#Journey episode 27

0
189

#Journey episode 27

জেসমিন,রাইফ আর সেলিম আইসিইউ এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।ভেতরে ডাক্তারেরা ছুটাছুটি করছে।জাফারের অবস্থা ভাল না,খিচুনী দিয়ে বারবার ওর দেহ উপরে উঠে যাচ্ছে,দুজন নার্স মিলে তাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে রেখেছে।বাইরে থেকে সবাই শুধু দেখছে,আর চোখের পানি ফেলছে।জেসমিন মুখ হাত দিয়ে চেপে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে যাচ্ছে আর আল্লাহকে ডাকছে।সেলিম একটু পর পর কাঁদছে আর জিজ্ঞাসা করছে “পাপা এরকম কেন করছে?” রাইফ চুপ করে তাকিয়ে আছে।ওর চোখ জোড়া খুব জ্বলছে,কারণ এখন কাঁদতে চেয়েও পারছে না।প্রিয় মানুষকে হাসপাতালের সাদা বিছানায় দেখে কেউই মানতে পারে না।জাফারের এরকম অবস্থা আর সহ্য করে না পেরে জেসমিন ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দেয়,দরজা খুলেই ভেসিনে হড়হড় করে বমি করে কিছুক্ষণ আগে খাওয়া সব খাবার বের করে দেয়।বমির প্রেশারে ওর মাথার রগ দুটো টনটন করে ওঠে।মাথায় ধরে দেয়ালে হেলান দেয়,আর পারছে না এতকিছু মেনে নিতে।

হাত মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে অজু করে বের হয় জেসমিন।ওয়েটিং রুমে এক কোণায় বসে পড়ে একটা পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে।দুরাকাত নামায পড়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায়,

“হে আল্লাহ! তুমি এই পৃথিবীর সবকিছুর মালিক,তুমি জানা অজানা সব জ্ঞান রাখো।আল্লাহ,তুমিই আমাদের রিযিকদাতা,পালন কর্তা,হায়াতের মালিক।আল্লাহ,আমাদের সেলিমকে তুমি এতীম করে দিও না,আমাদের উপর থেকে জাফার ভাইয়ের ছায়া নিয়ে নিও না।আল্লাহ,এটুকু দয়া কর,আমার হায়াত জাফার ভাইকে দিয়ে দাও,তবু আমার কারণে এত বড় ক্ষতি হতে দিও না।আমার কারণে একটা মানুষকে পৃথিবী থেকে নিও না,এক্টা নিষ্পাপ বাচ্চাকে এতীম করিও না।আল্লাহ! আমি যে নিজেকে কোনদিনও মাফ করতে পারব না…”

বিড়বিড় করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কাঁদতে থাকা জেসমিনকে দেখে আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে আছে,তবে সবারই ভেতরটা কষ্টের মোড়কে মুড়ে দিয়েছে ওর কান্না।এখন সবাই একটা জিনিসই চাচ্ছে,স্রষ্টা যেন এই মেয়ের কথা শুনেন,তার কষ্ট লাঘব করে দেন।

কিন্তু আমরা জীবনকে যেমন দেখি,যেভাবে ভাবি,যে হিসাবের খাতায় যেভাবে হিসাব রাখি,স্রষ্টাও কি তাই করেন? করেন না।তার হিসাব অন্যরকম।তিনি সবার জন্যেই তার রিযিক,অক্সিজেন,খাদ্য,পদক্ষেপ,সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।তার হিসেবেই আমরা আসি,আবার চলে যাই।আর তাই হয়ত জাফার একটা অপরিচিত স্থানে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য ছাড়াই চোখ দুটো বড় বড় করে ঘড়ঘড় শব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

জেসমিনের হাজার মিনতি,সেলিমের অবুঝ কান্না আর রাইফের বুকের ছটফটানি সত্ত্বেও ভেনিসের অস্পিদেইল এসএস জিওভানি ই পাওলো হসপিটালের আইসিইউতে জাফার সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। রাইফ আর সেলিম কাঁচের ওপার থেকে দেখে,অনেকক্ষণ ধরে দেহের ভেতর ছটফট করে কষ্ট পাওয়া জাফারের আত্মাটা ঝপ করেই বেরিয়ে গেল।ওর আত্মার চলে যাওয়াতেই যেন হার্টবিট মাপার পালস মনিটরের আঁকাবাকা দাগ গুলো একেবারে সমান্তরাল ভাবে চলতে শুরু করে।ডাক্তার দুবার তার বুকে ইলেক্ট্রিক শক দেয় আর মনিটরের দিকে তাকায়।মনে আশা,এই বুঝি প্রাণের স্পন্দনে সে দাগ গুলো কেঁপে উঠবে,নেচে উটজে তারা জাফারকে জীবন্ত প্রমাণ করবে।নিথর দেহ খানা খানিকটা কেঁপে ওঠে,কিন্তু তাতে কোন প্রাণের অস্তিত্ব ওরা দেখতে পারে না,না থাকে ঐ দুচোখে কোন প্রাণের স্পন্দন।কয়েক মিনিটের মাঝে তাই ডাক্তারের নির্দেশে তার শরীর সকল প্রকার যন্ত্রপাতি মুক্ত করা হয়।দুজন নার্স মিলে তাকে সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়।

সেলিম রাইফের শার্টের হাতা ধরে জোরে জোরে টানে,
“আঙ্কেল,পাপাকে ওরা ঢেকে দিল কেন?আঙ্কেল?এই আঙ্কেল? বল না? আঙ্কেল,তুমি কি কাঁদছ?আমারও কান্না পাচ্ছে…আমি কাঁদতে চাই না।আমি কাঁদলে পাপা খুব মন খারাপ করে।আমি কাঁদব না আঙ্কেল,তুমি বল না,পাপাকে ওরা কেন ঢেকে দিল?আমি পাপাকে দেখতে পাচ্ছি না যে…আঙ্কেল?কথা বলো না?তুমি যদি কান্না কর,তাহলেও কিন্তু পাপা কষ্ট পাবে।আমার ভাল লাগছে না,তুমি কেন কথা বলছ না??!!”

সেলিমের চিৎকারের উত্তর দিতে রাইফ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।ওর চোখে এখন শুধু নীরব অশ্রু।কোন সন্তানের এই প্রশ্নের উত্তর হয় না,এই উত্তর দেয়ার মত সাহস রাইফের নেই।সে সেলিমকে বুকে নিয়ে না চাইতেও শব্দ করে কেঁদে ফেলে।

পেছন থেকে এ সময় ডক্টরের আগমন হয়।মুখের মাস্ক সরিয়ে মুখ খুলে কিছু বলতে গিয়েও বলেন না,শুধু মাথা এদিক ওদিক দুলিয়ে মুখ নিচু করে চলে যান।রাইফ সেলিমকে কোলে তুলে নেয়।ছেলেটা ওর গলা জড়িয়ে “পাপা,পাপা” বলে কাঁদছে।রাইফ ওয়েটিং রুমের দিকে তাকায়,জেসমিনকে তখন দেখে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদছে।সেলিমকে নিয়ে আস্তে করে ওর পাশে বসে অপেক্ষা করে কখন ও মুনাযাত শেষ করবে।রাইফ আর সেইমের অস্তিত্বের টের পেতেই ও মুনাযাত শেষ করে চোখে প্রশ্ন নিয়ে ওদের দিকে তাকায়।রাইফ ওর সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারে না,কি করে পারবে?এত বড় দুঃসংবাদ কি করে দিবে?মাটির দিকে তাকিয়ে বলে,

“জানো,আমি এত কষ্ট বোধহয় বাবা মারা যাওয়ার পর আর কখনও পাইনি।একটা রক্ত মাংসের সম্পর্ক বিহীন মানুষ যে এতটা মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারে,তা আমি জাফারে ভাইকে না চিনলে জানতে পারতাম না।আজ তুমি আমি যে একত্রে,তার অনেকটা উনার কারণেই।ভাবতে পার,সেই মানুষটা তার সবচেয়ে বড় আমানত আমাদের কাছে দিয়ে চলে গেছেন?ভাবতে পার,কত বড় দায়িত্ব আমাদের দিলেন?জেস,আমরা কি পারব তার প্রিয় জিনিসের যত্ন তার মত করে নিতে?”

জেসমিনের আর কিছু বুঝার বাকি নেই।সেলিমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।ওদের তিনটা মানুষের কান্না দেখে আশেপাশের পরিবেশও গুমোট হয়ে ওঠে,নির্মল আকাশ হুট করে ছেয়ে যায় বিষাদের গাঢ় অন্ধকারে,সে আকাশ জুড়ে নামে অঝোর ধারায় বৃষ্টি।বাতাসের করাল ঝাপটায় গাছ গুলো এদিক ওদিকে পাগলের মত হেলতে শুরু করে,যেন আজকের বিষাদের আসরে ওরা শোকের মাতম করে যাচ্ছে।

রাইফের দৃষ্টি স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে বাইরের আকাশে গিয়ে ঠেকেছে।জেসমিন আর সেলিমকে বুকে চেপে মাথায় হাত বুলায়।
“কাল রাতে বলছিলে না,আমাদের এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে?জাফার ভাই সমস্যা কিছুটা সমাধান হলেই আমরা চলে যাব?দেখলে,আল্লাহ তোমার কথা শুনেছে,জাফার ভাইকে নিয়ে গেছে,সমস্যা পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছে।এখন আমাদের এই শহর ছেড়ে যাবার আর কোন বাঁধা নেই।আমাদের পিছুটান ছুটে গেছে…”
“আমি…আমি সেভাবে বলিনি!আমি তো চেয়েছিলাম ভাই সুস্থ হোক,আমরা তাকে নিয়ে…কিন্তু…”

জেসমিন যাই চেয়ে থাকুক,আল্লাহর ইচ্ছা মতই সব হয়েছে।যার যখন সময় শেষ,সে তখনই ছেড়ে যায় পৃথিবী,এটাই বিধাতার অলংঘনীয় নিয়ম।

সেদিন বিকেলেই গোসল জানাজা শেষে ভেনিসে জাফারকে সমাহিত করা হয়।রাইফ ওর খাটিয়ার এক প্রান্ত কাঁধে নেয়,ওর শার্টের কোণা ধরে হাঁটে ছোট্ট সেলিম।অনেক কষ্টে ও শান্ত হয়েছে,কারণ ও জানে না যে,ওর পাপা এখানেই শুয়ে আছে,তাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,সেখান থেকে পাপা আর আসবে না।জাফারকে কবরে শুইয়ে তার কবরে মাটি দেয়া হয়।তার মাথার কাছে ফলকে তাড়াহুরো করে লিখা হয়েছে,

“জাফার আহমাদ,যার নাম ভুলবে না সেলিম”

রাইফ সেলিমের হাত ধরে একটু একটু করে ওকে ওর পাপার কবর থেকে দূরে নিয়ে আসছে।ছোট মানুষটা ঠিক বুঝে উঠছে না,কেন ঐ কবরের দিকে না চাইলেও বারবার ঘুরে তাকাতে ইচ্ছে করছে,ওখানে কি ওর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে?

সেরাতে ১০টার ফ্লাইটে তিনজন রওনা দেয় সিসিলি।রাইফ আর জেসমিনের মাঝখানে সেলিম ঘুমিয়ে আছে।ভাঙা হাত নিয়ে রাইফ কোনোমতে বসে আছে,আর জেসমিন সেলিমের মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে ভাবছে,

জীবনের নষ্ট অতীত থেকে বাঁচতে এক জার্নিতে ভেনিসের বুকে ছুটে আসা,সেই জীবনের একটা গতি করতে সিসিলিতে জার্নি করা,সিসিলি থেকে আবার জার্নি করে ভেনিস,ভেনিস থেকে স্বামীর সাথে নতুন সংসার বাঁধতে আবারো সিসিলিতে জার্নি,আর সেই জার্নিতে জাফারকে হারানো,এখন জাফারের এক মাত্র সন্তান,ভবিষ্যতকে নিয়ে আরেক অনিশ্চিত জার্নি…

জাফারের জার্নি তো শেষ,কিন্তু ওর এই জার্নির শেষ কোথায়?

নাকি জীবনটাই একটা জার্নি?

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here