একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-১

0
792


~ আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ, আমার স্বাধীনতা। এক কথায় বিয়েতে রাজি হয়ে গেছি মানে এই না, আমি আপনাকে ভালোবাসি। বা আপনার প্রতি আমার অনুভূতি, ভালোলাগা, টান টাইপ কিছু কাজ করে।”

এক দমে কথাগুলো বলে থামল অথৈ। পুনরায় কথা শুরু করার আগে খানিক সময় নিল। সামান্য ঝুঁকে পড়ে তার সামনে বসে থাকা ছেলেটার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল। ছেলেটাকে তার বাবা জুটিয়েছে। অথৈ আজই প্রথম দেখা করতে এসেছে এর সাথে। ছেলেটাকে তার ভালো লাগলে বাসায় গিয়ে জানাবে। বাবা তার হ্যাঁ’র অপেক্ষাতে আছে। তার থেকে অনুমতি পেলেই বিয়ের আয়োজন শুরু করবে। দুই মিনিটের মত সময় কেটে গেলেও অথৈ ছেলেটার মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারল না। বরং সে এভাবে ছেলেটার মুখের দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে ছেলেটা যেন চোখ কেমন করে চাইল। অথৈ সোজা হয়ে বসল। গলা পরিস্কার করে নিয়ে আবার শুরু করল,

~আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি?”

~হুম বুঝেছি। আমাকে আপনি ভালোবাসেন না। এটা সম্ভবও না। কারণ আজই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছে। আমার প্রতি আপনার ভালোলাগা কাজ করারও তেমন কোন কারণ নেই। আর এক দেখাতে আমাকে নিয়ে আপনার মনে অনুভূতি তৈরি হবে তেমন কোনো বিশেষত্বও আমার মাঝে নেই। তাহলে কথাটা হচ্ছে আপনি বিয়েটা করছেন কেন? যাকে ভালোবাসেন না, ভালো লাগে না তাকে বিয়ে করার প্রয়োজন কী?”

অথৈ শব্দ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া ইঁদুর সে। বিয়েটা করা ছাড়া তার উপায় নেই। বাবা যে কেন বুঝে না! আজকাল কেউ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করে নাকি? এদিকে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ না করেও বা যাবে কোথায়? লাভ ভালোবাসা ইস্ক মোহাব্বত তো তাকে দিয়ে হচ্ছে না।
ছেলেটা তার উত্তর জানার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে দেখে বলল,

~যেহেতু বাবা আপনাকে আমার জন্য ফাইনাল করেছে তাই আপনাকে বলাই যায়। আসলে বিয়েটা করতে আমি প্রথমে একদমই রাজি ছিলাম না। তারপর ভেবে দেখলাম করলে আমারই লাভ। বাবার নজরবন্দি সাথে হাজার বারণ থেকে মুক্তি পাব। তখন আর কোনোকিছুর জন্য বাবার কানের কাছে প্যানপ্যান করতে হবে না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারব।”

মেয়েটার কথা শুনে আরমানের ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আবার ওর কথাগুলো মজাও লাগছে।

~বিয়ের পর যে আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবেন তার কি গ্যারান্টি? তখন তো আমার থেকে অনুমতি নিতে হবে।”

~ এজন্যই তো আজকের দেখা করা। বিয়ের আগেই কয়েকটা বিষয় ক্লিয়ার করে রাখা ভালো। বিয়েটা হবে শুধু বাবার ইচ্ছেতে। যেহেতু বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হচ্ছে না তাই বিয়ের পর আমি আপনার কোন কথা মানতে বাধ্য নই। ঘরসংসার আমাকে দিয়ে হবে না। আমরা দু’জন রুমমেটের মত থাকব। আপনি আপনার মত থাকবেন। আমি আমার মত। আমরা কেউ কারো কোন ব্যাপারে নাক গলাবো না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সাথে মিশছেন সেসবের কিছুই আমি জানতে চাইব না। আমার ক্ষেত্রেও সেম। আমার কোনোকিছু আপনি জানতে চাইবেন না। বিয়ের পরে আপনার টাকা আমার লাগবে না। আপনাকে বিয়ে করলে বাবার সবকিছুই আমার। ইচ্ছেমত খরচ করতে পারব তখন। আর বাবার কাছে শুনেছি আপনি নাকি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বছরের অর্ধেকটা সময় তো সমুদ্রেই কাটাবেন। এটাও একটা ভালো দিক। আমাদের কথা হবে সপ্তাহে দু-এক দিন। সে কথাও দু’জন বন্ধুর মত। মোট কথা আমার উপর কোনরকম দখলদারি দেখানো চলবে না। এখন যদি আপনি এই সব শর্ত গুলো মেনে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হোন তাহলে কংগ্রাচুলেশনস। আর যদি রাজি না হোন তাহলে আমার বাবাকে জানাতে পারেন।”

আশরাফ স্যারের একটি মেয়ে আছে এটা আরমান শুনেছিল। কিন্তু সেই মেয়েটির সাথে কোনদিনও দেখা হয়নি। স্যার তার কাছে পিতা সমতুল্য। তার পড়াশোনার খরচ তো স্যারই চালিয়েছেন। আজ সে যেখানে আছে তা শুধুমাত্র স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। স্যার তাকে মনে মনে স্নেহ করেন এটা তার জানা ছিল। কিন্তু স্যার যে তার উপর নিজের মেয়ের দায়িত্ব দেওয়ার মতন ভরসা করবে এটা তার ধারণা ছিল না। আশরাফ স্যার চাইলেই তার মেয়ের জন্য এই শহরের সবথেকে ভালো ছেলেটাকে ধরে আনতে পারতেন। তার তো কোনকিছুর কমতি নেই। এমনকি তার মেয়ের মাঝেও চুল পরিমাণ খুঁত নেই। দেখতে যেমন রূপবতী তেমনি কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে। পড়াশোনায়ও নাকি এই মেয়ে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন সে কখনও দেখেনি। স্যার তাকে ডেকে পাঠিয়ে নিজের জামাই হবার প্রস্তাব দিলে আরমান বড়সড় একটা ধাক্কার মতন খেল। স্যারের সামনে তখন গলা দিয়ে কথা বের করতে পারছিল না। যখন কথা বেরুলো তোতলাতে লাগল সে।

~স্যার আ-আমি, মানে স্যার…

আশরাফ হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে তার প্রিয় ছাত্রটির দিকে তাকালেন। তাতেই কাজ হয়ে গেল। আরমান স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল।

~কেন? আমার মেয়েকে বিয়ে করতে তোমার কি কোন সমস্যা আছে? গার্লফ্রেন্ড টার্লফেন্ডের মামলা নেই তো আবার!”

আরমান বিষম খেয়ে গেল। স্যার তার গার্লফ্রেন্ডের বিষয়ে জানতে চাচ্ছে! ভাগ্য ভালো এখন পর্যন্ত তার কোন গার্লফ্রেন্ড হয়নি। আর যদিও ভাগ্য করে একটা গার্লফ্রেন্ড থাকতোও তাহলেও এখন স্যারের সামনে অস্বীকার যেত সে।

~না না স্যার। তেমন কিছু নেই।”

আশরাফ হোসেন হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন,

~আমি জানতাম। তোমার সম্পর্কে কোন কিছুই আমার অজানা না।”

আরমান মনে মনে ভাবল, স্যার আমার সম্পর্কে সব খবর রাখেন?

~তাহলে আমার জামাই হতে তোমার আর কোন আপত্তি থাকার কথা না। নাকি আপত্তি আছে?”

আরমান স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

~না স্যার, নেই।”

স্যারকে সেদিন বলে এসেছিল, না স্যার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু স্যারের মেয়েরই যে তাকে বিয়ে করতে একগাদা আপত্তি তা তো সে জানত না। এই মেয়ে বিয়ে করতে চায় নাকি বিজনেস ডিল? যেসব শর্ত দিচ্ছে তা মেনে একজন সুস্থ মানুষ কোনমতেই বিয়ে করতে চাইবে না। বিয়ে হবে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মত কোন সম্পর্ক থাকবে না। কেউ কারো ব্যাপারে অধিকার দেখাতে পারবে না। রুমমেটের মত থাকবে! বন্ধুর মত কথা বলবে! সে একটা পরিবার চায়। মায়াবতী একটা বউ চায়। বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়েও চায়। অন্তত চারটা ছেলেমেয়ে তো তার চাই-ই চাই। সেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিবে। ওদের ঘর থেকে আরও ছেলে মেয়ে হবে। শেষ জীবনে ঘরভর্তি নাতি নাতনি নিয়ে হেসেখেলে জীবন কাটিয়ে দেবে। কিন্তু স্যারের এই নাক উঁচু মেয়েকে বিয়ে করলে তো সেসবের কিছুই হবে না দেখা যাচ্ছে। তার স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। না হবে ঘরসংসার, না হবে ছেলেমেয়ে আর না হবে নাতি নাতনি।

লোকটা এখানে বসে থেকে কোথায় হারিয়ে গেল? আজব মানুষ তো। অথৈ জোরে হাতে শব্দ করল। তার তালির শব্দের অনেকে ঘাড় ফিরিয়ে এদিকে দেখছে। আরমান লজ্জা পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

~কোথায় হারালেন? দেখুন আপনার যদি আমাকে পছন্দ না হয় তাহলে এই কথাটা দয়া করে আমার বাবাকে গিয়ে বলুন প্লিজ। আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি এই একটা কথাই যথেষ্ট। তাহলে আর বাবার কিছু করার থাকবে না। বিয়েটা উনাকে ভাঙতেই হবে।”

~আপনারও তো আমাকে পছন্দ না। আপনি এই কথাটা আপনার বাবাকে জানাচ্ছেন না কেন? তাহলেও তো বিয়েটা ভেঙে যাবে।”

~আপনার কি মনে হয় আমি এসব করতে বাকি রেখেছি?”

~স্যারকে জানিয়েছেন আপনার আমাকে পছন্দ না!”

অথৈ আরমানের দিকে দেখল। মুখটা অপরাধী করে বলল,

~কিছু মনে করবেন না প্লিজ। বাবাকে আমি এই কথাটাও বলেছিলাম।”

আরমান আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

~তখন স্যার কী বলল?”

~বলল, ওকে না দেখেই তুমি কীভাবে বলছ তোমার ওকে পছন্দ না? আমি জবাবে বললাম, দেখার পরে যদি পছন্দ না হয়। বাবা বলল, আগে তো দেখা করো। পছন্দ না হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি জেদ করে বললাম, যদি পছন্দ না হয় তাহলে কি বিয়ে ভেঙে দিবে তুমি?’ ‘বিয়ে হবে নাকি ভাঙবে সেটা পরের ব্যাপার। আগে ওকে পছন্দ না হওয়ার অন্তত তিনটা কারণ তোমাকে বলতে হবে।”

আরমান মুচকি হেসে ফেলল। স্যার তাকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের স্নেহ করে বোঝা যাচ্ছে। অথৈকে যুদ্ধে হেরে যাওয়া ক্লান্ত সৈনিক মনে হচ্ছে।

~ আপনার উপর বাবার কী আস্থা দেখেছেন? কত কনফিডেন্সের সাথে বলল, অপছন্দ হতেই পারে না। যেন আপনি টম ক্রুজ যে, আপনাকে আমার অপছন্দ হবেই না।”

আরমান বলল,

~আপনি শুধু শুধু চিন্তিত হচ্ছেন। আপনার সমস্যা তো মিটেই গেল। আপনি এখন বাড়ি গিয়ে আমাকে পছন্দ না হওয়ার তিনটা কারণ স্যারকে জানিয়ে দিবেন।”

অথৈ হতাশ মুখে আরমানকে দেখল। বলল,

~ সমস্যা মিটেনি। বরং সমস্যাটা তো এখন থেকেই তৈরি হলো।”

কপালে ভাঁজ ফেলে আরমান জানতে চাইল,

~মানে?”

~আপনাকে না দেখে আনতাজে তিনটা কেন আমি দশটা কারণও বলে দিতে পারতাম। কিন্তু আপনার সাথে দেখার পরে তো তিনটা কেন একটা কারণও খুঁজে পাচ্ছি না।”

এবার আরমান শব্দ করেই হেসে ফেলল। অথৈ নিরাশ গলায় বলল,

~হাসবেন না তো। আপনার হাসি পেলেও আমার মোটেও হাসি পাচ্ছে না।”

চলবে_
#একটি_রূপকথার_গল্প’১’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

যাদের কাছে গল্প পৌঁছুবে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। সবার গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here