#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৪৭

0
536

#ভুলবশত_প্রেম পর্ব ৪৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৭

তিনদিনের ছুটি কাটাতে আমরা গন্তব্য হিসেবে ঠিক করলাম সিলেট শহরকে। এ সিদ্ধান্ত অবশ্য আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন ইমাদ ভাইয়া ও আদ্রিশ। আমাকে জানানো হয়েছে গতকাল রাতে। গতকাল ক্লান্ত থাকায় ব্যাগপত্র গোছানোর সময় পাইনি৷ এজন্য আজ সকাল থেকেই সব গোছগাছ শুরু করলাম।
সকালের নাস্তা শেষে আমি ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। এদিকে আদ্রিশ যে তিনদিন শহরে থাকবেন না সে কারণে ল্যাবের কিছু কাজ এক সহকর্মী জুনিয়রকে বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে সেই এক ঘণ্টা যাবত অনবরত ফোনে লেগে আছেন উনি।

আমার জামাকাপড় ব্যাগে ভরে আদ্রিশের জামাকাপড় গুছাতে শুরু করলাম। আলমারি থেকে উনার টিশার্ট, প্যান্ট নিয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। আলমারি থেকে গুছানো একটি শার্ট উঠিয়ে নিতেই শার্টের নিচে উনার পিস্তল আবিষ্কার করলাম আমি। আচমকা পিস্তলটি দেখে খানিক চমকিত হলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম৷ কারণ আদ্রিশের কাছে পিস্তল থাকার ব্যাপারটি এখন স্বাভাবিক। তবে সেদিন উনার কাছে পিস্তলটি না দেখলে আজকে এটি স্বাভাবিক মনে হতো না আমার কাছে৷ সেদিন ঘটনাস্থলে আদ্রিশের কাছে পিস্তল দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্কে প্রশ্ন খেলে গিয়েছিলো, আদ্রিশের কাছে পিস্তল এলো কি করে? কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সেদিন প্রশ্নটা করা হয়ে উঠেনি এবং এ তিনদিনেও ছোট বড় ব্যস্ততার বেড়াজালে উনাকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে আজ যেহেতু সময় ও সুযোগ উভয়ই আছে সেহেতু উনাকে এ ব্যাপারে আজ জিজ্ঞেস করতেই হবে।
আমি মন্থর গতিতে পিস্তলটা হাতে নিলাম। জিনিসটা দেখতে ছোট হলেও ওজনে একটু ভারী। এতোদিনে সিনেমায় দেখে আসা পিস্তল আজ সচক্ষে নিজ হাতে ছু্ঁয়ে দেখলাম। জীবনে প্রথম আসল পিস্তল হাতে নিয়ে অকারণেই একটু ভয়জনক অনুভূতি হলো। কিয়ৎক্ষণ পিস্তলটি এদিকে ওদিক ঘুরিয়ে দেখলাম৷ অতঃপর সেটি নিয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। আদ্রিশ পুরো ব্যালকনি পায়চারি করে কথা বলছেন। হঠাৎ পিস্তলসহ আমাকে ব্যালকনিতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন উনি। মুহূর্তেই উনায় চেহারায় ক্ষীণ আঁতকে উঠা ভাব বিরাজ করলো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলেই উনি ফোন কানে নিয়ে ইশারায় আমাকে বাধা দিলেন। আমিও আগ বাড়িয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
দু মিনিটের মাঝেই আদ্রিশ ফোন রেখে দ্রুত আমার হাত থেকে পিস্তল নিয়ে নিলেন। প্রায় ধমকের সুরে বললেন,
” এটা বের করেছো কেনো?”

আমি সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনার কাছে পিস্তল এলো কি করে?”

আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আদ্রিশ পিস্তলটি নিয়ে আলমারিতে রাখলেন। অতঃপর আমাকে রুমে এনে নরম গলায় বললেন,
” তুমি প্রথম যেদিন আমার রুমে এসেছিলে সেদিন দেয়ালে ঐ শ্যুটিং ফেডারেশনের ঐ সার্টিফিকেটটা দেখোনি?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের দিকে চাইলাম। দেয়ালের সার্টিফিকেট লাগানো ঐ অংশের নিচের দিকে তাকালাম। আমি সার্টিফিকেটটা খুঁজে পেয়েছি বুঝতে পেরে আদ্রিশ মৃদু শব্দে হেসে বললেন,
” সার্টিফিকেটটা হাওয়ায় উড়ে আসেনি মিশমিশ। সার্টিফিকেটটা পেয়েছি এই পিস্তল চালানোর উপর ভিত্তি করেই।”

আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এর মানে আপনি পিস্তল চালাতে পারেন!”

” অবশ্যই এবং আমি এতোটুকু কনফিডেন্ট যে আমার টার্গেট কখনো মিস হয় না। একদম সঠিক নিশানায় গিয়ে গুলি লাগে। ”

আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো৷ কিন্তু এর পূর্বেই আমার ফোনে আপুর নাম্বার দিয়ে কল এলো। আমি কল রিসিভ করতেই আপু স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” রেডি হয়েছিস মিম?”

” উঁহু। এখনো না। তোমরা?”

” রেডি হবো। ইমাদ বলছে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে। না হলে সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। তোদের ব্যাগ গুছানো শেষ? ”

” হ্যাঁ। আচ্ছা আমরা তাহলে রেডি হচ্ছি।”

” আচ্ছা। রেডি হয়ে কল দিস।”

আপু ওপাশ থেকে কল কেটে দেওয়ার পর আদ্রিশকে বললাম,
” আপু রেডি হতে বলেছে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বের হবে বলে। ”

আদ্রিশ আলমারি থেকে একটা টিশার্ট ও জিন্সের প্যান্ট বের করে বললেন,
” আচ্ছা। রেডি হয়ে নাও তুমি। আমিও রেডি হয়ে নেই। ”
এই বলে আদ্রিশ ওয়াশরুমে চলে গেলেন৷ আর আমি বাকি জামাকাপড় গুছাতে লাগলাম।

.

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু প্রথম দফায় কেউ কল রিসিভ করলো না৷ আমি চোখ মেলে সামনে তাকালাম। আদ্রিশ ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করছে আর ইমাদ ভাইয়া ফ্রন্ট সিটে বসে আছে৷ আমি আর আপু পিছনে বসে আছি। আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি ইমাদ ভাইয়াদের গাড়িতে করে। লম্বা দূরত্বের রাস্তা হওয়ায় আদ্রিশ ও ইমাদ ভাইয়া পালাক্রমে ড্রাইভ করবেন বলেই সামনে বসেছেন। আমি আর আপু বসেছি পিছনে।
এ মুহূর্তে আপু হয়তো গভীর ঘুমে মগ্ন। আমার ঘুম একবার ভেঙে যাওয়ায় আবারো আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পুনরায় ফোন বেজে উঠলো। রিংটোনের শব্দ শুনে বুঝলাম, আদ্রিশের ফোনে কল এসেছে আদ্রিশ ড্রাইভ করতে করতেই বললেন,
” ইমাদ, কলটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দে তো। কে কল করেছে দেখি। ”

ইমাদ কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলেন৷ সাথে সাথে ওপর পাশ হতে একটি অর্ধপরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” মিস্টার আদ্রিশ বলছেন?”

আদ্রিশ বললেন,
” জি। আপনি শাহেদ সাহেব না?”

” জি জি৷ তাহলে চিনতে পেরেছেন। ”

” জি অবশ্যই। হঠাৎ আমায় ফোন করলেন যে অফিসার?”

” আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো। একচুয়েলি আপনাকে সাবধান করতেই আমি কল করেছি। ”

আদ্রিশ সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনার কথা বুঝলাম না অফিসার। কি নিয়ে সাবধান করবেন?”

ওপাশে শাহেদ সাহেবের ক্ষীণ দ্বিধাদ্বন্দ্বিত কণ্ঠ,
” রোহানের বেইল হয়ে গিয়েছে মিস্টার আদ্রিশ। ”

শাহেদ সাহেবের কাছ থেকে এ খবর শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রোহান ভাইয়ার বেইল পাওয়ার কথা শুনে দু চোখ থেকে আধো আধো ঘুমের রেশটুকু কেটে গেলো৷
আদ্রিশ আকাশসম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কবে কখন হলো! ও বেইল পেলো কি করে?”

” ওকে অ্যারেস্ট করার পরেরদিনই বেইল পেয়ে গিয়েছিলো ও। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মিস্টার রোহানের বাবা একজন বড় রাজনীতিবিদ। উনার সামনে এসব কিছুই না মিস্টার আদ্রিশ। ”

” তো আপনি আমাকে আগে বলেননি কেনো অফিসার!”

” ইমাদকে বলেছিলাম আমি। কিন্তু ও বললো, সামনে আপনাদের রিসেপশন। এ কারণে যেনো আপনাকে এসব জানিয়ে শুধু শুধু টেনশন না দেই। যাই হোক, আপনারা একটু সাবধানে থাকবেন। কারণ রোহানের হাবভাব আমার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট হিংস্রতা দেখেছি আমি। এজন্য বলবো, সাবধানতা অবলম্বন করুন। ”
এই বলে উনি নিমিষের জন্য থামলেন। পুনরায় বললেন,
” আমি পরে কথা বলছি মিস্টার আদ্রিশ। থানায় একজন আসামীকে আনা হয়েছে। তারা খাতির ব্যবস্থা করতে হবে। ”

আদ্রিশ ক্ষীণ শব্দে বললেন,
” আচ্ছা অফিসার।”

এরপর হয়তো শাহেদ সাহেব কল কেটে দিলেন। তৎক্ষনাৎ আদ্রিশ গাড়িতে ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন। অকপট রাগ দেখিয়ে ইমাদ ভাইয়াকে বললেন,
” তুই আমাকে এ ব্যাপারে আগে বলিসনি কেনো ইমাদ! ”

ইমাদ ভাইয়া মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,
” তোদের রিসেপশন ছিলো বিধায় বলতে চাইনি৷ আর আমি চাই না নাফিসা বা মিম এ ব্যাপারে জানুক। নাফিসার কাছে রোহান এখন একটা আতঙ্কের নাম।”

” তো তুই কি ভেবেছিস, আমি নাফিসা ভাবীকে এ ব্যাপারে বলতাম?”

” বলতি না। কিন্তু আমি তোদের কাউকেই এ ব্যাপারে জানাতে চাইনি৷ শাহেদকেও বলেছিলাম না জানাতে। কিন্তু ও কি মনে করে তোকে বললো বুঝলাম না। ”

” আশ্চর্য! আমাদের জানাতে চাসনি কেনো? এখন রোহান কিছু করে বসলে?”

ইমাদ ভাইয়া এবার খানিক রেগে গেলেন। বললেন,
” তো! রোহানের ভয়ে আমরা কতদিন গুটিয়ে থাকবো? কতদিন বাসায় বসে থাকবো?”

আদ্রিশ আর কথা বাড়ালেন না। হয়তো ইমাদ ভাইয়ার যুক্তির সাথে উনিও সহমত প্রকাশ করেছেন।
খানিক সময় পর উনি বললেন,
” ওদের দুজনকে এ ব্যাপারে কিছুই জানতে দেওয়া যাবে না। ওরা ঘুমাচ্ছে না এখন?”

আদ্রিশের কথা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি যে রোহান ভাইয়ার ব্যাপারে জেনে গিয়েছি তা উনাকে জানতে দেওয়া যাবে না। এতক্ষণ চলমান ঘুমের অভিনয় এখনও চালিয়ে গেলাম আমি৷
ইমাদ ভাইয়া বললেন,
” এখন বাসায় ব্যাক করবি না কি?”

” তা কি করে সম্ভব। আমরা তো সিলেট শহরে ঢুকে পড়েছি। ”

ইমাদ ভাইয়া আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে চাপা ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এলো। বন্ধ চোখের সামনে বারবার রোহান ভাইয়ার চেহারা ভেসে এলো৷ সেদিন শেষ মুহূর্তে উনার চেহারায় যে হিংস্রতা লক্ষ্য করেছি তা সে মুহূর্তে আমাকে ভীত করে না তুললেও এখন ঠিকই আমাকে ভয়ের অতল সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। জানি না সামনে কি হবে। তবে মনেপ্রাণে চাইছি, খারাপ কিছু যেনো না হয়৷ চোখ বন্ধ রেখেই আল্লাহর নাম নিচ্ছি।

.

সিলেট পৌঁছে আমরা হোটেলে উঠেছি কিছুক্ষণ পূর্বেই। পাশাপাশি দুটো রুম খালি না পাওয়ায় ইমাদ ভাইয়া ও আপু উঠেছে চতুর্থ তলার একটি রুমে। আর আমি ও আদ্রিশ উঠেছি তৃতীয় তলার একটি রুমে।

রুমে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আদ্রিশ কিছু কাজে বেরিয়ে পড়লেন। আমায় বললেন, জরুরি কিছু কাজ আছে এবং এ জরুরি কাজটা কি তা আমি ঢের আন্দাজ করতে পেরেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই আদ্রিশ রোহান ভাইয়া সম্পর্কিত কোনো কাজেই বেরিয়েছেন।
আদ্রিশ রুম থেকে বেরুনোর পূর্বে আমায় সতর্কতার সহিত বলে গেলেন উনি বাদে অন্য কেউ আসলে যেনো আমি দরজা না খুলি। রোহান ভাইয়ার বেইল হওয়ার খবরটা আমার জানা থাকায় এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে আর প্রশ্ন করিনি উনাকে। আদ্রিশ বেরিয়ে যেতেই আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দীর্ঘ জার্নির কারণে ক্লান্তি শরীর নিয়ে বেশি সময় ওয়াশরুমে রইলাম না আমি৷ দশ মিনিটের মাঝেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই হঠাৎ সোফায় কাউকে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলাম আমি। আমার চমকানোর মাত্রা আরো বেড়ে গেলো যখন সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিটিকে রোহান ভাইয়া হিসেবে চিনলাম আমি। অস্ফুটস্বরে উনার নাম নিতেই উনি মুহূর্তমধ্যে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন৷ আতঙ্কে চিৎকার করার পূর্বেই রোহান ভাইয়া আমার সামনে কি যেনো স্প্রে করলেন৷ ক্ষণেই কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আমার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি আমি জ্ঞান হারাচ্ছি।
®সারা মেহেক( নতুন করে গ্রুপ খুলেছি। আমার গল্পের পাঠকেরা জয়েন হয়ে নিতে পারেন। কারণ এ গল্পটির আর ৩/৪ পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই আমি গ্রুপে একটি “রোমান্টিক সাসপেন্স থ্রিলার” জনরার গল্প লিখবো।
গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ)

#চলবে
ছবি ক্রেডিট Tasmiah Tahmid Elma)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here