#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৩০
#মিদহাদ_আহমদ
ননাস যাওয়ার পর তামান্না রুমে এসে তার ভাইকে বলতে লাগলো,
‘ভাইয়া, কিছু কথা বলার আছে তোমায়।’
‘কী কথা?’
‘মা অসুস্থ। বাবার হার্টে সমস্যা। দুইদিন পর যখন আমিও চলে যাবো তখন মা একা হয়ে যাবে৷ মাকে একা একা রেখে আমি কখনো ভালো থাকতে পারবো না। বাবার তো এই ভালো এই খারাপ। মানুষটার কি এখনও সেই আগের মতো করে ব্যবসাপাতি দেখার বয়স আছে বলো? ডায়াবেটিস কখন বাড়ে আর কখন কমে তার কোন নির্ধারিত সময় নাই। এদিকে তুমি আছো, ভাবিও আছে। যে ভাবেই হোক তোমরা এখন মায়ের সাথে থাকতে হবে। তোমরা যদি এভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও, তাহলে তারা থাকবে কীভাবে? এই এতবড় ঘর, এই এতকিছুর শেষ সময়ে এভাবে অবহেলা আর অনাদর এদের প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়াবে?’
‘তুই যা তো। আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমার যা খুশি আমি তাই করবো।’
কথাটা বললো আসিফ। তামান্না আরও কিছুক্ষণ তার ভাইকে বুঝালো। তারপর রুম থেকে চলে গেলো। আমি খেয়াল করলাম একটা চাপা অভিমান আঁকড়ে ধরে সে বের হয়ে গেলো। হয়তো বলতে বলতেও বললো না
আমি আসিফের কাছে এসে বসলাম। আসিফকে বললাম,
‘দেখো আসিফ, তামান্না, মা দুজনের কথাও তো তোমাকে চিন্তা করতে হবে তাইনা? জীবন থেকে সরে যাওয়া মানে নিজের কাছে নিজেই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। আর দায়িত্বের বেলায় কখনো আমরা নিজের থেকে সরতে পারি না। দায়িত্ব জিনিসটাই যে আমাদের মনুষ্যত্ব। দায়িত্ব গ্রহণ আর দায়িত্ব পালন থেকে সরে আসার চেয়ে জীবনের আর কোন অন্যায় হতে পারে না।’
আসিফ কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকলো। আমিও আরও কিছুক্ষণ তাকে বুঝালাম। শাশুড়ি মা আমাকে ডাক দিলেন এমন সময়ে। আমি উঠে গেলাম ওনার কাছে। শাশুড়ি মা পানের বাটা থেকে পান সুপারি তুলতে তুলতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
‘তোমার পরীক্ষা শেষ হবে কবে নুপুর?’
এমন মোলায়েম গলায় শাশুড়ি মা আমাকে কখনোই কোনকিছু জিজ্ঞেস করেননি। শাশুড়ি মায়ের প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম,
‘সামনের মাসের শেষের দিকে। ব্যবহারিক সহ।’
‘তাহলে তামান্নার পানচিনি, বিয়ে এসব কবে নাগাদ হলে ভালো হয়?’
আমি ভেবে পুলকিত হলাম যে শাশুড়ি মা আমার কথাও চিন্তা করছেন। আমি ওনাকে বললাম,
‘মা আপনি আমার জন্য কোনকিছু আটকে রাখতে হবে না। আমার পরীক্ষা তো চলবে। এর মাঝে তামান্নার বিয়ের যেকোন আয়োজনে যেনো কমতি না আসে।’
শাশুড়ি মা আমার মাথায় ওনার হাত রাখলেন। কী এক শীতল স্পর্শ আমাকে যেনো আলতো করে ছুয়ে দিয়ে গেলো!
তামান্না রুমে এসেই বললো,
‘ভাবি তুমি এখানে! আর আমি তোমাকে তোমার রুমে গিয়ে খুঁজছি। ভাইয়াকে চা দিয়ে এসেছি। তুমি চা খাবে?’
আমার চোখের সামনে আমার এক পরিবার যেনো ফুটে উঠলো। এমন পরিবার যেই পরিবারের স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম কোন একদিন। তামান্না বললো,
‘ভাবি আমার সাথে রুমে আসো। জানোই তো আমি কখনো শাড়িটারি এসব পরিনাই। তুমি এদিকে কত সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারো। কাল তো চলে যাবা তোমার বাড়িতে। এখন আমাকে আজই শাড়ি পরা শিখিয়ে দিয়ে যাও।’
‘বাহ রে! আমি কি শাড়ি পরাতে পারি না? বোন রেখে ভাবি কেন? আমার কাছেই তো আসতে পারতি।’
কথাটা আমার ননাস এসে বললেন। তামান্না আমার ননাসকে বললো,
‘না তুমি তো কাজে কামে বিজি। তাই ভাবলাম ভাবিকে…’
‘হয়েছে হয়েছে। ভাবি লাগবে না। আমিই পরানো শিখিয়ে দিবো। আয়।’
বলেই ননাস তামান্নার হাত ধরে রুম থেকে বের হতে লাগলেন। শাশুড়ি মা পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন,
‘তানিয়া কিছু হিসাব করার ছিলো বিয়ে নিয়ে। কার, কোথায়, কীভাবে বাজেট এসব দেখার ছিলো। তুই একটু আয় তো এদিকে।’
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনেই আমার ননাস চলে এলো তামান্নার হাত ছেড়ে। তামান্নাও এসে বললো,
‘কীসের বাজেট?’
‘তুই যা নুপুরকে নিয়ে। তোকে এসব দেখতে হবে না।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। নুপুর যাও এখন তামান্নাকে নিয়ে। তাকে শাড়ি পরা শিখিয়ে দাও। এমনিতে তুমি গ্রামের মেয়ে। তোমরা এসব শাড়ির বিষয়ে বেশি জ্ঞান রাখো। যাও শিখিয়ে দিয়ে আসো তাকে।’
ননাস কথাগুলো বললো আমাকে। আমিও তামান্নাকে নিয়ে চলে গেলাম। যাবার সময় পেছন ফিরে তাকালে দেখলাম শাশুড়ি আমাকে চোখের ইশারায় তামান্নাকে নিয়ে যেতে বলছেন। তামান্না আমার সাথে যাওয়ার সময়ে মুখে বিরবির করে বললো,
‘জানি না কীসের হিসেব করবে আপা মায়ের সাথে। মানুষ চিনতে যে মানুষের এতদিন লাগে সেইটা আমার মাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।’
‘কিছু বললে তামান্না?’
‘না ভাবি। কিছু না। তুমি আইসক্রিম নিয়ে আসতে পারবা ফ্রিজ থেকে আমার জন্য? আজ গরম একটু বেশিই যেনো।’
‘আচ্ছা তুমি রুমে যাও। আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।’
‘ওই পাঁচ লিটারের টা থেকে নিও না। ওইটা মেঙ্গো ফ্লেভার। তুমি ছোট বক্স থেকে এনো। স্ট্রবেরি ফ্লেভারেরটা।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
আইসক্রিম নিয়ে তামান্নার রুমে গেলাম। দেখলাম সে দুইটা সুতি আর একটা জর্জেট শাড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার দিকে মুখ করে। আমাকে দেখে সে বললো,
‘এই এতো লম্বা কাপড় মানুষ সামাল দেয় কীভাবে ভাবি?’
আমার হাসি পেলো তামান্নার কথায়৷ তাকে বললাম,
‘বিয়ে হয়ে গেলে সব পারবা বুঝলা। একেবারে পাকা গিন্নি হয়ে উঠবা তখন।’
তামান্নাকে শাড়ি পরা শেখানোর পর রুমে আসতেই আসিফ আমাকে বললো,
‘আমি বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাড়িওয়ালাকে বলেছি যে বাসা ছেড়ে দিবো৷ বাসায় যা যা আছে সব নিয়ে আসবো বিকালে গিয়ে। তোমার বইখাতা সব সাথে তো? নাকি বাসায় কিছু রয়ে গিয়েছে?’
আসিফের এই কথা শুনে আমি যারপরনাই খুশি হলাম। একটা মানুষকে শুদ্ধ পথে আনতে তার পরিবারের থেকে দূরে রেখে না বরং পরিবারে রেখেই তাকে শুদ্ধ পথে নিয়ে আসতে হবে। আসিফকে তার এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ আর জিজ্ঞাসা করলাম না। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধও করলাম না। কিছু খুশি মনের মাঝে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়। আসিফের এই সিদ্ধান্তটাও ঠিক এমন। আসিফের উত্তর দিতে বললাম,
‘হ্যাঁ। বইখাতা সব আমার সাথেই আছে। চিন্তার কোন কারণ নেই।’
আমার রুম থেকে আমি দ্রুত প্রস্তান করলাম। খুশিমনে শাশুড়ির রুমের দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। শাশুড়িকে জানালাম যে আসিফ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শাশুড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন কপালে। ওনার চোখমুখে আনন্দের হাসি বইছে যেনো। এমন উচ্ছ্বাস আমি দেখে দেখে পরম সুখ অনুভব করতে লাগলাম। ননাস তানিয়া এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘আসিফ সত্যি সত্যিই থেকে যাবে?’
‘হ্যাঁ আপা।’
‘সত্যিই?’
‘হ্যাঁ। কেন? আপনি খুশি না?’
‘আরে না না৷ ঘরের ছেলে ঘরে থাকবে৷ এটাই তো নিয়ম। যাক। শেষমেশ সে বুঝলো। আমি তো ভেবেছিলাম সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে। এই জীবনে আর ঘরমুখো হবে না কখনো।’
ননাস রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। শাশুড়ি ওনার হাত থেকে চুড়ি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘মা রে, আজ থেকে তোকে আমার ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিলাম। তুই পেরেছিস আমার ছেলেকে আবার ঘরে ফিরিয়ে আনতে। তুই পেরেছিস তার জীবন থেকে সব অন্ধকার দূর করে দিতে।’
আমি জড়িয়ে ধরলাম শাশুড়ি মাকে।
পরেরদিন সকালেই আমি বাড়ি চলে গেলাম। মাঝখানে দীর্ঘ এক মাস কেটে গেলো। এর ভেতরে তামান্নার পানচিনি হয়ে গিয়েছে। আমার বায়োলজি ব্যবহারিক পরীক্ষার আগে কয়েক দিনের বন্ধ ছিলো। এই বন্ধের সময়ে তার পানচিনি ছিলো। আসিফ আমাকে আসতে নিষেধ করেছিলো তার পরও আমি ওর নিষেধ না মেনে চলে এসেছি। ঘরের বউ হিসাবে একটা দায়িত্ব তো আছে!
সেদিন বাসায় এসে দেখলাম আসিফের ঘর ঠিক আগের মতোই হয়ে গিয়েছে৷ রুমভর্তি সিগারেট এখানে সেখানে ফেলে রাখা। পুরোপুরি নির্ভুল না হতে পারলেও আন্দাজ করতে পারলাম সে আবার হুইস্কি খাচ্ছে প্রতিদিন৷ নিজেকে আর সামলে না রাখতে পেরে আসিফকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
‘তুমি কি আবার আগের মতো ড্রাস নিচ্ছো?’
আসিফ একটা হাসি দিলো। হেসে হেসে বললো,
‘কী আবোল তাবোল বকছো বলো? এসবে মাথা ঘামানোর দরকার নাই। আগে পরীক্ষা শেষ করো তোমার। এখন পুরোপুরি শেষ না করে আসার কী দরকার ছিলো বলো?’
‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আসিফ’
‘তোমার চোখ দুইটা দিনদিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছে নুপুর। কী গভীর চোখ দুটো! মায়াবতী চোখ!’
আমার কথার সরাসরি কোন উত্তর আসিফ দিচ্ছে না। আমি বুঝতে পারলাম আসিফ আমার থেকে কথাটা আড়াল করতে চাচ্ছে।
সেদিন শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম, আসিফ কখন বাসা থেকে যায় আর কখন ফিরে আসে। শাশুড়ি মা জানালেন, হোটেলে তার ইভিনিং শিফটেত ডিউটি। মাঝেমধ্যে নাকি বাসায় আসে না। তারপর আবার উপরি প্রশ্ন করলেন শাশুড়ি মা। জিজ্ঞেস করলেন,
‘কেন নুপুর? কিছু কি হয়েছে? জানো নুপুর, মাঝেমধ্যে যখন আসিফ বাসায় বাজার করে আনে, আমার জন্য একশো দুইশো গ্রাম সুপারি কিনে আনে, আমি তখন যারপরনাই খুশি হই। মাছ কিনতে সে অপটু। যেসব মাছ সে নিয়ে আসে, এগুলো তোমার শ্বশুর কখনো খান না৷ কাটা সুপারি নিয়ে আসে আমার জন্য, সাথে বাংলা পান৷ জানোই তো আমি সিঙ্গাপুরি সুপারি আর খাসিয়া পান ছাড়া খাই না। তবুও যত্ন করে ছেলের আনা বাজারগুলো রাখি। আমার ছেলে আমাকে বাজার করে এনে খাওয়াচ্ছে, এরচেয়ে বড় খুশির আর কী হতে পারে? আমার কোটি টাকার সম্পদের চেয়েও আমার ছেলে তার দায়িত্ব পালন করতে শিখেছে এইটা জানাই আসল জরুরি৷’
শাশুড়ি মায়ের চোখ মুখে এত আনন্দ দেখে আমি আর আমার মনের শঙ্কা ওনার কাছে বললাম না। চেপে গেলাম।
সেদিন রাতে ঘুমানোর বাহানা করে আসিফের পাশে আমি শুয়ে আছি। রাত তখন তিনটা হবে। আমি খেয়াল করলাম আসিফ চুপিচুপি ঘুম থেকে উঠে আলমারি খুলে কী যেনো নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। আমার অবুঝ মন আর ফিরে দেখতে চাইলো না আসিফ কী করছে সেখানে। হয়তো উঠে গেলে দেখতে পেতাম হুইস্কির বোতল হাতে সে বারান্দায় বসে আছে৷ ধোয়া ছাড়ছে সিগারেটের! অথবা এইটাও আমার মনের ভুল!
সকালে নাস্তা শেষ করলাম। শাশুড়ি মা বললেন, গাড়ি রেডি আছে। আসিফ আমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসবে।
আসিফ আমাকে নিয়ে নিচে নামলো। আমি আশা করেছিলাম আসিফ আমাকে নিয়ে তার বাবার দেয়া গাড়িতে না, রিজার্ভ করা একটা সিএনজি করে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমার সেই আশাকে ভেঙ্গে দিয়ে আসিফ কারের দরজা খুলতে খুলতে বললো,
‘আর তো এক সপ্তাহ মাত্র! তারপর আমার বউকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। এখন উঠে বসো তাড়াতাড়ি। আর শুনো, পরীক্ষা ভালোকরে দিও। কোন গাফিলতি যেনো না হয় পরীক্ষায়।
[এত প্রতিকূলতার মাঝেও গল্প দিচ্ছি৷ ইদানীং রিচ একই থাকলেও লাইক কমেন্ট কমে যাচ্ছে। প্রিয় পাঠক, গল্প পড়ে লাইক কমেন্ট করে যাবেন। মন্তব্য জানাবেন। আজকের পর্বে মিনিমাম ৩ হাজার লাইক আর ৫০০+ কমেন্ট আশা করছি৷ ভালো থাকবেন]