আলোকিত অন্ধকার পর্ব-২২

0
298

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
#২২তম_পরিচ্ছেদ
__________________________________
এয়ারপোর্টে একটু পরপর এদিকওদিক উঁকিঝুঁকি দিয়ে মানুষের ভীড়ে প্রিয় মুখগুলো খুঁজছে চারু। আজ তরু আসবে, তার সেই ছোট্ট ভাইটা আসবে। রেণু বলেছে আজ চারুকে নিয়ে সোজা চারুর নানাবাড়িতে যাবে। আনন্দ উপচে পড়ছে চারুর দু’চোখে।
নিধিকে অনেক অনুরোধ করেছিল একসাথে আসতে। কিন্তু নিধি শোনেনি। বলেছিল মায়ের সাথে ওর কি কথা আছে।
-এই চারু এখনো তো প্লেন এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছাতে বিশ মিনিট বাকি, তুই জোর করে আগে থেকে আসলি, আর কাকে খুঁজছিস?
রিহানের কথায় ভুল ভাঙে চারুর। নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জা পায়।
-গরমে বোরকা-হিজাবে কষ্ট হচ্ছে না তো?
-না বাবা ঠিক আছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
-হুম, ওদিকটাতে বসবি চল।
বলে রিহান চারুর কোল থেকে তনুকে নিয়ে হাঁটতে থাকে, বাবার পিছু নিতে নিতে চারুর হঠাৎই সকালের কথা মনে পড়ে কিছুটা মন খারাপ হয়ে যায়।
সকালে ক্লাস শেষ করে আজ স্কুল থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে চারু, এতদিন কোনো ছুটি নেয়নি তাই ছুটি পেতে অসুবিধাও হয়নি, এরপরের দুইদিন শুক্র-শনিবার। চারুদের স্কুল বড় বড় ছুটি গুলো ছাড়া বন্ধ থাকেনা, এইজন্য সপ্তাহে শুক্রবার শনিবার দুইদিন ছুটি থাকে। সব মিলিয়ে চারু ছুটি পাচ্ছে আজ বাদে পাঁচদিন।
পাঁচটা দিন গৎবাঁধা জীবন থেকে দূরে থাকতে পারবে ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল চারু। আচ্ছা মাহমুদের সাথে বিয়ের পর ও যদি বলে, ‘আমি দুটো দিক একসাথে সামলে পারব না, আমি বাচ্চাদের নিয়ে থাকতে চাই, মাহমুদ কি তবুও চাকরি করতে বলবে?’ চারুর শুধু সাক্সেসফুল হাউজওয়াইফ হতে ইচ্ছে করে, অতি আধুনিকা হয়ে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বাইরে গিয়ে নিজের পরিচয় জাহির করতে ভাল লাগে না।
এই দুই বছরে চারু বুঝেছে, আসলে মেয়েরা জেদ ধরে চাকরি করলেও ঘরের রান্না, সন্তান জন্ম-মানুষ করা সহ আনুষাঙ্গিক নারীত্বের কাজ গুলোও একান্তই তাদের। অর্থাৎ ঘর আর পর দুটোর দিকেই সমানতালে নজর দিতে হয়। এদিক থেকে ছেলেরা মুক্ত, একটা দিকই সামলে যেতে হয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
এগুলো অবশ্য চারুর নিজের মতামত। নিজেকে কারো মতামতের সীমারেখায় চলতে বলে না ও।
‘চাকরি করতে ভাল লাগেনা’ এটা শুনে কয়েকজন নারী অধিকার আদায় করা টাইপ মানুষের কাছে বকা শুনেছে। তারা চোখ কপালে তুলে বলেছে,
-বলো কি অন্যের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে কেন? নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
চারুর খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আল্লাহ তাহলে নারী-পুরুষকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন কেন!’ কিন্তু বলেনি, হয়তো বেয়াদবি হয়ে যাবে।
এখন অবশ্য এসব জবাব আর দেয় না। সোজাসাপ্টা বলে দেয়, ‘প্রয়োজন হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, চাকরি করবো, নয়তো না, আল্লাহ যা চাইবেন তাই করব’
আচ্ছা মাহমুদ কি তার এসব ভাবনা সমর্থন করবে?
আরে ধূর! বিয়ে কোথায় আর সে এসব কি ভাবছে!
নিজেকে তিরস্কার করে ব্যাগ গোছানোর দিকে মনোযোগ দেয়।
নিধি খেলছিল তনুর সাথে, হঠাৎই সালিহা আসেন। নিধির দিকে তাকিয়ে উল্টাপাল্টা বলতে শুরু করেন চারুকে। চারু হতভম্ব হয়ে বসে থাকে নিজের জায়গাতেই।
-মা!
চিৎকার করে ওঠে নিধি।
-একদম চুপ কর নিধি!
নিধি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলে
-বাসায় যাও আমি আসছি এক্ষুনি।
সালিহাকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সালিহার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে নিধি। মাকে রিকশায় উঠিয়ে দেয়। রাগে সালিহার মনে হচ্ছে তিনি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
সালিহাকে পাঠিয়ে নিধি স্বাভাবিক হয়ে যায়। চারুকে বলে,
-বড়পু মায়ের সাথে আমার কিছু কথা আছে, তুই কিছু মনে করিস না, আমি কিন্তু এয়ারপোর্টে যাবো না। তুই বাবাকে নিয়ে যাস।
চারু অনুরোধ করেও নিধিকে রাজি না করাতে পেরে একাই এসেছে।
হঠাৎ কেউ জড়িয়ে ধরায় ভাবনার জাল কেটে গেল চারুর।
কতদিন পর! সেই পরিচিত গন্ধ! সেই ভালবাসার স্পর্শ!
-ছোটমণি….!
অস্ফুটস্বরে ডাকে চারু।
-কেমন আছিস মা?
-আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?
-আলহামদুলিল্লাহ্।
-ত্বাসিন, তরু, আঙ্কেল কই?
তরুকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে চারু।
-আসসালামু আলাইকুম
ত্বাসিন তরু দুজনেই সালাম দেয়।
-কত বড় হয়েছিস তোরা! তরু তুই তো আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস, ছবিতে দেখে বুঝিনি।
এরই মাঝে তনুকে কোলে নিয়েছে ত্বাসিন। আদিব রিহান কুশল বিনিময় করছে। এ যেন এক মিলনমেলা!
.
-মা তুমি বড়পুর সাথে কেন এমন ব্যবহার করো বলতে পারো?
খুব নরম গলায় মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে নিধি। সালিহা রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,
-কি করি আমি?
নিধি বুঝল ঠিক এভাবে কথা বললে তার মা শান্ত হবে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিধি আবার বলে,
-মা জানো বড়পুর প্রতি তোমার এই মাত্রাতিরিক্ত শাসন আর আমার প্রতি অতি আদর দেখাতে গিয়ে আমার কত ক্ষতি করে ফেলেছ!
-মানে!
ভ্রু কুঁচকে তাকায় সালিহা।
-মা তুমি চারুপুকে শাসন করতে সহ্য করতে পারতে না তাই, বিপরীতে আমাকে প্রশ্রয় দিতে, চারুপু আমাকে শাসন করতে চাইলেও দিতে, আরো প্রশয় দিতে। কিন্তু মা এর ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবেছ কখনো? ভাবোনি। কারণ চারুর প্রতি তোমার প্রতিহিংসা এত বেশি ছিল যে তুমি দেখতেই পাওনি তুমি নিজের ক্ষতি করছ!
নিধির অতিমাত্রায় শান্ত কন্ঠস্বরে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন সালিহা,
-নিধি হেঁয়ালি করবি না! কি হয়েছে বলবি তো!
-কি বলব! আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি! তার জন্য সবচেয়ে বেশি দোষী তুমি আর বাবা, বাবার চেয়ে বেশি তুমি! বাবার নির্লিপ্ততা, নাহ তোমার বেশি দোষ ছিল, যেটুকু বাবা শাসন করতে গেছে তুমিই দাওনি!
তুমি আমাকে কখনো সেভাবে শেখাওনি উদ্ধত হয়ে চলার ভয়ংকর দিকগুলো। বলো? শিখিয়েছ?
নিধির কথার উত্তর দিতে পারেন না সালিহা৷ একটু থেমে নিধি আবার বলে,
-আমিও বড়পুর মতো আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, যখন আমার প্রেমিক ভালবাসার ছলনা করেছিল আমার সাথে। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক না বুঝেই আমি গা ভাসিয়ে দিয়েছিল তথাকথিত আধুনিক নষ্ট প্রেমের সাগরে!
একসময় তমালেরও আমার প্রতি আগ্রহ ফুরিয়ে গেল, সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ তমালকে দেওয়ার মতো ভালবাসার আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আমার কাছে।
তমাল হয়তো এখন খুঁজছে নতুন কাউকে।
এটুকু বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে নিধি।
-কি বলছিস এসব নিধি!
-যা বলছি শুনছ তো দু’কান ভরে! তারপর আত্মহত্যা করার মূহুর্তে মনে হলো বড়পুর কথা। মনে হলো একবার দেখে আসি ওকে। দেখি ওর জীবনটাকে।
মা আমি স্রেফ দেখতে গিয়েছিলাম আপুকে, আমার মধ্যে কোনো সিরিয়াসনেস ছিল না। তাই তোমাকেও উদ্ভট চিঠি দিয়ে গিয়েছিলাম।
আমি আসলেই খুব অবজ্ঞা নিয়েই গেছিলাম ওর বাসায়, কিন্তু এক সপ্তাহ আমার জীবনকে একেবারে বদলে দিয়েছে। চারুপুর হাত ধরে আমার পরিচয় তারানা আপুর সাথে। ওর কাছ থেকে আরো জেনেছি জীবনের নানা দিক! কেন মা তুমি শেখাও নি? বাবা কেন শেখাইনি? বাবা কে কি বলব! চারু আপুকেও বাবা সেভাবে কখনো বুঝিয়েছে কিনা আমার সন্দেহ!
মুখ নিচু করে শুনতে থাকেন সালিহা। দুচোখ ভেঙে কান্না আসছে তার। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছেন।
-মা খুব কি অসুবিধা হতো আমাকে আর আপুকে এক ভাবে দেখলে। সত্যি বলতে মা আমার এসব চোখে পড়েনি কখনো। তমাল আমাকে জীবনের সেরা শিক্ষাটা দিয়ে গেল। তোমাকে এসব কথা কেন বলিনি প্রশ্ন করতে পারো। মা আদৌ আমার সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক তৈরি করেছ তুমি!
নাহ!
আজ চারুপুর জন্যই তুমি আবার আমাকে পেয়েছ, তারানার আপুর জন্যই আমাকে পেয়েছ! আর আল্লাহ তো সহায় সবসময়ই।
-তারানা কে?
ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে সালিহা।
নিধি খুলে বলে চারু আর মাহমুদের বিষয়ে। তারপর আবার বলে,
-মা শুরু থেকে নিয়ে সব বিষয় গুলো ভেবে দেখো আরেকবার।
বলে নিধি উঠে যায় ছাদের উদ্দেশ্যে। চোখ দুটো খুব জ্বলছে, কান্না যেন দলা পাকিয়ে আছে গলায়। তমালের জন্য নয়! জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করার জন্য।
সে রাতে সালিহা যখন নামায শেষ করে দেখা যায় তার চোখমুখ ফুলে আছে। সালিহা শুধুই মনে মনে বলছে,
‘আল্লাহ মানুষের মন একেবারে বিপরীতে পরিবর্তন হতে পারে না। আমাকে সঠিক পথ দেখাও, আর ভুল করতে চাই না আমি!’
তারপর রিহানের পাশে এসে অঝোরে কান্না করতে থাকেন সালিহা। প্রথমে অবাক হয়ে রিহান জিজ্ঞাসা করে সালিহার কান্নার কারণ, আজ কিছু গোপন করে না সালিহা, চারুর কথা থেকে শুরু করে নিধির সব কথা। প্রথমে অবাক হলেও একসময় দেখা যায় রিহানের চোখেও পানি। কিন্তু সে কষ্টের না আনন্দের…!
.
-মা তুমি চারুকেই আবার আনতে কেন চাইছ!
-কারণ সৎ মায়ের ঘরের চারু আবারও আগের মতোই থাকবে! তোর সমস্যা বা অন্য কোনো সমস্যা ওকে ফেরাতে পারবে না! বিনা পয়সায় খেতে পাবে! আর সমাজ-সামাজিকতা টুকু করবে!
-মানে?
-মানে আর কি! সব যখন গেল… সমাজের স্ট্যাটাসের জন্য হলেও ঘরে বউ থাকা দরকার। সবাই জানবে চারুর সমস্যার জন্য বাচ্চা হচ্ছে না। আবার আমরা চারুকে ছাড়ছিও না। আমাদেরই লাভ!
মায়ের কথা শুনে দপ করে জ্বলে ওঠে তাহের,
-মা!
কিন্তু সে ক্ষণকালের জন্যই। আবার চুপসে গিয়ে বলে,
-এটা কি ঠিক হবে?
-যা বলছি তাই কর! আমি চারুকে আনতে বলেছি।
আদেশের ভঙ্গিতে বলে ছেলের ঘর থেকে উঠে চলে যান মাহিমা। বয়স হলেও ছেলের উপর কতৃত্ব একটুও কমেনি। এতদিন অবশ্য অন্য দুটো বউয়ের সাথে এঁটে উঠতে পারেননি। তাতে কি হয়েছে! দৌরাত্ম্য কমেনি একফোঁটাও।
হায়রে কাপুরুষ তাহের!
সেও ভাবতে থাকে মায়ের আদেশ পালনের কথা। কাল তো হবেনা, পরশুই যাবে চারুদের বাড়িতে।

(আগামী পর্বে সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here