#Journey episode14
#১৪
জেসমিন বসে আছে টেক্সির প্যাসেঞ্জার সিটের বাঁ পাশে,আর রাইফ বসেছে ডান পাশে।দুজনেই জানালার পাশ ঘেঁষে এমন ভাবে বসে আছে যেন পারলে জানালা টপকে বেরিয়ে যায়।জেসমিনের বেশ অস্বস্তি লাগছে,বারবার রাইফের হুট করে হাত ধরার কথা মনে পড়ছে।আঙুল মুখে দিয়ে নখের কোণে দাঁত দিয়ে খুটছে,যেটা চিন্তায় পড়লেই করে।ওদিকে রাইফ ভাবছে,বান্ধবী মনে হয় মাইন্ড করেছে,তানাহলে কথা বলত।কিন্তু এভাবে তো চুপ থাকা যায় না!অনেক ভেবে কথা শুরু করে,
“আচ্ছা দোস্ত,তোর জাভেদের কথা মনে আছে?”
জেসমিন ঘাড় ঘুরায়।
“হুম,আছে তো! কেন?ওর আবার কি হল?”
“জাভেদ তো গত মাসে বিয়ে করেছে”
“ওহ,হ্যাঁ,ফেসবুকে দেখলাম।বউটা মাশাল্লাহ সুন্দর আছে”
“হুম।সবুজের কথা মনে আছে?”
“ঐ মটুটা?থাকবে না আবার! র্যাগ ডে তে আমাকে রঙ দিয়ে যে কাহিনীটা করল রে বাপ! আমি তো ভেবেছিলাম ধরে পিট্টি না দিয়ে বসি ওকে!”
“হা হা হা!ও তো শুরু থেকেই এমন, কিছুই করবে না,আর যখন করবে,বেশিই করবে! ঐ মটুও তো বিয়ে করেছে”
“বলিস কি!”
“সত্যিই”
“আমার শুধু অনম আর সাবিনার সাথে কথা হয়।সাবিনা তো অনেক আগেই বিয়ে করেছে,অনমেরও বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে”
“দেখি তো, শালা প্রায়ই হবু বউকে নিয়ে ছবি দেয়”
“হুম…তার মানে আমাদের ব্যাচের সবার বিয়ে হয়ে গেছে”
“সেটাই।…শুধু তুই আর আমি বাকি!”
জেসমিন আনমনে মাথা নাড়ে,কথা সত্যি।রাইফ হেলান দিয়ে জেসমিনের দিকে ঘাড় কাত করে বলে ফেলে,
“চল,আমরা বিয়ে করে ফেলি!”
জেসমিন চট করে রাইফের দিকে তাকায়,ও কি দুষ্টুমি করছে?ওর ঠোঁটের কোণায় ঝুলে থাকা মুচকি হাসি দেখে সেটাই তো মনে হচ্ছে! এক সেকেন্ড পর জেসমিনের খেয়াল হল, রাইফের এই কথার মানে তো ওকেই বিয়ের প্রস্তাব না দেওয়াও হতে পারে!রাইফের দিকে ঘুরে বলে,
“আমার বিয়ের কোন ইচ্ছা নেই।এক কাজ করি,তোর জন্যে একটা মেয়ে খুঁজি,তার সাথে তোর বিয়ে দিয়ে দেই!”
রাইফ হতাশ হয়।ভেবেছিল জেসমিনের মনে কিছু আছে কিনা বের করবে,তা আর হল না।তারমানে…যাই হোক।রাইফও হেসে জবাব দেয়,
“আমার জন্য মেয়ে খুঁজতে হবে না রে।আমিই খুঁজে নেব।তোর জন্য এক ছেলে আছে,করবি বিয়ে?ইটালীয়ান,একদম সিটিজেনশীপ পেয়ে যাবি!”
জেসমিন কিছুটা গরম হয়ে যায়।
“তোকে বলেছি আমার জন্য ছেলে খুঁজতে?আমারটাও আমি খুঁজে নিতে পারব”
একটু থেমে যোগ করে,
“তাছাড়া আমি দেশী মানুষ বিয়ে করব,বিদেশী ছেলে চাই না আমার।তাই তুই নিশ্চিন্তে থাক!…কিরে,ওরকম করে দাঁত কেলাচ্ছিস কেন,?!”
“এমনিতেই!তোর যদি দেশি ছেলেই পছন্দ, তাহলে না বিয়ে করে বিদেশে আসলি কেন?”
জেসমিন মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“চার বছরে আমার জীবনের উপর দিয়ে কি গেছে,তা তো কোনোদিন জানতেও চাসনি।এখন আর সেসব জিজ্ঞেস করে কি হবে?…বিয়ে আমি দেশী ছেলেকেই করতে চেয়েছি,পারিনি,হয়ত ভবিষ্যতেও পারব না…”
“সরি রে,বিদেশ এসে পারিনি আগের মত আর থাকতে।তুই কিন্তু এখন বলতে পারিস কি হয়েছিল।আমি এখন শুনতে চাই”
“নাহ,তার প্রয়োজন নেই।কারণ আমি জানাতে চাই না। And for your kind information, I don’t want to share it with anyone. If you don’t ask me any further question, I will be glad”
এরকম স্পষ্ট বক্তব্যের পর আর কিছু বলার থাকে?রাইফ বুঝতে পারে না।জেসমিনের কি হয়েছিল?এমন কি হয়েছিল যাতে জেসমিন এভাবে কথা বলছে?আর বারবার চার বছরের গ্যাপের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? বিদেশে চলে গেলে,বড় হয়ে গেলে এরকমটাই তো হয়,তাই না?একেকজন একেকদিকে চলে যায়,যার যার জীবন নিজের মত গুছিয়ে নেয়,আগের বন্ধুরা দূরে চলে যায়,ব্যস্ত হয়ে যায়।কারো জন্য কারো সময় থাকে না।কিন্তু জেসমিন কেন এভাবে রিএক্ট করছে? এখন এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না,অন্য এক সময় না হয় জানা যাবে।রাইফ তাই প্রসঙ্গ পালটে ফেলে।
কথায় কথায় ওরা ত্রাপানিতে চলে আসে।টেক্সি থেকে নামার পর জেসমিন বুঝতে পারে না কি করবে।রাইফ প্রস্তাব দেয়,
“তোকে কি এখন হাঁটার সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যাবে?”
জেসমিন মাথা নাড়ায়। রাইফ জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে জেসমিনের পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
“আচ্ছা,বিয়ে করার জন্য কেমন ছেলে পছন্দ তোর?”
“তোকে না বললাম আমার বিয়ের ইচ্ছে নেই?”
“ঠিক আছে,তবে একটা না ইচ্ছা তো তবুও থাকে,তাই না?”
“আমার নেই”
রাইফ বুঝতে পারে জেসমিন রেগে আছে।একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,
“বুঝলাম। একটা মজার ব্যাপার কি জানিস দোস্ত?এই একবিংশ শতকে মানুষ নানারকম খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতে চায় না ঠিক,কিন্তু মনে মনে ঠিকই চায় কেউ একজন থাকুক যার ভালবাসায় কষ্টগুলো হিমালয়ের বরফ হলেও যেন গলে যায়, যত লুকানো কথা আছে সব যাকে বলা যাবে,দিন শেষে যার একটু ছোঁয়া সব ক্লান্তি দখিনা বাতাসের মত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে,অতি সাধারন মুহূর্তগুলোও বিশেষ হয়ে উঠবে,যার সাথে চায়ের কাপ শেয়ার করা যাবে,বৃদ্ধ বয়সে দন্তহীন হাসি হাসা যাবে।ভালোবাসা চায় না,এমন আত্মা না পৃথিবীতে একটাও নেই জানিস!
এই আমার কথাই ধর না!ভালোবাসা কি জিনিস বুঝলামই না,কিন্তু ঠিক বিলিয়ে গেলাম! যখন খুব ছোট তখন থেকে বাবা মায়ের সাথে সমস্যা।তাদের মতের মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি।তারা এক ছাদের নিচে ছিল কারণ আমি তাদের মাঝে ছিলাম,দুজনকে দুহাতে টেনে ধরে রেখেছিলাম।যখন সিক্সে পড়ি,তখন থেকে তাদের বিছানা আলাদা,ঘর আলাদা,পৃথিবী আলাদা,চাওয়া পাওয়া আলাদা,প্রায়োরিটি গুলো আলাদা।অনেক সময় মনে হত আমি দু’টুকরো হয়ে দুজনের কাছে কেন চলে যাই না?
তবুও টিকে ছিল,এই সমাজে নানা কারণে আমাদের ফাটল ধরা সংসার টিকে ছিল। কিন্তু অনার্স ফাইনালের শেষ দিকে যখন বাবা হুট করে মারা যায়, তখন মা আর আমার কথা ভাবত না।আমি বাবাকে খুব মিস করতাম,কারণ সে আমার আদর্শ ছিল,আর এটা মায়ের ভীষণ অপছন্দ ছিল।মা আমাকে অনেক কথা শোনাত প্রায়ই। যেখানে বাবা হারানোর শোকে আমি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছি,সেখানে মা আমাকে বাবাকে মিস করার কারণে খোঁচা দিচ্ছে!ভাবতে পারিস? অবশ্য মাকেও বা কি বলব,মা বাবাকে বিয়ে করতে চায়নি,সব নানা নানীর জোর করার কারণ।সে বাবাকে কখনো বেঁচে থাকতেই ভালবাসেনি,মারা যাওয়ার পর কিভাবে বাসবে?
আবার একই সময়ে ওশানা ঝামেলা করতে শুরু করল।প্রথম কিছুদিন আমাকে বেশ সান্ত্বনা দিল,কিন্তু আস্তে আস্তে বিরক্ত হতে থাকে। এটা কেন করলাম না,কল কেন দিলাম না,ভাত খাওয়ার কথা কেন জিজ্ঞেস করলাম না,পার্টিতে ওর সাথে কেন গেলাম না,ওকে নিয়ে আর ঘুরি না কেন,ওকে আগের মত খাওয়াই না তারমানে ভালোও বাসি না,আরো যত বাজে কথা! আমি শুধু বোকার মত সব দেখে যাচ্ছিলাম,আমার বলার কিছু ছিল না।মানুষ যে কত রঙের হতে পারে,সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি!
মা,গার্লফ্রেন্ড,সব এক অবস্থা।বিশ্বাস কর,কলেজ জীবন থেকে তুই আমাকে চিনিস,সেই আমি কলেজ জীবন থেকেই প্রিটেন্ড করে এসেছে,কোনোদিন কাউকে বুঝতে দেইনি আমার ভেতর কি হয়! কলেজে,ভার্সিটিতে এসে এমন ভাবে থাকতাম যেন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।ব্যস্ত থাকতাম নানারকম কাজে।কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আর পারিনি প্রিটেন্ড করতে।পাগলের মত ছটফট করে এই দেশে পাড়ি দিয়েছি।সব সময় সবাইকে ভালোবেসে গিয়েছি,কিন্তু প্রাপ্তির খাতায় বড় বড় দুটো শূন্য! কেন এমন হয় বলতে পারিস? কেন সব বিলিয়ে দেয়া মানুষ গুলো এত কষ্ট চেপে বড় হয়? পৃথিবী কিভাবে এত ভালবাসাহীন হল বলতে পারিস?”
রাইফের প্রশ্নগুলো ত্রাপানির প্রায় জনশূন্য রাস্তায় ভাসে।এই প্রশ্ন এই শতাব্দীর প্রতিটা মানুষের,এমনকি জেসমিনেরও।সে নিজেও জানে না কেন এতটা কষ্ট ও পেয়েছে,কিংবা রাইফ,কিংবা সেলিম আর জাফার।আচ্ছা,ভালোবাসার গল্পগুলো এরকম অপূর্ণ থাকে কেন???
ভাবনার মাঝেই রাইফের ডাকে সংবিৎ ফেরে জেসমিনের।রাইফ বলছে,
“কিরে,আমার গল্প শুনে করূণা হচ্ছে?ভাবিস না,আমি এখানে অনেক ভাল আছি।আমার দেশের মানুষের চাইতে অনেক বেশি ভালবাসতে জানে এরা!”
জেসমিন হাসে আর মাথা নাড়ে।
“ঠিক বলেছিস।তবে আমি তোকে করূণা করছি না।তোর মত গল্প সবার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে রে।আমার জীবনটাও এরকম।দোস্ত,আমাদের মত মানুষ গুলোই কেন এত কষ্ট পায় বল তো?”
রাইফ হাত নাড়ায়।
“বাদ দে! তোর কিন্তু যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।চল ডিনার করে নেই,তারপর হোটেলে যেতে হবে,সব গুছাতে হবে,সময় লাগবে।”
জেসমিন হাত ঘড়িতে দেখে।সত্যিই তাই,দু’ঘন্টা বাকি আর।রাইফ আর জেসমিন দু’জনেরই এখন মন খারাপ,সেটা নিজেদের অতীত ভেবে,নাকি বিদায় আসন্ন সেটা ভেবে,নিজেরাও জানে না।
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria