#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৩

0
587

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৩

#মিদহাদ_আহমদ

মা গল্পের হাতে ধরলেন। তারপর গল্পকে বললেন,

‘জানো আজ কে এসেছে নানুভাই?’

‘কে?’

‘ওইযে একটা ছবি দেখে তুমি বলতে না ওই সুন্দর মেয়েটা তোমার কে হয়? আমি কী বলতাম তখন?’

‘ওই মেয়েটা? ওইযে যার লম্বা লম্বা চুল, ইয়া মোটা মোটা চোখ ওই মেয়েটা?’

‘হ্যাঁ নানুভাই। ওই মেয়েটাই।’

‘ওই মেয়েটা কি আমার আম্মু হয়?’

এবার শাশুড়ি এগিয়ে গেলেন। গল্পকে বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই মেয়েটাই তোমার আম্মু হয়।’

গল্প এবার ননাসের দিকে ফিরে তাকালো৷ ননাসের চোখে চোখ রেখে কী যেনো সে অনুধাবন করলো। তারপর ননাসের আঙুল ধরে আমার গল্প বলতে লাগলো,

‘এইতো আমার আম্মু৷ এইতো আমার আম্মু৷ নানুভাই তুমি কি আমার জন্য মিত্তি মিত্তি পায়েস রান্না করেছো? আমি পায়েস খাবো। আমি পায়েস খেয়েই ছবি আঁকতে বসে যাবো৷ আজ আমার অনেক ছবি আঁকতে হবে। তুমি আমাকে হেল্প করবে মা?’

ননাস জড়িয়ে ধরে গল্পকে বললো,

‘হ্যাঁ মামুণি৷ মা তোমাকে পুরো রাত জেগে থেকে হেল্প করবে। এক্সিবিশনে আমার মামণিকেই ফার্স্ট হতে হবে। তাইনা?’

‘ইয়েস মামুণি।’

‘আচ্ছা মামুণি, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার আছে।’

‘কী সারপ্রাইজ মামুণি?’

‘ওইযে আমি তোমাকে গল্প বলি না? রাজকন্যার গল্প? রাজার মেয়ের গল্প?’

‘ওই গল্প না, যে গল্পে সব সময় ছোট্ট রাজকন্যা বিপদে পড়ে?’

‘হ্যাঁ মামুণি। ওই গল্পই। তারপর ওই গল্পে একজন আম্মু এসে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে দেয় না সব সময়? কিন্তু কখনো সামনে আসে না?’

এবার গল্প কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। তাকালো এদিক ওদিক। উপরের দিকে তাকাতেই আমাকে আর আসিফকে দেখতে পেলো গল্প। ননাস গল্পকে বললো,

‘ওই গল্পে রাজকন্যাকে এসে যে আম্মু বাঁচিয়ে নিতো সব সময়, সেই আম্মুকে তুমি দেখতে চাও?’

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো গল্প। তারপর আস্তে আস্তে তানিয়ার কাছে গিয়ে বললো,

‘সেই আম্মু কোথায়? আর ওইযে আমার আব্বু না? যাকে ছবিতে আর ভিডিও কলে দেখতাম?’

তানিয়া এবার গল্পের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। গল্পকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে আমার দিকে তাক করে বললো

‘এই হচ্ছে তোমার আম্মু। গল্পে যে আম্মু এসে তার রাজকন্যাকে বাঁচিয়ে নিতো সব সময়, সেই আম্মুই আজ তোমার সামনে চলে এসেছে।’

আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার চোখ ভিজে জল টলমল করছে। আসিফও আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে হাতে। ননাসকে গল্প বললো,

‘উনি তো আমার আন্টি। তাইনা মামনি? উনি রোজরোজ আমাকে কল করতেন তাইনা? ভিডিও কল দিতেন। আন্টি আন্টি, তুমি বলেছিলে আসার সময় আমার জন্য কালার পেন্সিল আর চকোলেট আনবে। এনেছো তো? জানো আন্টি, মামুনি আমাকে অনেক অনেক কালার পেন্সিল কিনে দেয়৷ কিন্ডারজয় কিনে দেয়। আমার পছন্দের পিৎজা খাওয়ায় সব সময়। আর নানুভাই আমাকে মিত্তি মিত্তি পায়েস করে খাওয়ায়।’

আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জড়িয়ে ধরলাম গল্পকে। গল্পও কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর গল্পকে তার বাবা এসে ধরতেই গল্প নিজ থেকে তার বাবাকে আকড়ে ধরলো। আর বলে উঠলো,

‘বাবা বাবা। আমি অনেক মিস করেছি তোমাকে। অনেক।’

এক হাতে গল্প তার বাবাকে আর আরেক হাতে ননাসকে ধরলো। তারপর গল্পের মুখে সে কী খুশি! সদ্য দুধদাঁত হারানো চোয়াল খালি চেয়ারায় অদ্ভুত মায়াবি লাগছে মেয়েটাকে। ননাস তার হাত ছাড়িয়ে গল্পের হাত আমার হাতে তুলে দিলো৷ গল্প আমাকে আর তার বাবাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ননাসকে। ননাস গল্পকে রেখেই তার রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি উপরে উঠে এসে গল্পের হাত ধরে বললেন,

‘দেখি দেখি তোমরা কী এনেছো আমার গল্পের জন্য? দেখি তো৷ দেখাও।’

আমি, আসিফ, গল্প, শাশুড়ি মা আমাদের রুমে ঢুকলাম। গল্পকে তার বাবা খাটে বসালেন৷ গল্প তার বাবাকে বললো,

‘তুমি আমার বাবা না? আমি কতো মিস করেছি তোমাকে। জানো মা বলেছে যে তুমি একদিন ঠিকই আসবে।’

তারপর গল্প তার দাদির দিকে চেয়ে বললো,

‘তাইনা দাদুভাই?’

‘হ্যাঁ দাদুভাই৷ তোমার আব্বু আম্মু সব এসেছে ‘

আমি ব্যাগ খুকে চকোলেটের বেশ কয়েকটা বড় বড় প্যাকেট বিছানার উপর ঢেলে দিলাম৷ বড় টেডি বিয়ারটা বিছানার নিচে রাখলাম। গল্প আমতা আমতা করে বললো,

‘এত্ত চকোলেট! এগুলো সব আমার জন্য?’

‘হ্যাঁ মা সব তোমার জন্য।’

‘আর ওই টেডিটা? ওইটাও কি আমার?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। টেডিটাও তোমার মা।’

‘আর পেন্সিল এনেছো? রেড, ইয়েলো, ভায়োলেট,গ্রিণ কালারের?’

আমি এক ব্যাগ রঙ পেন্সিল, ওয়াটার কালার, পোস্টাল কালার তুলে দিলাম গল্পের হাতে৷ গল্পের চোখেমুখে আনন্দ হাসি। গল্প দুই হাতের মুঠোয় কালার পেন্সিল ধরতে ধরতে যে কয়টা ধরতে পারলো, ধরেই এক দৌঁড় দিলো রুম থেকে। আমরা পিছুপিছু গেলাম। দেখলাম গল্প ননাসের রুমের দিকেই ছুটছে। দরজা লাগানো ভেতর থেকে। সে দরজার বাইরে থেকে ডাকতে লাগলো,

‘মামুণি, মামুণি দেখো এতো এতো কালার পেন্সিল পেয়েছি আমি৷ ওই আন্টি আমাকে দিয়েছে৷ দলজা খুলো তুমি। দেখো।’

ননাস দরজা খুললো। হাত উঁচুতে ধরিয়ে গল্প দেখালো কালার পেন্সিল গুলো। ননাস গল্পকে তার কোলে তুলে নিলো। শাশুড়ি আমাকে নিয়ে রুমে এলেন। মাও রুমে চলে এলো। শাশুড়ি মা আমাকে খাটে বসিয়ে বললেন,

‘জানো নুপুর, এই কয়টা বছর আমাদের কীভাবে কেটেছে? যদি গল্প না থাকতো, তাহলে হয়তো তানিয়া আর তানিয়া থাকতো না। মেয়েটা কেমন জানি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো প্রথমে! তারপর যেনো শক্ত হাতে হাল ধরলো গল্পকে নিয়ে। সারাদিন তার ধ্যান জ্ঞান সব গল্প। খাওয়া দাওয়া সব গল্প। পড়া, গান, খেলা, আঁকা সব যেনো গল্পকে ঘিরেই৷ গল্পই যেনো তার বেঁচে থাকার নতুন অনুষঙ্গ। আর মারে, দোষ আমার। আর কারো না৷ আমিই চেয়েছি গল্পকে তোর থেকে আড়াল করতে। গল্প যেনো আমার মেয়ের সাহারা বনে, আমার মেয়ের জীবন হয়ে উঠে, এইটাই চাইতাম বারেবারে। ‘

এবার আমার মা আমার হাতে নিজের হাত ধরে বললেন,

‘গল্পের বেড়ে উঠায়, তানিয়ার যেমন হাত, সেই হাত হয়তো তুই নিজেও পারতি না রে মা। তানিয়া গল্পের মা হয়ে উঠেছে তোর মা হয়ে উঠার আগেই।’

এমন সময় তানিয়া আপা রুমে এসে ঢুকলো। আমার পাশে বসে তানিয়া আপা বললো,

‘নুপুর বোন আমার, এই জীবনে আমি অনেককিছু হারিয়েছি৷ আমাকে আর কোনকিছু হারাতে দিস না। আমি গল্পকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি কথা দিচ্ছি, আমি গল্পকে কাছে টেনে না, দূরে থেকেই দেখে যাবো। তবুও আমার গল্পকে আমার থেকে দূরে নিস না।’

তানিয়া আপা তারপর তার ভাইয়ের হাত ধরে বললো,

‘কীরে আসিফ? আমরা একসাথে যখন লুডু খেলতাম, আর আমাকে তামান্না খেয়ে দিতে আসলে তুই আমার গুটি একঘর এগিয়ে নাহয় পিছিয়ে দিতি মনে আছে রে ভাই? তোর বোনকে আগে যেমন জিতিয়ে দিতি, এবারও নাহয় জিতিয়ে দে। তোর বোনটা তার জীবন যুদ্ধে হেরে, তোরই বাচ্চাটাকে নিয়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেছে। তোর বোনটাকে আবার জিতিয়ে দে।’

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ননাস। আমি কোনকিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। এক স্তব্ধতা ভর করেছে যেনো আমাকে। আসিফ আমার দিকে তাকালো। তার এই তাকানোর মানে হয়তোবা আমার মেয়েকে তার বোনের হাতে তুলে দেওয়া! আমার চোখে আর কানে বারবার ভাসতে লাগলো, এই কয়েক বছরে আমি যতোবারই কল দিতাম দেশে, শাশুড়ি আর ননাস মিলে শুধু আমাকে আমার মেয়ের সাথে দেখা করাতেন। কথা না! দূর থেকেই দেখতাম আমার মেয়ে গাইছে, খেলছে, আঁকছে, খুশি করছে। আমি এতেই যেনো খুশি ছিলাম! আমার মাও তো এখানে আসা যাওয়া করতেন। তিনিও আমাকে কিছু বললেন না! একটাবারের জন্যও না? সবাই কি তাহলে আমার নিজের পেটের সন্তানের সাথে নিজেদের সমঝোতা করলো? শেষ পর্যন্ত আসিফও? মেয়েটা আমার তার বাবাকে চিনতে পেরেছে কিন্তু যেই আমি নয়মাস পেটে রেখে তাকে জন্ম দিয়েছি, সেই আমাকে চিনতে পারলো না? এই তাহলে আমার মাতৃত্বের জোর?

আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত শক্ত করে ধরলো। এই ধরার মানে আমি বুঝি। আমি কি আবার চুপ করে যাবো? ভেতর থেকে আমার মাতৃশক্তি যেনো জেগে উঠলো। আমি বললাম,

‘না। কখনো এমন হবে না। আমার মেয়েকে আমি অন্যকারো হাতে তুলে দিবো না।’

শাশুড়ির রুম থেকে বিকট একটা শব্দে কেঁপে উঠলো আমাদের দ্বিতল ভবন। জীবন এক বিশাল মোড়ে যেনো ঘুরে গেলো মুহূর্তেই।

প্রিয় পাঠক লেখাটা পড়বেন প্লিজ। প্লিজ পড়বেন। আজ প্রায় দশদিন লেখা বন্ধ ছিলো কারণ আমি বন্যা দুর্গতদের জন্য ফান্ড রাইজিং এ ছিলাম। নিজেই বন্যার কারণে বাসাছাড়া এখনও। আমি আলহামদুলিল্লাহ মহান আল্লাহর কাছে কারণ আমি আমার লেখালেখির মাধ্যমেই শুধুমাত্র এই গ্রুপ থেকে ফান্ড কালেকশন করেছি। আলহামদুলিল্লাহ দুই লাখেরও বেশি টাকার ফান্ড এই গ্রুপ থেকে কালেক্ট হয়েছে ও ডিস্ট্রিবিউশন হয়েছে। কিছু টাকা হাতে আছে আমার৷ আমার লেখালেখি জীবনে যদি সামনে আরও বড়ো কোন সাফল্য আসে, সব সাফল্যের কাছে আমি অবনত মস্তকে চির কৃতজ্ঞ থাকবো বন্যার সময় আপনাদের দেয়া ডোনেশনের কাছে। আপনারা সবাই আমার লেখালেখি থেকেই আমাকে চিনেন। এতদিন পাবলিকলি আমি আমার বিকাশ নাম্বারটা দেইনি। কিন্তু আজ দিচ্ছি। আপনারা সবাই প্লিজ ডোনেশন করবেন। আমি বড় ধরণের একটা প্রজেক্ট রান করাতে চাই বন্যাদুর্গতদের জন্য। বন্যার ভয়াবহতা কমে গেলেও এর যে রেশ রয়ে গিয়েছে, তার কল্পনাতীত। যারা যারা এতদিন ডোনেশন করেছেন, সবার ডোনেশনের অংক অনেক রিচ ছিলো। আমি বারবার বলি, আমাদের ডোনেশনের টাকাটা আল্লাহ দেখেন না, আমাদের নিয়ত আর মন দেখেন৷ আমার গল্পটা এই গ্রুপেই ডেইলি ৮ হাজার+ পাঠক পড়েন। আপনারা যারাই আজ এই লেখাটা পড়ছেন, আপনারা সবাই প্লিজ পারলে অল্প অল্প কিছু ডোনেশন করিয়েন। বেশি না, ১০০/২০০/৫০০/১০০০ যে যেভাবে পারেন আরকি৷ এই গ্রুপেরই অনেক মেম্বার ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডোনেশন করেছেন সর্বোচ্চ। আল্লাহ আপনাদের সবাইকে ভালো রাখুন। আমি গল্প আবার কন্টিনিউ করবো নিয়মিত৷ আমি অসুস্থ বেশ খানিকটা। তবুও গল্প দিবো। কারণ আমার ফান্ড রাইজিং করতে হবে আরও। আল্লাহ চাইলে আমি এই গ্রুপ থেকেই ফান্ড কালেকশন করে ১/২/৩/৪/৫ যতোটা পারি, ঘর বানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। আমার নেক ইচ্ছা অবশ্যই আল্লাহ পূরণ করবেন ৷ বন্যায় সুনামগঞ্জ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে একেবারে। কোনকিছু অবশিষ্ট নাই আর। আমার বিকাশ নাম্বারঃ

01762095729 (পারসোনাল)

আল্লাহ আমাদের সবার দানকে কবুল করুন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here