আলোকিত অন্ধকার পর্ব-২১

0
332

#আলোকিত_অন্ধকার
#কলমে_নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
#২১তম_পরিচ্ছেদ
______________________________
আজ ছয়দিন হয়ে গেল রিহান মাত্র একবার মেয়ের খোঁজ করেছেন। তাতে সালিহা উত্তর দিয়েছিলেন,
-বান্ধবীর বাড়িতে গেছে।
ব্যস এতটুকুই! রিহান আর কোনো কথা বলেননি। সালিহা অনেক ভেবে বুঝেও নিধির পালিয়ে বিয়ে করার কথা রিহানকে বলার সাহস পায়নি। তবে নিজেও বসে থাকেনি, পরিচিত সব জায়গায় সর্বোচ্চ খোঁজ নিয়েছেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। চারুর কাছে ফোন করবেন করবেন করেও সংকোচে তা আর হয়ে ওঠেনি।
ভাবতে ভাবতে রিহানের পাশে গিয়ে বসলেন। সালিহাকে দেখে রিহান মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করে,
-কিছু বলবে?
-কেন বলা ছাড়া এমনিতে বসে পারিনা?
প্রথমে ঝাঁঝিয়ে কথা শুরু করলেও দ্রুত নিজেকে আয়ত্ত্বে নিয়ে আসে সালিহা। তারপর নিজেই আবার বলে,
-আচ্ছা তোমার কি নিধির প্রতি কোনো টান নেই? যা টান সব ওই চারুর উপর?
সালিহার প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে যায় রিহানের। অসম্ভব বিরক্তির সাথে বলে,
-কি বলতে চাও বলো তো! অকারণে ঝগড়া করছ কেন? তোমার স্বভাবই এমন হয়ে যাচ্ছে।
-কি বললে? আমি ঝগড়া করি তাই না? তোমরা বাবা মেয়েরা আমাকে ঝগড়াই করতে দেখো! নিধি কোথায় গিয়েছে খোঁজ নিয়েছ একবার!
ধুপধাপ পা ফেলে চলে যান সালিহা। সালিহার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন রিহান, আজও রিহানাকে ভুলতে পারেন না তিনি। কি এক অদ্ভুত ভাগ্য। তিনি জানেন নিধি চারুর ওখানে, কিন্তু নিধি স্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিয়েছে রিহান যেন এটা সালিহার সাথে না বলে। রিহান অবশ্য হ্যাঁ/না কোনো উত্তরই দেয়নি। ভেবেছিলেন নিধি আর ওর মায়ের ঝগড়া হয়তো।
একটু পরে আবার ফিরে আসে সালিহা,
-শোনো না, একটা কথা বলি আমায় কিছু বলো না। নিধি বলেছে ও কাউকে ভালবাসে আর পালিয়ে বিয়ে করবে।
রিহান চমকে তাকান সালিহার দিকে,
-মানে? কবে বলেছে?
-পাঁচ ছয়দিন আগে। আমি তোমাকে বলতে সাহস পাইনি।
-কিন্তু নিধি তো চারুর বাসায়!
বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেন রিহান, ভুল করে তো বলে দিলেন। নিধি কেন মাকে মিথ্যা বলেছে কে জানে। যা পারে করুক। হাতের পত্রিকা নিয়ে উঠে গেলেন।
সালিহার রাগে মাথা চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। তারই পেটের মেয়ে তাকে পাত্তা না দিয়ে মিথ্যা বলে ওই চারুর বাসায় গিয়ে পড়েছে। এসবই চারুর কূটবুদ্ধি! কাল সকালেই যাবেন তিনি। এর শেষ দেখে ছাড়বেন! রাগে গজগজ করতে থাকেন সালিহা।
.
তুর্যের বাড়ি থেকে তিন্নির গাড়ি যেখানে এক্সিডেন্ট করেছিল সেই রাস্তা ধরে, গত দুইদিনযাবত তুর্য আর রাইয়্যানা প্রত্যেকটা বাড়িতে খোঁজ করছে কোনো দুইবছর বয়সী বাচ্চা পেয়েছে কিনা।
রাইয়্যানা আর তুর্যের মনে কোনো আশাই নেই যে সেই দুবছর আগের বাচ্চা বেঁচে আছে! আর বেঁচে থাকলেও এখানে রাস্তায় রাস্তায় বাড়ি বাড়ি খুঁজে তাকে আদৌ পাওয়া যাবে কিনা। তবুও তুর্য নাছোড়বান্দা, বোন তো পাপ করেছে, কিন্তু তার সাধ্যের মধ্যে শেষ চেষ্টা করতে সে ছাড়বে না, যদি বাচ্চাটাকে পাওয়া যায়!
চলতি পথে বারবার আতিফের ছবিটা দেখছে তুর্য, বাচ্চাটা যদি বেঁচেই থাকে তিন্নি বা তুর্যের মতো দেখতে হবে। আল্লাহ আমাকে একটা সাহায্য করো। একটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে চাপা স্বরে বলে তুর্য।
-তুর্য শান্ত হও, আল্লাহ একটা সাহায্য করবেনই, হয়তো আমরা পেয়ে যাবো নয়তো….
কথা শেষ করেনা রাইয়্যানা।
-রাইয়্যানা তুমি জানো আমাদের এই খোঁজাখুঁজি এক পাগলামি, তবু আমি আমার মনকে মানাতে পারছি না। বুঝতে পারছ আমি সব কাজ ফেলে কেন পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি!
-আচ্ছা তুর্য আজ না হয় ফিরে চলো, কাল আবার আসবো?
-না রাইয়্যানা আরেকটু দেখি।
অগত্যা চুপ করে যায় রাইয়্যানা।
.
রেণুর দেশে ফিরতে আরো দেরি হবে। তাই সে জানিয়েছে চারু বা মাহমুদ রাজি থাকলে তাদের একবার ফর্মাল দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য। রিহানের পূর্ণ সমর্থন আছে এ বিয়ের ব্যাপারে।
তবে আজকে তারানার বাসায় রিহান আলাদাভাবে আসলেও, প্রথমে আসতে রাজি ছিল না। কিন্তু তারানার অতিরিক্ত অনুরোধের কারণে আসতে রাজি হয়েছে, বিশেষত সালিহার কথা ভেবে। ওই বাসায় গেলে সালিহা কিনা কি বেফাঁস কথা বলবে। তারচেয়ে এখানে একটা মোটামুটি মতামতে আসাই ভাল মনে হয়েছে।
তবুও আপত্তি করছিল রিহান। নিধি হঠাৎ বলে ওর মায়ের সাথে একটা বোঝাপড়া আছে। এখন কিছুতেই ও বাড়িতে যাওয়া যাবে না। অগত্যা রাজি হতে হয়েছে।
-ভাইয়া আর আপু কথা বলুক আমরা যাই এখান থেকে?
ড্রয়িংরুমে মাহমুদ আর চারুকে কথা বলতে দিয়ে তারানার দিকে তাকায় নিধি।
-আমি ওদিকটাতে যাই দেখি তনুকে নিয়ে।
বলে রিহান উঠে যায়।
-তোরা বস।
রিহান যাওয়ার সাথে সাথে বলে মাহমুদ।
-আরে ভাইয়া তোমরা কথা বলো আমরা আছি এই রুমেই।
এটা বলে তারানা নিধির হাত ধরে ড্রয়িংরুমেরই জানালার ধারে গিয়ে নিধির সাথে কথা বলতে থাকে।
-বাব্বাহ তোমার ভাইয়া পরনারীর দিকে তাকায় না বুঝি!
ফিসফিসিয়ে বলে চটুল হাসি দেয় নিধি। চোখ বড় করে হাসিমুখে কপট রাগ দেখিয়ে নিধিকে চুপ করিয়ে অন্য কথা বলে তারানা।
-আসসালামু আলাইকুম
গম্ভীরমুখে সালাম দেয় মাহমুদ। ধীর কন্ঠে উত্তর নেয় চারু,
-ওয়ালাইকুমুস সালাম
-আসলে ঠিক বলা উচিত বুঝতে পারছি না। আমরা দুজনেই পূর্ববিবাহিত। বাচ্চা আছে। আপনি সরাসরিই বলুন এই বিয়েতে আপনার অমত আছে কিনা?
প্রশ্ন করেই মাহমুদের মনে হলো বড্ড সরাসরি প্রশ্ন হয়ে গেল তবু এক্ষেত্রে সরাসরি জানাই ভাল।
চারু উত্তর না দিয়ে হাতের আঙুল কচলাতে থাকে। সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় মাহমুদ।
-জ্বি।
কয়েক মূহুর্ত পরে মৃদুস্বরে উত্তর দেয় চারু।
মাহমুদ আবার বলে,
-দেখুন এভাবে সরাসরি জানতে চাইতাম না শুধুমাত্র পরিস্থিতির জন্য…
-জ্বি
-আমার কোনো অমত নেই।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে মাহমুদ।
-কেন?
প্রশ্নটা করেই চারুর কেন যেন মনে হলো প্রশ্নটা এভাবে করা একটু কেমন যেন হয়ে গেল।
-জ্বি আমি আল্লাহর উপর ভরসা করতে পছন্দ করি। আমার সিদ্ধান্তেও সেই বিশ্বাসেই অটল থাকতে চাই। এ কারণে আমি ইস্তেখারার দোয়া করেছি এবং আমার ইতিবাচক মনে হয়েছে।
-ইস্তেখারা কি?
মাহমুদ বুঝল চারুর ভিতরে জ্ঞান বেশ সীমিত। আগ্রহ নিয়ে বলে,
-আমি তারানার কাছে একটা বই দিয়ে দিবো, আপনাকে দিবে “দোয়া অধ্যায়” আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ স্যারের। যাবতীয় দোয়া সেখানে একত্রে পাবেন।
-জ্বি
আগের মতোই মৃদুস্বরে বলে চারু। মাহমুদ প্রশ্ন করে,
-আর কিছু বলার বা জানার আছে আপনার?
না বোধক মাথা নাড়ায় চারু।
নিধির সাথে চারু চলে গেলে রিহান আরো কিছুক্ষণ কথা বলেন মাহমুদের সাথে। মাহমুদের কথাবার্তা মুগ্ধ করে রিহানকে। তবুও তিনি রেণু আর আদিবের সাথে কথা না বলে সিদ্ধান্ত নিতে চান না।
.
-আন্টি এখানে বছর দুই তিনের কোনো বাচ্চা আছে?
গেইট মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে তুর্য। প্রশ্ন করেই বুঝল ভুলভাল প্রশ্ন করেছে সে।
-বাচ্চা আছে মানে? বাচ্চা দিয়ে কি হবে?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সালিহা।
-না মানে আমাদের একটা বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছিল।
-কবে?
এবার বিপদে পড়ে যায় তুর্য। সবাই যেখানে দুইএকটা কথা বলেই ছেড়ে দেয় ইনি এত কথা বলছে কেন কে জানে!
-অনেকদিন আগে…
-আজব তো ছেলে তুমি! অনেকদিন আগে হারিয়েছে আর আজ খুঁজতে এসেছ! না না কোনো বাচ্চা নেই!
‘আগে বলে দিলেই হতো এত প্যাঁচাল করার কি দরকার ছিল’ মনে মনে বলে ধীর হাতে গেইট লাগিয়ে দেয় তুর্য।
‘কোথা থেকে যে আসে এসব, আগে গেইট লাগিয়ে দিই’ তুর্য যেতেই গেইট লাগাতে পা বাড়ায় সালিহা।
(চলবে)
(গল্পের এই পর্যন্ত আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি- নাঈমা বিনতে আয়েশা)
************************
#ইস্তেখারার_দোয়াঃ

জাবের (রাঃ)হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যাবতীয় কাজের জন্য ইস্তেখারা শিখাতেন। যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। এবং বলতেন, ‘যখন তোমাদের কারো কোন বিশেষ কাজ করার ইচ্ছা হয়, তখন সে যেন ফরয সালাত ব্যতীত দু’ রাকআত নামায পড়ে এই দো‘আ বলেঃ-

ْ: اَللهم إنِّي أسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ، وَأسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْألُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيْمِ، فَإنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أعْلَمُ، وَأنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ . اَللهم إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هَذَا الأمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أمْرِي أَوْ قَالَ: عَاجِلِ أمْرِي وَآجِلِهِ، فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي، ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ . وَإنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ: عَاجِلِ أمْرِي وَآجِلِهِ ؛ فَاصْرِفْهُ عَنِّي، وَاصْرِفْنِي عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أرْضِنِي بِهِ

‘#উচ্চারণঃ আল্ল-হুম্মা ইন্নী আস্তাখীইরুকা বিইলমিকা ওয়া ওয়াসতাক্বদিরুকা বি ক্বুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিং ফায্বলিকাল আযীইম, ফাইন্নাকা তাক্বদিরু ওয়ালা আক্বদির, ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লাম, ওয়া আংতা
আল্লা-মুল গুয়ূউব।
আল্ল-হুম্মা ইং কুংতা তা’লামু আন্না হা-যাল আমরা (এখানে যে কাজের জন্য ইস্তেখারা করা হচ্ছে তা মনে মনে উল্লেখ করবে) খাইরুল লী ফী দ্বীনী ওয়া মাআ’শী ওয়া আ’-ক্বিবাতি আমরী আ’-জিলিহী ওয়া আ-জিলিহ ফাক্বদূরহু লী, ওয়া ইয়াছছিরহু লী
ছুম্মা বা-রিক লী ফীহ। ওয়া ইন কুন্তা তা’লামু আন্না হা-যাল আমরা শার্রুল লী ফী দ্বীনী ওয়া মাআ’শী ওয়া আ’-ক্বিবাতি আমরী আ’-জিলিহী ওয়া আ-জিলিহ ফাসরিফহু আন্নীই ওয়াস্বরিফনীই আনহু,
ওয়াক্বদির লিয়াল খয়রা হাইছু কা-না ছুম্মারয্বিনী বিহ।’’

#অর্থ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট তোমার ইলমের সাথে মঙ্গল প্রার্থনা করছি। তোমার কুদরতের সাথে শক্তি প্রার্থনা করছি এবং তোমার বিরাট অনুগ্রহ থেকে ভিক্ষা যাচনা করছি। কেননা, তুমি শক্তি রাখ, আমি শক্তি রাখি না। তুমি জান, আমি জানি না এবং তুমি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। হে আল্লাহ! যদি তুমি এই (এখানে যে কাজের জন্য ইস্তেখারা করা হচ্ছে তা মনে মনে উল্লেখ করবে) কাজ আমার জন্য আমার দ্বীন, দুনিয়া, জীবন এবং কাজের বিলম্বিত ও অবিলম্বিত পরিণামে ভালো জান, তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত ও সহজ করে দাও। অতঃপর তাতে আমার জন্য বরকত দান কর। আর যদি তুমি এই কাজ আমার জন্য আমার দ্বীন, দুনিয়া, জীবন এবং কাজের বিলম্বিত ও অবিলম্বিত পরিণামে মন্দ জান, তাহলে তা আমার নিকট থেকে ফিরিয়ে নাও এবং আমাকে ওর নিকট থেকে সরিয়ে দাও। আর যেখানেই হোক মঙ্গল আমার জন্য বাস্তবায়িত কর, অতঃপর তাতে আমার মনকে পরিতুষ্ট করে দাও।

তিনি বলেন, ‘‘সে এ সময়ে তার প্রয়োজনের বিষয়টি উল্লেখ করবে।’’ (অর্থাৎ দো‘আ কালীন সময়ে ‘আন্না হা-যাল আমরা’ এর জায়গায় প্রয়োজনীয় বিষয়টি উল্লেখ করবে।)

(বুখারি শরিফ, মিশকাত শরিফ, তিরমিযি শরিফ, নাসাঈ শরিফ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here