#তোমার_পিছু_পিছুপর্ব-৬

0
393

#তোমার_পিছু_পিছুপর্ব-৬

দীর্ঘ চার ঘন্টার ননস্টপ অফিস ট্যুরের পর মিলন সাহেব আর বর্ন এসে বসেছে অফিসের ক্যান্টিনে। এই দীর্ঘ চার ঘন্টায় বর্নর মুখ থেকে এইমুহূর্তের জন্যও হাসি উধাও হয় নি। মিলন সাহেব বার বার আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়েছেন,,,,, কিন্তু প্রতিবারই ছেলেকে হাসি মুখেই দেখেছেন। বর্ন অতি বাধ্য এবং আগ্রহী ছেলের মত অফিসের প্রতিটা স্টাফ এবং প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের সাথে পরিচিত হয়েছে। মিলন সাহেবের মাঝে মাঝে মনে হয় তার পাগলা ছেলেটা বোধহয় কাদতেই জানে না। ছোটবেলা থেকেই বর্ন খুব বুঝদার…… আচ্ছা… বর্ন শেষ কবে কেদেছিলো!!!! মিলন সাহেব চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন। এইমুহুর্তে বর্ন কান্না করার যেই ঘটনা মনে পড়ছে,,,,তা ছিলো বর্ন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়কার ঘটনা। ঘটনা তেমন বড় না…… বর্নর ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিলো নুডুস….. কিন্তু ও নিজের এই অতি প্রিয় খাবারটা ঠিকমত উচ্চারণই করতে পারতো না….. ওর জন্য নুডুস ছিলো তুতুস…. এভাবেই একদিন বাড়িভর্তি মেহমানের সামনে নুডুসকে তুতুস বলায়… সবাই হো হো করে হেসে উঠে…… এবং নিজের ভুল উচ্চারণে অতিমাত্রায় লজ্জা পাওয়াই ছিলো বর্নর কান্না করার কারন।
সেই ঘটনা এখন আবার মনে পড়ায় মিলন সাহেবের মুখে আবার মুচকি হাসি ফুটে উঠল। উনি চোখ মেলে ছেলের দিকে তাকালেন…..
বর্ন নিজের চায়ের কাপের মাথায় আংগুল বুলিয়ে যাচ্ছে…. কিন্তু চুমুক দেয় নি…. ওর দৃষ্টি আবদ্ধ জানালার বাহিরে। দিন কালো করে আছে ভারি মেঘে…. একটু পর পর গুড়ুম গুড়ুম করছে…. আর দমকা বাতাস বইছে……
-কিরে তুতুস বাবা…. কি ভাবচ্ছিস….!!??
বর্ন বাবার দিকে তাকালো….. লজ্জা এবং দুষ্টুমি মিশ্রিত একটা হাসি দিলো।
-তোমার এখনো মনে আছে….. বাবা!!!
-অবশ্যই……. একটা মাত্র ছেলে আমার তুই……. তোকে ঘিরে অতি ছোট থেকে ছোট ঘটনাও আমার মনে আছে…….
-তাহলে তো বলতে হয়…. তোমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো….
-হুম,,,,,তা বলতে পারিস….. আফটারঅল আই এম এ বিজনেসম্যান……..
-বাবা মা কিন্তু হাউসওয়াইফ….. কিন্তু মা’র স্মৃতিশক্তিও খুব ভালো…..
-ওরে বাবারে!!! তোর মা’র সাথে আমার তুলনা হয় নাকি!!! তোর মা’তো ৫০০ পর্বের হিন্দি সিরিয়াল পানির মত মুখস্ত বলে যেতে পারবে……….
বলেই নিজেই হাহা করে হাসতে শুরু করলেন…. সাথে যোগ দিলো বর্নও….. কিন্তু মনে মনে বলল
“সরি মা…. কিন্তু কথাটা সত্য ছিলো”
অফিস থেকে বের হয়ে মিলন সাহেব নিজের গাড়িতে উঠলেন…… আর বর্ন উঠল নিজের….
মিলন সাহেব এখন নিজের অফিসে যাবেন বিধায়…. বাসা থেকে ফোন দিয়ে বর্নর গাড়ি আনানো…..
বর্ন গাড়িতে উঠার কিছুক্ষন পর বলল….
-সালাম চাচা,,,গাড়ি নিয়ে একটু নীলক্ষেত চলুন তো…..
-জ্বী….. আচ্ছা স্যার।
গাড়ি নীলক্ষেত বইয়ের দোকানগুলোর সামনে এসে দাড়ালে….. বর্ন গাড়ির বাহিরে এসে দাড়ালো…..
-স্যার,,,, আপনে কেনো বাইর হচ্ছেন…..?? আমাকে বলুন কি কি বই লাগবে… আমি যায়ে নিয়ে আসছি……
সালাম মিয়ার অতি শুদ্ধভাষা শুনে বর্ন হালকা মুচকি হাসলো…. পারভিন বেগমের কড়া নির্দেশ ছিলো বর্নর সামনে সবসময় শুদ্ধভাষায় কথা বলতে হবে….. এবং তাদের বাড়ির এই মানুষ গুলো অর্থাৎ জরজরি বেগম.. সালাম মিয়া আর বাগানের মালী কুদ্দুস মিয়া অতি সততার সাথে এখনো পর্যন্ত সেই আদেশ পালন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন….
-চাচা বইগুলো দেখে কিনতে হবে….. আপনি বুঝবেন না যে…..
-কিন্তু স্যার…………….
সালাম মিয়া পুরো বাক্য শেষ করার আগেই পিছন থেকে অন্য গাড়ি হর্ন বাজানো শুরু করল…..
-স্যার আপনি এখানে একটু সময়ের জন্য খাড়ান…. আমি গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে আসি……
সালাম মিয়া গাড়ি ঘুরালে… বর্নও ঘুরে দাড়ালো…..ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র হওয়ার সুবাদে… নীলক্ষেত এর আগে দেখে থাকলেও বর্ন কখনো নিজে এসে বই কিনে নি….. এর আগে যত প্রকার বই প্রয়োজন ছিল…. ওর বাবার ম্যানেজার সোলাইমান সাহেবই সব বই নিয়ে যেতেন ওর কাছে…… কিন্তু আজ বর্ন নিজের এই ছোট দ্বায়িত্বগুলো নিজেই সম্পুর্ণ করতে চায়…. অনেক বড় কোন দ্বায়িত্ব নেওয়ার পুর্বে ছোটখাটো নিজের দ্বায়িত্বগুলো নিজেরই পূরণ করা প্রয়োজন।

তামান্নার মেজাজ চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ হয়ে আছে….. ১৫০০ টাকা দিয়ে বইগুলো এই নীলক্ষেত থেকেই কিনা হয়েছিলো…. আর এখন যখন বিক্রি করতে এলো তখন ধরিয়ে দিলো কত…!!!! ৫০০ টাকা!!!! ১৫০০ টাকার অর্ধেকও না….. এর আগের দোকানদার তো ৩০০ ধরিয়ে দিতে চাইছিলো..… তামান্না বুঝে পায় না…. ৭ মাসে বইগুলোর কি এমন পরিবর্তন হয়ে গেলো…. যে দোকানদার সব বই দেখেই নাক ছিটকানো শুরু করল….. তামান্না চোখ কান বন্ধ করে দোকানদারকে ভয়ানক দুইটা গালি দিলো…… মেজাজ খারাপের আরো একটা কারন হল…. বৃষ্টি….. যখন বইয়ের দোকানগুলোর ভিতরে গেলো… তখন কেবল মেঘ করতে শুরু করেছে…. তামান্না ভেবে রেখেছিলো দ্রুর কাজ সেড়ে বাড়ি চলে যাবে…… কিন্তু ভাগ্যের কি নিরমম পরিহাস…..
তামান্না নিজের ছাতা খুলে ফুটপাতে ধরে হাটতে শুরু করল….. পুরোপুরি ভিজে যাওয়ার আগে বাস ধরা প্রয়োজন। বেশকিছুদূর হাটার পর তামান্না মোড় ঘুরে একটু দাড়ালো…. বৃষ্টির তেজ বাড়ছে…. হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠল…
-এক্সকিউজ মি…. হ্যালো….
তামান্না ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো…. দুই হাতে বিশাল মোটা মোটা দুইটা সম্ভবত বইয়ের প্যাকেট হাতে…… একদম সাদা জিন্সের প্যান্ট আর সাদা একটা শার্ট পড়নে একটা ছেলে দাঁড়ানো….. ছেলেটা হালকা ভিজে আছে…. কিন্তু প্যাকেট দুইটা খুব সাবধানে ধরে রেখেছে যেনো ভিজে না যায়….. তামান্না এদিক সেদিক তাকালো…. কারন ও বুঝতে পারছে না…. ছেলেটা কি ওকে ডাকছে নাকি অন্য কাউকে…..
-জ্বী মানে…. আমি আপনাকেই ডাকছিলাম…..
-কারন??
-আসলে….. আমি…. মানে বুঝতে পারিনি…. বৃষ্টি এতো জোরে নামবে……
তামান্নার এখন বিরক্ত লাগছে…. এই ছেলে বলতে চাইছেটা কি!!!
-আপনি আমার কাছে কি চাইছেন…?
-জ্বী,,, আসলে…. আমার গাড়িটা একটু সামনেই পার্ক করা আছে….আপনি যদি আমাকে একটু লিফট দিতেন!!!! আসলে বইগুলো না থাকলে আমি বৃষ্টিতে ভিজেই চলে যেতাম…. কিন্তু…….
-ছাতা হাতে কি শুধু আমাকেই আপনার চোখে পড়ল….. আর মানুষ কি চোখে লাগে না আপনার!!!
-না…. মানে… আসলে…. আছে… অনেকের হাতেই ছাতা আছে…. কিন্তু…. মানে সবাই এত তাড়াহুড়োর মধ্যে চলাফেরা করছে যে…. কাউকে জিজ্ঞেস করবো সেই সূযোগটাও পাচ্ছিলাম না…. আর তাছাড়া আপনাকে দেখে আমার একটু কম আনইজি লাগলো তাই আর কি…….
তামান্না তীক্ষ্ণ চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো….
-সরি… কিন্তু আমি আপনাকে কোন হেল্প করতে পারবো না…… আর বইয়ের জন্য আপনি যেকোন দোকান থেকে পলি চেয়ে নিন….
-জ্বী আমি চেয়েছিলাম….. কিন্তু তাদের কাছে নাকি পলি নেই…. আর এদিকের দোকানগুলো বন্ধ তাই আর কি…..!!
তামান্না আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো… আসলেও দোকানগুলো বন্ধ….
-সরি…. আমি তারপরও আপনার হেল্প করতে পারবো না…..
-আমার গাড়িটা একটু সামনেই….. প্লিজ যাস্ট একটু হেল্প করুন….. আপনি চাইলে,,, আমি আপনাকে গাড়িতে লিফট দিয়ে…..
-দেখুন… সস্তা ফাজলামি বন্ধ করুন….. এটা কি মেয়ে পটানোর কোন নতুন থার্ডক্লাস ট্রিকস শুরু হয়েছে নাকি….
-মেয়ে আবার পটায় কিভাবে!!!!
-ও!!!! ভাবটা তো এমন নিচ্ছেন যে মেয়ে কি জিনিস তাই জানেন না….. মেয়ে কিভাবে পটায় তা পাবলিকের ধোলাই খেলে অ আ-এর মত মনে পড়ে যাবে…..
-আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না…. আপনি কি……………..
-এই মিয়া এই….. ঢং করেন….. আমি কি এতোই বোকা ভেবেছেন…..
-নাতো…. আপনি কেনো বোকা হবেন!!!
তামান্না ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়লো..
-আপনি আপনার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বলুন…
ছেলেটা মুখ কাচুমাচু করে বলল
-আমার কাছে ফোন নেই…. আমি ইউজ করি না….
তামান্নার মেজাজ আবারো খারাপ হতে শুরু করল….. তামান্না মনে মনে বলল,,,তোরে রে লুইচ্চা শালা,,,,আজ আমি এমন ধোলাই খাওয়াবো…..দাড়া তুই….
-শোনেন,,,,ছাতার নিচে আসার আগে একটা কথা খুব ভালো করে শুনে রাখুন,,,,, আমি যদি সামনে কোন প্রকার গাড়ি না পাই… তাহলে আজ আমার একদিন কি আপনার একদিন…..
ছেলেটা মাথা ঝাকিয়ে টুপ করে এসে ছাতার নিচে দাড়ালো….. তামান্নার পাশাপাশি…..
তামান্না আর ছেলেটা পাশাপাশিই হাটছে…. তামান্না একনজর ছেলেটার দিকে তাকালো…. ছেলেটা হাসি হাসি মুখ করে সামনে তাকিয়ে হেটে যাচ্ছে….. ছেলেটার মাথার ঘন কালো চুলগুলো কপালের উপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে…. তামান্না হঠাৎ খেয়াল করল…. ছেলেটার একদম মাথা বরাবর ছাতার উপর একটা ফুটো…. সেই ফুটো দিয়ে টুপ টুপ করে ছেলেটার মাথায় বৃষ্টির পানি পড়ছে……কি ভয়ানক লজ্জাজনক পরিস্থিতি…. তামান্না খুব কৌশলে ছাতাটা ঘুরানোর চেষ্টা করল….. কিন্তু তার আগেই…..
-স্যার…..
তামান্না এবং ছেলেটা উভয়ই মাথা ঘুড়িয়ে পাশে দাড়ালো…. একজন বয়স্ক লোক…. হাতে বিশাল বড় একটা কালো ছাতা…. যার নিচে হয়ত এই লোকের পুরো গুষ্ঠি আশ্রয় নিতে পারবে…. লোকটা দৌড়ে এসে ওদের পাশে দাড়ালো…
-স্যার,,,, আপনে কোথায় আছিলেন….. আমি আপনারে খুইজ্জা মরি….

(আসছে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here