#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা বিনতে আয়েশা
৪র্থ পরিচ্ছেদ _________________________________
রিহান নিজের রুমে এসেছিল মোবাইলটা নিতে। অফিসে একটা ফোন করতে হবে।
-বাবা রিহান?
রিহানের দরজার সামনে এসে ডাক দিলেন রিহানার বাবা।
-জ্বি বাবা, মা আসুন আসুন। শ্বশুর-শাশুড়িকে এসময় একসাথে এভাবে আসতে দেখে একটু অবাক হলো রিহান। সাধারণত এই সময়টাতে রিহান রুমে আসে না। তাই রিহানের ঘরে ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে চারুকে গল্প শোনাচ্ছিল রেণু, চারুর রেণুর কাঁধে মাথা রেখে প্রায় ঢুলুঢুলু করছে ঘুমে। গল্প থামিয়ে কেবল চারুকে নিয়ে উঠতে যাবে তখনই ঘরে ঢুকলো রেণুর বাবা মা। তারা জানেন না রেণু ঘরেই আছে। তাহলে হয়তো রিহানের সাথে রেণুর বিয়ের কথাটা এখানেই বলতেন না।
রিহান বিয়ের কথা শুনে চমকে উঠল। তার চেয়ে বেশি চমকে উঠল রেণু। কোনো সাড়া না দিয়ে কাঠ হয়ে বসে রইল ও।
রিহান হুট করে জোরে বলে উঠল,
-এখনই!
রিহানার বাবা বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,
-রিহান, ভেবে দেখো ভাল করে। দেখ চারু তরুর অবস্থা ওদের জীবনে একজন মায়ের খুব দরকার, আবার তোমার জন্য একজন গুছিয়ে নেওয়ার মানুষ দরকার, হয়তো ভাবছ খুব তাড়াতাড়ি বলছি, আসলেই তাই। তবে কারণ শুধুই তরু৷ একেবারে বাচ্চা ও, তোমার ভাই ভাবি চলে গেলে কি করে চলবে তোমাদের? চারু যেখানে নিজেই একটা বাচ্চা তাই আরেকজন কে মানুষ করার প্রশ্নই উঠে না। বলো তুমিই?
রিহান শ্বশুরের যুক্তির কাছে কিছু বলতে পারলেন না।
রিহানকে নিরুত্তর থাকতে দেখে রিহানার মা এবার কথা বললেন,
-তুমি বিয়ে যেকোনো জায়গায় করতে পারো কিন্তু চারু তরুকে নিজেদের সন্তানের মতো দেখবে কি তারা? রেণু সেটা পারবে। তাই আমরা রেণুর সাথে তোমার বিয়ের কথা ভাবছিলাম। রেণু রাজি হবে আমাদের বিশ্বাস, তুমি কি বল?
রেণুর কথা শুনে আরেকবার ধাক্কা খেল রিহান। বারান্দায় রেণু আছে সেটা জানে রিহান, আর তাই কোনোভাবেই ওর উপস্থিতিতে বিব্রত হতে চাইছিল না সে। এমনিতেই অনেক হয়ে গেছে। তাই দ্রুত বলল,
-বাবা মা আপনারা যান, আমি পরে এ বিষয় নিয়ে কথা বলব।
রিহানের কথা শুনে দোমনা নিয়ে চলে গেলেন রিহানার বাবা মা। ঠিক বুঝতে পারলেন না রিহান কি বলতে চাইছে। তারা চলে গেলে রিহান বারান্দায় গিয়ে ঘুমন্ত চারুকে কোলে নিয়ে চলে আসতে গিয়ে পিছন দিকে ফিরে রেণুকে বলল,
-রেণু তুমি কিছু চিন্তা করো না আমি ম্যানেজ করে নিবো!
রিহানের কথায় আশ্বস্ত হলো রেণু। চিন্তার বোঝা নেমে গেল অনেকখানি। ভগ্নীপতির পারসোনালিটি সম্পর্কে ধারণা আছে রেণুর তাই পাল্টা জবাবে আর কিছুই বলল না। চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে রইল ও, এইতো মাত্র ছয় মাস আগের কথা,
রিহানের অফিসের আদিব নামে এক কলিগের সাথে রেণুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল রিহান। আদিব রিহানের বেশ জুনিয়র আর অল্পদিন চাকরিতে জয়েন করলেও আদিবের সাথে রিহানের পরিচয় অনেক দিনের তাই রিহান জেনেশুনেই আদিবের জন্য রেণুকে ভেবে রেখেছে। এটা রিহান, রিহানা আর রেণু ছাড়া কেউই জানে না। ছেলেটা ধর্মীয় দিকসহ সব দিক থেকে ভাল হওয়ার রিহানার খুব পছন্দ ছিল। রেণুর মতামত টাও জেনে রিহানা রিহান কে জানিয়েছিল কথা ছিল রিহানার ডেলিভারির পরই এটা নিয়ে বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে তারা৷ পারিবারিক ভাবে কোনো কথাবার্তা না হলেও রেণুর ব্যাপারে সব শুনে সানন্দে রাজি ছিল আদিব। কিন্তু এরই মাঝে অঘটন ঘটলো।
যদিও ছবিতে দেখা ছাড়া রেনুর সাথে সরাসরি আদিবের সাথে দেখা পরিচয় কিছুই হয়নি। তবু না দেখেই আদিবের জন্য একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে রেণুর মনে। আদিবের ধর্মীয় গুনাবলী আর চরিত্রের দৃঢ়তার শুনে। অনেক চেষ্টাতেও মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারেনি। তাই মনের এক কোণে রেখে দিয়েছে সেটা নিয়ে বেশি ভাবেনি। কারণ মানুষ জোর করে কিছু ভুলতে চাইলে সেটাই বেশি মনে পড়ে।
আজ কিভাবে সে এত দিনের কল্পনার মানুষটাকে সরিয়ে রিহানকে তার জায়গায় বসাবে! আর রিহানকে বড় ভাইয়ের সম্মান দিয়ে এসেছে, রিহানও যথেষ্ট দূরত্ব রেখে চলেছে। বর্তমানের তথাকথিত শালি-দুলাভাই এর মশকরা-উপহাসের সম্পর্ক তাদের কখনোই ছিল না। এই শিক্ষাটা রেণু পেয়েছে বোন আর বাবা মায়ের থেকে। আমাদের বর্তমান সময়ে দেবর-ভাবি বা শালি-দুলাভাই যে সম্পর্ক দেখা যায় ইসলাম সেটাকে পুরোপুরি নিষেধ করে। অতিরিক্ত ঠাট্টা-তামাশার কোনো সুযোগ নেই ইসলামে। আমরা ভেবে থাকি অনেক বেশি রেস্ট্রিকশন অনেক বেশি নিয়ম-কানুন, এত কি মেনে চলা যায় নাকি! আবার অনেকেই আমরা একটু আগ বাড়িয়ে বলি দেবর ভাইয়ের মতো বা শালি বোনের মতো, এটা কখনো হওয়ার না। শুনতে খারাপ লাগলেও এগুলোও জন্ম দেয় পরকিয়া, সংসার ভাঙন আর বিভিন্ন ভয়াবহতার। সবার উচিত নিজেদের সতর্ক রাখা।
-রেণুকে বিয়ে করতে তোমার অসুবিধা! এসব কি বলছ তুমি?
চোখমুখ কুঁচকে বললেন রিহানার মা।
-রেণুর কি অ্যাফেয়ার আছে কোথাও?
পাশ থেকে প্রশ্ন করলেন রিহানার বাবা। এবারে যথেষ্ট বিব্রতবোধ করতে লাগল রিহান।
-মা আসলে আমি একটু বুঝিয়ে বলি..
রিহান যথাসম্ভব গুছিয়ে বলতে শুরু করলো আদিবের কথা। তারপর শেষে বলল,
-আর রিহানাকে তো আপনারা জানেনই যে সে ছেলে ওর পছন্দ হবে না, কথা ছিল ওর ডেলিভারির পর এ বিষয়ে কথা বলব, কিন্তু….
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল রিহান। তারপর আবার দ্রুত নিজেকে সামলে বলল,
-আপনারা কি বলেন?
শান্ত ধীর স্থির মানুষ রিহানার বাবা। একটু ভেবে ধীরকন্ঠে তিনি বললেন,
-বেশ তাই হবে যেটা রিহানার ইচ্ছে ছিল।
এ নিয়ে কেউই আর কোনো কথা বলতে পারল না। রিহানার স্মৃতি তাদের কন্ঠরোধ করে নিয়ে এসেছে। কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় সবাই ব্যস্ত। কান্না গুলো গলার কাছে এসে যেন আটকে আছে আর কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরোত্তর।
সিহান তুহিনা দুইদিন আগেই নিজেদের বাসায় চলে গিয়েছে। রিহানই পাঠিয়েছে, আপাতত চারুর নানা নানি আছে বলে সমস্যা হচ্ছে না। এখানে থেকে সিহানের অফিসে যাওয়ার ঝামেলা হচ্ছে।
তুহিনা যাওয়ার আগে সিহানকে আরেকবার তরুর কথা মনে করিয়ে দিলো। সিহান এবারেই থামিয়ে রাখল,
-আর কয়েকটা দিন যাক।
মায়ের কাছে রিহানের বলা কথা গুলো শুনে ভীষণ আশ্বস্ত হলো রেণু। রিহানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল অনেক।
বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল।
বারান্দায় বসে আছে রিহান। সবার দেখাশোনাতে তরুর আপাতত কোনো সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু তবুও তরুকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছে রিহান। কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। চারুও একদম অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ থাকে সবসময়। তরুকে নিয়ে মনের ভিতর একটা আশার আলো জ্বলেও নিভে যাচ্ছে।
দূর রিহানকে বসে থাকতে দেখে দূর থেকে দীর্ঘঃশ্বাস ফেললেন রিহানার মা। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন দৃশ্য হয়তো মায়ের সামনে সন্তানের মুখ। তিনি খুব শক্ত মানুষ আর আর আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়তো যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছিলেন তাই হয়তো নিজেকে শক্তভাবে সামলে রাখতে পেরেছেন। ©নাঈমা বিনতে আয়েশা।
-বাবা রিহান?
শাশুড়ির ডাকে পিছনে ফিরে উঠে দাঁড়ালো রিহান।
-জ্বি মা বলুন?
-তোমার সাথে কিছু কথা ছিল…
-জ্বি মা, ঘরে চলুন।
বসার ঘরে ঢুকে সোফার এক প্রান্তে বসতে বসতে রিহানার মা বললেন,
-দেখো বাবা কথাটা তুমি কিভাবে নেবে আমি জানিনা, তবে ভেবে দেখো।
-জ্বি বলুন কি কথা?
মৃদুস্বরে বলল রিহান।
-তরুকে নিয়ে কি ভাবছ?
নিরুত্তর রইল রিহান।
-দেখো তরু এখনো খুব ছোট, আর চারু নিজেও বাচ্চা। এসব ভেবেই রেণুর কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে যাক। আপাতত তুমি তরুকে আমার কাছে দাও, অন্তত বছর দুয়েক থাকুক আমার কাছে, তুমি যেয়ে দেখে আসবে মাঝে মাঝে। তারপর না হয় নিয়ে এসো।
দেখ আমি বলছি মানে এই না যে তোমাকে মেনে নিতেই হবে! ভেবে দেখো!
আনন্দের অশ্রুতে চিকচিক করে উঠল রিহানের চোখ,
-মা আপনি বিশ্বাস করবেন না আমি এটাই ভাবছিলাম! কিন্তু সংকোচে বলতে পারছিলাম না। এই বয়সে আপনাকে কষ্ট দিবো!
রিহানের কথাতে সামান্য হাসলেন। তার বড় আদরের মেয়ে রিহানা। সেই রিহানা আজ নেই। তার বাচ্চাটাকে মানুষ করতে কষ্ট হবে কি করে! তিনি যে মা!
রিহান আবার বলল,
-মা সিহানদের কাছে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুহিনা একটু বেশিই মর্ডান। অনেক বলেও সে শোনেনি সে। রিহানার রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি তরু। ওকে আমি রিহানার মতো করে বড় করতে চাই, তুহিনা সেটা পারবেনা।
তুহিনার সমালোচনা এড়িয়ে রিহানের উত্তরে বললেন,
-বেশ তাহলে এক সপ্তাহ পর তো আমরা চলে যাচ্ছি। আচ্ছা রিহান রেণুর বিয়েটা আরেকটু পরে দিলে হয় না?
-না মা, আপনারা ব্যবস্থা করুন, লোকে যা ভাবে ভাবুক। এভাবে রাখা ঠিক হচ্ছে না। আমি ভালোর জন্যই বলছি। দরকার হয় খুব ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করুন, তবু বিয়েটা দিয়ে দিন।
রিহানের কথা শুনে আর না করলেন না রিহানার মা,
-ঠিক আছে এই সপ্তাহ পর আমরা বাড়িতে যাব। তুমি, চারু, তরুও যাবে। ওখান থেকে অফিস করো কিছুদিন। ততদিনে চারুও স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এর মাঝে রেণুর বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা চলবে।
শাশুড়ির কথা যুক্তিযুক্ত ভেবে সম্মতি জানালো রিহান।
(চলবে)
(কোনো ভুলত্রুটি চোখে পড়লে জানাবেন)