#মৃত_কাঠগোলাপ – ২২

0
307

#মৃত_কাঠগোলাপ – ২২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের স্তর। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। এমনই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে আয়েশী এবং ধ্রুবর বিয়ে ধার্য করা হয়েছে। হ্যাঁ, আজ আয়েশী-ধ্রুবর বিয়ে।
আয়েশীদের বাড়ি পুনরায় সেজে উঠেছে হরেক রঙে। টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ধ্রুব ইউহান শেখের বিয়ের তাজা খবর। চারপাশে হল্লোল-কল্লোল! এত বড় ঘরে বিয়ে হওয়ায় আয়েশীকে অনেকে বাঁকা চোখেও দেখছেন, আবার অনেকে আয়েশীর কপাল খুলে গেছে বলেও মন্তব্য করলেন। এসব কিছুতে আয়েশী নির্বিকার। কে কি বলছে, কে কি করছে কিছুতেই তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কনে সেজে চুপটি করে স্টেজে বসে আছে সে।
ধ্রুবর বিজনেস পার্টনার অনেকেই ধ্রুব-আয়েশীর কাছে এসে ছবি তুলছেন। ধ্রুব তাদের হাসিমুখে সামলাচ্ছে। তবে আয়েশী বিরক্ত। এসব ফর্মালিটি, ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি টেনে রাখতে তার ভালো লাগছে না। ভালোই ভালোই বিয়েটা মিটে গেলেই বাঁচে।
আয়েশী একনজর নিজের হাস্যোজ্বল পরিবারের দিকে তাকায়। ওই তো বাবা গর্ব করে বলছেন, মেয়ে আমার রাজরানী হয়ে থাকবে। জামাই পেয়েছি লাখে একটা।
মা পাড়ার মহিলাদের সাথে বসে মিষ্টি খাচ্ছেন। হাসি যেন সরছেই না মুখ থেকে। তুষার ভাই ব্যস্ত সবাইকে অ্যাপায়ন করতে। বোনের বিয়েতে কোথাও যেন কোনো কমতি না থাকে। সে কি ব্যস্ততা তার।
সবাই খুশি, শুধু আয়েশী বাদে। আজ যদি ধ্রুবর জায়গায় মৃদুল থাকত, তবে আয়েশীও খুশি হত। কিন্তু সে নেই। তাই পরিবারের খুশিই আয়েশীর খুশি!

ধ্রুব সবার থেকে মনোযোগ সরিয়ে আয়েশীর দিকে তাকাল। আয়েশী তখন ঘাড়ে হাত রেখে কিছু একটা খুঁটছে। ধ্রুব একটু ঝুঁকে বলল,
‘ এনিথিং রং? ‘
আয়েশী তাৎক্ষণিক ঘাড় থেকে হাত সরাল। স্পষ্ট কণ্ঠে জানাল,
‘ না। ‘
ধ্রুব মানল না। আয়েশীর ঘাড় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দেখতে লাগল কি সমস্যা। আয়েশী কাচুমাচু করছে। শাড়ির ঘাড়ের কাছের সেফটিপিন আয়েশীর ঘাড়ে ফুটে গেছে। সেফটিপিনের সূচের আ’ঘাতে নরম ত্বক ছিঁড়ে কিছুটা র’ক্তও বেরিয়ে গেছে। ধ্রুব সেফটিপিন হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ যা সামলাতে পারো না, তা পড় কেন? ‘
আয়েশী কথা বলল না। চুপ করে সরে গেল ধ্রুবর থেকে। ধ্রুব ঠিক হয়ে বসল। বাম হাতে আয়েশীর অলক্ষে একপাশে লুকিয়ে নিয়ে, আঙ্গুল দিয়ে সেফটিপিন মুঁ’চড়ে দিল। যার দরুন সেফটিপিনের সূচের আ’ঘাতে ধ্রুবর আঙ্গুল ঝাঁ’জরা হয়ে গেল। র’ক্ত ফিনকি দিয়ে বের হল। অথচ এত মারাত্মক আঘাতে ধ্রুব নির্বিকার। হিং’স্র চোখে চেয়ে রয়েছে র’ক্তে রাঙ্গানো সেফটিপিনের দিকে। অতঃপর সে সেফটিপিন পায়ের নিচে রেখে জুতো দ্বারা পি’ষে ক্ষান্ত হল সে। তার র’ক্তজবাকে আঘাত করার অধিকার একমাত্র ধ্রুব ব্যতীত আর কারো না। যে জিনিস আয়েশীকে আঘাত করবে, সে মুহূর্তেই ধ্রুবর হিং’স্র থা’বায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। চাই সেটা লোহার ছোট এক সেফটিপিন’ই হোক না কেন!

‘ হ্যালো মিস্টার ধ্রুব! বিয়ে করে তো বেশ ফুর্তিতেই আছ দেখছি। ‘
বহু বছরের পুরনো শ’ত্রুর কণ্ঠ চিনতে ধ্রুবর একটুও বিলম্ব হল না। ধ্রুব নয়নে তীক্ষতা ঢেলে মধ্যবয়স্ক লোকটার দিকে তাকাল। আকরাম খালিক নাম তার। একসময় ধ্রুবর বাবার শত্রু ছিল, এখন ধ্রুবর। রাজনীতি করেন, কিন্তু রাজনীতির দুনিয়ার পাশাপাশি তার নিজের এক কালো সাম্রাজ্য আছে। ধ্রুব এবং খালিক পরস্পর দন্ধ প্রতিযোগী।
খালিক ধ্রুবর পাশে এসে দাঁড়াল। ধ্রুবর হাতে গিফট প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ধ্রুবর কানেকানে বলল,
‘ সুন্দর মেয়ে বিয়ে করেছ, ভাতিজা। তার সৌন্দর্য্যের ভাগ কিছুটা চাচাকেও দিও। চেখে দেখি একটু, নয়া মাল নাকি আধখাওয়া? হা হা হা! ‘
ধ্রুবর চক্ষু র’ক্তে পরিণত হল। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বুজে ফেলল। অত্যধিক রাগে কান ধপধপ করছে। কপালের দুটো রগ ফুলে নীল হয়ে গেছে। ধ্রুব শুধু এটুকু বলল,
‘ আমার জিনিসের দিকে নজর দিস না। নাহলে চোখ দিয়ে কিছু দেখার মত অবস্থায় রাখব না। চোখ দুটো গেলে উপড়ে ফেলব,শালা। ‘
খালিক খারাপভাবে হাসল। বলল,
‘ একটা শুভ দিনে এই কা’টাকাটি মা’রামারির কথা না বলাই কি ভালো নয়? আসি তবে। আর হ্যাঁ, খাবার দারুন হয়েছে। বহুদিন পর পেট পুড়ে খেলাম। আচ্ছা এখন আসি। নতুন জীবনের জন্য অ-শুভকামনা। ‘

খালিক চলে গেল। ধ্রুব শুধু তাকিয়ে রইল। সময় এসে গেছে, শিয়ালের মাথা কে’টে বলি দেবার। ম’রার জন্য বড্ড তড়পাচ্ছে।
____________________
ধ্রুব এবং আয়েশীকে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। নিয়মমাফিক আয়েশীর এখন কান্না করা উচিৎ। অথচ সে কাঁদছে না। চুপ করে গাড়ির এক পাশে বসে রয়েছে। জানালার দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। হয়তো মৃদুলের কথা! ধ্রুব লক্ষ করেছে বিষয়টা। ধ্রুব একটু সরে আয়েশীর পাশে এসে বসল। আয়েশী বুঝত পারল! বিয়ে হতে না হতেই কাছ ঘেঁষা শুরু। বেহায়া লোক!
আয়েশী আরো একটু চেপে বসল জানালার পাশে। ধ্রুব মুচকি হাসল। কৌতুক করে বলল,
‘ ওদিকে আর জায়গা নেই। আরো সরতে চাইলে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে হবে। ‘
আয়েশী রাগ হল। ধ্রুবর গা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ নাকে আসছে। দামি সুগন্ধি ব্যবহার করেছে বোধহয়। আয়েশী চুপ করে জানলার সাথে ঠেসে বসে রইল। ধ্রুব বলল,
‘ চা খাবে? ‘
আয়েশী মাথা নেড়ে না জানাল। ধ্রুব ভাবল, আয়েশী কখনোই তার বলা কোনো কিছুতে হ্যাঁ জানাবে না। অতএব তার না’টাকেই হ্যাঁ ধরে নিতে হবে। ধ্রুব ড্রাইভারকে বলল,
‘ হিমেশ, গাড়ি থামাও। ‘
ড্রাইভার গাড়ি থামাল। ধ্রুব গাড়ি থেকে নেমে আয়েশীর দিকের দরজা খুলে দিল। হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ নামো। ‘
আয়েশী হাত ধরল না, নেমে দাঁড়াল গাড়ি থেকে। ধ্রুব হাত বটে নিল। আয়েশীর হাত না ধরার বিষয়টায় ধ্রুবর আত্মসম্মানে আ’ঘাত হেনেছে ঠিকই। কিন্তু পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে সে আ’ঘাতকে সহ্য করে গেছে। শেরওয়ানি গায়ে দিয়ে ধ্রুব বুক টানটান করে হেঁটে গেল টঙের দোকানের সামনে। সদ্য বিয়ে করে আসা বরকে দেখে টঙের মালিক ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল। বলল,
‘ আফনে কি বিয়ে ছাইড়া পলাইয়া আসছেন? ‘
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
‘ বেশি কথা না বলে, দু কাপ কড়া লিকারের চা দাও।’
আয়েশী ধ্রুব ও দোকানদারের কথা শুনে সেদিকে তাকাল। বাবার বয়সী দোকানদারের সাথে এমন কঠিন ভাবে কথা বলছে কেন ধ্রুব?
একটু পর ধ্রুব হাতে দু কাপ চা নিয়ে হেঁটে আসল। আয়েশীকে এক কাপ চা এগিয়ে দিল। আয়েশী কাপ হাতে নিল। গা বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে। ক্লান্তিতে হাত পা মুঁ’চড়ে আসছে। এ সময় চা খেতে পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। গায়ে ফুরফুরে ভাব আসছে। ধ্রুব চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল। সামান্য শব্দ করে চেঁচিয়ে বলল,
‘ এসব কি চা? মনে হচ্ছে চিনি গুলিয়ে খাচ্ছি। বাজে টেস্ট। ‘
ধ্রুবর অভিযোগ শুনে আয়েশী চোখ তুলে তাকাল। বলল,
‘ চা এতটাও খারাপ হয়নি। ‘
ধ্রুব শুনেও যেন শুনল না। তার কাছে খারাপ লেগেছে সুতরাং সবার কাছে খারাপ লাগবে, লাগা উচিৎ। ধ্রুব রা’গে নিজের হাতের চায়ের কাপ মাটিতে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিল। কাঁচের কাপ মাটিতে আছড়ে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে ভে’ঙে গেল। নিজের কাপ ভেঙে ধ্রুব এবার আয়েশীর কাপ কেড়ে নিয়ে মাটিতে আ’ছাড় দিয়ে ভে’ঙে ফেলল। আয়েশীর চোখ কপালে উঠে গেল। উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ এটা কি করলেন আপনি? ‘
ধ্রুব স্বাভাবিক সুরে জানাল,
‘ যা আমার পছন্দ হয়নি, তা তোমার পছন্দ হোক সেটা আমার সহ্য হবে না। তাই ফেলে দিলাম। উত্তর পেয়ে গেছ? আর চা খেতে হবে না। গাড়িতে উঠ। ‘
আয়েশী ড্যাবড্যাব চোখে ভে’ঙে ফেলা কাপের দিকে তাকিয়ে রইল। কাপটা কি নির্দয় ভাবে মাটিতে ভেঙে পড়ে আছে। একটু আগে ঝকঝক করা কাপ এখন সামান্য কয়েকটা ফেলনা কাঁচের টুকরো হয়ে গেছে। ইশ!
ধ্রুব আয়েশীকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠাল। গাড়ির দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে টঙের দোকানে গেল। দোকানদার তাড়া দিয়ে বলল,
‘ দুই কাপ চা, দশ টাহা। টাকা দিন, আমি দোকান বন্ধ করুম। ‘
ধ্রুব শুনল না সেসব। হিং’স্রতা তখন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে মুহূর্তেই বেঞ্চের উপর থাকা সমস্ত চায়ের কাপ মাটিতে ফেলে দিল। কাঁ’চের কাপ মাটিতে পড়ে একে একে সবগুলো ঝনঝন শব্দ তুলে ভে’ঙে গেল। দোকানদার কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে ধ্রুবর দিকে তাকাল। পরক্ষণেই মাথায় হাত দিয়ে চোখের পানি ছেড়ে বলল,
‘ এ আফনে কি করলেন? আমার কত বড় সর্বনাশ কইরা দিলেন। এত টাহার ব্যবসা আমার। সব নষ্ট কইরা দিলেন। হায় আল্লাহ! আমার লস হওয়া টাহা দিন। নাইলে আপনারে ছাড়ুম না আইজ। ‘

ধ্রুব বাঁকা হাসল। পকেট থেকে এক হাজার টাকার নোট দোকানদারের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলে বলল,
‘ এ টাকা দিয়ে ভালো চা বানানো শিখে নিস। ‘

ধ্রুব চলে গেল। পেছন থেকে দোকানদার অশ্রুভেজা চোখে চেয়ে রইল। তার পঞ্চাশ বছরের জীবনে এইভাবে কেউ তার সাথে বেয়াদবি করেনি। আজকালকার ছেলেদের উপর বেয়াদবির হিড়িক পড়ে গেছে। তাই জন্যেই আজ পৃথিবীতে এত গজব পড়েছে। মধ্যবয়স্ক দোকানদার টাকা হাতে মলিন বদনে বসে রইলেন।

#চলবে ( শব্দসংখ্যা- ১২০০+)
পেইজের রিচ বারবার উঠানামা করছে। বুঝতে পারছি না সমস্যা কোথায়? যারা গল্পটা পড়বেন, প্লিজ রিয়েক্ট-কমেন্ট করবেন। ভালোবাসা!

গল্প সম্পর্কে সমস্ত আপডেট পেতে জয়েন হোন লেখিকার গ্রুপে,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here