত হয়ে বলল, “মজা করা বাদ দিয়ে সত্যি সত্যি বল কি হয়েছে।”
শায়েরী বিরক্তিতে বলল, “ধ্যাত মজা করছি না। বখে যাওয়া আমার দুইমাত্র ভাই আজ আমাকে দিয়ে শুধু কাপড় কাঁচানোই না, আয়রন করানো, বিছানা গোছানো, মশারি খোলা, হানিফ সংকেতের ইত্যাদি ইত্যাদি কাজ করিয়েছে।
আদুরীর চোখও ছানাবড়া। আদুরী আর নিজেকে সামলাতে পারল না। অবাধ্য ঠোঁটজোড়া আন্দোলন করে উঠল। মনের অজান্তেই বলে ফেলল, “তুই কি তার বউ নাকি যে এসব কাজ করে দিয়ে এসেছিস?”
শায়েরী তেঁতে উঠে বলল, “তুই কি তৈমুরের বউ নাকি যে তার সাথে বিছানায় যাস?”
আদুরী ঝাঁজের সুরে বলল, “আমরা একটা রিলেশনশিপে আছি। তাও অনেক বছর ধরে। কিন্তু তুই আর তোর সো কলড কাজিন ব্রাদার তোরা কিসে আছিস বলতো? তুই রাত বিরাতে তার ঘরের সব কাজ করিস লাগে যেন তুই তার বউ।”
শায়েরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “নক্ষত্র ভাইয়ের সাথে আমাকে জড়িয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না খবরদার।”
আদুরী তেলে বেগুণে জ্বলে উঠে বলল, “কেন বলব না? সত্য কতদিন চাপা দিয়ে রাখবি? আমি কিছু বুঝিস না ভেবেছিস? তুই আমাকে জবাব দে এত রাতে কেন তুই তোর মামার বাসায় গেলি? তোর টিউশনি যে তুই মিস দেসনি আমি শিউর। তো রাত ৭টা ৮টার দিকে কেন গেলি নক্ষত্রের বাসায়? আর গিয়ে আবার তার কাজও করে দিয়ে এসেছিস এর মানে কি? কলা দিয়ে ছেলে ভুলাবি ভেবেছিস?”
“তুই আমাকে জবাবদিহি করার কে? তোর জন্যই এই অবস্হা আমার। তোর জন্যই এতগুলো কাজ করতে হয়েছে আর খেচরটা আমাকে বাজে কথা বলবারও সাহস পেয়েছে।”
আদুরী হাত দেখিয়ে বলল, “ওয়েট! ওয়েট! আমার জন্য মানে?”
শায়েরী ঝগড়ার সুরে বলল, “হ্যাঁ তোর এসব দেখেই তো আমার মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। আর তাই ওই খেচরের কাছে গিয়েছিলাম।”
আদুরী এবার চোখ কপালে তুলে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার মত করে বলল, “ছিঃ! ছিঃ! শায়ু। ছিঃ! তুই উত্তেজিত হয়ে তোর কাজিনের কাছে গিয়েছিস?”
শায়েরীর মাথায় যেন বাঁজ পড়ল। শায়েরী থতমত খাওয়া গলায় চিৎকার করে বলল, “চুপ কর। তুই এত বাজে কথা বলতে পারিস! ঘেন্নায় আমার গা রিরি করছে। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! এসব কথাও আমাকে শুনতে হচ্ছে। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।”
“একটা থাপ্পর দিব মেয়ে। আমার জন্য তুই করবি মানে? কি করবি? তুই কি আমার সব রটনা ঘটনা তোর প্রেমিক নক্ষত্রকে বলতে গিয়েছিলি নাকি?”
শায়েরী ছোট করে বলল, “তা না।”
আদুরীর চোখ থেকে আগুন ঝরছে। সে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, “তো আমার কাহিনী দেখে তোর কেন সেখানে যেতে হলো?”
শায়েরী মিনমিন করে বলল, “আমার যখন মাথা কাজ করে না, কি করব বুঝে উঠতে পারি না তখন আমি উনার কাছে যাই। এটা ছোটবেলাকার অভ্যাস।”
“বাহ্ বাহ্ এই মেয়ে কত নাটক করতে জানে, দেখেছিস মৌন? সে নাকি কিছু হলেই তার উনার কাছে ছুটে যায়। আবার বলে কিনা উল্টাপাল্টা কথায় না জড়াতে।”
মৌন এবার কথা বলার রাস্তা খুঁজে পেল। সে এতক্ষণ দুই বান্ধবীর ঝগড়ার তান্ডবে টিকতেই পারছিল না, কিছু বলবে কি! সে বলল, “আরে ভাই তোরা কিসব বলছিস? তোদের কথা শুনে নিজেকে ভীনগ্রহের প্রাণী মনে হচ্ছে।”
আদুরী মৌনকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “আমার কাছ থেকে শোন।”
শায়েরী বলল, “মু হা হা। হ্যাঁ, হ্যাঁ এসব কথা তুই’ই বলতে পারবি। বল বল বেশি করে বল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেও তো এসব কথা মুখ খুলে বলতে পারব না।”
আদুরী রিনরিনে গলায় বলল, “আহারে ধোয়া তুলসী পাতা আমার! কাপড় কেঁচে টায়ার্ড হয়েছিস নাকি চুমু খেয়ে সেটা আগে বল।”
শায়েরী আদুরীর দিকে তেড়ে গেল। মৌন দুজনের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “দুজনেই চুপ। একদম চুপ। আর একটা কথাও না। দুইটাই ঘুমা। দুইটাই পাগল হয়ে গিয়েছিস। আজ আর কারো কিছু বলতে হবে না। যা বলার কাল বলিস। আমার পার্টি করার মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছিস তোরা।”
শায়েরী মৌনর কথায় সায় দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস আমার এখন ঘুম দরকার। আমি তো আর এই মেয়ের মতন আজাইরা বসে খাই না যে শরীরে তেল মেখে ঝগড়া করতে নামব।”
আদুরী ভেঙচি কেটে বলল, “তেল দিবি কেন শরীরে? নক্ষত্রের প্রিয় বডি লোশন মাখবি বেশি বেশি বুঝলি?”
শায়েরী আবারো তেড়ে এসে মারতে চাইল আদুরীকে। মৌন চিৎকার করে দুজনকে থামাল। তারপর শায়েরীকে ঠেলে ধাক্কে বিছানায় ফেলে বলল, “ঘুমা তো তুই। পাগল ছাগল দুইটা।”
শায়েরী প্রতিবাদ করে বলল, “পাগল ছাগল তো এই মেয়ে।”
আদুরী কিছু বলবার আগেই মৌন হাত দিয়ে আদুরীর মুখ চেপে ধরে বলল, “একদম চুপ, একদম।”
আদুরী জোর করে নিজের মুখ থেকে মৌনর হাত সরিয়ে বলল, “তোর নাম মৌন, তুই চুপ।”
শায়েরী বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে বলল, “তোর নাম আদুরী তুই বসে বসে তৈমুরের আদর খা। আর আমার নাম শায়েরী তাই শায়েরী করতে করতে তোর বাবাকে সুন্দর করে খবরখানা আমি বলে আসি গিয়ে কেমন?”
আদুরী এবার ভেজা তুলার মতন চুপসে গেল। করুণ মুখ করে চুপচাপ নিজের বিছানায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ভয়ে তার হাত পা অনবরত কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে।

মৌন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তার মাথা ব্যাথা করছে। কই ভেবেছিল সে আজ নতুন রেসিপিটা ট্রাই করবে তা তো হলোই না বরং তার রাতের খাওয়াটাও হলো না। ডাইনিং এ গিয়েও ফিরে এলো সে। ক্ষুধা আছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। চুপচাপ গিয়ে শায়েরীর পাশে শুয়ে পড়ল। খানিক এপাশওপাশ করে উঠে বসল আবার। চোখ বুজলেই শুধু চাচ্চুর মুখখানা ভেসে উঠছে। খুব বেশি অস্বস্তি হচ্ছে মৌনর। কেমন যেন একটা গুমোট হাওয়া মৌনর কানের পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সে কি কোনো ভুল করে ফেলেছে? তার সিদ্ধান্তে কি কোনো বড় রকমের মাশুল তাকে গুণতে হবে? বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। এদিক সেদিক হাঁটতে হাঁটতে ঘরময় পায়চারি করল সে। তারপর নিজের স্টাডি টেবিল এর লকার খুলে সেখান থেকে একটা ফাইল বের করল। নীল রঙা ফাইল। সেই ফাইলের মাঝে কাগজের বান্ডিল। বান্ডিলটা আসলে একটা ডায়েরীর সবগুলো পাতার ফটোকপি। ডায়েরীটা তার চাচা মাহফুজ সাহেবের। এই ডায়েরীটা মৌন খুঁজে পেয়েছিল বেশ অনেক অনেক বছর আগে। পরে ডায়েরীর কাগজগুলো ফটোকপি করে সে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। আর চাচ্চু যেন টের না পায় তাই ডায়েরীখানা আগের জায়গায় রেখে দিয়েছিল। যখন’ই মৌন বিচলিত বোধ করে, নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুটানায় ভোগে তখন’ই সে লেখাগুলো পড়ে। বারবার পড়ে, আওড়াতে থাকে। এতবছরে কতশত বার যে লেখাগুলো পড়া হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবুও এই লেখাগুলো তাকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়, শক্তি দেয়, শক্ত-সামর্থ্য করে তুলে। অদম্য শক্তিতে রুখে দাঁড়াতে বারবার অতীতকে মনে করিয়ে দেয়। বর্তমানকে ছোবলে ছোবলে নাশ করে ফেলবার প্রেষণা দেয়।
মৌন বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে কাগজগুলো নিয়ে পাশের ঘরে গেল। তারপর দরজা আটকে বাতি জ্বেলে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে মৌনর চোখ জোড়া বার ভিজে ভিজে উঠছে। সে হাতের উল্টোপিঠে সেই পানি মুছে চোয়াল শক্ত করে লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত আবারো পড়ে শেষ করল। এবং আরো একবার তার মনে হলো তার সিদ্ধান্তই যথার্থ এবং নির্ভুল সিদ্ধান্ত। সায়াহ্নকে বিয়ে করবার কোনো মানেই হয় না। সায়াহ্নকে বিয়ে করা মানে মৌনর হেরে যাওয়া। মৌন হারতে চায় না। জীবনে হার মেনে নিতে নারাজ সে। অতীত এবং জিত এই দুটো শব্দ বুকে নিয়েই প্রবল তেষ্টায় তড়পাচ্ছে সে। ধ্বক করে জ্বলে উঠেছে তার চোখ জোড়া। আগুনের লেলিহান শিখা আর অশ্রুজলের কি আশ্চর্য মিলবন্ধন মৌনর চোখজোড়ায়! মৌন জানলার থাই গ্লাসটা খুলে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজল। তারপর গান ধরল,
“হারতে চাহিনা তাই তো হারাতে হলো।
ভুলতে চাহিনা তাই তো ভুলাতে হলো।
তোমায় চাহিব না বলে, পিছন ফেরার ছলে,
রুমাল ভিজে যায় নিঠুর চোখের কোলে।

হারতে চাহিনা বলে, ভুলতে পারি না ছোবলে,
হারাতে হলো, ভুলতে হলো, তোমায় বলতে হলো!
ভালো থেকো আমায় তুমি ভুলে,
রুমাল ভিজে যায় নিঠুর চোখের কোলে।”
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here