আলোকিত অন্ধকার পর্ব-১৪

0
362

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
১৪ তম পরিচ্ছেদ
____________________________
বিচিত্র জীবন! সময়ের প্রভাবে জীবন রঙ বদলায়। একটু সুখের দেখা দিয়েই আবার কালো ছায়ায় ঢেকে যায় জীবনের রঙিন পাতাগুলো।
জানালার পাশে বসে ভাবছিল চারু। কি এক অন্যরকম জীবন কাটাচ্ছে সে। মায়ের মৃত্যুর পর জোয়ার না আসলেও জীবনে ভাটার শেষ হয়নি।
এখন নতুন এক চিন্তা যোগ হয়েছে। তনু আজ ছোট, কিন্তু দুইদিন পরে তনু বড় হবে কি নাম দেবে চারু ওর বাবার? এই সমাজে সিঙ্গেল মাদার হয়ে একটা বাচ্চা লালনপালন করা মুখের কথা নয়।
আল্লাহ আমি কি করব!
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে চারু।
দেখতে দেখতে ছয় মাস হয়ে গেছে চারু চাকরি করছে ‘চাইল্ড হ্যাভেন কিন্ডারগার্ডেন স্কুল” এ। এখন দিনের শুরুটা হয় সালাত আদায়ের মাধ্যমে। ইদানীং সুযোগ মতো সালাত আদায় করে চারু। চেষ্টা করে অনিয়মিত না হওয়ার। পুরোপুরি নিয়মিত না হতে পারলেও আগের চারুর আর এখনকার চারুর মাঝে যোজন যোজন দুরত্ব।
সালাত শেষের খুব ভোরে ঘুম ভাঙায় তনুর, প্রায় একমাস পরে দেখা গেল ভোরে ঘুম থেকে ওঠা তনুর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
এখন এমন হয় যে চারুর সালাত শেষ হতেই তনু উঠে গিয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙার কারণে চারুর ক্লাসটাইমটা তনু ঘুমিয়ে কাটায় ফলে আর কোনো বাড়তি চিন্তা বা চাপ নিতে হয় না ওর।
সকালের টুকটাক নাস্তা তৈরির কাজটা চারুকে কোলে নিয়ে অথবা খেলনা দিয়ে বসিয়ে শেষ করে। এরপরেই রিহান আসে।
চারু আলাদা বাসা নেওয়ার পর থেকে রিহান আসবেই প্রত্যেকদিন দুবেলা, এতটা সালিহা জানেনা। ও বাড়ি ছেড়ে দেওয়াতে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সালিহা। তনুকে নানুর কাছে দিয়ে চারু বাকি কাজ গুলো সেরে নেয়।
স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের পরে তনু আরেক তরফা ঘুম দেয়, সবকিছুই নিয়মমাফিক হয়ে গিয়েছে চারুর। একমুহূর্ত এদিক ওদিক করা হয় না, তনুর বেলায় তো নয়ই! সালাত শেষ হতেই কলিংবেলের শব্দ পায় চারু। বুঝতে পারে রিহান এসেছে।
-আরে বাবা এত খেলনা! কেন?
-কেন আবার তনুর জন্য!
ক্ষণিকের জন্য চারুর মুখটা মলিন হয়ে যায়। দরজা লাগিয়ে বাবাকে ফ্রেশ হতে বলে ও। রিহান ফ্রেশ হয়ে এলে বলে,
-বাবা
-বল মা
-বাবা তনুকে তুমি এভাবে অভ্যস্ত করো না, আজ তুমি দিচ্ছ। কিন্তু কাল আমি ওকে দিতে পারবো না হয়তো, তখন তনু জেদি হয়ে উঠবে আমি কখনোই তা চাইনা। ও ওর অবস্থানটা বুঝে নিয়ে বড় হোক, মানিয়ে নিতে শিখুক।
রিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন চারুর দিকে। তিনি রিহানাকে দেখতে পাচ্ছেন। চারুর বেলায় রিহান যখন অমিতব্যয়িতার পরিচয় দিচ্ছিলেন রিহানা তখন বুঝিয়েছিল, “আজ আমাদের প্রাচুর্য আছে, কাল নাও থাকতে পারে। চারু যেন সব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, সেভাবে বড় করব ওকে। বাড়তি চাহিদা যেন না থাকে”
আচ্ছা চারু তো রিহানাকে এসব বলতে শোনেনি, তবে চারু একই কথা কিভাবে বলছে? এটাই বুঝি রক্তের টান!
-ও বাবা!
চারু হাত ধরে নাড়া দেওয়াতে যেন বাস্তবে ফিরে আসেন রিহান।
-কি বাবা কখন ধরে চুপ করে আছ! রাগ করেছ? আচ্ছা তোমার যা খুশি এনো! তবু রাগ করো না।
আশ্চর্য! সেদিন রিহানার বিচক্ষণতা আর দূরদর্শিতা দেখে রিহান খুব চমৎকৃত হয়েছিলেন। বিস্ময়ে চুপ করে ছিলেন সেটাকে রাগ ভেবে রিহানাও এমন করেই বলেছিল, “যা খুশি এনো কিন্তু রেগে থাকবে না প্লিজ”
-ও বাবা!
-হ্যাঁ রে মা তুই ঠিক বলেছিস।
তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয় রিহান। তারপর আবার বলে,
-মা ইলিশ কিনেছি, একটু ইলিশ-খিচুড়ি কর না মা!
হেসে ফেলে চারু।
-আচ্ছা কিন্তু ওই বাসার জন্য?
-লাগবে না।
নির্লিপ্ত উত্তর দেয় রিহান।
চারু আর কথা না বাড়িয়ে কিচেনের দিকে যায়।
দুটো মাছের একটা ওবাড়ির জন্য রাখে। অবশ্য কেটে ধুয়ে দেয়। তারপর খিচুড়ি রান্নার তোড়জোড় শুরু করে।
আপাতত তনুকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না।
রান্না শেষ করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়।
সালাত শেষে তনুকে ফিডার দিয়ে রিহানকে দেখতে বলে এসে এই ফাঁকে চারু সালাদ সাজাতে বসে।
ছুরি দিয়ে টমেটোর বাইরের অংশটা কেটে নিয়ে গোলাপ বানায়, শসার খোসা না ছিলে পাতলা করে কেটে বানায় পাতা। তারপর আরো দুটো গোলাপ বানায় শসা দিয়ে। চারপাশ সাজিয়ে দেয় শসা কুচি দিয়ে আর দুই একটা টমেটো কুচি দিয়ে।
ইলিশ খিচুড়ি আর সালাদ দিয়ে প্লেট খুব চমৎকার ভাবে সাজিয়ে বাবাকে ডাক দেয় চারু। খাবার দেখে আরো একবার থমকে যায় রিহান। আনমনে বলে ওঠে,
-রিহানা বড্ড পারতো এইকাজ গুলো।
হঠাৎ মায়ের নাম শুনে চমকে উঠে চারু। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় রিহান,
-তুই এত কিছু শিখলি কার থেকে?
-ইউ টিউব দেখে।
হাসে চারু। আজ খুব ভাল লাগছে তার। এখানে আসা পর্যন্ত বাবা প্রায় প্রতিদিনই আসে আর তনুর সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে যায়, কিন্তু আজকের দিনটা একদমই অন্যরকম। খুশিতে চোখে পানি এসে যায়। মেয়েরা বেশি খুশি হলে সহজেই কেঁদে ফেলে।
চোখের পানি লুকাতে কিচেনে চলে যায় চারু। কিছুক্ষণ পরেই আবার চলে আসে। খেতে বসে রিহানের সাথে।
রিহান চলে যাওয়ার পর তনু ঘুমিয়ে গেলে সে রাতে চারু অনেক বেশি কান্না করে। কাঁদতে কাঁদতে দুর্বল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
.
আতিফ আজকাল ব্যস্ত অনেক, গত একবছরে তিন্নির সঙ্গ একটু একটু করে কাটিয়েছে। এবারের ঝামেলাটা কাটাতে একটু বেশিই পরিশ্রম করতে হয়েছে। এসব অবশ্য ঝামেলাই মনে হয় আতিফের কাছে।
আরে বয়সটা তো এনজয় করার, কি বিয়েশাদি করে সংসারি হবে সে বয়স তো হয়নি এখনো।
এগুলো আতিফের ভাবনা।
অবশ্য এই ভাবনা আমাদের সমাজেরও। সরকার বিয়ের বয়স বেঁধে দিয়েছে ১৮ আর ২১। আর আমাদের সমাজ আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মেয়ের বয়স ২৫+ আর ছেলের ৩৩+ করে রেখেছে।
মেয়েটাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, ছেলেটাকে একটা ভালো চাকরি করতে হবে তারপর বিয়ে! বিয়ের নাম করলেই মেয়ে বা ছেলে হয়ে যায় ছোট। সংসারের কি বুঝে! এদিকে তারা যে নিজেদের নাতি-নাতনীর বিয়ে দিয়ে ফেলে সে খবর বাবা মা রা বুঝেও বুঝতে চায় না।
মেয়ে বা ছেলে বর/বউ সামলাতে পারবে না অথচ এদিকে বিয়ের বাইরে ছেলেমেয়েদের জাস্টফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড এর সংখ্যা তারা সন্তর্পণে এড়িয়ে যায়। হায়রে সমাজ!
হায়রে মানসিকতা!
এই সমাজ জন্ম দেয় আতিফ আর তিন্নিদের। বাবা মায়েরা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে ভয় পান অথচ যিনা-ব্যাভিচারকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই যাচ্ছেন।
রাইসার ফোন রেখে বারান্দার দিকে এগোতেই আবার ফোন বেজে উঠল। একটু অবাক হয়েই আবার ফোনের দিকে এগিয়ে গেল আতিফ।
তিন্নির ফোনকল দেখে আরো বেশি অবাক হলো। ইদানীং তিন্নি বুঝতে পেরেছে আতিফ এড়িয়ে চলছে, তিন্নিও যেন সরে এসেছে, আতিফ এতে নিশ্চিন্তই হয়েছে।
-হ্যাঁ তিন্নি বলো…
-তুই মেরেছিস আমার বাচ্চাকে! তোর জন্য আমি বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে এসেছি! অসভ্য, বেয়াদব…. এরপর নানা অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে তিন্নি।
আতিফ একেবারে থতমত খেয়ে যায়। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে আতিফ বিদেশ থেকে আসার পর তিন্নি আতিফকে বাচ্চা নিয়ে কিছু বলেনি আতিফ জানতে চায়নি।
তারপর আস্তে আস্তে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে এসব নিয়ে কখনো কথা বলাই হয়নি। তখন তিন্নির কাছে এসব বিষয় খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কুমকুম আর ভাই ভাবীকে দেখার পর তিন্নি ধারণাতে চিড় ধরেছে।
-কি বলছ তিন্নি, তুমি এবরশোন করাওনি?
-তোকে বলেছিলাম না এবরশোন করা যাবে না? রাস্তায় ফেলে এসেছি বাচ্চাটাকে!…
কেঁদে ফেলে তিন্নি, ছুঁড়ে ফেলে মোবাইল। আতিফ কান থেকে ফোন সরিয়ে বসে পড়ে খাটের পাশেই।
আতিফ এমন কিছু স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে ওর।
.
-মিফা তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
-মিস আমার মামণি এখনো নিতে আসেনি, আজ তাড়াতাড়ি ছুটি দিবে মামণি জানেনা।
শুকনো মুখে উত্তর দেয় চারুর স্কুলের স্টুডেন্ট মিফা।
-কিন্তু দু’ঘন্টা পর তোমার মামণি আসতে আসতে এখানে কেউ থাকবে না। তুমি আগে বললে হেড মিস তোমার বাসায় ফোন করতেন, যেমনটা অনেকের করেছেন। কিন্তু এখন তো তালা দেওয়া হয়ে গিয়েছে সব।
একটু ভেবে আবার চারু বলে
-আচ্ছা… তুমি কি আমাকে তোমার আম্মুর মোবাইল নাম্বারটা বলতে পারবে?
-না মিস।
-তাহলে বাসার ঠিকানা বলতে পারবে?
আবারো না সূচক মাথা নাড়ে মিফা, তারপরই দ্রুত বলে ওঠে,
-তবে এখান থেকে বাসা চিনিয়ে দিতে পারবো।
-আচ্ছা বেশ চলো।
তনুকে নিয়ে আবার উলটো পথে যাওয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য মনে হলেও এই বাচ্চাটাকে এভাবে একা রেখে যেতে পারে না চারু।
রিকশা চলতে থাকে মিফার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী। এতক্ষণ মা না আসার খারাপ লাগা ছিল সেটা উধাও হয়ে মিস যে তাদের বাসায় যাচ্ছে এই আনন্দটা মিফার ছোট্ট মনটাকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে তনু ঘুমিয়ে গিয়েছে। বাসায় সামনে এসে রিকশা থেকে আর নামতে চায় না চারু কিন্তু মিফার অতিরিক্ত আগ্রহের কারণেই চারুকে যেতে হয় মিফাদের বাসা পর্যন্ত।
কলিংবেল দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দরজা খুলে একজন পুরুষ। দরজা খুললেই মিফা চেঁচিয়ে ওঠে
-মামা আমাদের স্কুলের মিস
-ভিতরে আসুন
বলে চারুকে কিছু বলার সুযোগ দরজা ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায় লোকটি। চারুর বিরক্ত লাগে লোকটির অভদ্রতা দেখে। যেন তার দিকে তাকানো বারণ!
কে এসেছে সেটা দেখতে মিফার মা তারানা এগিয়ে আসে।
-মামণি আমার স্কুলের মিস এসেছেন।
মিফার কথা শুনে চারুকে বসতে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারানা।
মিফার মুখে আজকের বাসায় আসার কথা শুনে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে তারানার মন। চারু না এলে মিফার কোনো বিপদও হতে পারতো। তনুকে নিয়ে শুইয়ে দেয় তারানা। এরপরই তারানা চারুকে নিয়ে পড়ে, চারুও বাঁধা দিতে দিতে পুরোটা সময় উপভোগ করে তারানা সরল আথিতেয়তা।
(চলবে)
(ক্ষমা করবেন আমি একটু ব্যস্ত, তার মাঝেও চেষ্টা করছি নিয়মিত হওয়ার। গল্পের এই পর্যন্ত কেমন লাগছে সবার? আপনাদের মন্তব্যই আমার লেখালিখি করার অনুপ্রেরণা। তাই গঠনমূলক মন্তব্য করে আমাকে অনুপ্রেরণা দিবেন যাতে পরবর্তীতে আরো ভাল কিছু লেখা উপহার দিতে পারি। পাশে থাকবেন। জাযাকুমুল্লাহ খায়রান। হ্যাপি রিডিং – নাঈমা বিনতে আয়েশা)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here