#অদ্ভুত_প্রেমবিলাস
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-০৯|
সকালে গ্রামের ঠাণ্ডা পরিবেশে যেন মন জুড়িয়ে যায়। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। এমন রোমাঞ্চকর পরিবেশে ধারা গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি বিদ্যমান। হয়তো সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এই মৃদু হাসি ঠোঁটের বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ করে এক মগ পানি এসে পড়লো ধারার মুখে। ঘুম থেকে হকচকিয়ে উঠে বসে চোখ বন্ধ করে চিৎকার শুরু করে ধারা। ধারার এক চিৎকারে পুরো বাড়ি মাথায়। দ্বিতীয় চিৎকার দেওয়ার আগে কারো ধমক শুনে চুপ হয়ে যায় ধারা। পিট পিট করে চোখ খুলে তাকায়, সামনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে ওর রাগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিছানা থেকে একটা বালিশ তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল,
‘ জাহান্নামের শয়তান তুই আবার এসে গেছিস আমাকে জ্বালাতে। গেছিলে তো বিশ দিনের জন্য তার আগেই চলে গেলি কেন? ও তোর তো আবার আমাকে জ্বালাতন না করলে পেটের ভাত হজম হয়না।’
জান্নাত রাগী চোখে ধারার দিকে তাকায়। এই মেয়ে এখনো ওর সঙ্গে ঝগড়া করে যাচ্ছে। সাহস কত বড় ওর? একেতো ওকে না জানিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বিয়ে করতে গেছিল। তার ওপরে এখন ওর পায়ের সঙ্গে পা আগে ঝগড়া করছে। জান্নাত তীব্র রাগী গলায় বলল,
‘ হয়ে গেছে আপনার ভাষণ? এবার আমি কিছু বলি আপনি কান খুলে শুনুন, আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমাকে না জানিয়ে আপনি বিয়ের আসরে পর্যন্ত চলে গেছে। মাত্র বারো দিন ছিলাম না এখানে, এর মধ্যে এত কিছু করে ফেললেন? একবারও ভাবলেন না আপনার এই জাহান্নামের শয়তানটাকে একবার ফোন করে ওইসব জানানো দরকার।’
এইটুকু বলে জান্নাত থামে। নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও অভিমানী গলায় বলল,
‘ আর বলবেনই বা কেন আমাকে? কে আমি আপনার? আপন কেউ? উঁহু আপন কেউ তো নই! তাহলে? বলুন না আমি আপনার কে?’
ধারা বিছানা থেকে উঠে এসে জান্নাতের হাত ধরতে গেলে, জান্নাত ওর হাত ছাড়িয়ে নেয়। ধারা জান্নাতের সঙ্গে না পেরে জান্নাত কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ জানু তুই রাগ করিস না, আমার তখন কি হয়েছিল আমি নিজেই জানিনা। তখন আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।’
জান্নাত ধারার থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ উফ ছাড়ুন আপনি আমায়! আপনি এভাবে অপরিচিত কাউকে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন?’
ধারা নিচু স্বরে বলল,
‘ আমি জানি তুই রাগ করে নেই, অভিমান করে আছিস। কিন্তু তুই বোঝার চেষ্টা কর, আমি পরিস্থিতির শিকার ছিলাম। আমার হাত-পা বাঁধা ছিল। আমি কি করব না করব আমার মাথা তখন কাজ করছিল না। তোকে ফোন করার কথাও আমার মাথায় আসেনি। সরি। প্লিজ মাফ করে দেন এই বারের মত আর কখনো এমন করব না।’
জান্নাত অভিমানের অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। কোন কথা বলছো না। চোখ দুটো ছল ছল করছে। ধারা জান্নাতের গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
‘ কথা বলবি না আমার সাথে? এত অভিমান তোর?’
জান্নাত আর অভিমান করে থাকতে পারো না। ধারাকে ধরে কিছুক্ষণ কেলিয়ে বলল,
‘ আর যদি কখনো আমার থেকে কোন কথা লুকিয়ে ছিস তাহলে গুন্ডা ভাড়া করে এনে তোকে মার খাওয়াবো মনে থাকে যেনো কথাটা।’
ধারা হাত-পা ডলতে ডলতে বলল,
‘ আমি বেঁচে থাকতে এমন আর কখনো করবোনা। আজকে খুব শিক্ষা পেয়েছি আর দরকার নেই। তোর হাত গুলো কি শক্ত রে।’
জান্নাত চোখ গুলো ছোট ছোট করে ধারার দিকে তাকালে, ধারা বোকা বোকা হেসে বলল,
‘ আরে জানু আমি তো মজা করছিলাম। তোর হাত গুলো কি নরম তুলার মত। কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, তুইতো বিশ দিনের জন্য তোর নানার বাড়িতে গেছিলি, তাহলে বারো দিনের আগেই চলে এলি কেন?’
জান্নাত হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসে বলল,
‘ তুই তো জানিস হঠাৎ করে নানু অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে আমরাও তাড়াতাড়ি সেখানে চলে যাই। নানু তার ছেলেমেয়ে, বাড়ির বউ জামাই, নাতি-নাতনিদের সবাইকে একসাথে পেয়ে এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। আমাদের তো আরো আগে আসার কথা ছিল কিন্তু নানুর জন্য আসতে দেরি হয়েছে।’
ধারা মুখ উঁচু করে বলল,
‘ ওহ।’
জান্নাত ধারাকে আবার কিছু বলবে তার আগে ওদের রুমের জোনাকি ঢুকে বলল,
‘ এইযে নাট বল্টু দুই জন। আপনাদের দুইজনকে আম্মা নাস্তা খেতে ডাকছে। আপনাদের শলাপরামর্শ শেষ হলে তাড়াতাড়ি করে খাবার টেবিলে আসুন। আর ধারা তুই এখনো এখনো হাতমুখ ধুসনি! যা জলদি গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আয়।’
এইটুকু বলে জোনাকি না দাঁড়িয়ে ব্যস্ত পায় আবার চলে যায়। ধারা জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তুই এখানে বস আমি এক্ষুনি কলতলা থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসি।’
জান্নাত ছোট করে বলল,
‘ তাড়াতাড়ি করবি।’
ধারা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ এইতো যাব আর আসব।’
এইটুকু বলে ধারা তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
জান্নাত ধারার বেস্ট ফ্রেন্ড। দুইজনের ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। জান্নাতের বাবা এই গ্রামের নদীর ওপারের শহরে একটা ব্যাংকে চাকরি করে। তিনি শহরের ছেলে। তার এই গ্রামের পরিবেশ ভালো লেগে যাওয়ার কারণে তিনি আর শহরে ফিরে নি। এখানেই থেকে গেছেন ছোট্ট একটা বাড়ি তৈরি করে। তবে মাঝেমধ্যে গিয়ে বাবা মাকে দেখে আসেন তিনি। ধারার বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই জান্নাতের নানু অসুস্থ হয়ে পড়ায় জান্নাতরা তাড়াতাড়ি করে সেখানে চলে যায়। কাল রাতে বাড়ি ফিরে এসে জান্নাতরা। সকালে জান্নাতের বাড়ির পাশের এক চাচির কাছ থেকে ধারার বিয়ের কথা শুনে এখানে চলে আসে জান্নাত।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে দুজনে পুকুর পাড়ে এসে বসে। একজনে বেঞ্চে বসে আছে অন্য জনে সিঁড়ির উপর বসে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। কথাবার্তার এর মাঝে জান্নাত বলল,
‘ কাল রেডি হয়ে থাকবি আমি এসে তোকে নিয়ে যাব।’
ধারা চোখ গুলো ছোট ছোট করে বলল,
‘ কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?’
জান্নাত মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
‘ তোকে আমার বিয়ে খেতে নিয়ে যাব। গাঁধী কোথাকার, বোর্ড পরীক্ষার যে আর দুই মাসও বাকি নেই সে খেয়াল আছে তোর। কাল আমার সাথে স্কুলে যাবি। শুনেছি অনেকগুলো নোট ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে। এখন না গেলে আরো অনেক পড়া মিস করবো আমরা।’
ধারা বিড় বিড় করে বলল,
‘ আমি মনে হয় কালা কানে শুনতে পাইনা। আস্তে বললেই তো হয়। জাহান্নামের শয়তান যেন কোথাকার!’
জান্নাত চোখগুলা ছোট ছোট করে বলল,
‘ তুই আবার বিড়বিড় করে কি বলছিস যা বলার জোরে বল।’
ধারা দুষ্টুমি হেসে বলল,
‘ বলছি তুই আর একদিন আগে এলে ছোট ভাইয়ার সঙ্গে তোর দেখা হতো। ভাইয়া কাল রাতের গাড়িতে ঢাকা চলে গেছে।’
জান্নাত একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
‘ তোর ভাইয়াকে দিয়ে আমি কি করব।’
ধারা দুষ্টুমি করে বলল,
‘ হুম, হুম, আমার ভাইয়া কে দিয়ে তুই কি করবি? ভাবছি কি জানিস, এবার ভাইয়া শহর থেকে ফিরলে আমি বলব, তোর তো বয়স হয়েছে এবার একটা বিয়ে কর। পাত্রী না হয় আমি আর জান্নাত মিলে খুঁজে দেবো। তুই কী বলিস এই ব্যাপারে?’
জান্নাত ধারার দিকে তেড়ে গিয়ে বলল,
‘ তবে রে দাঁড়া তুই। খুব শখ না তোর ভাইয়ার বিয়ে দেওয়া।’
ধারা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
‘ হ্যাঁ খুব শখ। একটা লাল টুকটুকে দেখে বউ হবে আমার ভাইয়ের।’
জান্নাত দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
‘ তুই দাঁড় একবার। তারপরে দেখাচ্ছি তোকে মজা।’
ধারা সে কী আর দাঁড়ায় সে তো দৌড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেছে।
চলবে….