এক মুঠো রোদ পর্ব-৪৫

0
668

#এক_মুঠো_রোদ
#Writer_নৌশিন_আহমেদ_রোদেলা
#part_45
#collected Sk Galib
ক্লাস শেষে বাঁশ চত্তরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। কপালটা হালকা কুঁচকানো। মাত্র চারদিন পর সিটি আর এখনও নোট কালেক্ট করা হয়ে উঠে নি তার। ছাত্রী হিসেবে খারাপ নয় সে কিন্তু ভালো রেজাল্টের জন্য পড়াশোনাটাও তো করা চায়। বাবার দেওয়া শর্ত পূরণ করতে গিয়ে এবার না সেমিস্টার লস করে বসে সে। ভারি চিন্তার বিষয়! রোজার ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এলো। বিরক্ত নিয়ে পেছন ফিরে তাকালো রোজা। তীর্থ বাইকে বসে দাঁত বের করে হাসছে আর ক্রমাগত হর্ণ বাজাচ্ছে। রোজা ভ্রু কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে গিয়েই জারি দিয়ে বললো,
—” এমনে হর্ণ বাজাচ্ছিস কেন? থাপড়াইয়া গাল ফাটাইয়া দিমু। বেদ্দপ।”
তীর্থ হর্ণ বাজানো বন্ধ করে বোকা হাসি দিয়ে বললো,
—” জলদি ওঠ। তোরে পৌঁছে দিয়ে মালিহার কাছে যাবো।”
তীর্থের কথায় পাত্তা না দিয়ে হাতের ডায়েরিটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বললো রোজা,
—-” তুই চলে যা। আমি সিএনজি দিয়ে চলে যাবো। সমস্যা নাই।”
তীর্থ গম্ভীর গলায় বললো,
—” তোরে একলা রাইখা যামু না। ভং ধইরা খাড়াই না থাইকা জলদি ওঠ।”
রোজা আর কথা বাড়ালো না। বাইকে উঠে তীর্থের কাঁধে হাত রেখে বললো,
—” এই লাবিবের থেকে থিসিসের নোটটা নিছিস?দিছে তোরে?”
—” হুম ব্যাগে আছে। বের করে নে। তুই নোট করিস আমি পারতাম না। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ গ্রুপস্টাডি করলেই হয়ে যাবো। এতো পইড়া ধনী হইছে কেরা?”
রোজা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—” ডাক্টারনী বউ পাবি। টাকা আর টাকা। তুই আর পড়ে কি করবি? এনিওয়ে? মালিহাও তো এবার ফাস্ট টার্ম দিলো রেজাল্ট কেমন হইছে রে?”
তীর্থ দাঁত বের করে হাসলো। বাইকের স্পিড বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো,
—” আবে, ও সামনে থাকলে দুনিয়া ভুইলা যাই আর রেজাল্টের কথা জিগামু কেমনে? ভালোই করছে মনে হয়। আর তুই যে এতো কইতাছিস…তোরা মাইয়ারা তো রেডিমেট ব্যাংক পাস। বিয়ের সাথে ক্রেডিট কার্ড ফ্রী। আহা! কি সুখ।”
রোজা ঠোঁট উল্টে বললো,
—” হু। দেখোস না কতো পোলা ক্রেডিট কার্ড নিয়া আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।”
রোজার কথার মাঝেই বাইক থামালো তীর্থ। হালকা হেসে বললো,
—” নাম।”
রোজার এতোক্ষণে খেয়াল হলো। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” এখানে এনেছিস কেন? আমি তো ভেবেছিলাম শর্টকাট নিবি। তারপর আর খেয়াল করি নি। এখানে বাইক থামানোর মানে কি?”
তীর্থ ঘাড় ফিরিয়ে ডানচোখ টিপে বললো,
—” এইখানে তোর ক্রেডিট কার্ড ওয়ালা দাঁড়ায় আছে মামা। জলদি নাম না রে বাপ।”
রোজা তেতে উঠে বললো,
—” মাঝ রাস্তায় ফাজলামো করবি তো একটা থাপড়া লাগামু। জলদি বাইক স্টার্ট দে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নোট কমপ্লিট করা লাগবে। তারপর আবার মুখস্থ করা লাগবে। অনেক কাজ…এই টাইমে ফাজলামো করিস না তো।”
তীর্থ বিরক্ত হয়ে বললো,
—” ঢং না করে নাম। কাঁকড়ার মতো ঝেঁকে বসে আছিস কেন? এমন ভাব করতেছিস যেন একঘন্টায় তুই ভার্সিটি টপার হয়ে যাবি। পরীক্ষা বহুত দিতে পারবি। পড়ার জন্যও সারা রাত আছে। সো এখন প্রেম কর যা। ওই দিকে তাকা।”
রোজা তীর্থর দৃষ্টি অনুসরণ করে ডানদিকে তাকালো। ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নদীর পাশে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়। ধূসর রঙের শার্টে বেশ লাগছে তাকে। রোজাকে নামতে না দেখে বাইকটা বামদিকে খানিকটা কাঁত করে দিলো তীর্থ। চমকে উঠে নেমে দাঁড়ালো রোজা। ফিসফিস করে বললো,
—” উনি এখানে কেন? আর আমরাই বা এখানে কেন?”
তীর্থ বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
—” তোর লগে হানিমুন করতে আসছে। গাধী! তোর সাথে কথা বলবে বলে এসেছে। এমন ভাব করতাছিস যেন….”
রোজা রাগ নিয়ে বললো,
—” একদম বাজে কথা বলবি না।”
কথাটা বলে একটু থামলো রোজা। একবার মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে তীর্থর বাম হাতটা চেপে ধরে বললো,
—” আমাকে একা ফেলে কই যাস? এই তুই আমার দোস্ত?”
তীর্থ দুঃখী দুঃখী গলায় বললো,
—” আমার মতো বন্ধু দুনিয়া ছাইকা পাবি? আহারে! তোগোর প্রেমের কথা চিন্তা করে আমার সাত সাতটা জানটুসরে কোরবান কইরা দিলাম। অন্যকেউ হলে দিতো? যাহ্ তো, দহন বাড়াইস না আর। ”
কথাটা বলেই বাইক ছুটিয়ে রাস্তার বাঁকে হারিয়ে গেলো তীর্থ। ততোক্ষণে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে মৃন্ময়। তাই বাধ্য হয়েই এগিয়ে গেলো রোজা। সামনা-সামনি দাঁড়াতেই হালকা হেসে প্রশ্ন করলো মৃন্ময়,
— ” কেমন আছেন মিস.রোজা।”
রোজা হালকা হাসলো। মৃন্ময়ের কন্ঠে জড়তার লেশমাত্র নেই। কাল সকালেই যে এতো এতো প্রেমময় কথা বলে গেলো তা যেন তার মনেই নেই। অথচ, রোজা? অস্বস্তিতে নিঃশ্বাসটাই বন্ধ হয়ে আসছে তার। মৃন্ময়ের সাথে কয়েক পা এগিয়ে গাড়ির অপর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো তারা। এখানে দাঁড়ালে রাস্তা থেকে সহজে দেখা যাবে না তাদের। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়াতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো মৃন্ময়,
—” আমার উত্তরটা?”
রোজা মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—” জি?”
মৃন্ময় শান্ত গলায় বললো,
—” কাল যা বললাম তার উত্তর জানতে চাইছি রোজা।”
রোজা হাসার চেষ্টা করে বললো,
—” আপনি সিরিয়াস ছিলেন নাকি? আমি ভেবেছিলাম মজা করেছেন।”
মৃন্ময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। শক্ত গলায় বললো,
—” আমি যে এমন টাইপ মজা করি না তা আপনি খুব ভালো করে জানেন রোজা। উত্তরটা দিন।”
রোজা এবার দমে গেলো। জিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
—” দেখুন মিষ্টার.মৃন্ময়, আপনার আর আমার মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। কোথায় আপনি আর কোথায় আমি। আমি এমন একজনের সাথে নিজেকে জড়াতে চাই যাকে নিয়ে আমার মনে ভয় কাজ করবে না। আমি বিশ্বাস করতে পারবো যে, সে আমার হাতটা সারাটা জীবন আঁকড়ে ধরে রাখবে। কখনো ছেড়ে যাবে না। আর মাঝপথে তো কখনোই না। কিন্তু আপনার সাথে জীবনটা ভাবতে গেলে ভয় হয়। আমি যেভাবেই চলাচল করি না কেন দিনশেষে আমি একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। খুবই সাধারণ আমার জীবনযাপন। আজ হয়তো আমার সাধারণ জীবনটা আপনার ভালো লাগছে কিন্তু কাল কি লাগবে? আপনারা অন্য জগতের মানুষ যাদের কাছে পছন্দ হওয়া আবার ছুঁড়ে ফেলা সবই প্যাশনের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমাদের জন্য তা নয়। আমাদের সমাজে বাঁচতে হয়। কাল যদি আপনার মন ভরে যায় আর আমাকে ছুঁড়ে ফেলেন তাহলে এই সমাজে আপনার কিচ্ছু হবে না। দু-একদিন খবরের কাগজে হেড লাইন হবেন তারপর সব স্বাভাবিক। কিন্তু আমি? আমাকে তো মরে মরেই বাঁচতে হবে। তাছাড়া, মিডিয়া জগতের হিরো হিরোইনদের বিয়ে, ডিবোর্স তো কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আমাদের মতো মেয়েদের জন্য তা বিরাট ব্যাপার। একটা বিয়ে যেমন একটা পরিবার গড়ে তুলে ঠিক তেমনে ভেঙে তছনছ করে দেয়। আপনার আমাকে ভালো লাগাটা শুধুই এট্রাকশন ছাড়া কিছু নয়। দু’দিন পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাকে আর ভালো লাগবে না আপনার। আমার থেকে বেটার কাউকে পেলে তার প্রেমে পড়াটা আপনাদের জন্য অন্যায়ও হবে না। হুমায়ুন আজাদের একটা উক্তি আছে —–” মানুষের জীবনে প্রথম,দ্বিতীয়, তৃতীয়,চতুর্থ প্রেম বলে কোনো কথা নেই। মানুষ যখনই প্রেমে পড়ে সেটাই তার প্রথম প্রেম।” এই কথাটা আপনাদের মতো মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। আমাদের জন্য তা ধোঁকা,কষ্ট আর পরাজয়। আসলে আপনাদের জীবনের রুলসগুলোই এমন…. মুক্ত। আপনার তো আর মেয়ের অভাব হবে না। কতো শত সুন্দরী মেয়ে আপনার পেছনে ঘুরে। তাদের মাঝে আমি তো কিছুই নই। বাবা কখনো সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কিছু চাইতে শেখায় নি আমায়। আর আপনি আমার সামর্থ্যের থেকেও অনেক উপরে। মনের ভুলে আপনাকে চেয়ে ফেলাটাও অন্যায় আমার জন্য। আমি বরং আমার ক্যাটাগরির কাউকে খুঁজে নেব মিষ্টার.হিরো। ভালো থাকবেন।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে ফেরার জন্য পা বাড়ালো রোজা। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে তার। বুকটা এতো ভারি লাগছে কেন? মন কেন সামর্থ্যের বাইরে হাত বাড়াতে চায়? এতোটা লোভী কেন তার মন? রোজা জোরে একটা শ্বাস টেনে নেয়। নাহ্ কাঁদবে না সে। ভুলটা যেহেতু মনের ছিলো মনই কাঁদুক,শরীর নয়। এই রহস্যময় পৃথিবীতে দুর্বলদের ঠাঁই তো কেবল পায়ের তলায়। সে তো দুর্বল নয়। বাবা তাকে দুর্বল হতে শেখায় নি। কখনো না। রোজার ভাবনার মাঝেই ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো কেউ। রোজা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। মৃন্ময়ের টলমলে চোখদুটো দেখে আৎকে উঠলো । দ্রুত চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো রোজা। মৃন্ময় কাঁপা গলায় বললো,
—” আমি তোমায় ভালোবাসি রোজা। আমার সেলিব্রিটি হওয়াটা আমার অপরাধ হতে পারে না রোজা। এই একটা কারণে তুমি আমাকে এভাবে অবিশ্বাস করতে পারো না। আমার সেলিব্রিটি হওয়ার পেছনে আমার হাত ছিলো না। এটা আমার নিয়তি… সেই দোষে আমি আমার ভাগের ভালোবাসাটুকুও পাবো না? এটা কি আমার ওপর অবিচার নয়?”
রোজা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত গলায় বললো,
—” আপনার ভালোবাসার অভাব পড়বে না মিষ্টার.হিরো। আপনি একবার বললে কত শত রূপবতীর লাইন লাগবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ থাকবে রূপে,গুণে অনন্য। তাদের সামনে আমার মতো হাজারটা রোজাকে ভুলে যাবেন আপনি। আমি কারো বেস্ট অপশন হতে চাই। যার কাছে আমিই হবো ফার্স্ট এন্ড লাস্ট অপশন। আমি আপনার বেস্ট অপশন কখনো হতে পারবো না। আর না পারবো হাজার মানুষের ভীরে পড়ে থেকে নিজের আত্মসম্মান খোয়াতে। আসছি!”
রোজা দ্রুত হাঁটছে। মৃন্ময় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোজার হেলেদুলে চলা সেই লম্বা বেনুনি আর বাতাসে উড়া আঁচলটির দিকে। এই দীর্ঘ জীবনে আজই চোখদুটো ভিজে আসছে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে ছোট্ট বেলার কথা। বাবা-মা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর মাঝরাতে জেগে উঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কথা। অন্ধকার রাতে ছোট্ট মৃন্ময় আপন কারো হাত চেপে ধরার আশায় এদিক ওদিক তাকাতো। কিন্তু পৃথিবীতে একা পড়ে যাওয়া এতিম বাচ্চাটি কখনোই একটা বিশ্বাসের হাত খুঁজে পেতো না। হাজার মানুষের চোখে সহানুভূতি দেখতো কিন্তু কারো চোখে ভালোবাসা দেখতো না। মৃন্ময় এখনও আগের মতোই একা,এতিম। পার্থক্য শুধু এই, আগে কাঁদতে পারতো এখন আর পারে না। আচ্ছা? আশেপাশের মানুষগুলোর মতো ভালোবেসে না হোক একটু সহানুভূতির দোহাই দিয়েও কি থেকে যেতো পারতো না রোজা? মৃন্ময়ের গাল বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। দ্রুত চোখ মুছে নেয় মৃন্ময়। গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটিয়ে বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসলো। গাড়িতে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বেদনাভরা হাসি নিয়ে বিরবির করতে লাগলো সে,
—-” তোমার কাছে আমার অনেক অভিযোগ আছে বিধাতা। অনেক! আমার ভাগ্যে একফোঁটা ভালোবাসা না রাখার অভিযোগ। পৃথিবীতে একদম একা করে এই দীর্ঘ জীবনটা কাটিয়ে নেওয়ার অভিযোগ….”
মৃন্ময়ের চোখ টলমল করে উঠলো। সাথে সাথেই বেজে উঠলো ফোন। আবারও মুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন তুললো সে,
—” আসসালামু আলাইকুম, হ্যালো?”
—” আদাব দাদা। প্রদীপ বলছি। কই আপনি দাদা? আজ তো রেকর্ডিং ছিলো।”
মৃন্ময়ের চেচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,” ভেসে যাক দুনিয়া। যা হয় হোক। গাইবো না আর গান।” কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো সে। শান্ত গলায় বললো,
—” আসছি প্রদীপদা। আধাঘন্টা ওয়েট করতে পারবে না?”
প্রদীপ হাস্যোজ্জল কন্ঠে বললো,
—” কি যে বলেন না দাদা। আপনি বললে সারাদিনই ওয়েট করতে পারবো।”
_____________
আরু আড়চোখে বারবার রাফিনের দিকে তাকাচ্ছে। হুট করেই কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। গায়ে বাসার ড্রেস সাথে ওড়নাটিও নেই। রাফিনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করার পর জায়গাটা পরিচিত লাগতে লাগলো আরুর। আৎকে উঠলো সে। চোখে-মুখে ভয় ফুঁটে উঠলো তার। রাফিনের শার্টের কোণা টেনে আতঙ্কিত গলায় বললো,
—” আমি সোনাপুকুর যাবো না। ব বাসায় যাবো।”
এই প্রথম নিজে থেকে কথা বললো আরু। রাফিন বার কয়েক আড়চোখে তাকিয়েই বলে উঠলো,
—” কি হয়েছে আরু? ভয় পাচ্ছো কেন? ওখানে তোমার ভাইয়া,ভাবি,বাবা সবাই আছে। তুমি তো তাদের ভালোবাসো তাহলে?”
আরু জেদ ধরা গলায় বললো,
—” নাহ। যাবো না। কিছুতেই না। বাসায় যাবো। বাসায় নিয়ে চলেন আমায়। ওখানে যাবো না আমি। যাবো না।”
রাফিন ড্রাইভ করতে করতেই একহাতে আরুকে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—” পাগলী। এমন করছো কেন? দেখবে তোমার ফ্যামিলি তোমায় পেয়ে অনেক খুশি হবে।”
আরু মৃদু গলায় বললো,
—” উহুম। আমি গেলেই ক্ষতি হবে ওদের। ভাইয়া বলেছে আমি অপয়া,অলক্ষ্মী….”
রাফিন আদুরে গলায় বললো,
—” কখনো না। আমাদের আরু কখনো অপয়া হতে পারে না। কখনো নয়। শান্ত হও প্লিজ।”
আরু শান্ত হয় নি। ছটফট করতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে ছটফট ভাবটা বাড়ে বৈ কমে না। আরো আধাঘন্টা পর আরুদের বাড়ির সামনে গিয়ে থামে গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে জোর করেই আরুকে কোলে তুলে নেয় রাফিন। আরু ভয়ে রাফিনের কলার আঁকড়ে ধরে সিঁটিয়ে থাকে বুকে। রাফিন বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই অবাক চোখে তাকায় আরিফ-লিনা। বাইরের খোলা রান্না ঘরে রান্না করছিলো লিনা। আর আরিফ এটা ওটা এগিয়ে সাহায্য করছিলো তাকে। রাফিনের কোলে নেতিয়ে পড়া আরুকে দেখে আৎকে উঠলো লিনা। ভারি শরীরটা নিয়ে চট করে উঠে দাঁড়িয়েই আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করলো,
—” কি হয়েছে আরুর? কি করেছেন ওকে? মেরেছেন?”
আরিফ কিছু বলছে না। চুপচাপ একটা কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সে। লিনা দৌড়ে গিয়ে আরুর ডানহাতে হাত রাখলো। আরু হাত সরিয়ে নিয়ে রাফিনের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। রাফিন এক পা পিছিয়ে গিয়ে আরুকে কোল থেকে নামালো। আরিফ একদৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আরুর দৃষ্টি অস্থির। রাফিনের বামহাত চেপে রাফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে। সবাইকে চুপ থাকতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে কথা শুরু করলো রাফিন,
—” আরু নিজেকে ভয় পাচ্ছে। ওর ধারনা ও আপনাদের কাছে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে আপনাদের। ওকে নাকি ওর ভাই বলেছে সে অপয়া,অলক্ষ্মী।”
আরিফ অবাক চোখে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” আমি?”
রাফিন শান্ত গলায় বললো,
—“হ্যাঁ আপনি। আপনাদের ও এতোটাই ভালোবাসে আর আপনাদের নিয়ে এতোটাই ভাবে যে ওর হ্যালুসিনেশন হয়। আর প্রতিবার হ্যালুসিনেশনে আপনি ওকে এই কথাগুলোই বুঝান। যা ও মেনেও নেয়। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার সুইসাইডের চেষ্টাও করেছে সে। আমি আরুকে ভালোবাসি। আমি চাই ও ভালো থাকুক। আর ওর ভালো থাকার মেডিসিনগুলো আপনারা। আমি একরকম জোর করে,মিথ্যে বলে বিয়ে করেছিলাম ওকে। তার একমাত্র কারণ ছিলো হসপিটালে আপনার বলা কিছু কথা। আমার অপমানবোধটা এতোটাই বেশি ছিলো যে আরুর কষ্টটা চোখে পড়ে নি। দোষগুলো যেহেতু আমার সেহেতু আপনাদের রাগগুলোও আমার ওপর থাকাই উচিত। আপনারা প্লিজ ওকে আগের মতোই আগলে নিন। একমাত্র আপনারাই পারেন ওর ভয়টা দূর করতে। প্লিজ।”
রাফিনের কথার মাঝেই এগিয়ে এলো আরিফ। বোনের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আদুরে গলায় বললো,
—” বনু? কাছে আয়, ভাইয়া ডাকে।”
আরু ফুঁপিয়ে উঠলো। টলমলে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। আরিফ মুচকি হেসে আবারও বললো,
—” ছুটে আয়। ভাইয়া ডাকে তো।”
আরু রাফিনের হাত ছেড়ে দিয়ে দ্বিধাভরা পায়ে এগিয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে আরিফের চোখের দিকে তাকালো। নাহ্ আজ চোখদুটো অনুভূতি শূন্য নয়। আজ চোখদুটোতে আছে একরাশ মমতা। আরু সাহস পেলো। ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ভাইয়ের বুকে। লিনাও মৃদু হেসে হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। বড্ড রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা!
# চলবে,

#part_46
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943516519831809/

#part_44
https://m.facebook.com/groups/459470204903112/permalink/943515636498564/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here