#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৪

0
401

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৪

#মিদহাদ_আহমদ

শ্বশুরের রুমে ছুটে গেলাম আমরা সবাই। গিয়ে দেখি তিনি বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছেন। আসিফ আর শ্বাশুড়ি গিয়ে তাকে ধরে বিছানায় তুললো৷ পায়ে বাজেভাবে আঘাত হয়েছে। তানিয়া আপা আর শাশুড়ি গাড়িতে করে শ্বশুরকে হসপিটালে নিয়ে গেলো সাথেসাথে। আসিফ যেতে চাইলে শাশুড়ি না করলেন। বাসায় মাত্র এসেছে৷ শাশুড়ি তাকে রেস্ট নিতে বললেন।

আসিফ সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলো। সিগারেটের প্যাকেটটা সাথে নিলো। আমি রুমে ঢুকে বিষন্ন হয়ে বসা রইলাম খাটের উপরে৷ মা এসে ঢুকলেন৷ আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। মাকে রাগান্বিত গলায় বললাম

‘মা তুমি কি তোমার পেটের মেয়েকে অন্যকারো হতে দিবা? দেখতে পারবা যে অন্যকারো হাতে তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে? আমি কি এসব মেনে নিবো এবার?’

মা বললেন,

‘মারে, তোকে আজ না, এখন না, আজ থেকে কত বছর আগে বলেছিলাম যে ঘরকর্ম কর। সংসার কর। এসবে মন দে। কিন্তু কী করলি তুই? নিজের ঘর, সংসার, সাজানো সবকিছু ছেড়ে চলে গেলি দেশের বাইরে? একমাত্র পেটের সন্তানকে ছেড়ে? আমি আর কী বলবো রে মা। দুনিয়া বড়োই নিষ্ঠুর।’

‘তাই বলে মা আমি এখন আমার নিজের মেয়েকে অন্যের হাতে…’

‘না। অন্যের হাতে কেন হবে? যা নিজের হাতে নেই, তা নিজের হাতে আনতে হবে। এইটাও তো ভুল না গল্প তোর ননাসের কাছে মায়ের আদর পেয়েছে। মিথ্যা বলবো না। আমি তো দেখেছি নুপুর, তোর মেয়েকে তোর ননাস কেমন করে আগলে রেখেছিলো? কারো স্নেহ তো আর ভুল হয় না রে মা। পেটের সন্তান না, যে কোন সন্তান বলেই যদি কোন মহিলা কাওকে আগলে নেয় নিজের কাছে, সেই হয়ে উঠে মা। মা হওয়ার জন্য মাতৃত্ব শুধু থাকা লাগে না। মা হওয়ার জন্য একটা মন লাগে, একটা প্রেম লাগে, একটা নিষ্ঠা লাগে। মায়েরা করকিছু ছাড় দেয় জীবনে! জীবনের ছাড় ছাড়া কি আর মা হওয়া যায় রে মা?’

মায়ের কথা শুনে আমি কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মনে হতে লাগলো পুরো দুনিয়াটাই আমার কাছে অন্ধকার হয়ে আসছে। আসিফ এসে ঢুকলো রুমে। আসিফ মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘মা আপনিই বুঝান এখন নুপুরকে। আর আমার বড় বোনের কোন বাচ্চা নেই। কোন সন্তান নেই। সে তো আমাদের মেয়েকে মাতৃস্নেহে আগলে নিয়েছে নিজের মাঝে। তার দাবীর কাছে তো আমরা এখন কোনকিছু বলতেও পারবো না। মেয়েতো আমাদের সামনেই আছে তাইনা?’

‘কেন বলতে পারবো না? কেন? আমি কি বলেছি তোমার বোন আমার মেয়েকে মাতৃস্নেহ দেয়নি? আমি কি বলেছি আমার মাতৃত্ব শতভাগ ছিলো? আমি কি দাবী করেছি আমার মেয়েকে তোমার বোনের থেকে আলাদা করে দিবো? না করিনি। তাহলে সেক্রিফাইজ আর হেনতেন এসব আমাকে শুনতে হবে কেন? আমাকে কেন এসব সাফার করতে হবে?’

‘নুপুর, নুপুর, নুপুর তুমি শুধু শুধু…’

‘কী শুধুশুধু? আমি শুধুশুধু? আমি বকবক করছি তাইনা? গল্প আমার মেয়ে। গল্প শুধু আমার। আমি আমার জীবন বাজিতে রাখবো তবুও কখনো গল্পকে হাতছাড়া করবো না৷ গল্পের জন্য আমার জীবনের শেষ বিন্দু রক্ত অবধি যদি দিতে হয়, তবে আমি তাই দিবো।

রুমে এমন সময় ধীরপায়ে চুপিসারে এসে ঢুকলো গল্প। গল্পকে দেখেই আমি এগিয়ে গেলাম। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে গল্পকে কোলে নিতেই গল্প আমতা আমতা করে বললো,

‘আমি কর্ণফ্লাক্স খাবো। আমাকে কর্ণফ্লাক্স দিবা?’
‘কেন না মা? আম্মু তোমাকে এক্ষুণি কর্ণফ্লাক্স করে দিচ্ছি৷ তুমি বাবার পাশে বসো একটু।’

গল্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ফ্রেশ না হয়েই পরনের কাপড় পরে রান্নাঘরের দিকে চললো নুপুর। নুপুরের মা মনে মনে বললেন, মেয়েকে এসব বলার পর যদি তার ঘর সংসারে মন বসে, তাহলেই ভালো। নুপুরের মা নাতনিকে কোলে করে নুপুরের পেছন পেছন রান্নাঘরে গেলেন। নাতনিকে নুপুরের দিকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন,

‘দেখো নানুভাই তোমার আম্মু তোমার জন্য কর্ণফ্লাক্স করতে গিয়েছে। তোমাকে তোমার আম্মু কতো আদর করে দেখেছো?’

‘কই? আম্মু তো এখানে নেই। আম্মু কই গিয়েছে নানুভাই?’

গল্পের মুখ থেকে এই কথাটা স্পষ্ট আমি শুনতে পেলাম। আমি কাজের মেয়েকে দুধ বের করতে বেলে চুপিসারে গল্পকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘এইতো আম্মু। আম্মু এসেছি।’

গল্প কেমন জানি নীরব হয়ে গেলো। মা পাশে থেকে গল্পকে বললেন

‘আম্মু এসেছে তো নানুভাই। এই দেখো।’

ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চোখে গল্প আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি আমার আম্মু হও? আমাকে নিয়ে স্যারের ক্লাসে যাবা? সারগাম শেখাতে পারবা আমার মামুণির মতো?’

‘কেন পারবো না মা? অবশ্যই পারবো।’

বাবাকে নিয়ে রাত নয়টা নাগাদ শাশুড়ি আর ননাস বাসায় চলে এলো। পায়ে বাজেভাবে আঘাত লেগেছে। প্লাস্টার করে দিয়েছে ডাক্তার। হুইল চেয়ারে করে শ্বশুর যখন বাসায় এসে ঢুকলেন, গল্প তখন এক দৌঁড়ে তার দাদার কাছে গেলো। ছোট ছোট হাত পা দিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতে লাগলো তার দাদাকে। তারপর আমার ননাসের হাতে ধরে বলতে লাগলো,

‘কী হয়েছে দাদুভাইয়ের? জানো মা, আজ না ওই যে নতুন মা এসেছেন একজন, ইয়া লম্বা আর ডাগর ডাগর চোখের উনি আমাকে নিয়ে অনেক্ষণ খেলেছেন। মিউজিক স্যারের অনলাইনে ক্লাসের পুরোটা সময় আমাকে উনি হেল্প করেছেন। তোমার থেকে ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন উনি। আমার আঙুল ধরে ধরে আমাকে বসিয়ে দিয়েছেন। জানো আমাকে একটুও ব্যথা দেননি। বকাও দেননি। তুমি চলো রুমে। তোমার সাথে আজকের অনেক গল্প বাকি আছে। চলো আম্মু।’

গল্প চোখের সামনে আমার ননাসের হাত ধরে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো। এক পা, দুই পা করে উপরে চলে গেলো। ননাস তার রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। শ্বশুর আমাকে ডেকে বললেন,

‘এবার নাহয় এই বুড়োটার চায়ের একটা রফাদফা হবে৷ তোর শাশুড়ি আমার চায়ের চিনিতে কার্ফিউ বসিয়ে দিয়েছে।’

মা পাশ থেকে বললেন,

‘হয়েছে বেয়াই সাহেব। আমার মেয়েকে দিয়ে চায়ে চিনি মিশিয়ে আবার আমাকে বিপদি বানাইয়েন না।’

শ্বশুর হাসলেন মুখ ভরে। হাসতে হাসতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললেন,

‘আপনি দেখি আমার বউয়ের মতো কথাবার্তা বলছেন। আমার মেয়ে চলে এসেছে। আমার আর কোন চিন্তা নেই।’

‘কীরে মা? কেমন আছিস?’

শ্বশুর যখন আমাকে কীরে মা বলে সম্বোধন করলেন, আমার চোখের কোণে জল চলে এলো। আমার সামনে ভাসতে লাগলো আমার বাবার মুখ। এই একইভাবে আমার বাবাও আমাকে বলতেন, ‘কীরে মা, আজ খাওয়া হলো? আজ পড়া হলো? আজ কি তোর মন খারাপ রে মা?’ এই ডাক, এই আদর, এই আবহ আজ কত বছর হলো আমি শুনি না!
চোখের কোণে জলের আবহ হয়তো শ্বশুর বুঝতে পারলেন। বললেন,

‘হয়েছে এখন জল না। জল না। আসিফের মা আর আসিফের শাশুড়ি, দুজনে মিলে দুজনের মেয়ে জামাই আর আরেকজনের ছেলের বউয়ের জন্য খাবার রেডি করো। আজ জম্পেশ খাবারদাবার হবে। আমাকে কেউ আটকাতে পারবা না।’

শাশুড়ি আমাকে বললেন,

‘নুপুর তুমি শ্বশুরকে নিয়ে রুমে দিয়ে আসো। আমি আসছি তানিয়াকে দেখে।’

আমি শ্বশুরের হুইল চেয়ারের হাতল ধরলাম। মাও আমার সাথেসাথে চললেন। আসিফও চললো সাথে। যেতে যেতে শ্বশুর বললেন,

‘মারে, আমি সব বুঝি। বুঝেও আমি বুঝি না। তোকেও কী বলবো আর নিজের মেয়েকেও কী বলবো৷ কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে কিছু উপদেশ দিবো রে মা। দেখ, মাতৃত্ব আর মা হয়ে উঠা প্রতিটা নারীজীবনের আরাধ্য। আল্লাহ যাকে খুশি মা করেন, যাকে খুশি মা করেন না। কিন্তু এই মা করা আর মা না করার পেছনে যে জিনিসটা প্রধান সেই জিনিসটা হলো মায়ের ভালোবাসা। আজ তো চোখের সামনেই দেখলাম, গল্প তোকে নতুন মা বলে ডাকছে। তোর প্রশংসা করছে তার মায়ের কাছে। বাচ্চারা হয় নাজুক, নরম, কোমল আর স্রস্টার দেয়া ফিরিশতা। ফিরিশতা শুধুমাত্র ভালোবাসা বুঝে। ভালোবাসায় পৃথিবী গড়া যায়। আমি জানি তুই এমন এক মেয়ে, যে কিনা তার ঘর সংসার বুঝবে, ক্যারিয়ার বুঝবে আবার তার মায়ের দায়িত্বও বুঝবে। আমি এইটাও বুঝি, তুই কখনো আমার মেয়ের থেকে তোর গল্পকে আলাদা করবি না৷ সত্য তো এটাই, গল্প এখন পর্যন্ত তানিয়ার ভালোবাসা আর আদর্শেই বড় হয়েছে। এই আদর্শ আর মমতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে এই অস্বীকারে। কিন্তু গল্পকে পেটে ধরা মা তুই। তোর থেকে গল্পকে আলাদা করে দেয়ার মতো গর্হিত কাজ আমার চোখের সামনে আমি হতে দিবো না। এই কাজ আমি সহ্য করতে পারবো না। শুধু দোয়া করি রে মা, আল্লাহ যেন সবকিছু ঠিক করে দেন। দুই মায়ের আদর্শেই যেনো আমার গল্প দাদুভাই বেড়ে উঠে।’

শ্বশুরের কথাগুলো নীরবে শুনলাম শুধু। একবার তাকালাম আসিফের দিকে। এবার দেখলাম এক ভিন্ন জিনিস৷ আসিফ খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলে তার সাদা ফকফকা চেহারা লালবর্ণ ধারণ করে৷ মনে হয় যেনো টুনকা দিলেই রক্ত বের হবে। ফিনকি দিয়ে যেনো সব রাগ আর ভয়ংকর প্রলয় বের হবে। শ্বশুরের হুইল চেয়ারের হাতলে আমার হাত রাখা ছিলো। আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত এনে শক্ত করে ধরলো। জানি না এই ধরার মানেটা কী! আমি স্থির করলাম, আমার লড়াই আমাকে একাই প্রয়োজনে লড়ে যেতে হবে। কোন বাধাই আমার জন্য বাধা হয়ে আসবে না। এই লড়াই আমার না, এই লড়াই আমার মাতৃ পরিচয়ের। শক্ত যদি হতেই হয়, তবে এবার শক্ত হবো আমি।

এদিকে তানিয়া গল্পকে রুমে নিয়ে বলতে লাগলো,

‘তুমি আর ওই ডাগর ডাগর চোখের মেয়েটার কাছে যাবে না৷ কেমন মা? আমার অনেক ভয় করে মেয়েটাকে। তোমাকে যদি সে নিয়ে গিয়ে রাক্ষসীর হাতে তুলে দেয় তখন?’

‘ও কি রাক্ষসী?’

‘হ্যাঁ মা। অনেক বড় রাক্ষসী।’

‘আমাকে খেয়ে দিবে?’

‘আস্ত করে খেয়ে দিবে।’

‘কীভাবে?’

‘অনেক অনেক অনেক ভয়ংকর। আমি বলতেই ভয় পাচ্ছি মা। তুমি ওর কাছে একদম যাবে না।’

‘তুমি না বললা ওই মেয়েটা আমার গল্প রাজকন্যাকে যে এসে বাঁচাতো সেই মেয়েটাই?’

‘আমার ভুল হয়েছে মা। ‘

‘অহ আচ্ছা। বুঝেছি।’

তানিয়ার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেলেন তানিয়ার মা। রুমে এসে মেয়েকে চোখ ইশারায় এসব বলতে নিষেধ করলেন। তানিয়াও তার মায়ের দিকে তাকালো ভয়ার্ত চোখ নিয়ে। এ যেনো চোখেচোখে কথা বলা হচ্ছে। একদিকে নিজের পেটের মেয়ে আর অন্যদিকে নিজের বংশের একমাত্র পুত্রবধূর মেয়ে, কার দিকে যাবেন তিনি! এ এক অসহায় মানব কথন। মায়েরা যুগে যুগে এতোটা অসহায় হয় কেন?

প্রিয় পাঠক, গতকাল মাদ্রাসার খাবার চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম এক সপ্তাহের৷ আল্লাহ মহান। তিনি আমাকে কখনো নিরাশ করেন না। সেই খাবার ম্যানেজ হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আমি মাদ্রাসায় ২৮ জনের এক সপ্তাহের জন্য চাল, ডাল, তেল, পেয়াজ, আলু, লবণ, হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, রসুন, মোরগ, ডিম, ব্রেড সবকিছু কিনে দিয়ে আসবো আপনাদের ডোনেশনের টাকা দিয়েই৷ কিন্তু সিলেটের বন্যা দুর্গত মানুষ বড়োই অসহায়। মানুষ সবদিক দিয়ে বিপদে আছে। বন্যার পানি কাল থেকে আবার বেড়েছে। আমার বাসায়ও আবার পানি নাই। গত দুইদিন ট্যাংকি থেকে পানি নেমে গেলেও আজ আবার ট্যাংকি ডুবে গিয়েছে। আমি অনুরোধ করে বলছি, এবার আপনারা আপনাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছুটা ডোনেশন করিয়েন৷ আগামীকাল মাদ্রাসায় যাবো ডোনেশন নিয়ে। এরপর আমি আরেকটা ডোনেশন করতে চাচ্ছি চাল, ডাল, তেল, পেয়াজ, আলুর প্যাকেটের। আশাকরি আমি সফল হবো। এজন্য প্রয়োজন আপনাদের সহায়তা। যে যতো পারেন শরীক হবেন এই কাজে। আমার বিকাশ নাম্বারঃ 01762095729 (পারসোনাল)। আল্লাহ আমাদের নেক কাজে করা নিয়তকে কবুল করুন৷ আপনাদের মাধ্যমে যাদের ঘরে খাবার যাওয়ার হুকুম আল্লাহ করেছেন, ইনশাআল্লাহ তা যাবেই। এর একটু বেশিও না, কমও না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here