#প্রেম_তুমি,পর্ব-১৫
ফাবিহা নওশীন
অংকটা কিছুতেই মেলাতে পারছে না দর্শন। তাই ওর পড়ায় মন বসছে না। খাতার পাতা উল্টালো। একটা অংকের জন্য পাঁচটা পাতা নষ্ট করেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে অংকের একটা পিকচার তুললো। ওয়াই-ফাই অন করে ফ্রেন্ডস গ্রুপে দিয়ে দিল। দ্রুত টাইপ করল কেউ সমাধান বের করে দে। তারপর মনে হলো অর্ষাকে একটা কল দেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু কল দেওয়ার পর কানে ভেসে এল যে লাইনগুলো তা দর্শনের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। নাম্বারটি সুইচড অফ বলছে। দর্শন ফেসবুকে গেল। অর্ষাকে এক্টিভ দেখাচ্ছে। মেসেঞ্জারে কল দিল। অর্ষা দর্শনের কল দেখে লাফিয়ে রিসিভ করতে গিয়েও করল না। ঘড়িতে সময় ন’টা। এখন তো দর্শনের কল দেওয়ার কথা না। আর তাছাড়া এখন যদি অর্ষা কল রিসিভ করে দর্শন ধমকে উঠবে,”এই মেয়ে সব সময় ফেসবুকে কী করো? পড়াশোনা নেই? পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মোবাইল। পড়তে যাও। রাত এগারোটার আগে যেন ফেসবুকে না দেখি। ব্লা ব্লা ব্লা।”
ওর এত এত ভাষণ শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নাই। তাই কল রিসিভ করল না। লাইনে থেকেও না থাকার ভান। পরে জিজ্ঞেস করলে জানাবে ওয়াই-ফাই অন ছিল তাই এক্টিভ দেখিয়েছে। কল রিসিভ না হওয়ায় দর্শন আবারও কল দিল। কিন্তু এবারেও রিসিভ হলো না। মেসেজ দিল তাও সিন হলো না।
মেসেজ সিন না করায় দর্শন মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,
“লাইনে নেই নিশ্চয়ই পড়তে বসেছে। যাক সুমতি হয়েছে।”
ঠিক এগারোটায় দর্শনের মোবাইল বেজে উঠল। বই গুছিয়ে মাত্র টেবিল ছেড়েছে। দর্শন মোবাইল হাতে নিয়ে আননোন একটা নাম্বার দেখতে পেল। দেখতে দেখতে কল কেটে গেল।
পরেরবার রিং বাজতেই কল রিসিভ করল দর্শন।
রিসিভ করে কানে দিতেই শুনতে পেল,
“জানু, তুমি এত লেট করলে কেন কল রিসিভ করতে? তুমি আমাকে এখন আর ভালোবাসো না।”
বলেই নেকা কান্না শুরু করল। দর্শন ভরকে গেল। অচেনা নাম্বার, অচেনা গলা। মোবাইল কান থেকে নামিয়ে আবারও নাম্বার চেক করে কানে দিয়ে কনফিউশন নিয়ে প্রশ্ন করল,
“কে আপনি?”
অপর প্রান্ত হতে নেকা কান্না থামিয়ে বলল,
“আমি কে? আমাকে চিনো না? হ্যা চিনবে কি করে। এখন তো আর আমাকে চিনবে না। চেনার তো প্রয়োজন নেই। নতুন একটা পেয়েছো না। দিবারাত্রি তো তাতে বিভোর থাকো। চোখ বুজে খুলে তাকেই দেখো। চারদিকে তার সুভাস। কানে শুধু তার সুমধুর কন্ঠ ভাসে। এখন আর আমাকে চিনবে কী করে?”
দর্শন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। তারপর বলল,
“এক্সকিউজ মি, কে আপনি? আর এসব উল্টো পালটা কী বলছেন? নাম্বার চেক করে কল দিন। আমি রাখছি।”
ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল,
“একদম কল রাখবে না। আমি উল্টো পালটা বকছি? তুমি প্রেম করছো না?”
“সেটা আমার পার্সোনাল ব্যাপার। আপনাকে কৈফিয়ত কেন দেব? আমি প্রেম করলে আপনার কী?”
“অনেক কিছু।”
“আপনি কে বলুন তো?”
“আপনাকে ভালোবাসে এমন একজন।”
দর্শন চুপ করে গেল। তারপর ভাবতে লাগল এ আবার কে?
তাই চট করে উত্তর দিল,
“আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“তাতে কী? ব্রেক আপ বলেও একটা শব্দ আছে।”
“থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেব বলেও একটা লাইন আছে। ছ্যাচড়া কোথাকার। ফোন রাখ।”
দর্শন ধমকে উঠে।
অপর প্রান্ত হতে মুচকি হেসে বলল,
“দর্শন,,
দর্শন কল কেটে দিল। মোবাইল রেখে খেতে চলে গেল। খাওয়া শেষ করে ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। লাইট অফ করে মোবাইল নিয়ে শুয়ে পড়ল। অর্ষাকে কল দিতে যাবে তখনই দেখে যে ওই নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসড কল আর মেসেজ। মেসেজ চেক না করে অর্ষাকে কল দিল। কিন্তু কল যাচ্ছে না। বারবার সুইচড অফ বলছে। দর্শন চিন্তায় পড়ে গেল। ওই নাম্বার থেকে আবারও কল আসছে। দর্শন বিরক্তবোধ করছে। কল রিসিভ করে কিছু শক্ত কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে কল রিসিভ করল।
” দর্শন, আমি অর্ষা। কল কেটো না প্লিজ।”
দর্শন চমকে গেল। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নাম্বার দেখল। এটা তো সেই নাম্বার। অর্ষা এলো কোথায় থেকে। দর্শন মোবাইল কানে নিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“তুমি! ”
“হ্যা, আমি। কতবার কল দিলাম তোমাকে।”
“এটা কার নাম্বার? তোমার মোবাইল অফ কেন? মেসেঞ্জারে কল, মেসেজ কিছুই রিপ্লাই করছো না। তোমার নাম্বারও বন্ধ। আর তুমি এই নাম্বার থেকে কল দিচ্ছো। কার নাম্বার এটা?”
“এটা আমার নতুন নাম্বার। বাবা কিনে দিয়েছে।”
“তবে কিছুক্ষণ আগে যে একটা মেয়ে…..
অর্ষা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। ওর হাসি শুনে দর্শনের বুঝতে বাকি নেই।
” কন্ঠটা তো তোমার ছিল না। বুঝতে আমার এতটা ভুল হতে পারে না।”
“তুমি এতটাও ভুল না। আসলে কন্ঠ চেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। তাই ধরতে পারোনি।”
“আমাকে ট্রাই করছিলে? চরিত্র কেমন তা যাচাই করছিলে?”
“উহু, কনফিউজড করে ফান করছিলাম। নতুন নাম্বার তো তাই। অনেক মজা পেয়েছি।”
“আগের নাম্বার কী হয়েছে?”
“ওটা অফ। ওটা আর চালাব না। এখন থেকে এটাতেই পাবে আমাকে।”
“কেন? কোন সমস্যা হয়েছে? কেউ ডিস্টার্ব করছে?”
“হ্যা, একটা ছেলে ভীষণ বিরক্ত করছে। প্রায় এক বছর যাবত। কয়েকদিন আগে বাবাকে জানিয়েছি।”
দর্শন কথার কথা বলেছে কেউ বিরক্ত করছে কি-না। এখন দেখে সত্যি।
“বিরক্ত করছে? কে বিরক্ত করছে? নাম কী ছেলেটার? আমাকে বলোনি কেন? এতদিনে তো কিছুই জানলাম না। তুমি আমাকে কেন বলোনি? আমাকে কি তোমার বলা উচিত ছিল না?”
দর্শনের কণ্ঠস্বর বলছে ও ভীষণ রেগে গেছে।
অর্ষা বুঝতে পারছে না এখন কি বলবে। এটা কি দর্শনকে জানানো উচিত ছিল? না জানিয়ে ভুল করেছে?
“কাম ডাউন। তেমন ব্যাপার না। বিরক্ত করছিল বাবাকে জানিয়েছি। বাবা সব ম্যানেজ করে নিয়েছে।”
“কোথায় থাকে ছেলেটা? কী করে?”
“আমাদের উপর তলায় থাকে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সামনা-সামনি তেমন বিরক্ত করত না। মোবাইলে কল দিত, মেসেজ করত। বাবাকে জানানোর পর বাবা ওর বাবাকে জানিয়েছে। ওর বাবা কি করেছে জানো? আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তার ছেলের সাথে বিয়ে পাকা করার জন্য বাবার কাছে এসেছিল। বাবা খুব রেগে গেছেন। ওদের না করে দিয়েছে। আর বলে দিয়েছে উনার ছেলে যদি আর কখনো আমাকে বিরক্ত করে তবে আইনী স্টেপ নিবে। আর আমাকে সাবধানে থাকতে বলেছে। সিম চেঞ্জ করে দিয়েছে। কোন সমস্যা হলে জানাতে বলেছে।”
সব শুনে দর্শনের মাথায় যেন বাজ পড়ল।
“মাথা খারাপ তোমার? এত ইজিলি নিচ্ছো কিভাবে? সমস্যা সমাধান না আরো বেড়েছে। একই বিল্ডিংয়ে থাকো। কতটা আস্কারা পেলে ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে ছেলেকে শাসন না করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। আর তোমরা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছো বুঝতে পারছো ব্যাপারটা?”
“ফিরিয়ে দেব না তো কি করব? বিয়ে করে বসে থাকব?”
“আরে বোকা আমি তাই বলেছি? বলছি ছেলেটা রিজেক্ট হয়েছে, মোট কথা ওর ফ্যামিলি রিজেক্ট হয়েছে। মনে মনে একটা রাগ পোষণ হতে পারে। আর তুমি একা একটা ফ্ল্যাটে থাকো। তোমার বাবা সেই রাতে ফিরে। বুঝতে পারছো কত বিপদ আসতে পারে? ওই ছেলেটা যদি তোমার ফ্ল্যাটে ঢুকে যায়। যদি কিছু করে বসে?”
“আরে না, ওই ছেলের এত সাহস নেই। হাদারাম একটা। আর ফ্যামিলি যথেষ্ট ভালো। আমাকে ওদের অনেক পছন্দ তাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাটের দরজায় সিসি ক্যামেরা আছে। আর তাছাড়া আমি একা নই। আমার সাথে খালা মানে বুয়া থাকে।”
“দেখ, হাদারা ভেতরে ভেতরে বেশি বিপদজনক হয়। আমার তো তোমার জন্য প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে। তোমরা বাসা চেঞ্জ করো তাড়াতাড়ি।”
“এটা আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাট তাই চেঞ্জ করা পসিবল না।”
“অবশ্যই পসিবল। এই ফ্ল্যাট কাউকে রেন্টে দিয়ে দিবা। এখান থেকে যা টাকা পাবে তা দিয়ে অন্য জায়গায় রেন্টে থাকবা।”
“আইডিয়া ভালো তবে কার্যকরী নয়। তুমি অযথা এত চিন্তা করছো। এত চিন্তার কোন কারণ নেই।”
দর্শন কল কেটে দিল। ভিডিও কল দিল। অর্ষা রিসিভ করল। দর্শন মৃদু আলোয় বিছানার উপরে বসে আছে। এক পা ভাজ করা আর আরেক পা মেলে রাখা। চুল এলোমেলো। কপালে চিন্তার রেখা।
“আহা, এত চিন্তা কেন করছো? কিছু হবে না। আমরা না দেখে দরজা খুলি না। আর দরজার কাছে হাতের নাগালে প্রতিরক্ষার জন্য ছোট খাটো যন্ত্রপাতি রাখা আছে। নিজেকে আমি রক্ষা করতে পারব। ছোট থেকেই বাবা আমাকে ট্রেইনিং দিয়ে রেখেছে। তুমি শান্ত হও।”
“আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি অর্ষা। তাই ভীষণ ভয় হয়।”
দর্শনের আকুলতায় অর্ষার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায়। অর্ষা চুপ করে যায়। দর্শনের মুখ থেকে এমন আকুল করা কথা শোনার জন্য মরে যেতেও রাজি ও।
দর্শন প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“আচ্ছা এখন আমাকে নিয়ে আর ডায়েরি লিখো না?”
অর্ষা চমকে গেল ডায়েরির কথা শুনে। আশেপাশে তাকাল। না ডায়েরি তো নেই। কিছুক্ষণ আগেই দর্শনকে নিয়ে দু-চার লাইন লিখে যত্ন করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে। তাহলে দর্শন ডায়েরির কথা কি করে জানল?
অর্ষা চোখ ছোট ছোট করে মেকি হেসে বলল,
“কিসের ডায়েরি? আমি বুঝলাম না।”
দর্শন ওকে পর্যবেক্ষণ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“আহারে! ডায়েরি চিনো না? সিলভার কালারের মলাটে আবরণে ডাকা ছোট ডায়েরিটা। যেখানে এক জনকে নিয়ে পুরো উপন্যাস লিখে ফেলেছো।”
অর্ষা চোখ বড়বড় করে তাকাল। ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“তুমি কি করে জানলে?”
“তোমার ডায়েরি নিখোঁজ ছিল না কিছুদিন?”
অর্ষার মনে পড়ল সেসব দিনের কথা। তারপর চোখ বড়বড় করে বলল,
“তোমার কাছে ছিল? তুমি সব পড়ে ফেলেছো?”
অর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে নেকা কান্না জুড়ে দিল।
“তুমি খুব খারাপ। তোমার সাথে থাকি না। শয়তান ছেলে। অনুমতি ছাড়া আমার ডায়েরি পড়ে নিয়েছে। যাও ব্রেক আপ।”
দর্শন শুধু হাসছে। অর্ষা রাগে গজগজ করতে করতে কল কেটে দিল।
দর্শন শুয়ে পড়ল। আর মনে মনে বলল,
“ব্রেক আপ!”
তারপর আবারও মুচকি হাসল।
…..
পরেরদিন অর্ষা কলেজে গিয়ে দর্শনকে খুঁজছে। অর্ষা রণমুর্তি ধারণ করেছে। চোখ মুখ খিঁচে রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটছে। মনে হচ্ছে দমকা হাওয়া নিয়ে তুফান আসছে৷ দর্শন, রুশান, রাতুল আর তামিম ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বলছে।
হঠাৎ রুশান ওর কাঁধে আলতো করে দুবার আঘাত করে বলল,
“তুফান আসছে।”
দর্শন ওর কথা শুনে ভরকে গেল। তারপর পেছনের দিকে তাকাল। অর্ষা যেন রকেটের গতিতে ওর দিকে আসছে। মনে হচ্ছে সাইক্লোন ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
রুশান অর্ষাকে এভাবে দেখে দর্শনকে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে কী করেছিস? এত ক্ষেপেছে কেন? আজ তো মনে হচ্ছে বোমা ফাটাবে।”
দর্শন ওর ধেয়ে আসার কারণ জানে। অর্ষা ততক্ষণে ওর সামনে চলে এসেছে। কোমড়ে দুহাত ভাজ করে রণমুর্তি ধারণ করে গর্জে উঠে বলল,
“আমার কল রিসিভ করোনি কেন? এতগুলো মেসেজ দিলাম কোন রেসপন্স কেন পেলাম না। গতকাল যে বললাম ব্রেক আপ তারও কোন রিয়েকশন নাই। ঘটনা কী? কী মতলব আঁটছ?”
“ওই যে ব্রেক আপ। ব্রেক আপ হয়ে গেছে এখন তুমি প্রাক্তন। প্রাক্তনের কল কেন রিসিভ করব? প্রাক্তনের কল রিসিভ করতে নেই। পাপ হয় পাপ।”
অর্ষা রাগে ফুসফুস করছে। নাক ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
“দেখেছেন রুশান ভাইয়া, ও কত খারাপ? ব্রেক আপ বলেছি কই আমাকে মানাতে আসবে তা না বলছে আমি না-কি প্রাক্তন। আমি গ*লায় দ*ড়ি দেব, বি*ষ খাব তারপর ওকে ফাঁসিয়ে দেব।”
অর্ষা হনহন করে হেঁটে চলে গেল। রুশান ওর চলে যাওয়া দেখে বলল,
“পাগল কেন ক্ষেপিয়েছিস?”
“আমি জানি না-কি এত ক্ষেপে যাবে? হুটহাট ব্রেক আপ বললে কি করব?”
“এখন যা, রাগ ভাঙা।”
দর্শন অর্ষার রাগ ভাঙাতে গেল। তামিম আর রাতুল ক্লাসে গেল। রুশান দাঁড়িয়ে আছে। অর্পা কোথাও থেকে ছুটে এল ওর কাছে। অর্পাকে দেখে রুশান বলল,
“এক তুফান যেতে না যেতে আরেক তুফান কই থেকে উদয় হলো?”
অর্পা ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না।
“মানে? কীসের তুফান?”
রুশান আলতোভাবে হাসল। তারপর বলল,
“কিছু না। কী বলতে এসেছিলে?”
“ওই আসলে মেম…. ওয়েট ওয়েট। আমি কি এমনি আসতে পারি না? কিছু বলতেই কেন আসব?”
“অদ্ভুত তো। মেয়েরা এত ওভার রিয়েক্ট কেন করে? সহজ জিনিস কেন প্যাচায়?”
অর্পা কর্কশ গলায় বলল,
“মেয়েরা? কোন মেয়েরা?”
রুশান পড়ল বিপদে। দর্শনের লাইফে যে সাইক্লোন আসতে যাচ্ছিল সেটা ট্রান্সফার হয়ে ওর কাছে কেন চলে এল? হোয়াই?
“কোন মেয়ে না। তুমি এমনিতে অবশ্যই আসতে পারো কিন্তু যেভাবে দৌড়ে এলে তাই মনে হচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু তাই জিজ্ঞেস করেছি। জিজ্ঞেস করে কি পাপ করে ফেলেছি?”
“হ্যা, ফেলেছো। আর এই পাপের শাস্তিস্বরূপ যেটা বলতে এসেছিলাম সেটা আর বলব না।”
অর্পা রুশানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল। রুশান কিছুই বুঝতে পারল না। কি বলতে এল কি বলে গেল। রুশান মাথা চুলকাচ্ছে আর বিরবির করে বলছে,
“আমি করলামটা কী?”
অর্পা গেল ওর ক্লাসের মেয়েদের কাছে। কয়েকদিন পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সিনিয়র হিসেবে দায়িত্ব ওদের উপরে দিয়েছে মেম। প্রতিটি সেকশনে পার্টিসিপ্যান্ট কালেক্ট করে যাচাই-বাছাই করা। ফাইনালিস্ট করবে স্যার মেমরা। ওদের প্রতিষ্ঠানে ক্লাস সিক্স থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত স্টুডেন্ট আছে। এদের মধ্যে থেকে আলাদা করে পার্টিসিপ্যান্ট সিলেক্ট করতে হবে। স্যার মেমদের সর্বোপরি সব কাছে হেল্প করতে হবে। তাই ওরা এখুনি কাজ শুরু করে দিচ্ছে। এটা বলতে গিয়েছিল রুশানকে। কিন্তু রাগ করে চলে এল।
….
অর্ষা লাইব্রেরিতে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সামনে নেই বই কিংবা খাতা। কাঁধের ব্যাগ কাঁধেই আছে। ঝুঁটি করা চুলগুলো খুলে নিয়েছে। ডান হাতে রাবার ব্যান্ডটা মুঠো করে ধরে আছে। বাম হাতটা টেবিলের উপরে আঙুল ছড়িয়ে রাখা। দর্শন এসে ওর বাম হাতটা টেনে উঁচু করে নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। অর্ষা বিস্ময় আর রাগান্বিত হয়ে কিছু বলতে গেলে ওর ঠোঁটে আঙুল দিল দর্শন।
“হিশশ,, এটা লাইব্রেরি। কথা বলা নিষেধ। চুপচাপ বাইরে এসো।”
অর্ষা বাধ্য হয়ে ওর সাথে বাইরে এল। দর্শন তখনও ওর হাত ধরে আছে। মাঝেমধ্যে অর্ষার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। অর্ষা মুখের আবরণ এখনো নরম হয়নি।
অর্ষা শক্ত গলায় বলল,
“কি হলো এভাবে নিয়ে এলে কেন?”
“তুমি না বললে আমার উচিত তোমার রাগ ভাঙানো, তোমাকে মানানো?”
অর্ষা ঝারা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
“আমার রাগ ভাঙাতে হবে না মানাতেও হবে না তোমার।”
অর্ষা চলে যাচ্ছিল পেছনে থেকে দর্শন শীতল কণ্ঠে শুধু বলল,
“অর্ষা!”
অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। ওর ডাক অগ্রাহ্য করার শক্তি ওর নেই। পেছনে ঘুরে তাকাল। দর্শনের ডান হাতে একটা পায়েল ঝুলিয়ে রেখেছে। ওর চোখ মুখ তখনও থমথমে।
“প্রথম কোন মেয়ের জন্য কিছু কিনলাম। আশা করি ফিরিয়ে দেবে না।”
অর্ষা রাগ উধাও হয়ে গেল। প্রথম ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কিছু পাচ্ছে। কি করে ফেরাবে? মাথায় তাজ করে রাখবে। অর্ষা দু পা এগিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দর্শন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। অর্ষার পায়ে কলেজের কেডস, মোজা। মোজার উপর দিয়েই দর্শন পায়েল পরিয়ে দিল। সাদা রঙের পায়েলে সাদা পাথর জ্বলজ্বল করছে। অর্ষা পায়ের দিকে তাকাল। আর দর্শন ওর মুখের দিকে। অর্ষার চোখমুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। এ যেন সামান্য পায়েল নয় হিরা-মুক্ত পেয়ে গেছে। দর্শন অর্ষার মুগ্ধ মুখের দিকে বিভোর হয়ে চেয়ে আছে।
চলবে……