এক মুঠো রোদ পর্ব-২৪

0
664

#এক_মুঠো_রোদ
#Writer_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#part_24
#collected Sk Galib
স্টোর রুম লক করে চাবিটা আজিম সাহেবকে ফিরিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলে মৃন্ময়,
— স্যার,একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে পারি?
আজিম সাহেব সরু চোখে তাকান। হাসি ফিরিয়ে দিয়েই বলেন,
— জি, অবশ্যই। বলুন কি প্রশ্ন।
মৃন্ময় হাতদুটো হাঁটুর উপর রেখে কিছুটা ঝুঁকে এসে শান্ত গলায় বলে,
— আপনাদের এখানে এমন কোনো কর্মচারী আছে যে প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন?
আজিম সাহেব কপাল কুঁচকে খানিক ভাবেন। মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে চশমাটা ঠিক করে বলেন,
— ঠিক মনে করতে পারছি না মৃন্ময় সাহেব। চা বাগানে শক্ত সামর্থ্য লোকদেরই বেশি রাখা হয় তবুও দু’একজন সিনিয়র কর্মচারী থাকতে পারে। কিন্তু কেনো বলুন তো?
— আমি তাদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
আজিম সাহেব মৃন্ময়ের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা ভাবেন। পরক্ষনেই,রমজান নামে এক ছেলেকে ডেকে পাঠান। কয়েক মিনিট পর চকচকে লাল শার্ট পড়ে হেলেদুলে আজিম সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ায় কালো করে শুকনা একটি ছেলে। চোখে-মুখে ঘুম ঘুম ভাব। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভোরের অসম্ভব মিষ্টি ঘুম থেকে জোর করে তোলে আনা হয়েছে তাকে। আর ব্যাপারটায় চরম রকম বিরক্ত সে। রমজান পাশে দাঁড়াতেই আজিম সাহেব গলা খাঁকারি দেন। গলাটা হালকা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন,
— রমজান?
— জে স্যার।
— আমাদের চা বাগানে ১৩/১৪ বছর ধরে চাকরী করছে এমন কেউ আছে?
— জে স্যার, আছে। ৪/৫ জন আছে। কেন স্যার? ডাকুম হেগোর?
— হ্যাঁ, ডাকবে। এবং খুব জলদি ডাকবে।
রমজান নামক ছেলেটা চলে গেলে চা’এর কাপে চুমুক দেয় রোজা-মৃন্ময়সহ সবাই। চায়ের কাপে প্রথমবার চুমুক দিয়েই অবাক হয় রোজা। একদমই অন্যরকম ফ্লেভারের চা। রোজা আবারও কাপে চুমুক দিয়ে আজিম সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— চা-এর স্বাদটা একদম ভিন্ন রকম। কোনো স্পেশালিটি আছে নাকি এই চায়ে?
আজিম সাহেব হাসেন। মাথা দুলিয়ে বলেন,
— চায়ের দেশের চায়ে স্পেশালিটি তো থাকবেই। বাংলাদেশের ১৬৩ টি চা-বাগানের ১৩৫ টি-ই এই সিলেটকে ঘিরে রেখেছে। এমন একটা জায়গায় চা খেয়ে তৃপ্তি না পেলে কি চলে?
আজিম সাহেবের কথার মাঝেই প্রবেশ করে ৪/৫ জন মধ্যবয়স্ক এবং মোটামুটি বয়স্ক লোক। সবার চেহারায় জীবনব্যাপী প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে চলার ছাপ। তাদের দেখে উঠে দাঁড়ায় মৃন্ময়। হাতের কাপটা টেবিলে রেখে বলে,
— কেমন আছেন আপনারা?
মৃন্ময়ের কথার কোনো উত্তরই দেয় না কেউ। মৃন্ময় মৃদু হেসে আবারও প্রশ্ন করে,
— আপনারা তো এখানে প্রায় ১৩/১৪ বছর থেকে কাজ করছেন। তাই না?
লোকগুলো মাথা নাড়ায়। মৃন্ময় বলে,
— আপনারা কি শাইয়াম চাং নামে কাউকে চিনেন? ১৪ বছর আগে চা-বাগানে কাজ করতো উনি। যদি চিনে থাকুন তাহলে বলুন এর বিনিময়ে আপনাদেরকে একমাসের ডাবল বেতন দিবো আমি। জানেন কেউ?
তারা একজন আরেকজনের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। রোজা উঠে এসে পাশে দাঁড়ায়। আলগা গলায় বলে,
— হ্যাঁ বা না কিছুতো বলুন, চাচা। জানেন?
একজন রোজার মুখের দিকে তাকায় বিরবির করে বলে তারা জানে না। রোজা আশাহত হয়। তীর্থও বিরক্তিতে মুখ বাঁকায় অথচ মৃন্ময় স্বাভাবিক। হাসিমুখেই ওদের যেতে বলে আজিম সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে। রোজা বুঝতে পারে না, এই মৃন্ময়ের মাঝে অনুভূতি নামক কোনো সিস্টেম আছে? নাকি নেই? অদ্ভুত! চা-বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তা ধরে হাঁটে ওরা। রোজা একবার সবুজে রাঙা টিলাগুলোর দিকে তাকায় তো একবার আড়চোখে মৃন্ময়কে দেখে। উজ্জল শ্যামা মুখটিতে অসম্ভব সুন্দর দুটো চোখ। সেই চোখদুটো যেন আবেগশূন্য, বেপরোয়া। হঠাৎই মৃন্ময় ফিরে তাকায়, চোখে চোখ পড়ে। রোজা চমকে ওঠে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলে সে। ইশ! এভাবে ধরা খাওয়ার কি দরকার ছিলো? কি ভাবলো মৃন্ময়? ছি! মালনীছড়ার প্রবেশপথ অতিক্রম করার পূর্বমুহূর্তেই পেছন থেকে ডেকে উঠে কেউ। ওরা ফিরে তাকায়। ওই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন ব্যক্তি ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকে বলে,
— চাচা,কিছু বলবেন?
লোকটি মাথা নাড়ে। গলার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলে,
— শাইয়াম চাং রে আমি চিনি। একসাথেই কাজ করতাম। সে মাত্র ৪ মাস কাজ করছে এখানে তারপর হুট করেই উধাও হয়ে গেছে। শেষ মাসের বেতনটাও নিয়ে যায় নি শাইয়াম।
তীর্থ চোখ পাকিয়ে বলে,
— যখন জিগ্যেস করা হলো তখন বললেন না কেন, মিয়া?
— ওইখানে ডরাইতাছিলাম।
মৃন্ময় কপাল কুঁচকে বলে,
— ভয়? কিসের ভয়?
— বড় বাবু আছিলো হের লাইগা।
লোকটিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে শীতল কন্ঠে বলে রোজা,
— এই শাইয়াম চাং-এর ঠিকানা দিতে পারবেন চাচা? কোথায় থাকেন উনি?
— আমি জানি না সে কই। বললাম না? হঠাৎ চলে গেছে। কেউ কোনো খোঁজ জানে না। আর কেউ খোঁজ নেয় ও নি। ভাবছে হয়তো অন্য কোথাও চইলা গেছে।
মাথার ঘন চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে পকেটে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠে মৃন্ময়,
— উনার খোঁজ কোথায় পাওয়া যাবে জানেন? উনার পরিচিত কারো ঠিকানা?
— জে না। তেমন কেউ রে জানি না। তবে,তাহেরা পতাম বলতে পারবো।
তীর্থ ঝটপট জিগ্যেস করে,
— এই তাহেরা পতাম কে? বাড়ি কই?
— জে। তাহেরা পতামের লগে শাইয়ামের খুব ভাব ছিলো। শাইয়াম আগে শ্রীমঙ্গলের একটা চা-বাগানে কাজ করতো। তাহেরা পতাম জাতে খাসিয়া৷ নিরালা খাসিয়াপুঞ্জিতে থাকে। মাঝে মাঝে শাইয়ামের সাথে দেখা করতে আসতো।
মৃন্ময় প্রশ্ন করলো,
— তাহেরা পতাম কি এখনও নিরালা খাসিয়াপুঞ্জিতেই থাকে?
— থাকুনের তো কথা। আপনারা খাসিয়াপুঞ্জিতে গিয়া মন্ত্রীরে জিগায়লেই সাহায্য করবো। পুঞ্জির মন্ত্রীটা বড্ড ভালা মানুষ।
মৃন্ময় ধন্যবাদ দিয়ে লোকটির হাতে বেশ কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ঘুরে গেইটের দিকে এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে না ফিরেই কয়েকপা পিছিয়ে যায় সে। রোজাকে কাছে টেনে নিয়ে একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে তীর্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— চা বাগানে এলাম অথচ ছবি তোলা হলো না! দারুন কিছু ছবি তোলো তীর্থ।
মৃন্ময়ের হঠাৎ এমন বিহেভিয়ারে রোজার সাথে সাথে তীর্থও অবাক হয়ে তাকায়। কোমরে মৃন্ময়ের স্পর্শ পেয়েই কেঁপে উঠে রোজা। সারা শরীরে বয়ে যায় অদ্ভুত এক শিহরণ। রোজা মুখ তুলে মৃন্ময়ের দিকে তাকায়। মৃন্ময়ের মুখে কোনো ভাবাবেগ নেই। রোজা তাকাতেই সামনের দিকে তাকিয়েই ধীর কন্ঠে বলে উঠে মৃন্ময়,
— টাচ করার জন্য সরি। আমাদের কেউ ফলো করছে মিস.রোজা। আমার ধারনা ঠিক হলে আমাদের পেছনের ঝোপটাতেই গা ঢাকা দিয়েছে কেউ।
মৃন্ময়ের কথায় চমকে গিয়ে পেছনে তাকাতে নিতেই কোমরে চাপ দেয় মৃন্ময়। মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখেই বলে উঠে,
— পেছনে তাকাবেন না। তীর্থকে ছবি তুলতে দিন। ওর হাতের ক্যামারাটা অসাধারণ। ছবি জুম্ করে কিছু পেলেও পেতে পারি কিন্তু আপনি পেছনে তাকালে সেটাও সম্ভব হয়ে উঠবে না।
রোজা ঢোক গিলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামান্য নড়ার শক্তিও পাচ্ছে না সে। মৃন্ময়ের ছোঁয়ায় ভেতরটা কেমন শিরশিরে অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেছে। মৃন্ময় এক হাতে ফোন বের করে তীর্থকে ম্যাসেজ পাঠায় এবং চোখের ইশারায় ফোন চেক করতে বলে। তীর্থ মৃন্ময়ের বিহেভিয়ারে বরাবরই অবাক হচ্ছে। পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে বিরবির করতে থাকে সে,
— শালা পাগলা নাকি? মাথার তার তুর ঢিলাঢুলা আছে কিনা কে জানে?
ফোনের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ম্যাসেজটা দেখেই কপাল কুঁচকে যায় তার। ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে গিয়ে মৃন্ময়ের কথামতো পেছনের ঝোপটায় ফোকাস দেয় তীর্থ। একি! ঝোপের মাঝে লাল রেইনকোটের অংশ দেখা যাচ্ছে। এসবের মানে কি? ওখানে কি করছে লোকটা?
বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো ওরা। ড্রাইভারের পাশের সিটে মৃন্ময় আর পেছনে রোজা-তীর্থ। রোজা এখনও স্থির হয়ে বসে আছে। কোমরে,কাঁধে সব জায়গায় মৃন্ময়ের ছোঁয়াটা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। রোজা ঢোক গিলে জানালার বাইরে তাকায় এমন ফিলিংস এর আগে কখনো হয় নি তার। তাহলে আজ হঠাৎ? মৃন্ময় ছবিগুলো চেইক করছিলো। দু’ঠোঁট চেপে কিছু একটা চিন্তা করতে করতে সামনের গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই রোজার মুখটা ভেসে ওঠে। মৃন্ময় রোজার অস্বস্তিটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। তীর্থ খুব মনোযোগ দিয়ে রোজা- মৃন্ময়কে পর্যবেক্ষন করে চলেছে সেই কখন থেকে। এতোক্ষণ যাবৎ রোজাকে চুপ থাকতে দেখে রোজার দিকে খানিকটা চেপে বসে মাথায় টোকা মেরে ফিসফিসিয়ে বলে সে,
— দোস্ত? এখনও কি শকে আছিস নাকি?
রোজা কিছু বলে না। তীর্থ মুখ টিপে হেসে বেসুরে গলায় গান ধরে,
“I am sixteen, going on Seventeen
দিল কিউ না ধাক ধাক কারে….
হাইয়ে…দিল কিউ না ধাক ধাক কারে”
রোজা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই থেমে যায় তীর্থ। মুখে নিষ্পাপ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলে,
— আল্লার একশ পয়ষট্টিটা দিন তুই আমারে সন্দেহ করস। গানটা কিন্তু তোকে ইন্ডিকেইড করে গাইনি আমি।(রোজার দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ম হতেই) এখন কি গান গাইতেও পারবো না? আচ্ছা যা, গাইলাম না আমি। স্যার? আপনি গান না প্লিজ! এতোবড় গায়ক আমাদের সাথে অথচ এতো রোমান্টিক ওয়েদারে গান হবে না তা কি করে হয়?
মৃন্ময় ক্যামেরা থেকে মুখ উঠিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— এখানে রোমান্টিকের কি দেখছো তীর্থ?
তীর্থকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ড্রাইভার ছেলেটা বলে উঠে,
— স্যার? সাইডের কথায় ফোকাস করেন ক্যান? ওইটা তো কথার কথা। ওয়েদারকে যেমন ভাববেন তেমনই। রোমান্টিক ভাবলে রোমান্টিক আর ছ্যাঁকা ভাবলে ব্যাঁকা। মন রোমান্টিক হইলে খা খা মরুভূমিও রোমান্টিক মনে হয় স্যার। আপনি শুধু গান ধরেন।প্লিজ স্যার….
— হ্যাঁ স্যার। আলী ঠিক বলছে। আমাদের জন্য একটা গান তো গাইতেই পারেন। প্লিজ…
মৃন্ময় ক্যামেরাটা হাতে রেখে গ্লাসে একবার রোজার মুখটা দেখে নিয়ে বাইরে তাকায়। তীর্থ সামনের সিটের দিকে ঝুঁকে পড়ে গান শোনার জন্য। রোজাও জানালার বাইরে চোখ রেখে কান খাঁড়া করে। মৃন্ময় গায়,
—-” ফ্রেমে বন্দী কোন ক্যামেরায়
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল তুমি
অথবা বর্ষার আকাশে মেঘের আদলে
লুকিয়ে থাকা ওই রোদ তুমি
তোমার ঐ মেঘকালো চোখের ভাষায়
মাতাল করা হাসি আর ভেজা চুলে
গোলাপি ঐ ঠোঁটের ব্যালকনিতে
রঙ তুলিতে আঁকা আমার অবসর বিকেল
সব তুলনার উর্ধ্বে তুমি
আজও তোমার স্পর্শ লোভে
খুঁজি তোমায় স্বপ্ন গানে
আজও তোমার অপেক্ষাতে
টুকরো কিছু বাক্যে স্বপ্নে আপন
মাঝখনে অদৃশ্য দেয়াল
খুঁজে ফিরি তোমায় কোন মায়ায়
দাঁড়িয়ে যেন উপহাসে
হারিয়ে সেই সকাল,হারিয়ে সে বিকেল
বৃষ্টি ভেজা দুপুর,অলস মেঘ রোদ্দুর
আসবে না জানি ফিরে।
— তাহসান…”
মৃন্ময়ের গান শেষ হতেই সিটি বাজায় তীর্থ। রোজার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— দোস্ত? তোগোর সিচুয়েশনের লগে একদম খাপে খাপ। আহা! কি প্রেম।
রোজা রাগী চোখে তাকায়। তীর্থ দাঁত কেলিয়ে হাসে। রোজা গাড়ির গ্লাসে তাকাতেই ভেসে ওঠে মৃন্ময়ের মুখ। তার মুখে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, কোনো আবেগ নেই। গান শেষ করে আবারও কাজের মাঝে ডুব দিয়েছে সে। আচ্ছা? এতো কি কাজ তার? এতো কিসের ব্যস্ততা তার চারপাশে?
৪৫.
আরু ঘরের এককোণায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটু আগেই আরিফের হাতে মার খেয়েছে সে। লজ্জায়,কষ্টে, অপমানে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। পাশের রুম থেকে আরমান সাহেবের ঘনঘন নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ আসছে। শ্বাসকষ্টটা সকাল থেকেই বড্ড জ্বালাতন করছে তাকে। আরিফ এখনও রাগে ফুঁসছে। লিনা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে চলেছে। স্বামীকে বলার মতো কোনো ভাষায় নেই আজ। আরুর কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে৷ টেবিলের কোণা লেগেই কেটে গিয়েছে হয়তো। লিনা আবারও আরুর দিকে পা বাড়াতেই গর্জে উঠে আরিফ,
— খবরদার আমাদের মাঝে আসবে না লিনা। আমাদের ভাই-বোনের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছো সেখানেই দাঁড়াও।
লিনা অবাক হয়ে বললো,
— আরু কি আমার বোন নয় আরিফ?
— অযথা কেচাল করো না তো লিনা৷ বিরক্ত না করে যাও এখান থেকে।
লিনা জল মাখা কন্ঠে বলে,
— আরিফ!
— কি? আরিফ কি? বলো? বোন, না? বোন মানো ওকে? বোন মানলে আমার নিষেধ সত্তেও ওকে বাইরে পাঠাতে না লিনা। আর আমাকেও এভাবে ছোট হতে হতো না। উনিশটা বছর ধরে যে বোনকে অন্ধের মতো ভালোবেসে এসেছি আজ সেই বোন একবারও আমার মান-সম্মানের কথা ভাবলো না। শুধুমাত্র ওর জন্য এলাকার বখাটে ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসার সাহস পেলো। বলে কিনা, ” আরে, আরিফ ভাই নাকি? তোমার বোন তো দেখলাম কয়েকটা ছোকরার সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। বোনকে বাজারে নামিয়ে দিছো নাকি?” ছি! এরপরও এই বোনের প্রতি মায়া থাকা সাজে? যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। যতো কষ্টই হয়েছে তবু ভেবেছি ওর হাসির জন্য এটুকু তো করতেই পারি। কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি এই বোনই আমার অপমান আর চোখের জলের কারণ হবে। আমার বাবার অসুস্থতার কারণ হবে। আজ বুঝতে পারছি, বোন নয় দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। মরে যেতে পারিস না তুই? এমন বোন থাকার চেয়ে না থাকায় ভালো।
আরু আর দাঁড়ায় নি ছুটে চলে এসেছে রুমে। দরজা বন্ধ করে হাত কামড়ে ধরে কেঁদেছে। একবার ভেবেছে মরে যাবে। ওই সিলিং ফ্যান কি আরুকে এই কষ্টের ভার থেকে মুক্তি দিতে পারবে না? আলমারি খুঁজে মায়ের সুঁতি শাড়ি বের করে আনে সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহসে কুলাই না। মরে যাওয়া কি এতোই সহজ? মানুষের চিন্তা-ভাবনাগুলো এতো নোংরা কেন হয় বুঝে না আরু। এই উনিশ বছর যে কল্পনার পৃথিবীটায় বেঁচেছে সে আজ তা হঠাৎই ধসে পড়েছে। খুব বিশ্রীভাবে ভেঙে পড়েছে। আরু ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে বসে হাঁটুতে মাথা রাখলো। শরীরটা থেকে থেকে কাঁপছে আরুর। কান্নাগুলো যেন সারা শরীরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই লিনার চিৎকার কানে এলো আরুর। আরু যেন চমকে উঠলো। তবে কি আরিফ লিনাকে মারছে? না, আরিফ কখনো লিনার গায়ে হাত তুলবে না। কি হলো তবে? আরু ওঠে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করলো। চিৎকারের আওয়াজ কমছে না বরং বাড়ছে। আরু দরজা খুলে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। চিৎকারের শব্দকে অনুসরণ করে আরমান সাহেবের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আরু। আরিফ দরজায় দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরু আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলো আরমান সাহেব ছটফট করছেন। মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে সাদা ফ্যানা। আরু আঁতকে ওঠে। কি হলো তার বাবার?
# চলবে…

#part_25
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943502583166536/

#part_23
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943501996499928/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here