আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১৩

0
347

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১৩ তম পরিচ্ছেদ
________________________________
চারুর সেই মেয়েটাকে আর কাছ ছাড়া করেনি। পুলিশও বাবুটার পরিচয় খুঁজে বের করতে না পেরে বাবুটাকে চারুর দায়িত্বেই দিতে দেয়। চারু সেটাকে অফিসিয়ালি কাগজে কলমে নিজের বাচ্চা হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছে। পরবর্তীতে কোনো ঝামেলা হতে দিতে নারাজ সে।
তনুর বয়স এখন ছয়মাস। চারু বাচ্চাটার নাম রেখেছে তাহিয়্যা তনু। এখন চারুর ব্যস্ত সময় কাটে তনুকে নিয়েই। তনুকে খাওয়ানো, গোসল করানো।
আত্মহত্যা, জীবনের প্রতি তীব্র হতাশা কেটে গিয়ে এক আশার সৃষ্টি হয়েছে তনুকে নিয়ে।
মাঝে মাঝে নানা বাড়ি বা সিহান তুহিনার ওখানে যায়, জানে তুহিনা তার বাবাকে খুব বেশি পছন্দ করেনা, কেন সেটাও জানে। তবুও যায় সবার সাথে সম্পর্ক ভাল রাখার উদ্দেশ্যে।
ইদানীং কারোর উপর রাগ হয় না চারুর। সব যেন ধুয়েমুছে গিয়েছে। তনুর মুখ চেয়ে চারু ভুলতে শুরু করেছে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়গুলো। শুনেছে তাহেরের দ্বিতীয় স্ত্রীও টেকেনি মাহিমা আর তাহেরের জেদের কারণে।
তাহের আবার বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, নিক।
চারুর মনে হয় ও ভালোই আছে।
কিন্তু এসব সহ্য করতে পারে না সালিহা। নিধির বিয়ে দিতে হবে, সব চাহিদা মিটিয়ে একেতো টানাটানির সংসার তাতে চারুর সাথে এসে জুটেছে কোন এক রাস্তার বাচ্চা! টানাটানি কবে ছিল সালিহা সেটা মনে করতে না পারলেও মুখে টানাটানি শব্দটা তার মুদ্রাদোষ হয়ে গিয়েছে।
তার দুচোখের বিষ হয়ে উঠেছে চারু আর তনু। এদিকে নিধি বিন্দুমাত্র কথা শুনেনা। ভার্সিটিতে উঠে উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েই চলেছে। বিয়ের প্রস্তাবগুলোও টিকছে না।
রিহানের অবুঝ ভাব তাকে আরো জ্বালাতে থাকে। তনু যেন নিজের নাতনী, বাসায় যতক্ষণ থাকে কি এক আহ্লাদ করতে থাকে!
-বাবা তনুর জন্য দুইটা ড্রেস এনো তো, আর ওর বেবি শ্যাম্পুটাও ফুরিয়েছে সেটাও মনে করে নিয়ে আসবে।
-আচ্ছা আনবো।
রিহান বেরিয়ে যাওয়ার পর একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সালিহা।
-চারু তোর মতলব টা কি বলতো?
সালিহার কথাতে ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও নির্লিপ্ত কণ্ঠে চারু উত্তর দেয়,
-কেন, কিসের মতলব?
-নিজে ও স্বামীর ঘর ভেঙে এসেছিস যন্ত্রণা দিতে আবার আরেকটাকে জুটিয়েছিস রাস্তা থেকে। দু’পয়সা কামাই করার মুরোদ নেই, এটা আনো ওটা আনো হুকুম করতেই থাকিস। কেন রে!
রাগে যেন দপ করে জ্বলে ওঠে চারু, কিন্তু সেটাও মূহুর্তেরই নিভে যায়,
-বেশ, কামাই করার কথা বলছ? বাবার টাকায় বসে খাচ্ছি তবু কথা শোনাচ্ছ, বেশ! বেশিদিন তোমাকে আমার আর আমার তনুর জন্য টাকা ঢালতে হবে না। বুঝেছ?
শুধু এরপরে আর কখনো আমার মেয়ের নামে কোনো বাজে কথা শুনলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না মা! বাবাকে বলে কিছুই হবে না, বাবা যেমন তোমার অন্যায়ে তোমাকে কিছু বলে না আমাকেও বলবে না। মনে রেখো এটা!
গটগট করে বেরিয়ে আসে চারু। আজ এত বছরে প্রথমবার সালিহার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলেছে সে। রোজদিন তনুকে রাস্তার মেয়ে বলে গালি দিবে, আর সহ্য হয় না চারুর।
দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল, খুব তো বলল সে নিজেদের ব্যবস্থা করে নিবে, কিন্তু কি ব্যবস্থা করবে!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে হলো লামিয়ার কথা। অস্থিরভাবে মোবাইলটা হাতে নিয়ে লামিয়াকে কল দিলো,
একে একে খুলে বলল সব।
-আচ্ছা চারু তুই কোনো কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে জব করতে পারবি? ছোটখাটো কিন্তু…
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল চারু,
-হ্যাঁ রে আমি এরকমই কিছু খুঁজছি।
-আমার বড় ভাইয়া আর ভাবির একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল আছে জানিস তো, ভাবি বলছিল একজন টিচার দরকার। তোর গুড লাক তুই টাইমলি বলেছিস। আমি বললে ভাবি না করবে না। কোনো প্রব্লেম নেই।
তবে তার আগে আমি ভাবির সাথে কথা বলে নিই।
লামিয়ার সাথে কথা বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল চারু। মন বলছে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
“আল্লাহ সহায় থেক” বলে চারু চলে যায় তনুকে গোসল করাতে।
ইদানীং চারুর বিশ্বাসের ভিত যেন নড়ে উঠেছে। মায়ের কথা মাঝে মাঝেই মনে হয়, কত সেইফে থাকতো মা। বাবাও সেভাবে রাখতো।
তার মেয়ে হয়ে চারু কি করছে। এসব ভাবনা উল্টেপাল্টে দেয় চারুর জগতকে।
লামিয়ার দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী দুই সপ্তাহের মাথায় চারুর জব হয়ে যায় কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে। দশ হাজার টাকা স্যালারি, তবে যদি শিক্ষকতার ফিডব্যাক ভাল আসে তবে স্যালারি বাড়তে পারে এও জানিয়েছে লামিয়া।
সব ঠিকঠাক হলেও চারুর চিন্তা এক জায়গাতেই আটকে গেল, সভয়ে লামিয়াকে প্রশ্ন করে,
-কিন্তু তনুকে কোথায় কিভাবে রেখে যাবো, মা কে জানিস….
তনুর আমতা আমতা দেখে হেসে ফেলে লামিয়া,
-আরে এটা কোনো ব্যাপার না রে পাগলি, আমার ভাবির মেয়েরা ছোট থাকতে ভাবি নিয়ে যেত। সবচেয়ে ছোট মেয়েটা এখন ওখানেই পড়ে। আর তাছাড়া মেয়ে শিক্ষকদের কথা ভেবে, বাচ্চাদের সুবিধার জন্য ভাবি একটা এক্সট্রা রুমের ব্যবস্থাও করে রেখেছে। ক্লাস শেষ করে সেখানে বাবুকে টাইম দিলেই হবে। তারপরও কিছুটা কষ্ট তো করতেই হবে চারু… তাই না?
লামিয়ার কথাতে আরেকবার নিশ্চিন্ত হয় চারু। আপাতত এত দ্রুত কোনো সমস্যা ছাড়াই এতবড় সুযোগ পেয়ে যাবে ভাবেনি। চাকরির বাজারের যে অবস্থা, আর মায়ের কথা ভেবে আপাতত এটাই ভরসা।
-লামিয়া তোকে যে কি বলে….
-থাম থাম চারু ফর্মালিটি ডোজ দিসনা!
চারুকে কথা শেষ করতে দেয় না লামিয়া। ওকে সাহায্য করতে পেরে নিজেরও খানিকটা ভাল লাগছে। মেয়েটাকে ছোট থেকেই দেখছে শুধুই কষ্ট পেয়েছে, এখন যদি ওই তনু মেয়েটাকে নিয়ে ভাল থাকতে চায়, থাকুক না!
রাতে রিহান বাড়ি ফিরে চারুকে চাকরি করতে দিতে আপত্তি জানায়, তার এক কথা,
-কত টাকা লাগবে তোর? আমি দিবো….
সালিহা রেগে যান,
-যা করছে করুক না, তোমারই বা এত টাকা কই যে দুইজনকে একসাথে পালবে!
সন্তর্পণে “রাস্তার মেয়ে” কথাটা এড়িয়ে যান সালিহা। সত্যিকার অর্থেই চারুর সেদিনের কথা শুনে ভয় পেয়েছিলেন তিনি।
রিহান সরু চোখে একবার তাকালেন সালিহার দিকে,
-নিধি কোথায়?
তটস্থ হয়ে উঠলেন সালিহা,
-ইয়ে…. মানে ফেরেনি!
-ফেরেনি মানে? যায় কোথায় তোমার মেয়ে! আজ ফিরলে বলে দিও এমন করলে বাড়িতে আর ঢোকাই হবে না তার!
সালিহা দুম করে উঠে চলে যান। এই মেয়েটাকে নিয়েও ভারি যন্ত্রণা!
এত বছর থেকেও সালিহার প্রতি এখনো ভালবাসার জন্ম দিতে পারেননি রিহান। যা করেছেন শুধু সম্পর্ক, দায়িত্ব আর কর্তব্যের খাতিরে। মনের গহিনে এখনো রিহানা। সব বুঝেন, কিন্তু কেন যেন কোনো অশান্তি ভাল লাগে না।
বয়সের কারণে এমন হচ্ছে কিনা কে জানে!
চারুর দিকে তাকিয়ে বলেন,
– বলতো হঠাৎ চাকরি কেন! তনু তো ছোট খুব!
-বাবা কিছু মনে করো না, এ বাড়িতে আমার যে কষ্ট হয়েছে সেটার তনুরও হবে। তনুর আমার গর্ভের সন্তান না হলেও প্রথম মাতৃত্বের সাধ ওর থেকেই মিটিয়েছি।
কোনো মা-ই চায়না তার সন্তানের কষ্ট দেখতে। তুমি প্লিজ আমাকে বাঁধা দিও না, পারলে আমাকে একটু সাহায্য করো। এ বাড়িতে মা তনুকে সহ্য করতে পারবে না।
এই নির্মম সত্য রিহানের চেয়ে ভাল কে জানে!
তিনি নিজেও জানেন যে আসলেই চারুর কোনো উপায় নেই।
-কি চাস তুই?
-বাবা একটা ছোটখাটো একরুমের বাসা ভাড়া করতে পারলে বেশ হতো। মাঝে মাঝেই আসবো এখানে, মা ও ভাল থাকবে আবার আমি, আমার মেয়েও ভাল থাকবো।
-কোথায় ভাড়া নিবি?
-স্কুলের আশেপাশেই, তবে এখনই না কারণ টাকা নেই, জব শুরু করি, স্যালারি পায় তারপর।
-বাসা ভাড়াটা তুই আমার থেকেই নিস।
-কিন্তু বাবা…!
-কিসের কিন্তু? আমি তোর বাবা চারু ভুলে যাস না। এতটা অক্ষম আমি না। যেদিন অক্ষম হয়ে যাবো সেদিন থেকে তুই নিজের দায়িত্ব নিজে নিস। শুধু সালিহাকে জানাবি না! ঝামেলা ভাল লাগেনা।
কিছুই তো করতে পারলাম না আর…
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারুর ঘর থেকে উঠে যান রিহান।
বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় চারুর মন…
.
তুর্যের দুই বছরের মেয়ে কুমকুমকে নিয়ে খেলছে তিন্নি। গতবার ওরা আসতে চেয়েও আসতে পারেনি কুমকুম অসুস্থ হওয়াতে।
ছোট থেকেই বাচ্চাদের সংস্পর্শে তিন্নি তেমন আসেনি। বড় ভাই তুর্য তিন্নির বছর সাতেকের বড়, তুর্য রাইয়্যানাকে বিয়ে করেই কানাডা চলে যায়।
বিয়ের দুই বছর পরে তুর্যকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় তিন্নি আর ওর বাবা মা।
রাইয়্যানা খুব বড়লোক বাবার মেয়ে হলেও ওর মাঝে এত ইসলামপ্রীতি আছে সেটা বুঝতে পারেননি টিনা। টিনার ভাষায় ধর্মীয় গোঁড়ামি। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আধুনিক ছেলেকে কি জাদুতে পুরো হুজুর করে দিয়েছে।
আর এবার চার বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে তুর্যের মুখ ভর্তি দাড়ি।
বিরক্ত হয়ে গেলেন টিনা,
-কি মুখটাকে জঙ্গল করে রেখেছিস বলতো! অস্বস্তি হচ্ছে দেখে। এসব দাঁড়িওয়ালা হুজুরি কোথা থেকে শিখলি!
রাইয়্যানা পাশ থেকে যাওয়ার সময় তুর্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে পা বাড়ায় তিন্নির ঘরের দিকে মেয়েকে আনতে।
-আরে কি জঙ্গল জঙ্গল করছ মা! আমাকে দারুণ দেখাচ্ছে না বলো তো?
দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল তুর্য।
-শোন বেশি পাকা পাকা কথা বলবি না, যা শেভ করে আয়! বয়স্কদের মতো লাগছে তোকে।
-মা দাঁত গুলো ফেলে দিয়ে আসি?
অবাক চোখে তাকালেন টিনা,
-মানেহ!…
-আরো বাচ্চা বাচ্চা লাগবে তাহলে…
রাগে টিনা কোনো কথা না বলেই উঠে চলে গেলেন নিজের রুমের দিকে।
তুর্যও হাসতে হাসতে সেন্টার টেবিলে রাখা নিউজপেপার টা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলো।
-ভাবি কুমকুমকে পরে নিয়ে যেও।
তিন্নির কথা শুনে রাইয়্যানা বলে,
-আমি ভাবছি তোমাকে ডিস্টার্ব না করে, যা দুষ্টু হয়েছে বুড়িটা।
হাসতে হাসতে চলে যায় রাইয়্যানা।
তিন্নি খেলার ফাঁকে ফাঁকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে কুমকুমের দিকে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here