এক মুঠো রোদ পর্ব-২০

0
773

#এক_মুঠো_রোদ
#Writer_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#part_20
#collected Sk Galib
রিক্সার কোণ ঘেষে বসে আছে আরু। পাশে যে লোকটি বসে আছে তার নাম সাইম। নূরুল আহমেদ সাইম। হাইস্কুলের গনিতের শিক্ষক সে। সম্পর্কে আরুর হবু বর। আজকাল বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আরুর বাবা আরমান ইসলামের ধারনা এই দুনিয়াতে আর বেশিদিন থাকা হবে না তার। খুব শীঘ্রই পাড়ি জমাতে হবে সেই দূরের কোনো দেশে। এইতো সেদিনই, আরু কলেজ থেকে ফেরার পর পরই আরুকে ডেকে পাঠালেন আরমান। মেয়েকে পাশে বসতে ইশারা করে দুর্বল গলায় বললেন,
— পড়াশোনা কেমন চলছে মা?
— জি বাবা, ভালো। এখন শরীর কেমন তোমার?
আরমান দুর্বল হাসি দিয়ে বললেন,
— আর শরীর! শরীরের দিন শেষ মা। এখন শুধু যাওয়ার পালা। অপেক্ষা আর অপেক্ষা…
— কি সব বলছো, বাবা? এসব বলতে নেই।
আরমান আরুর কথায় কান না দিয়ে নিজের মনে বলে উঠলেন,
— ১৭ বছর বয়সে তোর মাকে বউ করে এনেছিলাম, বুঝলি? গ্রামের একদম দস্যি মেয়ে ছিলো সে। আমি অফিসের সামান্য কেরানী ছিলাম তবু তোর মায়ের সাথে সুখের অভাব হয় নি। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই নির্ধারিত মা। এসব নিয়ে অতিরিক্ত ভাবতে নেই। ভাবলেও তার কূল কিনারা পাওয়া যায় না। সবই তো মা’বুদের হাতে। এইযে তোর মায়ের মতো সুন্দরী মেয়ে আমার মতো একজন মানুষের বউ হবে তা কি কেউ কখনো ভেবেছিলো? আর হুট করেই বিনা অসুখে হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, এটাই বা কে ভেবেছিলো? সবই নিয়তি, বুঝলি?
সেদিন আরু কিছু বলে নি। চুপ করে শুনে গিয়েছে শুধু। আরমান খানিক থেমে আবারও বলে উঠলেন,
— নূর আহমেদ কে চিনিস? তোর ভাইয়ের সাথেই পড়াশোনা করেছে। এখন হাইস্কুলের গণিতের মাস্টার। ছেলেটা বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার, এর থেকে ভালো বিয়ের ঘর কি আমাদের জন্য আর হতে পারে মা? ছেলে সরকারি চাকরি করে। রিটায়ার করার পর প্যানশন পাবে। জীবিকা নিয়ে কোনো রিস্ক নেই। ছেলের স্বভাব চরিত্রও ভালো। আমারও দিন শেষ, তোকে বিয়ে দিয়ে সুখী না দেখে তো মরেও শান্তি পাবো না মা। তোর মায়ের কতো শখের মেয়ে ছিলি তুই৷ তোর কোনো গতি না করে গেলে মরার পর তাকে কি জবাব দিবো বল? তোর ভাই আছে ঠিক। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মা-বাবা ছাড়া মেয়েরা একদমই এতিম। ভাই কতোদিন দেখবে তোকে কে জানে? কেমন বিয়ে দিবে তাও তো নিজের চোখে দেখতে পারবো না। মা রে? তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যা। বাপের কথাটা রাখ।
আরু তখনও কিছু বলেনি। শুধু জলমাখা চোখদুটো আড়াল করে মাথা হেলিয়ে উঠে এসেছে। সত্যিই তো, তারা মধ্যবিত্ত পরিবার। এতো বিলাসবহুল কল্পনা, ভালোবাসা নামক জল্পনা নিয়ে বসে থাকলে কি তাদের চলবে?কাঁধে কারো ঝাঁকুনিতে পাশ ফিরে তাকালো আরু। সাইম ডাকছে,
— তুমি ঠিক আছো, আরু? কখন থেকে ডাকছিলাম তোমায় শুনছিলে না যে?
— আমি ঠিক আছি।
— আচ্ছা, বেশ। কিছু খাবে? রিক্সা থেকে নেমে আইসক্রিম হাতে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়?
আরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জোরপূর্বক একটা হাসি টেনে নিয়ে বললো,
— ভালো। ভালো হয়।
আরুর মুখ থেকে পজিটিভ উত্তর পেয়ে সাইমের চোখ-মুখ উজ্জল হয়ে এলো। আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলো,
— তাহলে চলো, আমরা বরং নেমে পড়ি।
আরু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো। রিক্সাভাড়া মিটিয়ে রাস্তার পাশ থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে নিয়ে কিছুটা সামনে এগুতেই তাদেরকে পাশ কাটিয়ে সাই করে বেরিয়ে গেলো একটি গাড়ি। সাইম ইতস্তত করে আরুর বামহাতটা হাতের মুঠোয় নিতেই গাড়িটা ব্যাক করে ওদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। আরু-সাইম দু’জনেই চমকে উঠে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। গাড়ি থেকে যে মানুষটি বেরিয়ে এলো তাকে দেখে আরুর হাত-পা যেন মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে এলো। মানুষটি ওদের কাছাকাছি এসে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
— হাই আরু বেবি! কোথায় যাচ্ছো? আমাকে যে বললে তুমি বাসায়। মিথ্যে বলেছিলে?
আরু ঢোক গিললো। রাফিনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কি করতে চাইছে রাফিন? আরুকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছুটা এগিয়ে এলো রাফিন। সাইমকে ইশারা করে বলে উঠলো,
— এই ছেলেটা কে আরু? হোয়াটএভার, আই ওয়াজ মিসিং ইউ।
কথাটা বলেই আরু আর সাইমকে চমকে দিয়ে আরুর হাত ধরে কাছে টেনে ঠোঁটে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো রাফিন। আরুর নিঃশ্বাসগুলো যেন গলাতেই আটকে গেলো। সাইমও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। রাফিন যা করলো তারপরও আরুর এমন চুপ থাকা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সাইম। যে সমাজে ছেলে মেয়ের হাত ধরে হাঁটাটাও অশ্লীলতার শামিল সেখানে এতোকিছুর পরও আরু চুপ থাকে কিভাবে? সাইম নিজের রাগটুকু চেপে গিয়ে রাফিনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
— এটা কেমন অসভ্যতা? কে আপনি? মেয়েদের সাথে কেমন বিহেভ করতে হয় জানেন না আপনি?
রাফিন হাসলো। ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো,
— অন্যমেয়ে আর আরুর মাঝে তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য মিষ্টার। এসব তো আমার আর আরুর মাঝে প্রায়ই হয়। ইট’স নট আ বিগ ম্যাটার। এনিওয়ে, আপনি বুঝি ওর বড় ভাই? তাহলে তো আমার সমন্ধী হবেন তাই না?
সাইম বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
— আপনার সাথে আরুর সম্পর্ক কি?
রাফিন রহস্যময়ী কন্ঠে বললো,
— সেটা আরুই ভালো জানে। তবে আপনাকে আমি কিছু ক্লু দিচ্ছি। আই থিংক, আমাদের সম্পর্কটা সহজেই বুঝে যাবেন আপনি। আমার আর আরুর সম্পর্কেটা এমন যে আরু রাতে নির্দ্বিধায় আমার সাথে মেলায় ঘুরে বেড়াতে পারে, বন্ধ দরজার ওপাশে আমার সাথে বেশ কমফর্টোবেলভাবেই সময় কাটাতে পারে। আর কিছু বলবো?
সাইম অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরু সম্পর্কে এমন সব কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। আরুর গলা বন্ধ হয়ে আসছে। সাইমকে পুরো ব্যাপারটা কিভাবে বলবে, কিভাবে বুঝাবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। সাইমকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে উঠলো রাফিন,
— বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আরুকেই জিগ্যেস করুন, অন্ধকার রাতের ঝলমলে মেলাতে আমার হাত ধরে ঘুরেছিলো কি না? আমার হাতে নখের দাগ বসিয়েছিলো কি না?পিঠের কথাটা নাহয় বাদই দিলাম।তারপর.. বন্ধ চেম্বারে আমার সাথে সময় কাটিয়েছিলো কি না?জিগ্যেস করুন।
সাইম কিছুক্ষণ রাফিনের দিকে তাকিয়ে থেকে আরুর দিকে তাকালো। আরুর হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। যে রাফিনকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও ভয়ঙ্কর লাগতো না , তাকে আজ এতোটা ভয় পাচ্ছে কেন সে? এতোটা ভয়!
— আরু? তুমি কি উনার সাথে মেলায় গিয়েছিলে? চুপ করে থাকবে না জবাব দাও। ইয়েস অর নো।
আরু মাথা নাড়লো। হ্যাঁ! সত্যিই সেদিন মেলাতে ঘুরেছিলো সে। কিন্তু রাফিন কথার মাঝে যে টুন ইউজ করছে তেমন কিছু তো নয়। সাইম আবারও প্রশ্ন করলো,
— উনার চেম্বারে…
আর কিছু জিগ্যেস করতে পারলো না সাইম। গা টা ঘিনঘিন করছে তার। আরুর মতো মেয়ে এমন হবে ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে তার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরুর দিকে নিরব চাহনী নিক্ষেপ করে পেছন ফিরে হাঁটা দিলো সাইম। আমাদের চোখ-কানও মাঝে মাঝে ভুল সাক্ষ্য দেয়। রাফিনের প্রতিটি কথা সত্য হলেও সবকিছুই মিথ্যে, বানোয়াট। ওর বিশ্রী উপস্থাপনটা মিথ্যে। সহজ কথাগুলোও মাঝে মাঝে বিষের মতো কাজ করে। যে বিষে সাইমের মনটাকে খুবই কৌশলে বিষাক্ত করে দিয়েছে রাফিন! আরু সাইমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সেদিকে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে বলে উঠলো রাফিন,
— কেমন দিলাম, মিস. আরু? বলেছিলাম না? আমি ভালো লোক নই, আমার সাথে পাঙ্গা নিও না। এই কাজটা কিন্তু এমনি এমনি করি নি আমি। আমার গালে চড় বসানোর বিপরীতে এটাই তোমার প্রাপ্য ছিলো। আমাকে যতটুকু অপমান করেছিলে তার থেকে ডাবল অপমান অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। ছেলেটা তোমার হবু বর তাই না?
আরু অবাক চোখে তাকালো। রাফিন হাসলো,
— আগেই বুঝেছিলাম। তাই ড্রামাটা করলাম। এর পরের কাহিনীটুকুও বাংলা সিনেমার থার্ডক্লাস স্টোরিগুলোর মতো হবে। তুমি বাড়ি যাবে, ছেলেপক্ষ বিয়েটা ভেঙে দিবে। পুরো মহল্লায় সবাই জানবে তুমি সেই টাইপের মেয়ে। তোমার সাথে সাথে তোমার ফ্যামিলিও অপমানে, লজ্জায় ডুবে মরবে। তোমার বয়স্ক বাবা কষ্ট, লজ্জায় স্টোক করবে। মরেও যেতে পারে। না মরলেও সমস্যা নেই রাফিন চৌধুরীর গায়ে হাত তোলার জন্য এটুকু অসম্মান খুবই কম। এবারে বেঁচে গেলেও পরের বারের অপমানে বাঁচতে পারবে বলে মনে হয় না। তোমাদের মতো মিডিলক্লাসদের লাইফ অলওয়েজ বাংলা সিনেমার মতো ট্রেজেডিপূর্ণই হয়। তোমাদের নিশ্চয় অভ্যাস আছে তাই না? অভ্যাস থাকলেই ভালো কারণ এখন থেকে তোমাকে বুঝতে হবে জীবনটা কতোটা নরকীয় হতে পারে। সি ইউ আরু বেব্বি। এন্ড, হ্যাঁ! নাইস লিপস্।
কথাটা বলেই ডানচোখটা টিপে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো রাফিন।আরুর শরীরটা ঘিনঘিন করছে। একটা মানুষ এতোটা খারাপ কি করে হতে পারে? এই মানুষটাকে কি করে ভালোবেসেছিলো সে? কিভাবে? আরু মাথায় হাত দিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়লো। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। কি করবে সে? সাইম যদি বাসায় গিয়ে এসব বলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার অসুস্থ বাবাটা যে মরে যাবে। একদমই মরে যাবে। আরু উঠে দাঁড়ালো, হাত-পা চলছে না তার। কি হতে চলেছে কে জানে?
৩৮.
চারদিকে রাতের প্রথম প্রহরের ফ্যাকাশে অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে ছাঁপিয়ে বিরাট চাঁদ খেলা করছে আকাশে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে নব বধূর প্রথম শিহরণের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছের ঘন পল্লব। এই বিশাল চাঁদের চমৎকার আলোয় একজোড়া তরুন-তরুনী নদীর ঢেউ গুণছে। দু’জনের দৃষ্টিই স্থির। এই স্থির দৃষ্টি সরিয়ে একগুচ্ছ নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলো রোজা,
— আচ্ছা? আমাদের ইনভেস্টিগেশন কবে থেকে শুরু হবে? কোথা থেকে শুরু করবো? কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি।
মৃন্ময় আগের মতোই চুপচাপ। রাতের এই ঠান্ডা বাতাসটা বেশ লাগছে তার। মৃন্ময়কে চুপ থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠলো রোজা,
— সব কিছু উলোট পালোট লাগছে আমার। কোথা থেকে কি শুরু করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এতোদিনে খুঁজে একটা চিঠি পেলাম, তা দেখে ভাবলাম ভিকটিম হয়তো বান্দরবান গিয়েছিলেন কিন্তু সেটাতেও জল ঢেলে দিলেন আপনি। ফট করে বলে দিলেন, নাহ! বান্দরবান যায় নি। তাহলে গিয়েছিলোটা কোথায়? মঙ্গল গ্রহে?
— সিলেট।
রোজা অবাক চোখে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
— মানে?
মৃন্ময় এবার ফিরে তাকালো। স্পষ্ট গলায় বললো,
— আমরা পরশো সিলেট যাচ্ছি। ওখান থেকেই শুরু হবে আমাদের যাত্রা।
— আপনার বাবা সিলেট গিয়েছিলো?
— কোথায় গিয়েছিলো সেটা জানতেই সিলেট যাবো মিস. রোজা। এখন আর কোনো প্রশ্ন নয়। একমাসের জন্য সকল কাজ থেকে লিভ নিচ্ছি আমি। এই একমাসেই রহস্য উদঘাটন করতে হবে আমায়।কাল সকাল দশটাই আপনি আর আপনার বন্ধু আমার সাথে দেখা করবেন। নেক্সট কি কি করা হবে তা নিয়ে ডিসকাশন করবো। আর হ্যাঁ, এলিনা গেটাপেই আসবেন নয়তো পরের দিন সকালবেলা হয়তো আপনাকে নিয়েও নিউজ বেরিয়ে পড়বে। আপনাদের দু’জনকে আমি টিম হিসেবে নিচ্ছি সো বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করলে এমন কিছু হারাবেন যার জন্য সারা জীবন পস্তাতে হবে। যদিও বিশ্বাস শব্দটা আমার ডিকশনারিতেই নেই। এখন উঠুন। রাত হয়েছে, আপনাকে বাড়ি ফিরতে হবে।
— আপনি কথায় কথায় ধমকি দেন কেন?
— উঠুন, মিস রোজা।
রোজা উঠে দাঁড়ালো। একহাতে জুতো নিয়ে অন্যহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে খালি পায়ে হাঁটছে সে। শিশিরভেজা ঘাসে হাঁটতে বেশ লাগছে তার। কিছুটা পথ এসে রাস্তায় দাঁড়াতেই কয়েকটি বখাটে ছেলের পাল্লায় পড়লো তারা। রোজাকে দেখে সিটি দেওয়া থেকে শুরু করে নিম্নমানের কথাবার্তাও চললো তাদের মাঝে। রাগে শরীর ছিঁড়ে যাচ্ছে রোজার অথচ মৃন্ময় ভাবলেশহীন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফোন চাপছে সে। রোজার এই মুহূর্তে ছেলেগুলো থেকে মৃন্ময়ের প্রতি বেশি রাগ লাগছে। একটা মেয়েকে এভাবে টিচ করছে অথচ মৃন্ময়ের কোনো যায় আসছে না। অদ্ভুত! এক-দুটো ছেলে হলে রোজা নিজেই ধরে পেটাতো কিন্তু ৪- ৫ টা ছেলের সাথে কিছুতেই পেরে উঠবে না সে। রোজার গলা শুকিয়ে আসছে, ছেলেগুলোর ভাব-সাব কিছুতেই সুবিধার মনে হচ্ছে না তার। রোজা ছেলেদের দিকে চোখ রেখেই ফিসফিস করে বলে উঠলো,
— ছেলেগুলো আমাকে নিয়ে বিশ্রী কথা বলছে।
মৃন্ময় ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই স্বাভাবিক গলায় বললো,
— তো?
— তো মানে? আপনি কিছু করবেন না?আপনার কাছে রিভলবার থাকলে শুট করে দিন। এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
— মিস. রোজা? আমি রিভলবার নিয়ে ঘুরি না। তাছাড়া আপনার জন্য আমি কেন ঝামেলায় জড়াতে যাবো?
মৃন্ময়ের কথায় রাগ লাগলেও চুপ হয়ে গেলো রোজা। যার মধ্যে সামন্য মানবিকতা নেই তাকে কিছু বলে লাভটাই বা কি? মৃন্ময়ের নীরবতার সুযোগ নিয়েই আরো কিছুটা এগিয়ে এলো ছেলেগুলো। একজন তো রোজার হাতে বেশ বিশ্রীভাবে ছোঁয়েও দিলো। মৃন্ময় ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে হাসিমুখে বেশ নম্রভাবে বললো,
— হ্যালো গাইস, কিছু বলবেন?
ছেলেগুলো যেনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মৃন্ময়কে বড্ড পাগল মনে হচ্ছে তাদের।একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করছে দেখেও কোনো সুস্থ সবল মানুষ এমন একটা কোশ্চেন করতে পারে না। ভীতু হলে পালিয়ে যায় আর সাহসী হলে ঝামেলা করে কিন্তু এমন প্রশ্ন! তবে, তাদের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা বেশিক্ষণ টিকলো না। তাদের মধ্যে থেকে একজন দাঁত বের করে বিশ্রীভাবে হেসে বলে উঠলো,
— তোরে কিছু বলতে চাই না। তবে এই মাইয়াটারে বলতে চাই। ভালো চাইলে মেয়েটাকে রেখে কেটে পড়। আজ আমাদের সবার মদুচন্দ্রিমা হবে।
কথাটা বলে আবারও বিশ্রীভাবে হাসলো ছেলেটি। মৃন্ময় মিষ্টি হেসে বললো,
— মদু নয় মধু। ওটা মধুচন্দ্রিমা হবে। আপনাদের মধুচন্দ্রিমার জন্য অল দ্যা বেস্ট। তবে আমি এখান থেকে যেতে পারছি না।
— কেন রে? তোরও মধুচন্দ্রিমা করতে মন চাইছে নাকি?
ছেলেটার কথায় বাকিরাও হেসে উঠলো। কিন্তু মৃন্ময় ভাবলেশহীন। আগের মতোই মৃদু হেসে বললো,
— না তাই নয়। অন্য সমস্যা।
ছেলেগুলো অবাক হয়ে বললো,
— কি সমস্যা?
— এখানে শুটিং করতে এসেছি। নয়তো রাতের বেলা এমন নির্জন জায়গায় কেউ আসে? প্রটেকশনের জন্য গার্ডস আর আমাদের টিম এই পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। বাকিরা নদীর ওই পাশটাতে আছে। আর আমার পাশে যে আছে সে হিরোইন। আমরা দু’জন ন্যাচারেল রিহার্সালের জন্য একটু আগেই চলে এসেছি। যেহেতু, একটু পর শুটিং সো এখন চলে যাওয়াটা তো পসিবল নয়।
মৃন্ময়ের কথায় ছেলেগুলো কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকেই হাসিতে ফেঁটে পড়লো। হাসতে হাসতেই বলে উঠলো,
— ফাজলামো করস? আমাদের মগা মনে হয় তোর?কোন সুপারস্টার তুই? আরে আরে দেখ তোরা সুপারস্টার চলে আসছে অটোগ্রাফ নে, অটোগ্রাফ নে। শালা ধাপ্পাবাজ।
মৃন্ময় এবার ফোনের লাইটটা অন করে নিজের মুখে ধরলো। ছেলেগুলো একটু খেয়াল করে দেখতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তারা। একজন তো বলেই ফেললো,
— মামা? আসলেই তো নায়ক রে। আরিয়ান মৃন্ময়! সত্যিই শুটিং চলে। মামু চল কাল্টি মারি, হিরোইনের লগে কান্ড কইরা ফেলছি মামা। সবাই চলে এলে তো ধুয়ে দিবে রে। মাইয়া অন্য কোথাও থেকে তুলে নেওয়া যাবে।এদের লগে লাগলে কাহিনী হয়ে যাবো বন্ধু।
মৃন্ময় হাসিমুখে বললো,
— আরে, যাবেন কেন? শুটিং দেখে যান। সবাই এই পাঁচ মিনিটের মাথায় চলে আসবে। তাছাড়া বাকিরা ওদিকটায় আছে। একটু ওয়েট করুন।
ছেলেগুলো গদগদ গলায় বলে উঠলো,
— না বস। আমরা যাই। মাফ কইরেন বস। কিছু মনে নিয়েন না। আসি বস। আসি ম্যাডাম, স্লামালেকুম।
ছেলেগুলো ঝটপট পা পালিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। কয়েক মিনিট পরই তাদের সামনে একটা রিক্সা এসে দাঁড়ালো। রিক্সায় বসে আছে সোহেল। মৃন্ময়দের দেখে নেমে দাঁড়িয়ে নার্ভাস গলায় প্রশ্ন করলো সে,
— হ্যালো ম্যাম, ভালো আছেন? স্যার? আপনি উনার সাথে এখানে? কেউ দেখলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। আর রিক্সা দিয়ে কি করবেন স্যার? রিক্সা আনতে বললেন কেন?
— তুমি সবসময় বেশি কথা বলো সোহেল। মিস. রোজা? আপনি তো গাড়িতে যাবেন না। রিক্সায় উঠে যান। সোহেল?
সোহেল হন্তদন্ত হয়ে উত্তর দিলো,
— জি স্যার?
— তুমি মিস. রোজার সাথে যাও। উনাকে পৌঁছে দিবে।
সোহেল অবাক হয়ে বললো,
— আমি?
— কেন? কোনো সমস্যা?
— না স্যার। একদমই না। চলুন ম্যাম।
রোজা স্পষ্ট গলায় জবাব দিলো,
— দরকার নেই। আমি একা চলাচল করতে পারি।
মৃন্ময় তার থেকেও স্পষ্ট গলায় বললো,
— আপনার কাছে কেউ অনুমতি চায় নি। তবুও যদি একা যেতে চান তো যান। ছেলেগুলোকে হয়তো সামনেই পেয়ে যাবেন।
রোজা কিছু বললো না। চুপচাপ রিক্সায় উঠে গেলো। তার পিছু পিছু অসহায় মুখ নিয়ে রিক্সায় উঠে গেলো সোহেল। মৃন্ময়কে ব্যাপক সন্দেহ হচ্ছে তার। এই রাতের আঁধারে এই সাংবাদিক মাইয়ারে নিয়ে করেটা কি স্যার? কোনো কাহিনী চলছে না তো? আর কাহিনী চললে নিজে না আসে তাকে পাঠালো কেন? অদ্ভুত! রোজার রাগ লাগছে নাকি মন খারাপ লাগছে বুঝতে পারছে না সে। মৃন্ময় ছেলেগুলোকে দু-চারটে ঘুষি কি দিতে পারতো না? কতো বিশ্রী বিশ্রী কথা বলার পরও তাদের সাথে এতো সুন্দর ব্যবহার? বিরক্তিকর! কই তার সাথে কথা বলতে গলায় তো ধমকি ধামকিতে উড়িয়ে দেয় অথচ ওই বাজে ছেলেগুলোর বেলায় এতো নিশ্চুপ! কথাগুলো ভাবতেই মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে তার। একে বলে বিরক্তি জনিত মাথা ব্যাথা।
৩৯.
সকাল ৭ টা। হালকা রোদের ঝাপটায় ঘুম ভেঙে গেলো রোজার। কিছুক্ষণ বালিশে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকেই উঠে বসলো সে। ঘড়িটা দেখে নিয়ে ফ্রেশ না হয়েই রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দিলো সে। মাথাটা ব্যাথা করছে খুব। এই মুহূর্তে মায়ের হাতের এক কাপ চা ভীষণ প্রয়োজন তার। ড্রয়িং রুমে এসেই রিদকে চোখে পড়লো তার। টি-টেবিলে খবরের কাগজ বিছিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা দেখেছে সে। কুকরানো চুলগুলোর কিছুটা এসে পড়েছে কপালে। রোজা রিদের মাথায় চাটি মেরে পাশে বসেই বলে উঠলো,
— খবরের কাগজে ঢুকে যাচ্ছিস কেন?
রিদ মুখ তুলে তাকালো। রোজার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
— খবরের কাগজে আজ দারুণ একটা পাজল দিয়েছে আপু। ওটাই দেখছিলাম।
— তোর প্রাইভেট নেই আজ?
— আছে তো। এখনই বের হবো। যেতে ইচ্ছে করছে না।
রোজা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে ভাজ করতে করতে বললো,
— যাহ,ভাগ। খবরের কাগজ উড়ে যাবে না। বিকেলে দেখে নিস। এখন উঠ নয়তো মার ঝাড়ুর বাড়ি খেতে হবে তোকে।
রিদ হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো। মা বললে হয়তো আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতো সে কিন্তু রোজার কথা কিছুতেই ফেলতে পারে না সে। সোফা থেকে স্কুল ব্যাগটা নিয়ে কুকরানো চুলগুলো ঝাঁকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো সে,
— বাই আপু। রাতে দেখা হবে।
রোজা হাসলো। ভাইয়ের চুলগুলো ভীষণ ভালো লাগে তার। কেমন আদর আদর লাগে। দেখলেই হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নিজের মনে হেসে পেপারটা টেবিলের উপর রাখতেই একটা জায়গায় চোখ আটকে গেলো তার। খবরের কাগজের এককোণায় কয়েকজন ছেলের ছবি দেওয়া হয়েছে। ছবিগুলো বেশ পরিচিত লাগছে তার। কোথায় যেন দেখেছে সে। খবরের কয়েক লাইন পড়েই থমকে গেলো সে। এগুলো কাল রাতের ছেলেগুলো নয়তো? রোজা বেশ মনোযোগ দিয়ে খবরটুকু পড়লো। যার সারমর্ম দাঁড়ালো এই, কাল রাতে শহরের এক নির্জন রাস্তা থেকে ব্যাপক আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তাদের। যাদের মাঝে তিনজনই আইসিইউ- তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। বাকি তিনজন আশঙ্কাজনক না হলেও ব্যাপকভাবে আহত। এই ঘটনার তদন্তে ছেলেদেরকে জিগ্যেসাবাদ করা হলে তারা জানায়, নিজেদের মাঝে কথা-কাটাকাটির জের ধরেই এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি হয়। মদ খেয়ে মাতাল হয়েই এতোটা হিংস্র হয়ে উঠে তারা। হসপাতালের ডাক্তাররাও জানায় ভিকটিমদের পেটে প্রচুর পরিমানে নেশা জাতীয় দ্রব্য পাওয়া গিয়েছে। পুলিশের কাছে পুরো ঘটনাটা অস্পষ্ট হলেও বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না তারা। তারপর যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নিয়ে হেন তেন লম্বা এক বিবৃতি দিয়েছে সংবাদ লেখক। রোজা পেপারটা রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিষয়টা রোজার কাছেও বেশ রহস্যময় লাগছে। যা দেখানো হচ্ছে সত্যিই কি তাই? নাকি এর পেছনেও আছে অন্যকোনো গল্প!
# চলবে…

#part_21
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943501403166654/

#part_19
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943495856500542/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here