আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১৯

0
304

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১৯তম পরিচ্ছেদ
_____________________
তিন্নির মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে তিন্নির পরিবার। তুর্য বোনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে যতদ্রুত সম্ভব দেশে ফিরেছে। টিনা আর আশরাফ দুজনেই চরম ভাবে ভেঙে পড়েছেন।
তুর্যের সাথে তিন্নির ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি ছিল না। ছোট বোন হিসেবে আদর স্নেহ ছিল। রাইয়্যানার সাথে বিয়ের পর ইসলামের সঠিক বিষয় গুলো বুঝে তুর্য তিন্নিকে অনেক বলেছে। তিন্নি পাত্তা দেয়নি। বোনের উন্নাসিক মানসিকতা আর অতিমাত্রায় স্বাধীন চলাফেরা পছন্দ করত না তুর্য। তাই একটু দুরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবুও তুর্য নিজেকে সামলাতে পারছেনা।
রাইয়্যানার কাঁধে একসাথে সব দায়িত্ব পড়ে গেছে। কখনো তুর্যকে সান্ত্বনা দেয়, কখনো বাবা মাকে দ্বীনের পথে ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টায় থাকে। তিন্নি মারা যাওয়া পর্যন্ত তিন্নির ঘরে তেমন একটা ঢোকা হয়না। মাঝে মাঝে টিনা এসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
দুপুরে কুমকুমকে না পেয়ে এঘর ওঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে রাইয়্যানা,
-বড় বাড়ি হওয়ার এই এক সমস্যা! কোন ঘরে যে খেলছে আল্লাহ জানে।
খুঁজতে খুঁজতে কুমকুমকে পেয়ে যায় তিন্নির ঘরে,
-কুম মাম্মাম, তুমি এখানে, আমি তোমাকে খুঁজছি…
আদুরে গলায় মেয়েকে কাছে ডাকে রাইয়্যানা। কুমকুম মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে হেসে আবার নিজের খেলায় মনোযোগ দেয়।
-আসো কুমু?
দূর থেকেই ডাক দেয় রাইয়্যানা। কুমকুম না আসায় অগত্যা কাছে যায়। একতাড়া কাগজ নিয়ে খেলছে মেয়েটা।
-আরে আরে তুমি এত কোথা থেকে টেনে বের করলে, দেখি দেখি গুছিয়ে রাখি! এখানে কিছু হলে দাদিমণি বকা দেবে তোমাকে আমাকে, বুঝেছ কুমকুম?
মায়ের দিকে তাকিয়ে কি বুঝে কাগজ গুলো থেকে হাত সরিয়ে নেয় কুমকুম।
রাইয়্যানা কাগজ গুলোর দিকে তাকায়, তিন্নির বিভিন্ন এসাইনমেন্ট, ক্লাস টেস্টের শীট, রেজাল্ট, সাময়িক দরকারী বা অদরকারী কাগজ রয়েছে। আজ সব স্মৃতি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত হাতে ওগুলো গোছাতে থাকে রাইয়্যানা, কুমকুমকে ঘুম পাড়াতে হবে।
সবগুলো গুছিয়ে টেবিলের উপরে রেখে কুমকুমকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠে রাইয়্যানা।
কুমকুমকে নামিয়ে পিছন ফিরে আবার টেবিলের কাছে গিয়ে খামটা উঠিয়ে নেয়। একে একে খামের ভিতর থেকে কাগজ গুলো দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে উঠে রাইয়্যানার।
সেগুলো খামে ভরে, খাম হাতে কুমকুমকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে। মনে হাজারো প্রশ্ন আনাগোনা করছে। তুর্য ঘুমাচ্ছে, ঘরে গিয়ে কুমকুমকে রেখে দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে রাইয়্যানা।
.
-আপু মা কল করলে ধরবি না খবরদার!
তর্জনী তুলে বোনের দিকে নির্দেশ করে নিধি
-কেন রে?
-কারণ মা জানেনা আমি এখানে, তুই তো সাধুপুরুষ সরি সাধ্বিমহিলা, তুই মিথ্যা বলতে পারবি না সুতরাং
কল রিসিভ করার দরকার নেই।
-মা কে কি বলে এসেছিস?
-দেখ আপু… আমি আমার মা আর বাপের মেয়ে দুটোই পেয়েছি, ভাল ব্যবহার জানি আবার খুব খারাপ ব্যবহার করতেও পারি, মাকে ঘোড়ার ডিম বলে এসেছি, শিক্ষা হওয়া উচিত।
চারু আর এ নিয়ে তর্ক করেনা নিধির সাথে। এই মেয়ের মুডের কোনো ঠিক নেই। আল্লাহ জানে কি বাঁধিয়ে এসেছে। কখনো মেয়েটাকে খুব আপন মনে হয় কখনো বা খুব পর।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরকারি কাটায় মনোযোগ দেয় চারু।
-শোন আপু কথায় কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলবি না তো! বিরক্ত লাগে। আমিও ওমন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারি
বলেই নিধি মাথা উঁচু করে এমন ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলার অভিনয় করে যেটা দেখে চারু হেসে ফেলে। চারুর হাসি উপেক্ষা করে নিধি আবার বলে,
-তুই এত ম্যাদামার্কা হয়ে থাকিস, আমার রাগ হয়! ভাল কথা, আচ্ছা শোন আপু! আজ তুই মাহমুদ ভাইয়ের সাথে দেখা করছিস তো? আগের দিনটা ফালতু অযুহাত দিয়ে না করে দিলি। আজ তো তারানা আপু দুপুরে যেতে বলেছে।
মাহমুদের প্রসঙ্গ ওঠায় একটু বিব্রত হয় চারু। কিন্তু চুপ করে থাকলে নিধি শুনবে না তাই উত্তর দেয়,
-হ্যাঁ তারানা, দুপুরে যেতে বলেছিল আর দুপুরের খাবারটা একসাথেই খেতে বলেছিল, কিন্তু আমি দুপুরে যাবোনা। স্কুল থেকে ফিরে বাসায় খেয়ে তনু আর তোকে নিয়ে বিকালে যাবো। বলে দিয়েছি তারানাকে।
চারু রাজি হয়েছে দেখে বেশ খুশি হয় নিধি। হঠাৎ কি মনে পড়ায় বলে,
-বড়পু তুই আজ তনুকে নিয়ে যা স্কুলে, আমাকে আজ একটু বেরোতে হবে। তোর আসার আগেই ফিরব। চাবি দিয়ে যাস।
-কোথায় যাবি?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে চারু।
-তাতে তোর কি রে? তুই যা না তোর কাজে।
নিধির বেখাপ্পা কথা শুনে রাগ হয়ে যায় চারুর তবু কিছু বলেনা। একসাথে অনেক গুলো চিন্তা মাথায় ঘুরছে, বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চোখ ফিরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। এ কয়দিন নিধি থাকায় তনুকে রেখে যেত চারু। কি নিশ্চিন্ত থাকতে পারতো স্কুলে!
ইশ তার যদি চাকরি না করতে হতো! তাহলে মেয়েকে সবসময়ই সময় দিতে পারত!
.
-রাইয়্যানা তোমার কিছু হয়েছে?
তুর্যের কথায় চমকে ওঠে রাইয়্যানা।
-আরে চমকে উঠলে কেন? আমি তো…
-আচ্ছা তুর্য… তিন্নির গাড়িতে আরেকটা ছেলে মারা যায়, তার নাম যেন কি?
-আতিফ, কেন কি হয়েছে?
-না, কিছুনা।
রাইয়্যানা আবার বাইরে তাকিয়ে থাকে। মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেনা, বেঁচে থাকলে তিন্নির বাচ্চার দুবছর হয়ে যাওয়ার কথা। আদৌ কি বেঁচে আছে? তিন্নি কি করেছে বাচ্চাটাকে? তিন্নিরা কি এক্সিডেন্ট করেছিল নাকি আত্মহত্যা?
উত্তরহীন প্রশ্ন রাইয়্যানাকে ঘিরে ধরে।
হাতের উপর তুর্যের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তুর্যের দিকে তাকায়।
-রাইয়্যানা! কি হয়েছে? কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে? নাকি আমি ভুল করেছি?
আর চুপ থাকতে পারেনা রাইয়্যানা। চুপ থাকাটা কোনো সমাধান হবে না।
-তুর্য অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে,
রাইয়্যানা ধীরে ধীরে খুলে বলে তিন্নির ঘরে পাওয়া সব টেস্ট রিপোর্ট আর হসপিটালের কাগজপত্রের।
আসলে মানুষ অন্যায় কাজে যতই চালাকি করুক না কেন, একটা না একটা ভুল করেই ফেলে। তিন্নিও রিপোর্ট গুলো ছিঁড়বে বলে পরে আর মনে রাখতে পারেনি। কিংবা তারপরে অনুশোচনা বোধ আসাতে আর সেভাবে ভাবেনি।
রাইয়্যানার কথা শুনে আড়ষ্ট হয়ে যায় তুর্য! কি শুনছে সে এগুলো! কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে উঠে বাইরে চলে যায় তুর্য।
তুর্যের মুখ দেখে রাইয়্যানাও কিছু বলার সাহস পায়না, আস্তে করে বলে,
-বাবা মাকে এখনি কিছু বলো না যেন।
তুর্য ঘাড় ফিরিয়ে রাইয়্যানার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আশ্বাস দেয়। রাইয়্যানা আর কিছু না বলে ঘুমন্ত কুমকুমের পাশে শুয়ে পড়ে।
সন্ধ্যার পর এসে হঠাৎই বলে,
-কাল এক জায়গায় যাবো তুমি আর আমি, হসপিটাল থেকে ফিরছি আমি, কোনো রিপোর্টই মিথ্যে না। হসপিটালেও তিন্নি নিজেকে আতিফের স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু কোথাও আতিফের সই বা কোনো কিছুতেই আতিফের উপস্থিতির প্রমাণ নেই, অর্থাৎ ওরা বিবাহিত ছিল না। খুব সাবধানে খোঁজ নিতে হয়েছে আমাকে। কাল যাবো বাচ্চার খোঁজে, শুধু মাবাবা এখনই যেন কিছু না জানে। বেঁচে থাকলে ওই বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করতেই হবে যে করেই হোক।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here