#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ২৩

0
564

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ২৩
#লিখা_তানজিলা

-“বন্ধু! সীমান্ত শিকদারের বন্ধু হওয়া এতোটাও সহজ না! আপনার উপদেশ আপনি বরং নিজের জন্যই রাখুন।”
সীমান্তর ঠান্ডা গলায় বলা কথাগুলোর বিপরীতে রিয়াদের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। যেন সীমান্তর এরূপ কথায় অভ্যস্ত সে। বরং সে সীমান্তর শক্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আরও বলে উঠলো,
-“এতো কথার ফাঁকে যে প্রশ্নটা করতে চেয়েছিলাম সেটাই করা হলো না।”
-“অনেক বলেছেন আর না!”
-“এটাই শেষ স্যার! এরপর আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করবো না!”

সীমান্তর বিরক্ত লাগলেও রিয়াদের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে বুকে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়ালো ও। রিয়াদ বললো,
-“গত দুইমাস যাবৎ আপনাদের বাড়ির সামনে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি আমি। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে!”

সীমান্ত নির্লিপ্ত গলায় বললো,
-“আপনাকে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না! আপনি বরং আজ নিজের বাড়ি যান। ছুটি যেহেতু নিয়েছেন আমার সাথে ঘুরে সেটা নষ্ট করবেন না!”
রিয়াদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাথে সাথেই বাইক স্টার্ট করলো সীমান্ত। ও জানে বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আইজার মামা। আইজা যদি তার সাথে দেখা করতে চাইতো তাহলে হয়তো নিষেধ করতো না সীমান্ত। কিন্তু আইজা নিজেই সে লোকের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। তাই সীমান্তও এ ব্যাপারে আইজার সাথে কোন কথা বলেনি।

বাইক রাইডিং বরাবরই প্রিয় সীমান্তর কাছে। ইদানিং তো আইজা সাথে থাকায় শান্তিতে থাকা দায়। মেয়েটার জন্য বাইকের স্পিড বেশ কম রাখতে হয় ওকে। নইলে চিৎকার চেচামেচি করে মাথাটাই খারাপ করে ফেলে। তবে এই মুহুর্তে সে বাঁধা নেই। আজ মনের স্বস্তিতে ঘুরবে ও!

***
আজ দিনে প্রায় চার বার কফি খাওয়া হয়ে গেছে আইজার। তাও যেন মন ভরছে না। একটু পর পর শরীর সিগনাল দিচ্ছে কফি তার চাইই চাই। তাই এই মুহুর্তে পঞ্চমবারের মতো কফির মগ নিয়ে বসেছে ও। সাথে পাস্তা। এই দুটো যেন এখন ওর কাছে পারফেক্ট কম্বিনেশন। সারাদিন আর কিছু খাওয়া হয়নি ওর।

সময় এখন রাত নয়টা! আজও বাড়ির মেইন গেটের সামনে কালো রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। গত দুই মাস যাবৎ একই সময়ে গাড়িটা এখানে চলে আসে আর রাত বারোটার দিকে চলে যায়। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো আইজার মুখে। ওর মা বেঁচে থাকতে একবারও খোঁজ নেননি তিনি। আইজার মা নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলো বলে না-কি তার এতো রাগ জমে ছিলো। রাগ না ছাই! মানুষটা মরে যাওয়ার পর এখন ওদের জন্য পরান জ্বলছে!

আজ বাড়িতে তেমন কেউ নেই। নাজিম শিকদার এসময় অফিসেই থাকে। সীমান্ত সচরাচর বাড়িতে থাকলেও আজ তার কোন খবর নেই। ফিহা কয়েকদিন যাবৎ নিজের কোন ফ্রেন্ডের বাড়িতে ঘুরছে। কাল তার বাবা আর বড় বোন দেশে আসবে। তারা সোজা এ বাড়িতেই উঠবে। তখন ফিহাও আসবে তাদের সাথে। বলতে গেলে এই মুহুর্তে অর্ধেক রাস্তা ক্লিয়ার।

রাজিয়া আজ সকালে ছুটি নিয়ে নিজের বাড়ি গেছে। বাকি আছে পাখি। সে এসময় বাইরে থাকা গার্ডদের জন্য কফি তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢুকলো। পাস্তা শেষ করেই কফির মগ নিয়ে উঠে পড়লো আইজা। কফিটা এমনিই ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার গরম করে খাবে। আগে কফির প্রতি এতোটা নেশা আইজার কখনও ছিলো না। ইদানিং কী যে হলো বুঝতে পারছে না ও। কফির মগটা রেখে মাথার একপাশ চেপে ধরে একটা চিরকুট পাখির হাতে ধরিয়ে দিয়ে আইজা বললো,
-“মাথাটা ব্যথা করছে খুব! বাইরে গার্ডদের একজনকে এটা দিয়ে এসো। আমার এক্ষুনি এই মাথা ব্যাথার টেবলেটগুলো চাই!”

পাখি আইজার কন্ঠ শুনে চুপসে থাকা মুখ নিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে চলে গেলো। মেয়েটা প্রচন্ড ভীতু। পাখি চলে যেতেই আইজা উপরের কেবিনেটে লুকিয়ে রাখা কফি জার টা বের করলো। যেটা রায়হান এনেছিলো। সেই কফি জার থেকে দ্রুত পাখি যে কফি জার বের করে রেখেছে ঐ কফি জারের মধ্যে বেশ কিছু কফি অথবা কফির সাথে মেশানো বস্তু মিলিয়ে দিলো আইজা। পরক্ষণেই রায়হানের আনা কফি জারটা আগের জায়গায় রেখে দিলো।

ফার্মেসির দোকান এখান থেকে বেশ দূরে। এক ঘন্টা তো লেগেই যাবে। আইজা এবার নিজের কফিটা গরম করে ড্রইং রুমে বসে পড়লো। আজ ও ড্রইংরুমের বেশ চমৎকার ডেকোরেশন করেছে। তবে সীমান্ত যদি আজ বাড়িতে দেরি করে আসে তাহলে এই ডেকোরেশনের কোন আনন্দ পাবে না আইজা।

পাখি ততক্ষণে এসে বাইরের গার্ডদের ঐ কফি দিয়ে আসলো। বিষয়টা লক্ষ্য করতে করতে আইজার কফিটা আবারও হালকা ঠান্ডা হওয়ার পথে। ধুর! আর গরম করার ইচ্ছে নেই ওর। এভাবেই কফি খাবে!

কিছুক্ষণ পর পাখি বেরিয়ে গেলো তার বাড়ির উদ্দেশ্য। আইজা একটু পর পর বাইরে নজর রাখছে। কফির সাথে মেশানো বস্তুর রিয়াকশন হতে বেশি সময় লাগে না।

-“একদিনে এতো কফি খেলে শরীর খারাপ করবে! সকালেই তিন কাপ খেতে দেখলাম আপনাকে!”

হঠাৎ সীমান্ত কোথা থেকে এসে আইজার হাত থেকে কফিটা কেড়ে নিতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ও। কর্কশ কন্ঠে বললো,
-“আপনি কবে থেকে এসবে নাক গলানো শুরু করলেন? একেতো আটকে রাখছেন! এখন কী কফি খেতেও বারণ করবেন!”

সীমান্ত এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“আপনাকে কে আটকে রেখেছে! পুরো বাড়িতে তো টই টই করে বেড়ান!”

আইজা মুখে কিছু বললো না। এইতো সুযোগ পেয়েছিলো নিজের প্ল্যান অনু্যায়ী যাওয়ার কিন্তু সীমান্ত চলে এলো। যদিও বাইরে গার্ডগুলোর মধ্যে এখনো কোন রিয়াকশন দেখা যায়নি। নইলে ধরা পড়তো। সীমান্তর মনে এখনই সন্দেহ জাগলে সব প্ল্যান শেষ!

আইজা হুট করে শক্ত হাতে সীমান্তর বাহু চেপে ধরতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো সীমান্ত। আইজার তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ও সীমান্তকে টেনে ড্রইংরুম পর্যন্ত নিয়ে গেলো। সীমান্ত আইজার থেকে হাত ছাড়িয়ে ড্রইংরুমে এককোণে নিজের ফোন চার্জিং এ বসিয়ে বললো,
-“কী করার চেষ্টা করছেন আপনি…!”
-“একদম চুপ! কোন কথা না!”
সীমান্তর ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো আইজা। যদিও ওর এ ব্যবহারে সীমান্তর মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। ধীর গতিতে আইজার আঙুল নিজের ঠোঁট থেকে সরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। এক কদম ফেলেছিলো হয়তো। আইজা আবারও টেনে ধরলো সীমান্তর হাত। সীমান্ত বিরক্তি নিয়ে পেছনে ঘুরে তাকাতেই তার দিকে মোলায়েম চাহনি নিক্ষেপ করে উল্টো পাশের সোফায় নিয়ে বসালো আইজা। সীমান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“কী বলবেন দ্রুত বলুন। আমার সময়…!

সীমান্ত কথা শেষ করার আগেই আইজা হুট করে তার কোলে বসে পড়লো। বলতে গেলে ওখানেই চেপে ধরলো সীমান্তকে।
সীমান্তর বিস্মিত মুখখানায় তৎক্ষনাৎ সন্দেহের রেখা এসে জড়ো হলো। রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনাকে আগের থেকে অনেক ভারী মনে হচ্ছে! উঠে পড়ুন নইলে হয়তো আমার পা ভেঙে যাবে!”
সীমান্তর কথায় মুহূর্তের জন্য আইজার দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতার রেশ ফুটে উঠলেও পরক্ষনেই নিজেকে সামলে ও বললো,
-“ভাঙলে ভাঙুক। এটাই তো আমার প্ল্যান! আপনার পা ভেঙে আমি এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো!”
এরপর সীমান্তকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না আইজা। সোজা তার বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,
-“একটু এভাবে থাকতে দিন তো! সকালে রাগের মাথায় আপনার কাবার্টের সব কিছু জ্বালিয়ে তো দিলাম। এখন আমার ভালো লাগছে না! ঐ বিশ্রি পোড়া দুর্গন্ধ এখনো আমার নাকে লাগছে। আপনি আমার প্রিয় শাড়িটা কেন ফেলতে গেলেন!”

আইজার কথাবার্তার কোন মানে খুঁজে পাচ্ছে না সীমান্ত।
-“মাথা কাজ করছে আপনার?”

-“একদম না! বিন্দুমাত্র কাজ করছে না মাথা! আজ আমার নিজের সীমা অতিক্রম করতে ইচ্ছে করছে!”
মিহি কন্ঠে বললো আইজা। সাথে সীমান্তর বুকে এক হাত রাখলো ও। আইজার হাত টা নিজের বুকের ওপর লক্ষ্য করতেই এক ধাক্কায় সরিয়ে ফেললো সে। কিন্তু আইজা থেমে রইলো না। সাথে সাথে আবারও একই জায়গায় হাত রেখে দিলো ও। তবে এবার হাত টা এক জায়গায় স্থির হয়ে রইলো না। বুক থেকে বাহু অব্দি ধীর গতিতে বিচরণ করছে আইজার হাত।
সীমান্ত এবার নিজের কাছ থেকে আইজাকে সরাতে গিয়েও হুট করে থেমে গেলো। ঘোর লেগে থাকা দৃষ্টি আইজার চোখ জোড়ার দিকে গিয়েই আটকে গেলো। এই নিস্তব্ধতায় উপভোগের রেখা ফুটে উঠেছে সে চাহনিতে। আইজার স্পর্শে যেন তার তৎক্ষনাৎ হিতাহিত বোধ হারিয়ে গেছে। সীমান্তর এক হাত আইজার কোমরে গিয়ে থেমে গেলো। আরেক হাত আইজার দখলে। সীমান্তর মোহনীয় আঁখি জোড়ায় নজর রেখে ক্রমাগত তার শুকনো ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আইজা। আনমনেই বন্ধ হয়ে এলো সীমান্তর আঁখি জোড়া।

হঠাৎ আইজার হাত ছাড়াও নিজের হাতে অন্য কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই ক্লিক করে একটা শব্দ শুনতে পেলো সীমান্ত। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো ও। কয়েক সেকেন্ডেই বেশ খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালো আইজা। ঠোঁটের কোণে বিঁধে আছে ক্রুর হাসি। দুইমাস আগে গাড়িতে যে হ্যান্ডক্যাপ সীমান্ত আইজার হাতে পড়িয়েছিলো সেটা দ্বারা এইমুহুর্তে সীমান্তর হাত বাঁধা!

-“আইজা!!!”

সীমান্তর চিৎকারে আইজার কানগুলো যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ও নিজের দুই কানে আঙুল দিয়ে বসলো।

সীমান্ত আইজার দিকে ক্রোধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সোফা থেকে দাঁড়াতেই খেয়াল করলো সোফা থেকে কিছুদূর থাকা পিলারে বেশ মজবুত ছোট সাইজের শিকল বাধা। আর তাতে সেট করা ওর হাতে আটকে রাখা হ্যান্ডক্যাপ। আইজা বেশ নিখুঁতভাবে সেগুলোর অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখেছিলো!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here