#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৫

0
574

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৫৫

#মিদহাদ_আহমদ

গভীর অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে আছে আসিফ। ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে নুপুর। দুজন দুজনের পাশে থেকেও যেনো যোজন যোজন দূরে।

আসিফ আমার উপর তার ডান হাত রাখতেই আমি বিছানায় উঠে বসলাম। কোন কথা বললাম না৷ আসিফও উঠে বসলো। লাইট জ্বালালো৷ তারপর বললো,

‘আই এম সরি নুপুর। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জীবনে কখনো ভাই হয়ে বোনের উপর নিজের কর্তব্য পালন করিনি। তাই এখন ভেবেছি, হয়তো নিজের বোন এক স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে নিজের মাঝে, সেই স্বপ্নকে যেনো লালন করতে দেই৷ কিন্তু এখন রিয়েলাইজ করছি, আমি ভুল। আমার চিন্তা ভুল। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও নুপুর। আমি এই অন্যায় চিন্তার কারণে নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত।’

আসিফের এক নাগাড়ে বলা কথাগুলো আমি শুনলাম শুধু। কোন জবাব দিলাম না৷ আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত রেখে বললো,

‘তুমিই তো আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছো নুপুর৷ তোমার উপর ভরসা করেই তো আমি আমার জীবনে ফিরে এসেছি। আর আজ যখন আমি আমার জীবনে করা কোন এক ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, তখন তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না বলো?’

‘আমার গল্প…’

আসিফ এবার আমাকে তার বাহুতে নিয়ে ধরে বললো,

‘আমার গল্প, তোমার গল্প, আমাদের গল্প। আমাদেরই আছে সে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি নুপুর, আবদার আবদারের জায়গায় রেখে দিয়েও আমি তোমাকে তোমার গল্প ফিরিয়ে দিবো। আমি আমার বোনের চিন্তাও করছি, কিন্তু একজন মায়ের বুক থেকে তার বাচ্চা কেড়ে নিয়ে অন্যের সংসারের চিন্তা নয়!’

আমি আর সামলাতে না পেরে ঢলে পড়লাম আসিফের বুকে। কিছুক্ষণ কান্না করলাম তাকে জড়িয়ে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,

‘আমার মেয়েটাকে আমি নিজ থেকেই আমার দূরে সরিয়েছি। আমার চেয়ে খারাপ মা এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আমার পেটের সন্তান রেখে আমি কীভাবে দেশের বাইরে এভাবে পড়ে রইলাম। কীভাবে!’

‘কোন ভুল নাই এখানে নুপুর। লাইফে সবকিছুর দরকার আছে। আর দরকার যখন আমাদের গল্পের, তখন আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমাদের গল্প আমাদের মাঝেই ফিরে আসবে। আমাদেরই থাকবে।’

‘সত্যি তো?’

‘হ্যাঁ নুপুর। সত্যি।’

পরেরদিন সকালে আমি খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠলাম। শাশুড়ি আমাকে সকাল সকাল উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হলো? এত সকাল যে? কোথাও যাওয়া আছে নাকি?’

‘না মা। গল্পের ক্লাস না?’

‘না তো। আজ তো গল্পের ক্লাস না। আজ শনিবার না? ওর স্কুল শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে। আজ সে ড্রইং ক্লাসে যাবে। এখন বাজে সাতটা। ড্রইং ক্লাস সকাল এগারোটায়।’

আমার কেমন জানি এক অসহায় অসহায় মনে হলো নিজেকে। আমার নিজের মেয়ের কখন কোন ক্লাস, কখন স্কুল আর কখন ড্রইং মা হয়ে এর কোনকিছু আমি জানি না। এরচেয়ে বড় অসহায়ত্ব আমি এর আগে কখনো অনুধাবন করতে পারিনি। শ্বশুর ডাক দিয়ে বললেন,

‘মা এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো এনে। কতদিন আমার মেয়ের হাতের বানানো চা খাই না। ‘

আমি মুখে হাসি এনে শ্বশুরের জন্য চা বানাতে গেলাম রান্নাঘরে৷ মা রান্নাঘরেই ছিলেন আসিফের জন্য পায়েস রান্না করায়। মা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন,

‘তোর শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো তো এমনই। এগুলো মনে নেয়ার কী আছে? তারচেয়ে বরং দেখতে হবে কীভাবে গল্পের মা হওয়া যায়। তাইনা?’

আমি জবাব দিলাম না আর। চা বানিয়ে শ্বশুরের রুমে নিয়ে গেলাম। শাশুড়িও বসা ছিলেন বিছানায়৷ শাশুড়ি আমাকে কাছে এনে বসালেন৷ শ্বশুর চায়ের কাপ পিরিতে লাগিয়ে হালকা মৃদু শব্দ করে কেশে উঠলেন দুইবার। শাশুড়ি বললেন

‘মারে, আমি বুঝতে পারছি তোর সব কষ্ট৷ একজন মা আর যাই হোক, তার পেটের সন্তানকে অন্তত অন্যকারো কাছে দেখে শান্তি পায় না।’

‘না না মা। এ আপনি কী বলছেন? তানিয়া আপা তো…’

‘না রে মা। আমি একদিকে মেয়ে অন্যদিকে বউ, এই দুইয়ের পাতাটনে পড়ে কোনদিকে যাব কিছু বুঝতে পারছি না। একবার না, বারবার আমার মনে হয়, আমি আমার জায়গায় অপারগ। আমার শক্তি নাই। তোমরা যখন আমেরিকা চলে গেলা, তখন গল্পই আমার মেয়েকে জীবন দিয়ে দিলো। ডাক্তার জানিয়েছে তানিয়া যে মানসিক ট্রমার মাঝে আছে সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব৷ যেকোন সময়ে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। তানিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। এবং এখনও সে মানসিক ভারসাম্যহীন। গল্পকে যদি আমি কেড়ে নেই তার থেকে, তাহলে সে যদি তার উদগ্রীব কোনকিছু থেকে গল্পের খারাপ কোনকিছু করে বসে!’

‘কী বলছো এসব আসিফের মা। যা মুখে আসবে তাই বলে দিবা? একটু তো মহল বুঝবা নাকি?’

শ্বশুর জোর গলায় বললেন কথাগুলো। শাশুড়ি জবাব দিলেন,

‘সত্যকে আমি আর চাপা দিয়ে রাখতে চাই না আসিফের বাবা। নুপুর মা আমার, গতরাতে আমার সামনেই তানিয়া গল্পকে তোমায় ডাইনি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তানিয়া এখন যেকোন ভাবেই চাইবে, গল্প তার হোক। পেটে না ধরলেও, পিঠে ধরে সে বড় করছে গল্পকে। গল্প ছাড়া তানিয়া কখনোই নিজের জীবন কল্পনা করতে পারবে না আর। এদিকে আমি এই অন্যায় আর দেখতে দিতে পারবো না।’

এমন সময় আসিফ রুমে এসে ঢুকলো। আসিফ শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসে বললো,

‘মা, আমি কী করতে পারি এখন? আমি এই অন্যায় হতে দিতে পারবো না। একদিকে আমার বোন অন্যদিকে…’

আসিফ কথাগুলো শেষ করার আগেই ডাইনিং রুম থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ আসতে লাগলো। আমরা সবাই উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি ননাস জোর করে দুধ খাওয়াচ্ছেন গল্পকে। গল্প খাবে না৷ সে না করছে বারবার। আমি এগিয়ে গেলাম। চেয়ার টেনে বসতেই গল্প উঠে গেলো চেয়ার থেকে। গল্প তাকালো ননাসের দিকে একবার। আমি গল্পকে টেনে কাছে আনলাম। ননাসের দিকে গল্প আবার তাকালো। বুঝতে পারলাম গল্প তার মায়ের অনুমতি নিচ্ছে। ননাস চোখের পলক ফেলে গল্পকে আমার কোলে বসিয়ে দিয়ে বললো,

‘লক্ষ্মী মেয়ের মতো এবার দুধগুলো খেয়ে ফেলো মা।’

‘তারপর আমাকে কিন্ডারজয় দিবে?’

ননাসকে জিজ্ঞেস করলো আমার মেয়েটা। ননাস বলার আগেই আমি বললাম,

‘হ্যাঁ মা। কেন দিবো না? অবশ্যই দিবো। তুমি দুধ খেয়ে নাও আগে।’

‘তুমি দিবে?’

আবারও শিশুসুলভ প্রশ্ন করলো গল্প। ননাস বললো,

‘হ্যাঁ আমি দিবো, সেও দিবে। তুমি আগে লক্ষ্মী বাচ্চার মতো খেয়ে নাও দেখি।’

গল্পের দুধ খাওয়ার পাট চুকিয়ে গল্পকে কোলে করে রুমে নিয়ে গেলো ননাস। দশটা নাগাদ সে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো গল্পকে নিয়ে। মা পাশে থেকে বললেন,

‘তানিয়া, নুপুরকে নিয়ে যা আজ তোর সাথে। সে দেখে এলো। ‘

তানিয়া আপা বললো,

‘নুপুউউর, যাবে আজ? বাইরে অনেক গরম। অন্যদিন যাবে? আজ আমি নিয়ে যাই গল্পকে? তাছাড়া তার এখন মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করা লাগবে। এক্সিবিশন আছে সামনে। আমি গেলাম।’

কোন কথা না বাড়িতেই গল্পকে নিয়ে রওনা দিলো তানিয়া। ঘরের দরজা পেরোনোর আগেই আমি ডাক দিলাম গল্পকে। আমার হাতে থাকা এক বক্স কিন্ডারজয় দেখাতেই গল্প দৌঁড় দিয়ে এগিয়ে এলো। উৎসুক চোখ নিয়ে গল্প বললো,

‘এসব আমার জন্য এনেছো?’

‘হ্যাঁ মা তোমার জন্য।’

‘সবগুলা?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ সবগুলা।’

তানিয়া আপাও এগিয়ে এলো। বক্সটা তার হাতে নিলো৷ গল্পকে আরেক হাতে ধরে বললো,

‘আমরা কারে বসে বসে খাবো। তাড়াতাড়ি চলো। লেইট হয়ে যাচ্ছে মা।’

গল্প তানিয়া আপার হাতে ধরে ধরে বাইরের দিকে রওনা হলো। বারবার পেছনে ফিরে মেয়েটা আমার হাসছিলো। তার এই হাসিটা হয়তো কৃতজ্ঞতার হাসি। মা মেয়ের আত্মিক সম্পর্ক কি আর কেউ ভেঙ্গে দিতে পারে?

শ্বশুর, শাশুড়ি, মা আর আসিফ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। শ্বশুর বললেন,

‘দেখিস মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই তোর পাশে আছি।’

এদিকে ড্রইং ক্লাসের ফারুক টিচার, যিনি এক্সিবিশনের জন্য গল্পকে রেডি করছিলেন, তিনি আজ ক্লাসে আসেননি। তানিয়া এক ঘন্টা বসে থেকেও টিচারকে আসতে না দেখে আর্ট স্কুলের আরেকজন টিচারকে জিজ্ঞেস করলে উনি জানালেন, ফারুক স্যারের চার বছর বয়সী মেয়ে অসুস্থ। তাই তিনি আসতে পারেননি। স্যারের স্ত্রী মারা গিয়েছেন তার মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে৷ সেই থেকেই তিনি তার মেয়েকে একা একাই দেখাশোনা করছেন।

প্রিয় মানুষজন, সিলেটের বন্যার্তদের জন্য যদি ডোনেশন পাঠাতে চান, তাহলে পাঠাবেন। আমি আগামী পর্শুদিন একটা এতিমখানায় যাবো ইনশাআল্লাহ আপনাদের ডোনেশন নিয়ে। ডোনেশন পাঠাতে পারেন আমার বিকাশে। আমার বিকাশ নাম্বার
01762095729 (personal)

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here