প্রেম_তুমি,১৩,১৪

0
236

#প্রেম_তুমি,১৩,১৪
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৩

দর্শন কলেজে এসেই অর্ষাকে খুঁজছে। গতকাল রাতে ১১টা কল আর অসংখ্য মেসেজ করেছে কিন্তু রিপ্লাই পায়নি। সকালেও কল দিয়েছে রিসিভ করেনি। এর কারণ বুঝতে পারছে না দর্শন। তাই কলেজে এসে প্রথমেই অর্ষাকে খুঁজছে। অর্ষার ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছে। ওর বন্ধুদের দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওদের জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কথা বলতে অস্বস্তি লাগে ওদের সাথে। তাই সরাসরি ক্লাসেই যাচ্ছে। ওর ক্লাসে গিয়ে ওকে খুঁজতে লাগল। ক্লাসে নেই অর্ষা। ওকে না দেখে ওর বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। অর্ষা ক্লাসে আসেনি কেন? অসুস্থ? কোন সমস্যায় পড়েনি তো? দর্শন আবারও ওর নাম্বারে কল দিতে দিতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। দর্শন নিজের ক্লাসের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ পুকুর পাড়ের দিকে চোখ আঁটকে গেল। ও ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল। মোবাইলে কল কেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হ্যা, অর্ষাই তো প্রিয়ার সাথে। ওর হাতে মোবাইল। দর্শন আবারও কল দিল। কল দিতে দিতে ওর দিকে এগিয়ে গেল। অর্ষা কল দেখেও মোবাইল রেখে দিল। এর মানে ইচ্ছে করেই কল ধরেনি। কিন্তু কেন? দর্শন কল কেটে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অর্ষা ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে৷ বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন নাক সরু করে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে। অর্ষার থমথমে মুখ দেখে দর্শনের রাগ লাগছে।

“প্রবলেম কী তোমার? গতকাল থেকে কল রিসিভ করছো না কেন? আর এখন কল দেখেও ইগ্নোর করছো। হোয়াই?”

অর্ষা থমথমে মুখে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আমি আসলে…গতকাল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে লেট হওয়ায় মোবাইল দেখা হয়নি।”

“এণ্ড নাও? এক্সপ্লেইন করো।”

“ওই, আসলে প্রিয়ার সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলছিলাম। তাই ভেবেছিলাম দু মিনিট পর কল দেই।”

দর্শন প্রিয়ার দিকে তাকাল। প্রিয়া ওর তাকানো দেখে ঘাবড়ে গেল।
“প্রিয়া, কী কথা হচ্ছিল?”

“ওই, ভাইয়া আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম।”

“অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী?”

প্রিয়া অর্ষার দিকে তাকাল। তারপর তাড়া দেখিয়ে বলল,
“অর্ষাকে জিজ্ঞেস করুন ও বলে দিবে। আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে আমি নাহয় যাই।”

প্রিয়া চলে যেতে নিলে অর্ষা বলল,
“দাঁড়া আমিও তো যাব। আমারও তো ক্লাস আছে।”

প্রিয়া ওর কথা শুনে বলল,
“আগে এই ক্লাসটা শেষ কর। এটা গুরুত্বপূর্ণ বেশি।”
প্রিয়া এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল। অর্ষা আঁটকে গেল। দর্শনের দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বলল,
“আমি তোমাকে পরে কল করে নেব। ক্লাসে….

” রাখো তোমার ক্লাস। গতকাল রাত থেকে আজ কিছুক্ষণ অবধি এভাবে টেনশন দেওয়া আর হেনস্তা করার রিজন কী?”

“কোন রিজন নেই। আর তাছাড়া আমি কোন হেনস্তা করিনি।”

“হেনস্তা করোনি? ওকে ফাইন। তা গতকাল রাতে এমন অদ্ভুত টাইপ মেসেজ দিয়ে আমাকে কল ব্যাক করতে বাধ্য কে করল? আর কল দেওয়ার পর তুমি কী…..

অর্ষা তাড়া দিয়ে বলল,
” আমার ক্লাস!”
অর্ষা ওর কোন কথা না শুনেই ভো দৌড়। দর্শন ভ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে রইল। অতঃপর সে কারণ উউদঘাটন করতে সক্ষম হলো। অর্ষা গতকাল যা করেছে সেজন্য নিজেকে লুকিয়ে রাখছে৷ ওকে এভাবে ইগ্নোর করছে। দর্শন মজা করার জন্য ইস্যু পেয়ে গেল।

অর্ষা যেখানে যাচ্ছে সেখানেই দর্শনকে দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সারাদিন ফলো করে যাচ্ছে। তাই অর্ষা নিজ থেকে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কোমড়ে দুহাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুমি এভাবে আমাকে ফলো করছো কেন?”

দর্শন না বুঝার ভান করে বলল,
“ফলো? আমি! তোমাকে? হাউ ফানি? আমি না তোমার বয়ফ্রেন্ড? তাহলে ফলো কেন করব? যেভাবে বলছো মনে হচ্ছে আমি বখাটে ছেলে তোমাকে ইভটিজিং করছি।”

অর্ষা ভাবল ঠিকই তো। ওর কথায় যুক্তি আছে। বয়ফ্রেন্ড যদি গার্লফ্রেন্ডের পেছনে ঘুরে সেটা ইভটিজিং হয় না।
তখনই দর্শন বলল,
“হিসাব অনুযায়ী তোমার আমার পেছনে ঘোরার কথা।”

“কেন? কেন?”
অর্ষা ঘনঘন পলক ফেলছে।

দর্শন ভাব নিয়ে বলল,
“কারণ গতকাল একজন বলেছিল আমি দেখতে খুব কিউট। একটু বেশিই কিউট। আমাকে দেখলে মেয়েরা হুশ হারিয়ে ফেলে। প্রেমে পড়ে যায় ব্লা ব্লা। সেও নাকি আমার কিউট কিউট পিক দেখে দিনে পনেরো বার অজ্ঞান হয়ে যায়।”

“মোটেও না। আমি পনেরো বার অজ্ঞান হইনা।”

“আমি কী তোমার কথা বলেছি?”

“তাহলে কার কথা? কে পনেরো বার অজ্ঞান হয়?”

“ওহ আচ্ছা! তুমি! সে তুমি ছিলে? আমি কী সত্যিই কিউট?”
দর্শন বাকা হাসল। অর্ষা লজ্জা পেয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,
“হয়েছে হয়েছে। তুমি নিজেকে যতটা কিউট ভাবছো তুমি ততটাও কিউট না। তোমার চেয়ে আমি বেশি কিউট।”

দর্শন ওর চেহারা দেখে হেসে ফেলল। তারপর ওর গাল টেনে বলল,
“অবশ্যই তুমি কিউট। কিউট না হলে প্রেমে পড়েছি।”

অর্ষা গালে হাত দিয়ে লাজুক হাসল। দর্শনের ওর লজ্জা মাখা মুখ দেখতে ভালো লাগে। তখন অর্ষাকে একদম অন্য রকম লাগে।
“তোমার লজ্জা মাখা মুখ আমার ভীষণ প্রিয় অর্ষা।”

অর্ষা আরো লজ্জা পেয়ে গেল। দর্শন ওর হাত ধরে বলল,
“চলো, ফুচকা খেয়ে আসি।”

….

দর্শন আর অর্ষা এক সাথে ফুচকা খাচ্ছে। দর্শনের ইচ্ছে করছে ওকে খাইয়ে দিতে। যেমনটা বন্ধুদের দেখেছে। কিন্তু বিষয়টা হঠাৎ বেশি নেকামো মনে হচ্ছে। আর মানুষ দেখলে কী বলবে? আর অর্ষাই বা কী ভাববে? ওদের সম্পর্কের এখনো সপ্তাহ পেরোয়নি। আলিশা ফুচকা স্টলের পেছনে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে। ওরা এক সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর ফুচকা খাচ্ছে। এই দিনটা কখনো আসবে ভাবতে পারেনি। দর্শনকে একদম আলাদা ভেবেছিল। ভেবেছিল ওর কাছ থেকে কোন মেয়েই পাত্তা পাবে না। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় অর্ষা ওর গার্লফ্রেন্ড। আলিশা চোখ বন্ধ করে বড়বড় নিশ্বাস নিল। তারপর আবার চোখ খুলল। ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিরবির করে কিছু বলল।

ক্লাস শেষে অর্ষাকে অর্পা ওদের আড্ডাতে ডাকল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দর্শনের পাত্তা পাচ্ছে না। দর্শন বন্ধুদের সাথেই কথা বলছে অথবা চুপ করে আছে। তামিম মন খারাপ করে বসে আছে। ইদানীং ও কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। রাতুল ওকে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে তুই চুপ কেন?”
সবাই তামিমের দিকে তাকাল। ও উত্তর দিল না। শুধু আলতো হাসল।

রুশান মসকারা করে বলল,
“আরে গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে।”

আরেকজন বলল,
“আহারে! বেচারা।”

আরেকজন বলল,
“গার্লফ্রেন্ড যা যা নিয়েছিল ফেরত দেয়নি?”

তামিম মলিন হাসল। তারপর বলল,
“হ্যা, মন নিয়েছিল সেটা আবার ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আর কী চাই?”

সবাই ওর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। দর্শন সবার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি দিল। তারপর তামিমকে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে বল তো? কিছুই বুঝতে পারলাম না।”

“আমার ব্রেক আপ হয়েছে।”

“ব্রেক আপ? কিসের ব্রেক আপ? তোর তো কোন রিলেশনই নাই। তুই তো সিঙ্গেল।”

“না,আসলে আমার এলাকায় আমার একটা রিলেশন ছিল। তোদের কাছ থেকে লুকিয়েছিলাম। ও আসলে আমার প্রতি এতটা অবসেস ছিল যে আমি ওকে ফেরাতে পারিনি। প্রথম দিকে অনেক সময় দিতাম কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারছিলাম আমার পড়াশোনায় ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। আমি পিছিয়ে পড়ছিলাম। তারপর ওকে বললাম পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে। আগের মতো এত সময় দিতে পারব না। ও আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। পড়ায় মনোযোগ বাড়াতে বলেছিল। একদিন সকাল বেলায় দেখি একটা ছেলের সাথে আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। আমি তখনই কল দেই। ও বলে ওর পরিচিত একজন। দোকানে যাচ্ছিল। তখন অনেক কথা কাটাকাটি হয়। রাতের বেলায় আমাকে কল দেয় ভেবেছিলাম সরি বলবে। কিন্তু না ও বলে ব্রেক আপ করতে চায়। আমি রিজন জানতে চাইলে জানাল আমি ওকে সময় দেইনা, একজন বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ওর জন্য যা যা করা দরকার আমি তার কিছুই করি না। ওর লোনলি ফিল হয়। আমি শুধু আমার পড়াশোনা নিয়ে থাকি। তাই ও ব্রেক আপ করতে চায়। আর যার সাথে ওকে দেখেছিলাম সে ওর নতুন বয়ফ্রেন্ড। আমি যেন ওকে আর বিরক্ত না করি। বিশ্বাস কর এই কথাটা শোনার পর আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন আমার কিছুই ভালো লাগে না। পড়াশোনাটাও শেষ। মোট কথা আমি পুরো দমে শেষ। কিঞ্চিৎ শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি।”

সবাই ওর কথা শুনে স্তব্ধ। তামিমের চোখ ছলছল করছে। যে ছেলেটা দর্শনকে সব সময় প্রেম ভালোবাসায় জড়াতে নিষেধ করত সে যে কখনো প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে এত বড় আঘাত পেয়ে এসেছে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি।
তামিম চোখের কোন থেকে পানি মুছে বলল,
“লাস্ট এক মাস আমি মানসিক অশান্তিতে ছিলাম। একটা ট্রমার মধ্য ছিলাম। ইনফ্যাক্ট এখনো আছি। এটাই কী ভালোবাসা? এই ভালোবাসার জন্য এতটা পাগলামি করেছে? সব মিথ্যে ছিল। অভিনয় ছিল। আমি বোকা ছিলাম, বুঝতে পারিনি। তোরা কেউ প্লিজ আমার মতো ভুল করিস না৷”

দর্শন অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষাকে ভালোবেসে ভুল করেনি তো? অর্ষা ওকে এভাবে কষ্ট দিবে না তো? অর্ষাকেও তো এতটা সময় দেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব না। ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী। যা ওর স্বপ্ন পূরণের অন্যতম সোপান। এইচএসসির পর মেডিকেলের জন্য অক্লান্ত যুদ্ধ। এসবের মধ্যে অর্ষাকে পাশে পাবে? না অর্ষা দূরে ঠেলে দিবে ওকে। দর্শন ওকে শান্তনা দেবে কি ও নিজেই ভাবনায় পড়ে গেছে। অর্ষার দৃষ্টি হঠাৎ দর্শনের দিকে গেল। দর্শনের এই অসহায়, চিন্তিত দৃষ্টি কিছু একটা বলছে। তামিমের পরবর্তী কথায় সবটা ক্লিয়ার হলো অর্ষার।
তামিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এইজন্য তোকে নিষেধ করেছিলাম দর্শন। আমি চাইনা যে ব্যথা, যে ধোঁকা আমি পেয়েছি সেটা যেন কেউ আর না পায়। কেউ যেন আমার মতো ডেস্ট্রয় না হয়।”

সবাই অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা একবার আড়চোখে দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর কাউকে কিছু না বলে হুট করে উঠে যায় আর হনহন করে হাঁটতে লাগল। পেছনে থেকে অর্পা ডেকে উঠে। সাথে দর্শনও। কিন্তু অর্ষা থামেনি। ও চলছে ওর মতো।

চলবে…..

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৪

ভর দুপুর। মাথার উপর তেজস্বী সূর্য তার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। অর্ষা চুপচাপ বসে আছে কলেজের পেছনটায়। ভর দুপুরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সেখানে মাথার উপর বড় বড় পাম আর আম গাছ রাজত্ব করছে। পায়ের নিচে ছোট ছোট ঘাস লতা। দেয়াল ঘেঁষে একটা ছোট ঝোপের আনাগোনা। আম গাছে মৌমাছির চাঁক। মৌমাছি চাঁকের চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। অর্ষা বড় আম গাছের শেকড়ে বসে এক মনে সেদিকে চেয়ে আছে। ভর দুপুরে এই নিশ্চুপ পরিধিতে পাতার মরমর শব্দে অর্ষা চমকে গেল। চমকে গিয়ে চট করে পেছনে ঘুরল। দর্শন চিন্তিত আর বিমর্ষ মুখে অর্ষার দিকে আসছে। দর্শনের কপালে ভাজ পড়েছে। বিরক্ত আর রাগ ভ্রু যুগল, চোখ, ঠোঁট, নাক, গালসহ পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্ষা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণাটা আবার চড়া দিয়ে উঠল।

দর্শন ঠিক ওর পেছনটাই দাঁড়িয়ে বলল,
“এসবের মানে কী অর্ষা? এখানে বসে আছো কেন? এটা তোমার বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বা সময় কোনটাই না। জানো কত বিপদ হতে পারত?”

অর্ষা মুখ ফিরিয়ে রেখেই মলিন হাসল। তারপর তাচ্ছিল্য করে বলল,
“চিন্তা করো না মরব না। মরার হলে মায়ের সাথেই মরে যেতাম। প্রাপ্ত বয়স্ক শক্তপোক্ত মানুষটা মরে গেলেও একদিন পূর্ণ না হওয়া অসহায়, দূর্বল বাচ্চাটা বেঁচে গেছে সেখানে এখন কীসের ভয়?”

অর্ষার অভিমানী কথাগুলো দর্শনকে নরম করে দিল। দর্শন ওর পাশে গিয়ে বসল। অর্ষা একটু নড়ে-চড়ে বসল। হাতটা গুটিয়ে নিল কিন্তু দর্শনের দিকে তাকাল না। দর্শন এক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।
তারপর আকুলতা নিয়ে বলল,
“এসব কেন বলছো অর্ষা? তোমার কথাগুলো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।”

অর্ষা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে কান্না আটকানোর। কিন্তু পারল না। চোখে পানি এসে পড়েছে। গলা ধরে আসছে। বুক ভারি হয়ে গেছে। ধরা গলায় বলল,
“কষ্ট হয়? যখন তোমার বন্ধু আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ ধারণা দিল তখন তোমার কষ্ট হয়নি? যখন সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি দিল তখন তোমার কষ্ট হয়নি? আমার অপমান চুপচাপ মেনে নিতে কষ্ট হয়নি? আমি কষ্ট পাচ্ছি বুঝেও তোমার কষ্ট হয়নি? তাহলে এখন কেন হচ্ছে?”

অর্ষার গাল বেয়ে পানি পড়ল। অর্ষা ডান হাত উল্টো করে গালের পানি মুছে বলল,
“কষ্ট তো আমার হয়েছে যখন তোমার চোখে অনিশ্চয়তা আর আমাকে নিয়ে ভীতি দেখেছি। কষ্ট তো তখন হয়েছে যখন তোমার চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ দেখেছি। তোমার ওই দৃষ্টি আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে।”

দর্শন দু’হাতে অর্ষার ডান হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“অর্ষা, কিছু সময়ের জন্য আমি ভয় পেয়েছি কিন্তু তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। ট্রাস্ট মি প্লিজ। লুক, যারা সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসে তারাই ভালোবাসা হারানোর ভয় পায়। আমিও পেয়েছি। তুমি আমার ভয় দূর করে দেও প্লিজ। আমি আর কিচ্ছু চাইনা।”

অর্ষা কথা বলছে না। এখনো কাঁদছে। দর্শন ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“ডোন্ট ক্রাই প্লিজ। যদি ভুল করে থাকি তবে সরি।”

অর্ষা ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
“জন্মের সময় মা আমাদের বাবা-মেয়েকে নিঃস্ব করে চলে গেছেন। তাদের প্রেমের বিয়ে হওয়ায় শুধুমাত্র বাবার আদরে বড় হয়েছি। বাবা ছাড়া কারো ভালোবাসা পাইনি আর কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পাইনি। আমি যদি তোমাকে ভালো না বাসতাম, না চাইতাম তবে এতদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম না। তোমার পেছনে যত সময় ব্যয় করেছি ততদিনে আমার একটা রিলেশনের দু’বছর হয়ে যেত। আমি তোমাকে সত্যিকারের অর্থে ভালোবেসেছি তাই অপেক্ষা করেছি। সেই ক্লাস টেনে তোমাকে প্রথম দেখেছি। তখন থেকে তোমার পেছনে পড়ে আছি….

দর্শন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
” ক্লাস টেন? আমি তো ভেবেছি কলেজ থেকে।”

“না, জানুয়ারি মাস। সেদিন আমাদের টেনের স্টুডেন্টদের ভর্তি ডেট ছিল। তুমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। কোন একটা দরকারে তোমার বাবার সাথে স্কুলে এসেছিলে হেড স্যারের সাথে কথা বলতে। আমিও গিয়েছিলাম স্যারের রুমে। তুমি আর তোমার বাবা থাকায় আমাকে ওয়েটিংয়ে বসিয়ে রাখা হলো। তখন তোমাকে প্রথম দেখি। তুমি হেসে হেসে স্যারের সাথে কথা বলছিলে।”
অর্ষা কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল অন্য জগতে বিরাজ করছে। ওর চোখেমুখে হাসির রেখা।
“আরে, এতগুলো দিন যদি অপেক্ষা করতে পারি তবে তুমি কী আমার উপর একটু ভরসা রাখতে পারবে না?”

“ওকে। আমি ভুল করেছি। আ’ম সরি। তবে প্লিজ আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না।”
অর্ষা ওর আকুলিত চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“ছাড়ব না। ছেড়ে যাব না। তুমি প্লিজ কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে কখনো অবহেলা, অবজ্ঞা করো না। আমি কারো অবহেলা মেনে নিতে পারি না।”

“অবহেলা কেন করব? একটা সম্পর্কে একে অপরকে স্পেস আর সাপোর্ট দেওয়া দুটোই প্রয়োজন যা আমরা দু’জন দুজনকে দেব। তখন অবহেলা করার প্রশ্নই আসে না।”

“অবহেলা! অবহেলা হলো ধরো তুমি যদি কখনো আমাকে তোমার লাইফে সেকেন্ড অপশনে রাখলে অথবা আমার জন্য তোমার ফার্স্ট প্রায়োরিটির কোন ক্ষতি হলো অথবা তোমার মন পালটে গেল।”

“এমনটা কেন হবে? এমনটা কখনো হবে না। আমি অনেক ভেবেচিন্তে এই সম্পর্কে এসেছি। আমি টাইম পাস করার জন্য তোমার সাথে আছি তা নয়। কিংবা দু,চার-পাঁচ বছর তোমার সাথে কমিটেড থাকব তাও নয়। আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই এজ হাসব্যান্ড ওয়াইফ। কারণ আমি মনে করি আমার লাইফ পার্টনার হওয়ার সব এবিলিটি তোমার আছে। কিছু এদিক সেদিক আছে সেটা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে অথবা ঠিক করে নেব। আমি এইচএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়ব। তারপর ভালো একটা হসপিটালে জয়েন করব। জয়েন করেই বিয়ে করব। ভালো ক্যারিয়ার হবে সে আশায় বসে থাকব না। যদি তোমার না প্রব্লেম থাকে। বিয়ের পরেও পছন্দসই ক্যারিয়ার পড়া যায়।”

অর্ষা ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দর্শন কতদূর পরিকল্পনা করে ফেলেছে। অর্ষা তো কোন পরিকল্পনা করেনি। ওর-ও কি পরিকল্পনা শুরু করে দেওয়া উচিত? কিন্তু কী পরিকল্পনা করবে?
দর্শন তো বিয়ের পরিকল্পনা করেছে। তাহলে ও কী পরিকল্পনা করবে? বাচ্চাকাচ্চার? আচ্ছা ক’টা বাচ্চা হবে ওদের? একটা, দুইটা না তিনটা? না দুইটাই ঠিক আছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। পারফেক্ট। কিন্তু ছেলে মেয়ের কী নাম হবে? অবশ্যই ইউনিক হতে হবে। আজ সারা রাত নাম ভাববে। কিন্তু প্রথমে ছেলে হবে না মেয়ে?

অর্ষা প্রশ্নটা দর্শনকেই করে বসল,
“আচ্ছা আমাদের প্রথমে ছেলে হবে না মেয়ে?”
অর্ষা সিরিয়াস ভঙ্গিতে চেয়ে আছে। দর্শন ওর কথা আর ভঙ্গিমা দেখে ভরকে গেল। তারপর খুক খুক করে কাশতে লাগল। অর্ষা দুম করে এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে সেটা ভাবতেও পারেনি দর্শন।

ওর কথার উত্তর না দিয়ে একে বসা থেকে টেনে তুলল। তারপর বলল,
“এ-সব পরে ভাবা যাবে৷ এখন এখান থেকে চলো। আর কখনো এখানে একা একা আসবে না। যদি আসো তাহলে ভালো হবে না। আমি কিন্তু প্রচণ্ড রেগে যাব।…..

দর্শন নিজের মতো করে আরো কিছু বলছিল। কিন্তু অর্ষার কানে পৌছাল না। ও ভাবছে কিছুক্ষণ আগের কথা। হুট করে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দর্শনকে কি প্রশ্ন করে ফেলল। এখন তো চোখের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। দর্শন ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল কিন্তু অর্ষার হুশ হলো প্রশ্ন করার পর। আগে কেন হলো না? দর্শন মনে মনে কী ভাবছে? ছিঃ ছিঃ।

……

অর্ষা অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে প্রিতমের কথা বাবাকে জানিয়েছে। ছেলেটা আজকাল বড্ড বিরক্ত করছে। আগে ছাদে গেলে বিরক্ত করত। তাই ছাদে যায় না। একটার পর একটা সিম দিয়ে কন্টিনিউয়াসলি বিরক্ত করে যাচ্ছে। অর্ষা নিজের সিমটা পাল্টাতে পারছে না। বাবাকে কি রিজন দেখাবে? তাই আজ বাবাকে বলেই দিয়েছে ওর কথা। অর্ষার বাবা প্রিতমের বাবাকে বাসায় ডেকে জানিয়েছে ব্যাপারটা। তিনি বলেছেন এর একটা সমাধান করবেন। ভদ্রলোক প্রায়ই ওদের বাসায় এসে বাবার সাথে গল্প করে। আজও এসেছে। কি সমাধান করলেন তাই জানাতে। আগের মতোই অর্ষা সালাম দিয়ে ঘরে চলে যায়। বুয়া চা নাস্তা দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
ফ্রিজ থেকে পানি নিতে এসে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল অর্ষা। ওর কানে কিছু একটা ভেসে এল। চাপা কন্ঠস্বর বোঝার জন্য অর্ষা কান পেতে রাখল।
“আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছেন? আমার মেয়ে এখনো ছোট। এখনো আঠারো হয়নি। সতেরোতে পড়েছে। আপনার ছেলে ওকে প্রেম ভালোবাসার কথা বলছে। প্রেম ভালোবাসার বয়স কি ওর হয়েছে? আমার মেয়ের এ-সব নিয়ে কোন জ্ঞান নেই। ও আরেকটু বড় হবে। বুঝতে শিখবে। তখন আমিও ওকে বাঁধা দিতে পারব না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমার মেয়ে বলবে বাবা আমি ডিস্টার্ব ফিল করছি হেল্প করো। আমি করব।”

“আমি জানি আপনি ওকে খুব ভালোবাসেন। আর অর্ষা মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো। ওকে আমার ভীষণ পছন্দ। প্রিতম যখন ওকে….

” দেখুন প্রিতম নাহয় অবুঝ কিন্তু আপনি এই কথা কী করে বলছেন? অর্ষা ছোট। ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি। যখন হবে তখন প্রিতমকে ওর ভালো না-ও লাগতে পারে। এখুনি যখন ভালো লাগে না পরে লাগার সম্ভাবনা দেখছি না।”

“বড় হলে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রিতম ছেলে খারাপ নয়। আপনিও জানেন। ওদের বিয়েটা ঠিক করে রাখলে….

” আমি পারব না। অর্ষা আমার একমাত্র মেয়ে। ও যা চাইবে তাই হবে। ও যদি বড় হবার পর বলে প্রিতমকে বিয়ে করবে আমি আপত্তি জানাব না। কিন্তু অর্ষার অমতে প্রিতমের সাথে কিছুতেই আমি বিয়ে ঠিক করে রাখব না। প্রয়োজনও মনে করছি না। আপনি প্লিজ এসব নিয়ে আর কথা বাড়াবেন না। প্রিতমকে বলবেন ও যেন আর আমার মেয়েকে বিরক্ত না করে। আমার মেয়েকে বিরক্ত করলে আমি স্টেপ নিতে বাধ্য হব। আমার কাছে আমার মেতের ভালো থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ”

অর্ষা প্রিতমের বাবার প্রস্তাব শুনে তব্ধা খেলেও বাবার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।

…..

অর্ষা প্রিয়াকে সব জানানোর পর প্রিয়াও তব্ধা লেগে আছে৷ প্রিতমের বাবা সমাধান হিসেবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ওর কেন জানি হাসিও পাচ্ছে। প্রিয়া উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। অর্ষা ওর হাসি দেখে বলল,
“হাসতে থাক৷ আঠারো হতে দে।”

“আঠারো হলে কী করবি? আংকেলকে তোর আর দর্শনের রিলেশনের কথা জানাবি?”

“আরে নাহ! সে-সব জানাবো কেন?”

“তাহলে?”

“কয়েকদিন পর আমার সতেরো হবে তারপর আঠারো। আঠারো হলেই দর্শনকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করে ফেলব।”

প্রিয়া ওর কথা শুনে হাসতে লাগল। তারপর বলল,
“মানুষ ঠিকই বলে। প্রেমে পড়লে মানুষ বেক্কল হয়ে যায়। তুই ও তাই। তোর আঠারো হলেই কী দর্শন বিয়ে করতে পারবে?”

“কেন পারবে না? ”

“কারণ তোর আঠারো হলে দর্শনের একুশ হবে না। আর ওর একুশ না হলে বিয়ে করতে পারবে না।”

অর্ষার এতক্ষণে খেয়াল হলো। আসলেই বুদ্ধিশুদ্ধি সব খেয়ে ফেলছে। নিজের মাথায় নিজেরই বারি মারতে ইচ্ছে করছে।
“এতদিন প্রেম প্রেম করে পাগল হয়েছিস আর এখন বিয়ে বিয়ে করে পাগল হবি। দুদিন পর বাচ্চা বাচ্চা করে পাগল হবি।”

অর্ষা মনে মনে বলছে আসলেই পাগল আমি। কারণ আমি বাচ্চা নিয়েও পরিকল্পনা করে দর্শনের কাছে ফেঁসেছিলাম। অর্ষা বিরক্ত নিয়ে বলল,
“ধুর! সরকার ছেলেদের বিয়ের বয়স একুশ কেন করল? ওদের কি বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না?”
প্রিয়ার মাথায় হাত ওর কাণ্ডকারখানা দেখে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here