#আলোকিত_অন্ধকার
কলমেঃ-নাঈমা_বিনতে_আয়েশা
৯ম পরিচ্ছেদ
____________________________
-তুমি ওভাবে চলে এলে কেন?
রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চারু যখন নিজের গহনাগুলো খুলছিল তখন প্রশ্ন করে তাহের।
-ওখানে থাকতে আমার ভাল লাগছিল না৷ তোমার ফ্রেন্ডগুলোর ওভাবে হাত ধরা বা কথাবার্তা কোনোটাই আমার ভাল লাগেনি। কেমন যেন…
চারুর নির্লিপ্ত উত্তর শুনে রাগ আরো বেড়ে যায় তাহেরের।
-ফ্রেন্ডরা একটু মজা করতেই পারে তাই বলে ওভাবে ইগনোর করে চলে আসতে হবে? হাজার হলেও তারা এ বাড়ির গেস্ট!
-হ্যাঁ গেস্ট বলেই তোমার বউয়ের সাথে ফ্ল্যার্ট করবে আর তুমি হা করে দেখবে আর আমাকে ও সহ্য করতে হবে তাই তো? কানের দুল খুলতে খুলতে চারু তাকায় তাহেরের দিকে।
তাহের আর নিজেকে সামলাতে পারে না। চড় বসিয়ে দেয় চারুর গালে। চারুর হাতে থাকা কানের দুলের পিন এসে লাগে চারুর গালে, খুব বেশি ধারালো না হলেও চড় জোরে মারায় পিনের আঁচড়ে চারুর গাল কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে থাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় তাহের ভয় পেয়ে যায়। ঘর থেকে বের হয়েই মাকে ডেকে দেয়। চারু কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই বসে পড়ে…
মাহিমা এসে চারুকে উঠিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।
-গায়ে হাত তোলার ছেলে তো আমার তাহের না! কি করেছ?
চারুর মুখে তাহেরের মারার কারণ শুনে তিনি চারুকেই কথা শোনাতে শুরু করেন।
-তুমি বাপু বলিহারি বউমা! কেন ছেলেটা আমার বলেছে একটু বন্ধুদের মাঝে থাকতে। না এলেই কি হতো না! এখন সামলাও ঠেলা। আমি বাপু স্বামীর বাক্যকে কোনোদিন অবহেলা করতে পারিনি।
তাহের সেই মূহুর্তে আবার ঘরে ঢুকছিল। মায়ের কথা শুনে মনে করতে পারলো না কবে তার মা তার বাবাকে পাত্তা দিয়েছেন৷ তবু এখানে কিছু নিরাপদ না, আর মাহিমা এখনও চারুকে চব্বিশ ঝুড়ি কথা শোনাবেন ভেবে তাহের সোজা গিয়ে গেস্ট রুমে শুয়ে পড়ে।
-তাই বলি একটা বাচ্চা নিয়ে নাও, তাহেরের রাগ কমে যাবে। আমার কথা তো শুনবে না আমি বলি কি…
সেই পুরোনো কথা বলতে থাকেন মাহিমা৷ শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় চারু। গালটা খুব জ্বলছে।
চারু বুঝে গিয়েছে এখানে আর কোনো প্রতিবাদ করা চলবে না, করলেই মার খেতে হবে। একবার যখন তাহের গায়ে হাত তুলেছে, এটা শেষ হবে না, বরং বাড়তেই থাকবে।
পরের দিনগুলোতে দেখা গেল চারু সবই ঠিকঠাক করছে শুধুমাত্র হাসিটা একেবারেই হারিয়ে গেল চারুর মুখ থেকে…!
.
মায়ের কথা শুনে তিন্নি ভার্সিটি এসে ট্যুরের কথা বলার আগেই আতিফ ফ্রেন্ডদের উদ্দেশ্যে বলল সে সাত-আট মাস ভার্সিটি আসবে না৷ কোনো একটা কাজে তাকে হঠাৎই তার বাবার সাথে কানাডা যেতে হচ্ছে। তবে খুব দ্রুতই ফিরে আসবে। বন্ধুদের সাথে বলা কথাগুলো তিন্নি খুব সহজেই শুনতে পেল।
হয়তো তিন্নি যাতে শুনতে পায় সেইভাবেই বলেছে আতিফ। কথা শেষে তিন্নির দিকে আড়চোখে তাকায় ও। ভালভাবে না তাকিয়েও বুঝতে পারে তিন্নি এখনই চলে যাবে।
সত্যিই তিন্নি চলে গেল রাফিয়াকে টেনে নিয়ে৷ আতিফের ঠোঁটের এককোণে চাপা হাসি লেগে রইল যেটা বরাবরের মতোই দুর্বোধ্য।
গাড়িতে উঠেই রাফিয়া তর্জনী তুলে বলে,
“তোর কি হলো বলতো! গত একবছর ধরেই উল্টাপাল্টা পাগলামি করেই যাচ্ছিস! কেন তিন্নি! এগুলো ঠিক না!”
তিন্নি তখন সবেমাত্র গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আতিফের কথা গুলো শোনার পর ভালোমন্দ বোঝার অবস্থায় তিন্নি ছিল না। তাই রাফিয়ার কথা শুনে তিন্নি যে রেগে যাবে তা বলাই বাহুল্য।
গাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা রাফিয়ার সাইডের দরজা খুলে দেয়,
-গাড়ি থেকে নাম!
-মানে!
অবাক হয়ে তাকায় রাফিয়া।
-তোকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছি। নাম!
তিন্নির আকস্মিক চিৎকারে ব্যাগ নিয়ে নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় রাফিয়া। তিন্নি গাড়িতে উঠেই যেন চোখের পলকেই বেরিয়ে যায় রাফিয়ার সামনে থেকে।
রাফিয়ার যেখানে দাঁড়ানো সেটা লোকালয় না। আশেপাশে বাড়িঘর নেই বললেই চলে। স্রেফ রাস্তা, অনেক গুলো গাড়ি বেরিয়ে গেলেও কোনোটাই খালি পায় না রাফিয়া৷ অথচ এ রাস্তায় এমনটা হয় না। অগত্যা ফোন করে তার দুই বছরের ছোট ভাই রাফিজের কাছে।
-ভাইয়া তুই কোথায় এখন?
-কেন রে আপু!
-আমাকে নিয়ে যেতে পারবি একটু, গাড়ি পাচ্ছিনা।
রাফিয়ার কথা শুনে রাফিজ বলে,
-আপু একটু অপেক্ষা কর আমি এক্ষুনি বাইক নিয়ে আসছি।
প্রায় ত্রিশ মিনিটের পথ অর্ধেক সময়ে পার করে আসে রাফিজ৷ তারপর বোনকে নিয়েই আবার ধীরে ধীরে চলে বাড়ির দিকে৷ এবার ত্রিশ মিনিটের পথ চল্লিশ মিনিট লেগে যায়৷ এভাবে সময়ের তারতম্য করার জন্য রাফিয়ার কাছে কানমলাও খায়। এটাই বুঝি ভাই বোনের কেয়ার আর ভালবাসা।
গাড়ি নিয়ে বাসার গেইটে ঢোকার সময়ই তিন্নির মনে হয় রাফিয়ার সাথে কাজটা ঠিক হয়নি, ওখানে হয়তো সহজে কোনো গাড়ি পাবেনা ও।
তিন্নি গাড়ি ঘোরায়, যদিও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ে সেই দিন গুলোর কথা। রাফিয়ার সাথে সে নিজেই বন্ধুত্ব করেছিল আর রাফিয়াকে প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল যে প্রতিদিন তার সাথেই ফিরে৷ রাফিয়ার দ্বিধাদ্বন্দকে পাত্তা দেয়নি ও, আপন করে নিয়েছিল। নিজের একাকিত্ব কাটাতেই বুঝি এমন করেছিল তিন্নি।
আর আজ তাকেই এভাবে সামান্য ব্যাপারে অপমান করে ফেলে এসেছে।
রাফিয়াকে নামিয়ে দেওয়া জায়গায় এসে রাফিয়াকে না দেখে তিন্নি বুকটা ধ্বক্ করে ওঠে। দ্রুত ফোন বের করে ডায়াল করে রাফিয়ার নাম্বারে। তিন্নি ভেবেছিল রাফিয়া ফোন উঠাবে না। তিন্নিকে অবাক করে দিয়ে ফোন রিসিভ করে রাফিয়া৷ সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে রাফিয়া,
– কি বলবি বল?
– তুই কোথায়?
-সালামের উত্তরটা এটলিস্ট নেওয়া উচিত। আমি বাসায়, রাফিজ গিয়ে নিয়ে এসেছে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিন্নি।
-সরি রে।
-ইটস ওকে। ড্রাইভিং করতে করতে ফোনে কথা বলতে হয় না। ওখান থেকে বাসায় যা। আল্লাহ হাফেজ।
বাই বলে ফোন রেখে দেয় তিন্নি। রাফিয়াটা আসলেই আলাদা। গাড়ি চালানোর দিকে মনোযোগ দেয় তিন্নি।
পরের দিনগুলোতে রাফিয়ার রাগ ভাঙাতে বেগ পেতে হয় না তিন্নির। কিন্তু তিন্নির অগোচরেই একটা ক্ষত থেকে যায় রাফিয়ার মনে৷ হাজার চেষ্টাতেও সেটা দূর করতে পারে না রাফিয়া।
.
বিয়ের প্রায় দুই বছর হতে চলল। এখনো বেবি কনসিভ করতে পারেনি চারু। এই নিয়ে মাহিমার ক্ষোভের শেষ নেই। আগেই বলেছি মাহিমা প্রচন্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাই গর্ভধারণ না করার পুরো দোষটাই চারুর ঘাড়ে চাপাচ্ছেন তিনি৷ চারুর বাবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন৷ ইদানীং আবার রেণু না কোন খালা আসে, তার সাথে অত গল্প পছন্দ হয়না মাহিমার, তাতেও তার রাগ।
তিনি চারুকে ডাক্তারের কাছে যেতে দিচ্ছেন না, বাড়ি থেকে বের হওয়ার হুকুমই নেই।
তাহের কে তো ডাক্তারের কাছে যেতে দিবেনই না। তাহের মা ভক্ত ছেলে। তাই মায়ের অযাচিত অন্যায় কথাও বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিবে এটাই স্বাভাবিক।
চারুকে নানান রকম তাবিজ আর মাদুলি পরিয়ে রেখেছেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চারুকে সেসব বিদআতি কাজ করতে হয়৷ তার কাছে মাদুলি-তাবিজ না দেখলেই তাহের মারতে শুরু করে।
রেণু দেশে এসেই চারুর কাছে আসে৷ এসব বুঝে নিয়ে যেতে চেয়েছিল চারুকে৷ আবার বাঁধা দেয় রিহান, তার থেকে বেশি বাঁধা দেয় সালিহা৷
সালিহার এককথা শ্বশুরবাড়িতে গেলে তাদের কথানুযায়ী চলতেই হবে। আদরের মেয়ে আর কারো নেই!
অগত্যা সালিহার জেদের কাছে হার মানে রেণু। তবে চারুর নির্লিপ্ত চলাফেরায় আরো কষ্ট পায় সে। অজান্তেই নিজের মেয়ের দিকে তাকায় সে। তার মেয়ের এমন কি হবে সে না থাকলে!
আচমকা ঘুমন্ত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেণু। আদিব ঘরে ঢুকে সে সময়। রেণুর চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
-কি হয়েছে রেণু?
-কিছু না, আদিব আমি একটা বিষয় সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর সেটা তোমাকে না জানিয়েই!
আদিব বুঝে যায় রেণু খুব চিন্তিত অথবা আবেগতাড়িত হয়ে আছে। তাই এগিয়ে এসে রেণুর দু’কাঁধে দু’হাত রেখে বলে,
-আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি আগে স্বাভাবিক হও।
-না আদিব আমি ঠিক আছি।
নিজেকে যেন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে রেণু।
-আচ্ছা বেশ বলো তাহলে….
(চলবে)