#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
#২০_তম_পরিচ্ছেদ
_____________________________
তনুকে নিয়ে স্কুলে গেছে চারু। আজ তেমন কোনো ক্লাস নেই ওর। তনু কান্না করছে দেখে ওকে কাঁধে নিয়ে স্কুলের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে চারু।
তনুর কাঁধের উপর ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। হয়তো ঘুমানোর জন্য এমন করছিল।
চারু তনুকে শুইয়ে দিতে যাবে এমন সময় স্কুলের বাইরে এসে একটা গাড়ি থামে। পিছনে ফিরে তাকিয়ে চারুর চিনতে দেরি হয় না গাড়িটা কার। চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই।
গাড়ি থেকে নামে তাহের আর মাহিমা। মাহিমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় চারু, সেই শক্ত মুখ আর নেই, হুট করে যেন বুড়িয়ে গিয়েছেন।
বুকের মধ্যে তনুকে চেপে ধরে চারু। মাহিমা চারুর কোলে বাচ্চা দেখে থমকে যায়, থমকে যায় তাহেরও। আগের দিন দেখেনি।
-তাহের বাচ্চাটা কার? চারু বিয়ে করেছে?
চাপাস্বরে প্রশ্ন করে মাহিমা। মায়ের প্রশ্নে তাহের মাথা নাড়ায়। তাহের জানিনা অর্থে মাথা নাড়লেও সেটা বুঝতে পারে না মাহিমা।
-চারু দেখ মা ও আজ তোমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে।
মাহিমার থেকে কিছুটা এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে তাহের।
-কিন্তু এটা কার বাচ্চা? তোমার কোনো কলিগের?
-আমার!
মুখ শক্ত করে উত্তর দেয় চারু।
-তোমার মানে? বিয়ে করেছ তুমি?
এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে মাহিমা।
-আজব তো আপনারা আমার উপর অধিকার ফলাচ্ছেন কেন? তাহের যখন ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছিল কোথাও কি লেখা ছিল যে আমি বিয়ে করতে পারব না? এমন কোনো শর্তে কি আমি রাজি হয়েছিলাম?
না চাইতেও কথাগুলো বলে ফেলে চারু। চায়নি মাহিমাকে অপমান করতে কিন্তু মানুষ যখন নিজের মান নিজেই রাখতে জানেনা তাকে অপমান না করে উপায় থাকেনা।
চারুর দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাহিমা আর তাহের। চারু একটাও ভুল কথা বলেনি। তবু আজ নিজেদের স্বার্থের জন্য চারুকে নিতে এসেছেন।
-চলে যান আপনারা!
-আজ আমি ফিরে যাচ্ছি, আমার জানামতে তুমি বিয়ে করোনি। তাহলে এই বাচ্চা কার? আমি আবার আসব। এত সহজে আমি ছাড়ব না।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে মাকে নিয়ে চলে যায় তাহের। চারু নির্জীবভাবে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। আর পারছে না সে। আর কত পরীক্ষা নেবেন আল্লাহ!
স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফেরে চারু। বাসায় ফিরেই দেখে তারানা আর নিধি বাসায়।
-এত তাড়াতাড়ি?
নিধি প্রশ্ন করে।
তারানা চারুকে দেখে বলে,
-তুমি দুপুরে যাবে না আবার আদৌ যাবে কিনা ভরসা পাচ্ছিলাম না, তাই চলে এলাম। আর দেখা করার জন্য আমার বাসায় যেতে বলছি কারণ তোমার এখানে একটা রুম, তুমি একা থাকো বাইরের পুরুষ মানুষ নিয়ে আসা ঠিক হবে না। আবার কোনো রেস্টুরেন্টে ভাইয়া দেখা করতে চাইছে না। তাই বারবার বাসার কথা বলছি। ওটাই ভাল হবে না, ঠিক না?
-হু ঠিক।
আনমনে বলে চারু। এখনো মন পড়ে আছে তাহেরের কথায়, মাহিমার উপস্থিতিতে।
চারুর ‘ঠিক’ বলা শুনে একযোগে হেসে ওঠে নিধি আর তারানা। চারু কিছুটা বিব্রত হয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়।
-মিফা আজ যায়নি কেন স্কুলে?
-আর বলো না মিফা আর মেহরীন বায়না করেছে ঘুরতে যাবে, ওদের বায়নার ধাক্কা এত বেশি ছিল যে মিফার বাবাকে অফিস ছুটি করে ওদের ঘুরতে নিয়ে যেতে হয়েছে। এমনিতে কোনো জেদ আমার ভাল লাগে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছুটা না শুনলে ওদের ও মন খারাপ হয়ে যাবে।
-আচ্ছা ভাল হয়েছে। তোমরা বসো, আমি একটু বোরকা হিজাব চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসি।
-আচ্ছা।
তনুকে নিধির কোলে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায় চারু। চারু একেবারে নামায শেষ করে এসে বসে ওদের পাশে।
-খাবে না? তুই খেয়েছিস নিধি? রান্না করার কথা করেছিস?
-না।
উত্তর দেয় নিধি। ভ্রু কুঁচকে নিধির দিকে তাকায় চারু। তারানা বলে,
-চারু তোমরা আমার সাথে যাবে, ওখানেই খাবে। আমিই নিধিকে রান্না করতে দেইনি। তার আগে বলো তোমাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন?
সাথেসাথেই নিধি প্রশ্ন করে,
-আজ ওই তাহের ভাই এসেছিল ঠিক, তাই না?
চারু ধীরে ধীরে খুলে বলে স্কুলের ঘটনাগুলো।
-ঠিক উত্তর দিয়েছিস তুই।
নিধির কথায় সায় দিয়ে তারানা বলে,
-চারু তুমি কি জানো এখন তাহেরের কাছে ফিরতে হলে কিছু ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা আছে?
-জানি।
মৃদুস্বরে জবাব দেয় চারু। নিজেই আবার বলে,
-আমি তো ফিরতে চাই না তারানা। কিন্তু কি জানো প্রথম স্বামী। হয়তো কোনো সম্পর্কে থাকলে ওর প্রতি আমার কোনো টান আসতো না। এখন আমি একা তাই হয়তো…
এটুকু বলেই থেমে যায় চারু। আবার যেন কিছুটা জোর দিয়ে বলে,
-তারানা আমি ফিরতে চাই না ওই জীবনে! কি ভয়ংকর দিন গেছে আমার। আমার সাথেই কেন এমন হয় তারানা! কেন!
আচমকাই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে চারু। মায়ের দিকে তাকিয়ে তনুও কেঁদে ওঠে।
-নিধি তনুকে নিয়ে একটু হাঁটো তো।
নিধিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে তারানা এগিয়ে বসে চারুর দিকে দিকে,
-দেখো চারু আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের কষ্ট, আনন্দ, টাকা, পয়সা অভাব দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের পছন্দ করেন। এই যে দেখ আমি তোমাকে বলছি না এই কথা, কষ্টে পড়লে আমিও ভুলে যাবো এসব। এটাই স্বাভাবিক। তাই আল্লাহ মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন, একসাথে থাকার ব্যবস্থা করেছেন যাতে একে অন্যের দুঃখ বুঝতে পারে কষ্টে পাশে থাকতে পারে।
আর যদি আল্লাহ দুটো মানুষকে একসাথে নাও রাখেন তাও বুঝতে হবে সেখানে আল্লাহর কোনো পরীক্ষা আছে, মঙ্গল আছে।
তারানার কোলে মাথা রেখে কথা গুলো শুনছিল চারু। এ পর্যায়ে বলে,
-কিন্তু আমার সাথেই কেন? একটা রক্তমাংসের মানুষ আর কত পারবে?
-আল্লাহ তো কারো উপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে দেন না চারু, তুমি এটা বহন করার যোগ্য তাই তোমাকে দেওয়া হয়েছে।
দেখ তুমি যখন ভাবছ তোমার জীবন কষ্টে ভরা, একবার কুরআনের দিকে দেখ,
আল্লাহ বলছেন,
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি।” (৯৪ঃ৬)
এই যে বারবার বলছ আমি কিভাবে পারব, আল্লাহ বলছেন,
“আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পন করি না” (২৩ঃ৬২)
তুমি যখন ভাবছ সব প্রিয় মানুষ গুলো হারিয়ে ফেলেছ, সব হারিয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ বলছেন,
“অবশ্যই তুমি পাবে যা তোমার থেকে চলে গেছে,
তার চেয়েও উত্তম।” (৮ঃ৭০)
-কাছের মানুষ দূরের মানুষ সবাই মিলে আমার সাথে এমন করলে আমি কি করে পারি?
প্রশ্ন করে চারু। তারানা বুঝল আজকের ঘটনাতে চারু অনেক অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, ঠান্ডা মাথায় আবার বোঝাতে থাকে,
– দেখ চারু, তুমি ভাবছ কাছের মানুষের ব্যবহার সম্পর্কে, ইব্রাহীম (আঃ) এর নিজ জন্মদাতা পিতা তাকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল,
সতীসাধ্বী হযরত আয়েশা (আঃ) কে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল, হযরত ইউনুস (আঃ) ও খুব বিপদে পড়েছিলেন, মাছের পেটে ছিলেন তিনি।
তুমি একবার ভাবো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ আপন মানুষদের কাছে কত হাসি তামাশার স্বীকার হয়েছেন? নবী ﷺ হিযরত করেছেন নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে।
একবার এইসব মানুষগুলোর দিকে তাকাও। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তারাই এত কষ্ট করেছেন। সেখানে আমরা… তারা ছিলেন নিষ্পাপ, আর আমরা?
এবারে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে চারু।
তারানার কথা গুলো নিজের মনে ভাবতে থাকে ও। আসলে ওর ভাবতে খুব ভাল লাগছে।
(চলবে)