#__ফাগুন_প্রেম___পর্বঃ ১৩ +১৪

0
231

#__ফাগুন_প্রেম___পর্বঃ ১৩ +১৪
#_লিখাঃ Bornali Suhana

💛
বর্ণালী আর কথা না বাড়িয়ে বাকি খাবারগুলো খেতে লেগে গেলো। ইভান পাশে বসেই ওর খাওয়া দেখছে৷ খাবারগুলোও কত সুন্দর করে খায় এই মেয়েটা। পাঁচ আঙুলের মাথায় অল্প অল্প করে ভাত ধরে দুই ঠোঁটের ভেতর নিয়ে তারপর মুখে ঢুকায়। ঠোঁট দুটো কি সুন্দর একটা আরেকটার সাথে চেপে ধরে তখন। এই মেয়েটা কখন জানি আমায় পাগল করে ছাড়ে। অবশ্য পাগল হওয়ার কি আর বাকি আছে!
খাবার শেষ করে প্লেট খাটের নিচে ঢুকিয়ে রেখে দিয়ে সাইড টেবিল থেকে পানির বোতলটা এনে ইভানের দিকে এগিয়ে দিলো।
-“নাও পানি খাও।”
-“আগে তুমি খাও আর হ্যাঁ মুখ লাগিয়ে খাবে।”
-“মানে?”
-“যা বলেছি তাই করো। নয়তো চিৎকার করবো আমি।”
বর্ণালী চোখ ছোট ছোট করে তাকালো ইভানের দিকে। সাথে সাথে ও একগাল হেসে দিলো। কিছু না বলেই বর্ণালী খালিকটা পানি খেলো। ওর কাছ থেকে বোতল নিয়ে মুখ লাগিয়ে গটগট করে পানি খেয়ে শেষ করলো। বর্ণালীর কেমন যেনো লাগছে। ইভানের এমন আচরণ দেখে মনের মাঝে উতালপাতাল শুরু হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন তার আপন গতিতে দৌড়ায়।
-“পানিটা অনেক মিষ্টি ছিলো।”
বলেই ইভান চোখ মারলো বর্ণালীকে। ওর বুঝতে বাকি রইলো না একটু আগে ও কেন বলছিলো যাতে পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে খেতে। ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো। লজ্জায় গাল দুটো গোলাপি থেকে লাল হয়ে যাচ্ছে।
-“আচ্ছা এখন অনেক রাত হয়েছে প্লিজ বাসায় যাও।”
-“উহু যাবো না। আজকে এখানেই থাকবো।”
-“পাগল হয়ে গেছো?”
-“পাগল তো অনেক আগেই করেছো আমায়। আরো কি বাকি আছে নাকি? চলো আমার সাথে।”
বলেই ইভান ওর হাত ধরে টেনে টেনে বেলকনিতে নিয়ে আসে।
-“কি করছো কি?”
-“বস এখানে।”
ইভান ফ্লোরে বসে গেলো। বর্ণালীকেও টেনে পাশে বসিয়ে দিলো।
-“আজকে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। অনেক অনেক কথা। যে কথাগুলো আমাদের বলা প্রয়োজন। আমি জানতে চাই তুমি আমায় কেন ভালোবাসতে চাও না। জানতে চাই তুমি কেন আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো? জানতে চাই কি এমন আছে যা তোমাকে বেঁধে রাখছে আমাকে ভালোবাসা থেকে?”
বর্ণালী চুপ করে আছে। কিছুই বলতে পারছেনা। কি বলবে ও? ও তো ইভানকে ভালোবাসতে পারবেনা। ও যে একটা সমাজে থাকে। এই সমাজ কখনো কোন বড় ছোটর মাঝে বিয়ের সম্পর্ক মেনে নিবেনা।
-“আমি অনেকবার বলেছি তোমায় ইভান। তুমি ভালো করেই জানো কেন আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবোনা।”
-“বয়সের পার্থক্যটা তোমার কাছে এতোটাই ইম্পর্ট্যান্ট?”
-“শুধু আমার কাছে না সবার কাছেই ইম্পর্ট্যান্ট ইভান। আমাদের একটা সমাজ নিয়ে চলতে হয়। আর এই সমাজে ভালো কথার চেয়ে খারাপ ও মিথ্যে কথা দ্রুত ছড়ায়।”
একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে আবারো বলতে লাগলো,
-“জানো ইভান আমার জীবনটা খুব সিম্পল। মা, বাবা, ভাইয়া আর ওই একটা বেস্ট ফ্রেন্ড রুমু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ। হুম আজকে থেকে ঈশা আর রোহানীও আমার ফ্রেন্ড। আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। আমাদের মতো মানুষের না আছে ভুরিভুরি টাকা না আছে সেই রকম পাওয়ার। থাকার মাঝে শুধুমাত্র সম্মানটাই আছে। যেটা অনেক বছরের প্রাপ্তি।
আত্মীয়-স্বজন, পারা-প্রতিবেশি সবার কাছ থেকে এই সম্মানটাই পেয়েছি। আমি কখনোই চাইবো না আমার কারনে মা-বাবা আর ভাইয়ার মাথাটা সবার সামনে নিচু হয়ে যাক। একটু বুঝতে চেষ্টা করো প্লিজ। তাছাড়া আমার তোমার প্রতি কোন ফিলিংস কাজ করেনা। কিভাবে তোমাকে ভালোবাসবো?”
এসব কথা শুনে যেনো ইভানের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এতোদিনে ওর মনের মাঝে একটুও ফিলিংস ও তৈরি করতে পারলো না? এতোটাই অক্ষম ও?
-“প্লিজ আমাকে একটা সুযোগ দাও তোমার কাছে নিজেকে তুলে ধরার। একটা সুযোগ দাও আমাকে তোমার জীবনের একটা অংশ বানানোর। আর সমাজের কথা বলছো? এই সমাজকে কি আমরা এক হয়ে দেখিয়ে দিতে পারিনা যে ছোট বড়র মাঝেও ভালোবাসা হয়। এই ভালোবাসায় তো কোন পাপ নেই। পারবে না আমার হাত ধরতে?”
এভাবে কেন বলছে এই ছেলেটা? অনেক কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে বর্ণালী দ্বিতীয়বার আর নিজেকে ছড়াতে চায় না। একবার ছড়িয়ে গুছাতে অনেক সময় লেগেছে ওর আর পারবে না।
-“প্লিজ ইভান চলে যাও। আমি পারবোনা আর কতবার বলবো?”
-“তুমি যতবারই বল না কেন আমি মানতে রাজি না। একটু বিশ্বাস করে দেখো না প্লিজ। কথা দিচ্ছি ঠকাবো না। আর তোমার পরিবারের সম্মানে একটা ফুলের টুকাও লাগতে দেবো না।”
বর্ণালী কি বলে বুঝাবে বুঝতে পারছেনা। এই ছেলেটা যে একদম আঠার মতো লেগে আছে ওর সাথে। নাহ এভাবে কথা বললে কাজ হবে না। একটু গম্ভীরভাবে কথা বলতে হবে।
-” বিশ্বাসের কথা বলছো? আচ্ছা আমি তোমাকে কতটুকুই চিনি যে তোমাকে বিশ্বাস করবো আর তোমাকে আমার জীবনে অংশ করে নেবো?”
-“একটাবার চেনার তো চেষ্টা করো। তুমি তো আমাকে চিনতেই চাওনি। আমাকে কি কিছুটা সময় দেয়া যায় না?”
-“নাহ আমি পারবো না।”
-“আচ্ছা প্রেমিক হিসাবে সময় চাইনা। অন্তত বন্ধু হিসাবে আমাকে কিছু সময় দাও। এ….এক মাস সময় দাও প্লিজ। এই এক মাসে তোমাকে চিনিয়ে দেবো ইভান কি। একমাস পর যদি তোমার মনে আমার জন্য কোন ফিলিংস কাজ করেনা। তাহলে….”
এটুকু বলেই ইভান থমকে গেলো। ওর মুখ দিয়ে এতো কঠিন কথাটা যে আসছে না। না না এমন কিছুই হবেন। বর্ণালীকে ও এই এক মাসেই রাজী করিয়ে নেবে। বর্ণালী তো ইভানেরই হবে। ভালোবাসতেই হবে ওকে।
-“তাহলে কি ইভান? তা…..তাহলে কি তুমি আমার পিছু ছেড়ে দিবে?”
বর্ণালীর বুকটা যেনো অজানা কোন ভয়ে কেঁপে উঠলো। ইভান কি আসলেই আমার পিছু ছেড়ে দেবে? হ্যাঁ আমি তো এটাই চাই যে ও আমার পিছু ছেড়ে দিক। কিন্তু এই কথাটা শুনে তো আমার খারাপ লাগার কথা না। ইভান আবার বলে উঠে,
-“হুম তুমি যাই বলবে তাই হবে।”
বর্ণালী অনেকটা টেনশনে পড়ে গেলো। এই ছেলেটাকে যে কোনরকম মানানো সম্ভব হচ্ছেনা।
-“কি হলো বর্ণালী আমার এই একটা চাওয়াও কি তুমি পূর্ণ করতে পারবে না? প্লিইইইইজ।”
এমন আদুরেভাবে কথা বলছে কেন? ইস ইচ্ছে করেও না করতে পারছিনা।
-“কি হলো ভয় পাচ্ছো নাকি যে আমার প্রেমে পড়ে যাবে?”
-“আমি কেন ভয় পেতে যাবো?”
-“তাহলে দাও আমায় একমাস?”
-“হুম ঠিকাছে দিলাম। তবে কন্ডিশন আছে।”
-“সব কন্ডিশন মঞ্জুর ম্যাডাম বলেন কি কন্ডিশন?”
কথাটা কিভাবে বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা। লজ্জাও লাগছে ভীষণ কিন্তু তবুও বলতে তো হবেই। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
-“আপাতত আ….আমাকে কখনো ওইভাবে স্পর্শ করতে পারবে না। বাকীগুলো পরে বলবো।”
ইভান ব্রু দুটো কুচকে তাকালো ওর দিকে। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়েছে তার। সিল্কি চুলগুলো এসে কপালের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ণালী যদি তার এই সৌন্দর্যটা দেখতো তাহলে নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতো। কিন্তু বেচারি তো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় পাশে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতে পারছেনা।
-“ওইভাবে স্পর্শ বলতে?”
-“যে….যেভাবে স্পর্শ কর তু….তুমি সেভাবে।”
-“কেন আমি স্পর্শ করলে কিছু হয় নাকি?”
-“দেখো পিচ্চি ছেলে পিচ্চির মতো থাকবে ঠিকাছে?”
-“দেখো প্রথমত আমি একদমই পিচ্চি না। আমি যদি আজ তোমাকে বিয়ে করি কালকেই তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবে।”
বর্ণালীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ব্রু উপরে উঠে কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। এই ছেলেটা এতো খারাপ কেন? যতটা পিচ্চি ভেবেছি ততটা পিচ্চি নয়। ভাব দেখে মনে হয় আমার থেকেও বড়।
-“একদম বাজে কথা বলবা না। এখন যাও প্লিজ।”
-“না যাবো না তোমার সাথে কথা বলবো।”
-“দেখো আমি কিন্তু তোমার সব কথাই শুনেছি তাহলে তুমি কেন আমার কথা শুনবে না? আর কাল থেকে তো পুরো একটা মাসই তুমি আমায় পাবে এখন যাও প্লিজ। বাবা একটু আগেই বাইরে গেছেন যেকোন সময় বাসায় আসবেন। তোমাকে আমার সাথে দেখে ফেললে অনেক প্রবলেম হয়ে যাবে।”
-“হুম তা ঠিক। কালকে থেকে তুমি সম্পূর্ণ আমার।”
ইভান উঠে দাঁড়াতে চাইলো তখনি গেট খোলার আওয়াজ ভেসে আসতেই বর্ণালী ওদিকে তাকালো। বাবা হাবিব হাসানকে ঢুকতে দেকেই ইভানের শার্টের কলার ধরে একটানে ফ্লোরে শুয়ে গেলো। দুজনের শরীরের অর্ধাংশ রুমের ভেতর আর অর্ধাংশ রুমের বাইরে পড়ে আছে। দুজনে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। একজনের নিশ্বাস এসে আরেকজনের নিশ্বাসের সাথে মিশে অন্যরকম এক হৃদ কাঁপানো পরিবেশ সৃষ্টি করছে। একজনের গায়ের সাথে আরেক জনের গায়ের গন্ধ মিশে যাচ্ছে। ইভানের শরীর থেকে অনেক সুন্দর একটা গন্ধ এসে নাকে লাগছে। মাতোয়ারা করতে এটুকুই যতেষ্ট। দুজনের চোখ অনেক না বলা কথাই বলে দিচ্ছে। দুজনের চোখের পলক যেন পড়তেই চাইছেনা। কে বলবে বর্ণালী ইভানকে ভালোবাসেনা? ভালো না বাসলে কি এভাবে ওকে বাবার কাছ থেকে বাঁচানোর জন্য লুকোতে হতো? কিন্তু এই মেয়েটা যে নিজের হৃদয়ের কথাগুলো বুঝতে পারছেনা। হৃদয়টাকে যে ও লোহার শিকলে বেঁধে রেখেছে। হয়তো এটাও হতে পারে নিজের সম্মানের কথা ভেবে ইভানকে বাবার থেকে আড়াল করতে চাইছে। ইভান খেয়াল করলো বর্ণালীর বাবা গান গেয়ে গেয়ে ঢুলু ঢুলু হয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। নিজেকে কিছুটা সামলে উঠে বসলো বর্ণালী সাথে ইভানও। দুজনে দুই দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে বসে আছে৷ একজন একরাশ হতাশা নিয়ে মাথা নিচু করে আছে আরেকজন তার এই হতাশার কারন খুঁজতে মিশনে নেমেছে। চেহারাটা ইভান ঠিকই পড়তে পারছে। কিন্তু কিছু একটা ইভানকে বাঁধা দিচ্ছে এই বিষয়ে কথা বলা থেকে। ইভান ভাবলো কিছু সময় কিছু জিনিস এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। কিন্তু বর্ণালী এড়িয়ে যাওয়ার মত মেয়ে না। সবসময় সোজাসাপটা কথা ওর।
-“আমার বাবা হাবিব হাসান। মায়ের নাম শারমিন বেগম। ভাইয়া সজিব হাসান। আর আমি তো জানই। বাবা-মায়ের ভালোবাসার বিয়ে ছিলো। দাদা এসব পছন্দ করতেন না তাই বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। নানুবাড়ির সবাই একসময় মেনে নেন। এই যে জায়গা যার উপর আমাদের বাড়ি এটা মায়ের জায়গা। নানু ভাই দিয়েছে মাকে। বড় মামা বাবাকে নতুন ব্যাবসাও খুলে দেন। প্রথমে আমরা সবাই নানুবাড়ির থাকতাম। বাবার যখন খুব ভালো ব্যাবসা হলো তখন এই ঘরটা বানান। ক্লাস টেনে পড়া এই মেয়ে শখ করেই এই বেলকনি বানানোর বায়না ধরেছিলো। বাবা তাই শুধুমাত্র আমার রুমে বেলকনি বানিয়ে দিয়েছিলো।”
বর্ণালী একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করে।
-“আমি যখন ইন্টার পরীক্ষা দেই তখন জানতে পারলাম বাবার ব্যাবসার সব টাকা তারই বন্ধু-বান্ধবদের সাথে উড়াচ্ছেন। মা এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পারতেন না। প্রায়ই বাবা মাকে নানা ধরনের অশালীন কথাবার্তা বলতেন। এমনও কিছুদিন গিয়েছে বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলেছেন। তখন থেকেই বাবা নেশা করাও শুরু করেন। বন্ধুদের সাথে জোয়া খেলেন। নেশার পেছনে পুরো ব্যাবসাটা শেষ করে দেন। আজ বাবার ব্যাবসা নেই বললেই চলে। ভাইয়াটা জবের জন্য অনেক খাটছে ভালো কোন জায়গায় জব হচ্ছেনা। ভাইয়ার জব হয়ে গেলে পরিবারটা একটা আলোর দিশা পাবে।”
ইভান থ হয়ে গেছে এসব কথা শুনে। একটা মেয়ে কিভাবে এতো কষ্টের কথা হেসে হেসে নির্দ্বিধায় বলতে পারে? ভেবে পাচ্ছে না ইভান। বর্ণালীর চোখে মুখে প্রচন্ড কষ্টের ছায়া। তবুও ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলে আছে। কিন্তু এই হাসিটা ইভানের ভালো লাগছেনা। হাসিটাই ওর কষ্টগুলো জানান দিচ্ছে। বর্ণালী যে কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে ইভান। ও কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা।
-“সবকিছুই যে নিয়তির লিখন। আল্লাহ যার কপালে যা লিখে দিয়েছেন তাই হবে। পৃথিবীতে কেউ কখনোই পর্যাপ্ত সুখী নয়। সবারই কষ্ট আছে। আমারও কষ্ট আছে।”
-“তোমার কি কষ্ট?”
-“শুনতে গেলে যে রাত পোহাবে।”
-“শুনাতে চাইলে পোহাক না একটা রাত।”
ইভানের ঠোঁটে রাজ্যের হাসি ফুটে উঠলো। কেউ একজন যে তার কষ্টের কথা শুনতে চেয়েছে। আর এই কেউ একজন তার প্রিয়জন। অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বর্ণালী ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে।
-“আমার মা যখন বাবাকে বিয়ে করেন আমার বয়স তখন ৫বছর। বাবা আর মা দুজনেরই এটা দ্বিতীয় বিয়ে। মায়ের সাথে যখন বাবার বাসায় আসি তখন এসে একটা বোন পাই। বুমনির বয়স তখন ৮বছর ছিলো। আমি বিষয়টা মানতে পারছিলাম না। বুমনি কিভাবে এতো সহজে মানতো?
মায়ের সাথে বুমনি কথাই বলতো না। আর আমি বাবার সাথে। কিন্তু আজব ব্যাপার কি জানো? বুমনি আমাকে খুব বেশি আদর করতো। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের মাঝে ভাব জমে গিয়েছিলো। বুমনির আম্মু ছোট বেলায় মারা গিয়েছিলেন আর আমার আব্বু তখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন সংসার গুছাতে ব্যাস্ত।”
বর্ণালী বেশ অবাক হচ্ছে। যে ছেলেটাকে সে সবসময় হাসি খুশি দেখেছে তার মাঝেও এতো কষ্ট! ছোট বেলা থেকেই তার জীবন এতোটা কষ্টের মাঝে কেটেছে! ইভান আবার বলতে শুরু করে,
-” ক্লাস নাইনে থাকতে একদিন বুমনিকে একটা ছেলে খুব ডিস্টার্ব করছিলো আমি তখন মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি। এতটুকুন একটা ছেলে ছিলাম ভেবে দেখো। কিন্তু ইট ছুড়ে ওই ছেলেটাকে মেরে মাথা থেকে রক্ত বের করে দিয়েছিলাম। কত বড় সাহস আমার বুমনিরসাথে লাগতে যায়!
তারপর আপুও সেই ছেলেটাকে কি মাইর। ভাই-বোন দুজনে মিলে মেরে প্রায় জান যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের মানুষ এসে না ছুটালে দুজনে মেরেই দিতাম। সেদিন ভাবতেও পারিনি সবচাইতে ভালো কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলেটার মা-বাবা যখন আমাদের নামে বিচার নিয়ে আসে। মা তখন আপুর পক্ষ নিয়ে আমাকে দোষ দিয়ে যাচ্ছিলো আর বাবা আমার পক্ষ নিয়ে বুমনিকে দোষ দিয়ে যাচ্ছিলো। হাহাহাহা।”
-“আসলেই? এমনটাও হয় নাকি?”
-“হয়েছিলোই তো৷ সেদিন আমার বাবার প্রতি আর বুমনির মায়ের প্রতি আপনা আপনি ভালোবাসাটা তৈরি হয়ে যায়। ধীরে ধীরে দুজনেই ভালোবাসতে লাগি মা-বাবাকে। আমি বাবাকে আব্বুর জায়গায় বসাই আর বুমনি মাকে তার আম্মুর জায়গায় বসায়। বাবা আমাকে জীবনেও কোন কিছুর কমতি পড়তে দেন নি। আর মা বুমনিকে আমার চাইতেও বেশি ভালোবেসেছে। আজকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুখী পরিবারটা আমাদের। কিন্তু একসময় সবচেয়ে কষ্টে আমরাই ছিলাম। কষ্ট কারো জীবনে স্থায়ীভাবে থাকেনা সুখ পাখি এসে একসময় ধরা দিবেই।”
বর্ণালীর চোখে মুখে হাসি রেখা দেখা যাচ্ছে। চোখে জল চিকচিক করছে। কিন্তু এই জলের কারণ তার জানা নেই। নিজের মনেই ভাবছে ইভান আসলেই অনেক ভালো। নয়তো এভাবে কি কেউ কারো পরিবারের কথা বলে দেয় নাকি? খুব সরল মনের মানুষের পক্ষেই তা সম্ভব। আর নিসন্দেহে ইভান সৎ ও সরল মনের মানুষ। এই অল্প বয়সেই কত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। কত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলো সুখ পাখি এসে ঠিকই একসময় ধরা দেবে। ইভান প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,
-“আচ্ছা তুমি কোন কোচিং সেন্টারে জয়েন করেছো?”
-“এই তো স্কুলের পাশেই এডভান্স কোচিং সেন্টার ক্লাস নাইন থেকে ইন্টারের স্টুডেন্টদের কলেজ শেষে ইংলিশ পড়াবো।”
-“তাহলে তো আমিও পড়তে হবে ম্যাডামের কাছে।”
-“হাহাহা আচ্ছা এসো পড়াবো।”
দুজনেই অনেক্ষন চুপ মেরে যায়। মেঘ আর চাঁদ অন্যরকম এক লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে। কখনো মেঘ ভেসে এসে চাঁদকে আড়াল করছে আবার কখনো অন্যত্র ভেসে গিয়ে চাঁদকে উন্মুক্ত করে আলো ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। আজকের রাত আর চাঁদ দুটোই অনেক সুন্দর। বর্ণালী পাশে থাকায় হয়তো একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। কিন্তু ইভানের কাছে এই চাঁদকে সুন্দর মনে হচ্ছেনা। হবেই বা কিভাবে তার পাশে যে এর চেয়েও সুন্দর চাঁদ বসে আছে। এই চাঁদকে রেখে কি কেউ আকাশের চাঁদের দিকে তাকাবে নাকি? ইভানও তাই করছে। সে তার চাঁদকে দেখছে। আর বর্ণালী আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হটাৎ ইভানের দিকে তাকাতেই দেখলো এক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর নিজেকে কিছুটা অপ্রস্তুত লাগলো। ওড়নাটা টেনেটুনে ইভানকে বললো,
-“কয়টা বাজে?”
ইভান মোবাইল বের করে বললো,
-“২টা বাজে ১৫ মিনিট। কেন?”
-“একটা কথা বললে রাখবে?”
-“হ্যাঁ বলো একটা কেন? তোমার হাজারটা কথা রাখবো বাসন্তী।”
-“প্লিজ বাসায় যাও।”
-“তুমি কি সত্যি চাও আমি বাসায় চলে যাই?”
-“হ্যাঁ তাছাড়া কালকে তো দেখা হবেই। এখন বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দাও।”
-“ঘুম তো আসবে না বাসন্তী। সব ঘুম যে কেউ কেড়ে নিয়েছে।”
বর্ণালী কিছুটা লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে তাকালো। ইভান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ওকে দাড়াতে দেখে বর্ণালী জিজ্ঞেস করে,
-“কি হলো?”
-“বাসায় যাবো না নাকি?”
বসা অবস্থায়ই বর্ণালী জবাব দিলো,
-“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই যাও।”
ইভান বর্ণালীর দিকে ঝুকে একেবারে মুখের সামনে এসে চোখে চোখ রেখে বললো,
-“দেখ তুমি বললে থেকে যেতে পারি।”
ইভানের উষ্ণ নিশ্বাস এসে বর্ণালীর ঠোঁটে এসে লুটিয়ে পড়ছে। বুকের ধুকপুকানিটা দ্রুত বেড়ে চলেছে। বর্ণালীর ঠোঁট কাঁপছে। নিশ্বাসটা প্রায় ঘন হয়ে আসছে। ইভান ঠোঁট কামড়ে হেসে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বর্ণালী বুকের উপর হাত রেখে লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। ইভান দ্রুত রেলিঙ টপকে ওইপাশে চলে যায়। বর্ণালী উঠে দাঁড়িয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়ায়। ইভান কিছুক্ষণ চুপ করে বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“চলি। কাল দেখা হবে।”
-“হুম। আল্লাহ হাফেজ।”
-“তুমি আগে রুমে যাও আমি চলে যাচ্ছি।”
বর্ণালী একটুখানি হেসে পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলেই ইভান বলে উঠে,
-“বর্ণালী,”
-“হু?”
-“বিশ্বাস রাখতে পারো। আমি কখনোই তোমাকে খারাপ নজরে দেখতে পারিনা। তোমাকে বিয়ে করে একেবারে হালাল উপায়ে অধিকার আদায় করে তারপর দেখবো। তার আগে কখনো ইচ্ছে করে তো দূরেই থাক ভুল করেও তোমাকে ওইভাবে দেখবো না।”
বর্ণালী এবার নিজেই নিজের কাছে লজ্জা পেয়ে গেলো। ইভান ওকে ড্রেস চেঞ্জ করতে দেখেনি এটা ওর আগেই বুঝা উচিৎ ছিলো। অন্ততপক্ষে এতোটুকু তো ওকে চিনেই। তবুও তখন কেন যে শুধু শুধুই কেঁদে বুক ভাসালো। ইস….!!!! কি ভুলটাই না হলো। এখন কি বলবেটা কি ইভানকে?
-“এই যাও যাও প্লিজ রুমে ঢুকে দরজা ভালো করে লক কর। আর হ্যাঁ প্লিজ নেক্সট টাইম চেঞ্জ করার সময় একটু খেয়াল রেখো। সবাই কিন্তু তোমার বসন্তপথিকের মতো ভালো ছেলে না গো বাসন্তী।”
এবার বাসন্তীও লজ্জায় হেসে দিলো। কোন কথা না বলেই বর্ণালী রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিলো। ইভান বাইরে থেকে হাতের ইশারায় একটা ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলো ওর দিকে। হার্টবিট আবারো দৌড়াচ্ছে। খালি গলায় ঢোক গিলে দ্রুত পিছনে ফিরে দরজায় পিঠ ঠেকালো ও। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। ইভান ততক্ষণে বাইকের দিকে পা বাড়ায়। আজ ওর মন পাখির মতো উড়তে চাইছে।
ভালোই লাগছিলো ইভানের সাথে এভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলাটা। জীবনের প্রথম কোন ছেলের সাথে এভাবে নিজের ঘরে বসে চুপিচুপি ফিসফিস করে কথা বলেছে, সময় কাটিয়েছে, হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে এমনকি নিজের হাতে খাইয়েও দিয়েছে। ভাবতেও পারছেনা এসব ও করেছে! কিন্তু কেন করলো?
তাহলে কি রুমু আর ঈশার কথাটা সত্যি হতে চলেছে?
আসলেই কি ও তার প্রেমে পড়ে গেছে?
💛
#____চলবে……..

#__ফাগুন_প্রেম__
#_লিখাঃ Bornali Suhana
#_পর্বঃ ১৪
💛
ভালোই লাগছিলো ইভানের সাথে এভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলাটা। জীবনের প্রথম কোন ছেলের সাথে এভাবে নিজের ঘরে বসে চুপিচুপি ফিসফিস করে কথা বলেছে, সময় কাটিয়েছে, হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে এমনকি নিজের হাতে খাইয়েও দিয়েছে। ভাবতেও পারছেনা এসব ও করেছে! কিন্তু কেন করলো?
তাহলে কি রুমু আর ঈশার কথাটা সত্যি হতে চলেছে?
আসলেই কি ও তার প্রেমে পড়ে গেছে?
প্রশ্নটা প্রশ্নই থেকে যায় মনটা উত্তর দিতে ব্যার্থ নাকি ও মনের কথা বুঝতে ব্যার্থ অজানাই থেকে গেলো।
`
ঈশা বাবার কেবিনে বসে আছে। এতবছরে মেয়েটা একবারও অফিসে আসেনি। ফারহান আহমেদ চিন্তায় পড়ে গেলেন এই বিষয়টা নিয়ে। কোনরকম মিটিং শেষ করে কেবিনের দিকে পা বাড়ান। আজ কি এমন হলো যে মেয়েটা অফিসে এলো? এক গাদা ভাবনা নিয়ে কেবিনে ঢুকেন ফারহান আহমেদ।
-“গুড আফটারনুন প্রিন্সেস।”
-“গুড আফটারনুন বাবাই।”
-“কি নেবে বলো? কফি?”
-“হুম কোল্ড কফি।”
ফারহান আহমেদ ২টা কোল্ড কফি অর্ডার দেন। মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার মনের অবস্থা মুখ দেখে পড়ার বৃথা চেষ্টা করছেন। ঈশা মোবাইল ঘুরাঘুরি করতে ব্যাস্ত। মনের অবস্থাও ভালো না। বাবাকে কিভাবে কথাগুলো বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।
-“মামনি কি চাই বলো?”
ঈশা ফারহান আহমেদের কথায় কিছুটা থমকে যায়। বাবা কিভাবে বুঝলেন আমি কিছু চাই?
-“আসলে বাবা….”
-“হ্যাঁ মামনি বলো আসলে কি? কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া বলে ফেলো চাঁদের দেশে যেতে চাইলে সেখানেও পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দিতে পারবে তোমার এই বুড়ো বাবাই।”
ঈশা কিছুটা মৃদু হাসলো। পিয়ন কফি দিয়ে যেতেই ঈশা কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বললো,
-“বাবা একটা ভালো বেতনের জব চাই।”
-“কার জন্য মামনি? আমি যতদূর জানি আমার মামনির জব করার কোন প্রয়োজন নেই তাহলে এই জবটা কার জন্য চাইছেন?”
-“সত্যি বলবো না মিথ্যে?”
-“আমার মামনি তার এই বুড়ো বাবাইকে কখনো মিথ্যে বলবে না। আর জানোই তো সত্যিটা বললে বাবাই খুশি হবেন।”
-“আমি একজনকে ভালোবাসি বাবা।”
-“নাম কি সেই সুপুরুষের?”
-“সজিব হাসান।”
-“প্রেম চলছে নাকি?”
-“আরে না বাবাই সে আমার প্রপোজালটা এখনো এক্সেপ্টই করেনি। অনেক সেল্ফ রেস্পক্টেড ও। আমি বুঝতে পেরেছি বাবাই ও নিজের অবস্থান চিন্তা করে কখনোই আমার সাথে প্রেমের পথে এগুবে না।”
-“হুম যা বললে বুঝলাম মামনি কিন্তু এমন সেল্ফ রেস্পক্টেড মানুষ কি কখনোই আমার অফার করা জব এক্সেপ্ট করবে? কখনোই করবে না। আমাদের অন্যরকম কিছু একটা করতে হবে।”
ঈশা বাবার এমন জবাব হবে আশাও করেনি। হয়তো বাবা ওর মনের কথা বুঝতে পারছেন তাই তো সবকিছু এতো সহজে নিলেন। অনেকটা খুশি আর অবাক হয়ে বাবাকে বললো,
-“মানে?”
-“মানে হলো সাপও মারবো আর লাঠিও ভাঙবো না।”
-“বুঝিয়ে বলো না বাবাই।”
-“ওকে আমাদের কোম্পানিতে জব দিবো না। দিলে সন্দেহ করবে। অন্য কোন কোম্পানিতে জব দেয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। আর জব দেয়ার পর তো বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে যেতে হবে না? আমার পিচ্চি মামনিটা যে অনেক বড় হয়ে গেছে।”
ঈশার চোখে পানি এতো খুশি সে ধরে রাখতে পারছেনা। ভাবতেও পারেনি সবকিছু বাবাই এতো সহজে মেনে নেবে। চেয়ার ছেড়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-“বাবাই আই লাভ ইউ।”
-“লাভ ইউ টু মামনি। ওর নাম্বারটা দিয়ে যাও।”
-“জ্বি বাবাই।”
`
ইভান বসে আছে ক্লাসে। যদিও ক্লাসে ওর কোন মনোযোগ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সামনের মাসেই এইচ.এস.সি পরীক্ষা অথচ ও এখন কারো প্রেমে উড়ো চিঠি লিখছে। বর্ণালীকেও দেখা হলো না এখনো। মেসেজ দিলো কিন্তু রিপ্লেটা পর্যন্ত পেলো না। একটা মেসেজের রিপ্লেও কি ও আশা করতে পারেনা?
-“স্যার কখন ক্লাস থেকে বের হয়ে গেছেন সেদিকে খেয়াল আছে জনাবের?”
কারো কথায় ওর আকাশ দেখায় ব্যাঘাত ঘটে। পাশ ফিরে দেখে রাফাত, হিমেল, আসাদ, মিথি আর মালিহা ওকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে আছে।
-“জনাবের কি এখনো প্রেম প্রেম পাচ্ছে?”
-“হুম আর প্রেম প্রেম আগাচ্ছে।”
বলেই ইভান চোখ মারে রাফাতকে।
-“তুই কি এখনো ম্যামের পিছু পড়ে আছিস?”
-“হুম থাকবো না কেন? যতক্ষণ না ভালোবাসি বলবে ততক্ষণ তো থাকবোই অবশ্য এর পড়েও পিছু লেগে থাকবো।”
মালিহা এমন কিছু উত্তর আশা করেনি ইভানের কাছ থেকে।
-“তুই কি আর মেয়ে পাবিনা? ওই মহিলাকে ছেড়ে ভালো কোন মেয়ের সাথে প্রেম কর। কি আছে ওর মাঝে?”
ইভান মালিহার এমন কথায় রীতিমতো রেগে যায়।
-“দেখ মালিহা প্রথমত বর্ণালী বিবাহিত নয় যে তুই তাকে মহিলা বলবি। আর দ্বিতীয়ত ও এখনো হাই স্কুল লেভেলের মেয়েদের মতোই সুন্দর, কিউট আর মায়াবী। এখনো দেখতে ঠিক ১৫-১৬বছরের কিশোরীর মতন। আর কি আছে ওর মাঝে? ওর মাঝে যা আছে তা আজকালকার মেয়েদের মধ্যে মেলানো কঠিন। আমি সবাইকে একটা কথা ক্লিয়ারলি বলে দিচ্ছি। তোরা আমার ফ্রেন্ড যদি পারিস আমাকে সাপোর্ট করবি আর না পারলে প্লিজ এই ব্যাপারে কেউ আমাকে কোন কিছু বলবিনা। আমি ওকে ভালোবাসি আর সবদিক থেকেই ভালোবাসি তাতে ও যেমনি হোক না কেন। হোক বয়সে আমার থেকে বড়। আই ডোন্ট কেয়ার বিকয এই লাভ হার এজ শী ইজ।”
কথাটা বলেই ইভান হনহনিয়ে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো। পেছন থেকে রাফাত, আসাদ আর হিমেল কত ডাকলো শুনলোই না।
-“মিথি চল।”
মালিহা আর মিথি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো। মিথি মালিহার মনের অবস্থা কিছু হলেও আন্দাজ করতে পারছে।
-“মালিহা তুই কি কোনভাবে ইভানকে….”
মিথি কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই মালিহা হাটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যায়।
-“হ্যাঁ আমি ইভানকে পছন্দ করি শুধু পছন্দ না ভালোবাসি ওকে। আর ও ওই মহিলাকে নিয়ে আমায় কথা শুনিয়েছে না? এবার দেখবি ওই মহিলার এমন অবস্থা করবো না যে স্কুলে বা কলেজে মুখ দেখাতে পারবেনা। নিজের থেকে ছোট ছেলেকে ফাঁদে ফেলে ফাসিয়ে প্রেম করতে যাবে তাই না? খুব করে প্রেম করাবো আমি ওই মহিলাকে।”
-“দেখ মালিহা ম্যাডামের তো কোন দোষ নেই। তাছাড়া ম্যাডাম এখনো ওকে ভালো বাসেন বলেন নি। প্রেম কিভাবে করবেন? তুই বরং ইভানের পিছু ছেড়ে…..”
-“একদম এমন কথা বলবি না। এই মালিহা যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। আর ইভানকে যখন একবার চেয়েছি তখন ওকে আমার করেই ছাড়বো। এট এনি কোস্ট।”
`
বর্ণালীর আজ প্রথম কোচিং ক্লাস। স্কুল থেকে বের হয়ে কোচিং সেন্টারে চলে আসে। খুব নার্ভাস লাগছে। এক্সট্রা কিছু টাকা পাওয়া যাবে ভেবেই কোচিং সেন্টারে জয়েন করা। পরিবারের খরচ আর নিজের পড়ার খরচটা দিনদিন বেড়েই চলছে। ভাইয়াকে একটু সাহায্য করতে পারলে ভালোই হয়। ভাইয়ার উপর এমনিতেও অনেক বেশি চাপ পড়ে যায়।
ক্লাসে ঢুকেই বর্ণালী অবাকের সপ্তম আকাশে উঠে যায়। ইভান এখানে কি করছে? আসলেই এসে গেলো নাকি পড়তে? ওকে দেখেই এক গাল হেসে দিলো ইভান। বর্ণালী স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে নিজের পরিচয় দিয়ে ক্লাস নিয়ে নিলো। ইভান পুরো ক্লাসেই ওকে দেখে গেছে। যার জন্য বর্ণালীর খুব অসস্থি লাগছিলো। পড়া তো একটা বাহানা ছিলো ওর কাছে। উদ্দেশ্য তো বর্ণালীকে দেখা। ক্লাস থেকে বাইরে যেতেই ইভানও ওর পিছু পিছু দৌড় লাগায়।
-“একটু সময় হবে ম্যাডামের?”
-“নাহ আজকে সময় নেই। খুব ক্ষুধা পেয়েছে বাড়িতে যাবো এখন।”
ইভানের মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায়। মুখ কাচুমাচু করে বলে,
-“কিন্তু তুমি তো বলেছিলে….”
-“কাল দেখা করিনা প্লিজ। সত্যিই আজকে অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
-“চলো আমার সাথে।”
-“কোথায়?”
-“চলো না গেলেই তোমার ক্ষুধা মিটে যাবে।”
ইভান ওর হাত ধরতে যাবে তখনি বর্ণালী এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুটা পিছনে সরে যায়। কিছু একটা ভেবে বলে,
-“কিন্তু.. আচ্ছা চলো।”
বর্ণালী জানে ও এই ছেলের সাথে কথা বলে পারবেনা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ওর সাথে চলছে। যাবোনা বললে না জানি আবার কোন সিন ক্রিয়েট করে দেয়। ইভানের সাথে কিছুদূর এগিয়ে বাইকের সামনে এসে বর্ণালী থেমে গেলো।
-“ইভান আমি তোমার সাথে বাইকে যেতে পারবো না।”
-“কেন কেন? গেলে কি হবে?”
-“প্লিজ ইভান এই বিষয় নিয়ে জোর করো না।”
ইভান বাইক রেখেই দাঁড়ালো। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“রিকশা চলবে?”
বর্ণালী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-“ঠিকাছে।”
দুজনে প্রখর রোদের মাঝে রিকশায় উঠে বসেছে। বর্ণালীর সাইড ব্যাগটা ওদের মাঝখানে রাখতে দেখে ইভানের খুব খারাপ লাগলো। কিন্তু কিছু বললো না সবকিছুর পরেও তো তার সাথেই আছে। সূর্যটা মাঝে মাঝে কোথাও লোকাচ্ছে আবার অনেক গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে রোদ ছড়াচ্ছে। খারাপনা দিনটা ভালোই লাগছে। মৃদুমন্দ বাতাসে বর্ণালীর চুলগুলো উড়ে ইভানের মুখে এসে পড়ছে। বড্ড বেহায়া চুলগুলো। ওর হাজার বাঁধা মানতে রাজি না। চুলগুলো তার নিজের মাঝেই মেতে আছে। মাঝেমধ্যে বর্ণালীর আঙুলের সাথে খেলা করছে। ইভান যেনো এই রুপের মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে। বর্ণালী চোখ দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে কি? ইভান মাথা দু’দিকে নেড়ে ইশারায় বলে দেয় কিছুনা।
মিরপুর পল্লবীতে হটপ্লেট রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকশা থামায় ইভান। এমন একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলো না বর্ণালীর। ভেতরে ঢুকেই একটা কর্ণার টেবিল দেখে বসে পড়ে দূজন। লাঞ্চের জন্য চিকেন স্টেইক রাইস অর্ডার দেয় ইভান।
-“এটা আমার একটা প্রিয় রেস্টুরেন্ট। ভালোই লাগে এখানে আসতে। নিরিবিলি পরিবেশ। আর এখানের খাবারটাও ভালো। ঢাকাতে এখন সিফট হলে কি হলো আমার আসা যাওয়া প্রায়ই হতো।”
-“একা আসো নাকি সবসময়?”
-“প্রথম এসেছিলাম একটা গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে। দেন বন্ধুদের সাথেও অনেকবার এসেছি। গার্লফ্রেন্ড দের সাথেও দেখা করতে অনেকবার এসেছি। তবে সবসময় এই রেস্টুরেন্টেই না অন্যান্য রেস্টুরেন্টেও গিয়েছি।”
বর্ণালী খালি গলায় বিষম খেলো। গার্লফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে এসেছে? বাহ! না জানি কতটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো এই ছেলের।
ইভান একটু হেসে বললো,
-“কিন্তু জানো, আজকে এটা আমার কাছে অন্যদিনের চাইতে বেশি ভালো লাগছে কারণ তুমি পাশে আছো।”
বলেই লজ্জামাখা একটা হাসি দিলো ইভান। বর্ণালীও কেন জানি কিছুটা লজ্জা পেলো। ওর কথায় হার্ট দ্রুত বিট করতে লাগলো। ইভানের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি দিলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা রোমান্টিক গান চলছে যা এই পরিবেশকে আরো বেশি রোমান্টিক করে দিচ্ছে।
💛
#____চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here