প্রেম_তুমি,পর্ব-১১,১২

0
221

#প্রেম_তুমি,পর্ব-১১,১২
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১১

অর্ষা গোলগোল চোখ করে দর্শনের দিকে তাকাল। দর্শন কলেজ ড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ, চোখে চশমা পরে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একবার চোখাচোখি হলো। তারপর প্রিয়ার দিকে কটমটে চোখে তাকাল।

প্রিয়া আমতা আমতা করে বলল,
“আমি কিছু জানি না। উনি আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”

অর্ষা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“ফাজলামো করিস? উনি কী আমার বাসা চিনে? তোকে নিয়ে এসেছে, না তুমি নিয়ে এসেছিস?”
অর্ষা চেঁচাতে লাগল।

প্রিয়া কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“আমাকে অনেক জোর করেছে তাই……

দর্শন এরই মাঝে হাতের ঘড়িটা দেখল। তারপর কপাল কুঁচকালো। অর্ষা আর প্রিয়ার দিকে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,
“স্টপ গাইস! তোমাদের বাকি গসিপ পরে বসে নিরিবিলি শেষ করো। আমাদের টাইমলি কলেজে যেতে হবে।”

তারপর অর্ষার দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে পাগলের মতো লাগছে। আর যেভাবে চেঁচামেচি করছো মানুষ দেখলে ভাববে চুলাচুলি করেছো। ডু ইউ নো হুয়াট্স চুলাচুলি?”

অর্ষা ওর কথা শুনে চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। তারপর নিজের দিকে তাকাল। একটা লম্বা টপ আর প্লাজু পরা। সারাদিন ল্যাদ খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ভাজ ভেঙে মুচড়ে আছে। চুলগুলো ঝুঁটি করা ছিল। হেয়ার রাবার থেকে অধিকাংশ চুল বের হয়ে ফোলে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই কেঁদেছে কান্নার দাগটাও হয়তো স্পষ্ট। উফফ! অর্ষা ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ল।

অর্ষা যখন নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত তখনই দর্শন বলল,
“তাড়াতাড়ি কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নেও। নয়তো লেট হয়ে যাব।”

কলেজের কথা শুনে অর্ষা ভীষণ ক্ষেপে গেল।
“কলেজ? কলেজে যাওয়ার উপায় রেখেছেন? আমি যাব না। আপনি আসতে পারেন। প্রিয়া যা এখান থেকে।”

দর্শন আরো শান্ত কন্ঠে বলল,
“গেটে দাঁড়িয়ে গেটের বাইরের মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়। একটু সৌজন্য বজায় রাখো। আশা করতে পারি তো?”

অর্ষা ওর কথা শুনে থমকে গেল। একটু লজ্জাও পেল। চোখ নামিয়ে বলল,
“আমি কলেজে যাব না।”

দর্শন সে-সব পাত্তা না দিয়ে বলল,
“ফেস ভালো করে ওয়াশ করো। তুমি যে কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছো সেটা তোমার ফেস দেখে যে কেউ বুঝবে।”

অর্ষা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। বলছে যাবে না আর ওদিকে তিনি মুখ ধুয়ে নিতে বলছে।
“এভাবে দেখার সময় অনেক হবে। এখন তাড়াতাড়ি করো। আরে ভাই ক্লাস এটেন করতে হবে তো। ফার্স্ট।”

অর্ষা আবারও বলল,
“বললাম তো আমি যাব না।”

দর্শন দু পা এগিয়ে এসে খপ করে ওর হাত ধরে বলল,
“এভাবেই চলো। তোমাকে এভাবেই কলেজে নিয়ে যাব।”

তারপর দর্শন ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার ভালোবাসার মানুষের ছোয়া পেয়ে শিহরিত হওয়ার বদলে ভয় পাচ্ছে। প্রিয়াও আঁতকে উঠে। অর্ষাকে টেনে লিফটের কাছে নিয়ে গেছে।
অর্ষা আতংকিত চোখেমুখে নিজের হাত টেনে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
“কী করছেন? কেউ দেখলে কী ভাববে? এই ড্রেস আপে কলেজে যাওয়া যায়?”

দর্শন ওর হাত চেপে রেখে লিফটের দরজা খুলছে। অর্ষা প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল,
“আমি যাব। আমি এখুনি তৈরি হয়ে আসছি।”

দর্শন সাথে সাথে ওর হাত ছেড়ে দিল। তারপর ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল,
“একটা প্রবাদ পড়েছ নিশ্চয়ই গাধা সেই পানি খায় তবে ঘোলা করে খায়।”
তারপর কঠিন কন্ঠে বলল,
“দশ মিনিটে রেডি হয়ে আসো।”

অর্ষা সীমাহীন রাগ নিয়ে রেডি হতে গেল। প্রিয়া দর্শনকে ভেতরে এসে বসতে বলল। দর্শন প্রিয়ার পেছনে পেছনে ভেতরে গেল। বিশাল বড় বসার ঘরটা দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। সোফায় বসতে বসতে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। বাড়িটা যথেষ্ট বড় এবং পরিপাটি। প্রিয়া অর্ষার রুমে গিয়ে বসল। অর্ষা ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকাল। নিজের দিকে চেয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করছে,
“দর্শন কেন এসেছে? ও এখানে আসবে সেটা আমার কল্পনাতীত। ও কি আমাকে সরি বলবে? না-কি এতদিন ধরে কলেজে যাচ্ছি না তাই কি কারো রিকুয়েষ্ট রাখার জন্য এসেছে? ধূর কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে আমার বিরুদ্ধে কেউ কোন কাজ করাতে পারবে না। তবুও দর্শনের কথা শুনে কলেজে যাচ্ছি শুধু রিজনটা জানার জন্য। তাছাড়া আমার মনটা বড্ড বেহায়া। দর্শনকে ফেরাতে পারছি না।”

অর্ষা ফ্রেশ হয়ে কলেজ ড্রেস-সু পরে, চুলে একটা ঝুঁটি করে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ক্রসবেল টেনে ঠিক করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে এল। দর্শন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়িটা দেখল। তারপর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হতে লাগল।

…..

অর্ষা গাড়ি থেকে নামার পর দেখল কয়েকজন পরিচিত সহপাঠী ওদের দিকে চেয়ে আছে। অর্ষা প্রিয়াকে বলল,
“এই যে আমরা এক সাথে নামলাম কেউ যদি রিজন জানতে চায় তখন কী বলব?”

দর্শন চশমা পরতে পরতে বলল,
“চাপ নিচ্ছো কেন? বলবে আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম আর তুমি দীর্ঘ পনেরো মিনিট উইদাউট চা-কফি ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখেছিলে। সিম্পল।”

অর্ষা ওর কথা শুনে থ। বলে কী? আবার চা কফি দেয়নি সেটাও বলে দিচ্ছে। এত বড় অপমান এত সহজ ভাষায়? অর্ষার নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। আসলেই তো প্রথম বার গিয়েছে চা-কফি দেওয়া উচিত ছিল। খালি মুখে বসিয়ে রেখেছিল।
অর্ষা নিচু স্বরে বলল,
“চা-কফি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল? আপনি আমাকে এক প্রকার জোরজবরদস্তি করে নিয়ে এসেছেন।”

দর্শন দাঁড়িয়ে গেল। ওর দিকে তাকাল। গভীর সে চাহুনি।
“তোমাকে জোর করে আনা সম্ভব যদি না তুমি নিজে আসো?”
অর্ষা বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকাল। দর্শন মুচকি হাসল। কত মিষ্টি সে হাসি। কত নির্মল,স্বচ্ছ!
প্রিয়া ওদের কথা বলতে দেখে সামনে আগাল। দর্শন একবার প্রিয়ার যাওয়ার দিকে চেয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। খুবই শান্ত হয়ে দাঁড়াল। অর্ষা বুঝতে পারছে না কি হতে চলেছে। বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। প্রিয়ার উপর রাগ হচ্ছে একা ফেলে পালাল।
“অর্ষা, আমি খুবই দুঃখীত। সেদিন আমি তোমার সাথে খুব বাজে আচরণ করে ফেলেছি। এমনটা করা উচিত হয়নি। আসলে ওরা আমার অনেক বছরের ফ্রেন্ড। পড়াশোনা আর বন্ধুর বাইরে আমার আর কোন লাইফ নেই। আর সেই বন্ধুরা যখন আমাকে নিয়ে একটা প্লান করে আর আমি অন্যের কাছ থেকে জানতে পারি তখন খুব কষ্ট পাই, ভেঙে পড়ি। আর সব ডিপ্রেশন ওদের আর তোমার উপর ঢালি। আমি তোমার সাথে মিশিনি তাই জানি না তুমি কেমন, কি করতে পারো। তাই তোমাকে অবিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে বলব ভুল করেছি কি-না জানি না তবে সরি বলতে চাই। প্লিজ মাফ করে দিও। আমি এই কাজের জন্য অনেক অনুতপ্ত ছিলাম। তোমাকে অনেক খুঁজেছি, তোমার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আর তুমি আমাকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছো। তাই আমি বাধ্য হয়ে তোমার বাড়িতে গিয়েছি যেটা আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। এর জন্যও মাফ চাইছি। তুমি আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করো, কলেজে আসো। এটা আমার অনুরোধ প্লিজ।”

দর্শন এমন ভাবে কথাগুলো বলল অর্ষা আর ওর উপর রাগ করতে পারছে না যেহেতু ওর উপর একটা সফট ফিলিং আছে৷
দর্শন আবারও বলল,
“প্লিজ ফরগিভ মি।”

অর্ষার খুব বলতে ইচ্ছে করল পাব্লিক প্লেসে অপমান করেছেন পাব্লিক প্লেসে সরি বলুন। কিন্তু বলতে পারল না। শুধু বলল,
“ওকে। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন যাই?”

দর্শনের মাথা থেকে যেন বোঝা নেমে গেল। হাফ ছেড়ে বাচল। মাথা নাড়িয়ে শায় দিল। অর্ষা ওর চেয়ে দু-কদম এগিয়ে যেতেই দর্শন পেছনে থেকে ডাকল। অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন ওর কাছে এসে চিন্তিত ভাব নিয়ে বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“হ্যা, অবশ্যই।”

দর্শন কপালে দ্বিগুণ ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা, তোমার চোখগুলো এত বড় বড় কেন?”

অর্ষা ওর প্রশ্ন শুনে হতবাক। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। অর্ষা শুধু বলল,
“মানে কী?”

“বললাম তোমার চোখগুলো এত বড় বড় কেন?”

দর্শনের মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়নি। অর্ষা কী উত্তর দিবে এই প্রশ্নের? কী উত্তর দেওয়া যায়? অর্ষা অনেক খুঁজে কোন উত্তর পেল না। তারপর ওর দিকে লাজুক এক্সপ্রেশন দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। যতই আগাচ্ছে ততই মুচকি মুচকি হাসছে।

….

অর্ষাকে ক্লাসের সামনে দেখে আলিশা বলল,
“আরে অর্ষা, কলেজে এসেছো? হোয়াট এ সারপ্রাইজ!”

“কেন কলেজে আসার জন্য তোমার পারমিশন নিতে হবে? কলেজে আসতে হলে তোমাকে কল করে তোমার পারমিশন নিতে হবে? না কলেজে এসে জানাতে হবে আমি এসেছি।”

“ভদ্রভাবে কথা বলো আমি তোমার সিনিয়র।”

“তো এখন আপনি বলে সম্বোধন করব?”

“হ্যা, করবে কারণ আমি তোমার বয়সে বড়।”

“ওকে আন্টি। আমি আপনাকে আর তুমি করে বলব না।”

আন্টি শব্দটা শুনে আলিশা রাগে ফেটে যাচ্ছে। গজগজ করতে করতে বলল,
“তুমি অনেক বাড় বেড়েছো।”

“কেন তুমি কী একাই বাড়বে? বাড়তে বাড়তে পাতাল থেকে আসমান ছুয়ে ফেলবে?”

আলিশা যতই ওর কথা শুনছে গায়ে আগুন জ্বলে যাচ্ছে। রেগেমেগে সে জায়গা থেকে চলে গেল। অর্ষা মুখ ভেংচি কেটে ক্লাসে চলে গেল। ক্লাসে যেতেই সব ফ্রেন্ডরা ওকে ঘিরে ধরল। সবার হাত থেকে ছাড়া পেলেও প্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল না। প্রিয়া ওকে জিজ্ঞেস করছে দর্শনের সাথে কী কথা হলো। অর্ষা উত্তরে শুধু বলল,
“সেটা জানার ইচ্ছে থাকলে আমাকে ফেলে ড্যাংড্যাং করে চলে আসতি না৷”

অর্ষা ডায়েরিতে একটা পাতায় লিখল,
“বহুদিন আগে যে ঘা দিয়েছিল আজ সে মলম লাগিয়ে দিয়েছে।”

……
কলেজ শেষে অর্ষা আর ওর বন্ধুরা এক সাথে বের হচ্ছিল। পেছনে থেকে দর্শন ওকে ডাকল। ওর ডাক শুনে অর্ষা দাঁড়িয়ে গেল। দর্শন ওকে বলল,
“সাইডে আসো কথা আছে।”

অর্ষা ওর সাথে সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দর্শন বলল,
“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”

অর্ষা হুট করে আপনি থেকে তুমিতে নেমে বলল,
“কী বলবে? এখন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে আমার নাকটা এমন বোঁচা কেন?”

দর্শন ওর কথা শুনে স্তব্ধ। তারপর ভালো করে ওর নাকের দিকে চেয়ে দেখল আসলেই ওর নাক বোঁচা কিন্তু ও এটা বলতে আসেনি।
“আমি এটা বলতে আসেনি। অন্য কিছু বলতে এসেছি।”

তারপর দুজন নীরব। কেউ কোন কথা বলছে না। চুপ করে আছে। নীরবতা কাটিয়ে দর্শন বলল,
“তোমাকে অল্প ভালোবাসলে চলবে?”

চলবে…….

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১২

অর্ষা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ওর হতবিহ্বল দৃষ্টি দর্শনের চোখ এড়ায়নি। অর্ষা এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। ওর হার্টবিট এতই বেড়ে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ডটা বের হয়ে মাটিতে ছিটকে পড়বে। অর্ষার ইচ্ছে করছে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে স্পন্দন মাপতে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছে না। অস্থির অস্থির লাগছে। তাই চুপ করে স্থির হয়ে আছে। ওর অস্থিরতা দূর করতে দর্শন আবারও প্রশ্ন করল,
“এই মেয়ে, অল্প ভালোবাসলে চলবে কি? উত্তর দিচ্ছো না কেন?”

অর্ষা সামান্য কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“হ্যা, মানে,, কি বললে?”

দর্শন মৃদু হাসল। তারপর মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“আরে দূর, শুনোনি? আমি বললাম তোমাকে অল্প ভালোবাসলে চলবে? কারণ আমি বেশি ভালোবাসতে পারব না। কেন জানো? আমার প্রথম ভালোবাসা হলো পড়াশোনা। তোমাকে বেশি ভালোবাসতে গিয়ে যদি স্বপ্নটা ভুলে যাই। তাই ভয় হয়।”

অর্ষা চাপা হাসল ওর কথা শুনে। চাপা হাসলেও সে হাসিটা দর্শনের চোখে পড়ল। অর্ষা আড়চোখে তাকাতেই দর্শনের চোখে ওর চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় চোখ মুখ কুঁচকে লাজুক হেসে সামনের দিকে পা বাড়াল। যেন পালাতে পারলেই হলো। যেতে যেতে ভাবছে যার জন্য এতদিন পাগল ছিল, যাকে প্রেমিক হিসেবে পাওয়ার জন্য এতগুলো দিন ধরে স্বপ্ন দেখে এসেছে আজ সে নিজে এসে ধরা দিয়েছে। সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। অথবা রুপকথার কোন গল্প। যেখানে রাজকন্যা তার রাজকুমারকে পেয়ে গেছে। রাজকুমার তার জন্য সাত সাগর তেরো নদী পাড় হয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রেম নিবেদন করতে এসেছে।
অর্ষা মিটিমিটি হাসছে। একবার পেছনে ঘুরে তাকাল। দর্শন দু’হাত ভাজ করে ওর দিকেই চেয়ে আছে।
অর্ষা মিষ্টি হাসল তারপর দর্শনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“হ্যা, চলবে।”
তারপর আবারও মিষ্টি হাসল। দর্শন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটের কোনেও হাসি।

গভীর রাত। বাড়িতে নীরবতা ছেয়ে গেছে। বাবা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ আগে এসে ওকে চেক দিয়ে গেছে ঘুমিয়েছে কি না।
অর্ষা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে ছিল। এখন শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করছে। দর্শনকে আনব্লক করে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিয়েছে। দর্শনও তখন ফেসবুকে ছিল। নোটিফিকেশন আসতেই চেক দিয়ে দেখল অর্ষা ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দিয়েছে। দর্শন না চাইতেও হেসে ফেলল। তারপর ওর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসল। ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করবে না। ঝুলিয়ে রাখবে ব্লক দেওয়ার শাস্তি হিসেবে। অর্ষা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল একসেপ্ট হবার জন্য। দর্শন হয়তো অনলাইনে নেই তাই ওর টাইমলাইনের পোস্টগুলো দেখছে। মেসেজ অপশন বের করে মেসেজ দেওয়ার জন্য। আঙুল কি-বোর্ডে রাখতে চেয়েও রাখছে না। শুধু শুধু মেসেজটা রিকুয়েষ্ট মেসেজে গিয়ে পড়ে থাকবে বড্ড অবহেলায় আর অবহেলা অর্ষা একদম নিতে পারে না। মোবাইল রেখে দিল। তারপর ভাবতে লাগল সকাল থেকে কলেজ থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্তের ঘটনাগুলো। দর্শন ওর বয়ফ্রেন্ড এটা ভাবতেই শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন একটা লাগছে। এ যে আকাশ ছোয়া অনুভূতি। ধরা-ছোয়ার বাইরে। অর্ষা চোখ বন্ধ করে চোখ খুলে শুধু দর্শনকেই দেখছে।

….

আজ অর্ষা একটু পরিপাটি হয়ে এসেছে। পরিপাটি বলতে কলেজ ড্রেসটা সুন্দর করে রেখেছে একটুও ঘোচাতে দেয়নি। চুলগুলো সুন্দর করে ঝুঁটি করেছে। এলোমেলো হতে দিচ্ছে না। মুখে একটু ফেস পাওডার মেখেছে। যথাসম্ভব ভদ্র মেয়ের মতো সুন্দর করে হেঁটে কলেজে ঢুকছে। কলেজ গেটটা পাড় করে ভেতরে আসার পরই ওর দুচোখ দর্শনকে খুঁজছে। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। দর্শনের সামনে পড়লে কি বলবে? কিভাবে তাকাবে ওর দিকে? আচ্ছা এমন নয় তো যে দর্শন গতকালের কথা ভুলে গেছে?
এসব নানান ভাবনায় বিভোর অর্ষা। তখনই কাঁধে ধাক্কা লাগায় হুশ হলো। পাশেই অর্পা। দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে মিটমিট করে হাসছে।

অর্ষা ওকে এভাবে হাসতে দেখে ভরকে গেল।
“অর্পা আপু কী হয়েছে?”

অর্পা ওর হাত ধরে বলল,
“কিছু হয়নি তবে হবে।”

অর্ষা নিজের হাতের দিকে চেয়ে ঘাবড়ে যায়। ঘাবড়ে আমতা আমতা করে বলল,
“কী হবে?”

অর্পা হেসে বলল,
“প্রমাণ হবে বেবি, প্রমাণ।”

“কীসের প্রমাণ?”

“তা তো বলা যাবে না। চলো আমার সাথে।”

অর্ষা বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ওকে ধরে কি দর্শনের কাছে নিয়ে যাবে? ধরে নিয়ে যাওয়ার কি আছে। দর্শন চাইলে নিজে এসে কথা বলতে পারে। মনে হচ্ছে অন্য কেস।

অর্পা যখন ওকে নিয়ে যাচ্ছে তখন দর্শন বন্ধুদের দ্বারা ঘেরাও অবস্থা। সবাই ওকে চেপে ধরেছে। হাসি-ঠাট্টা করছে। দর্শন অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ ওর কথা পাত্তা দিচ্ছে না। অর্ষা দর্শনকে দেখে থমকে গেল। দর্শনেরও ওর চোখে চোখ পড়ল। সবাই যখন অর্ষাকে দেখল তখন হাসি-ঠাট্টা থামিয়ে দিল। সবার তখন সিরিয়াস দৃষ্টি ওর দিকে। অর্ষা ওদের সবাইকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অবাক হচ্ছে। ওর মন বলছে কিছু একটা হয়েছে।

অর্পাও ওকে চেপে ধরে বলল,
“তোমাদের মধ্যে কী চলছে?”

অর্ষা একবার দর্শনের দিকে তাকাল। তারপর না জানার ভান ধরে বলল,
“কী চলবে?”

অর্পা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কী চলবে? না বোঝার ভান করছো? এতদিন পরে কলেজে এলে তাও দর্শনের সাথে। আমরা কিছু জানি না বুঝেছ? আমরা সবাই সবটা জানি। এখন নাটক করে লাভ হবে না।”

“তোমরা যদি সবটা জানতে তবে আমাকে জিজ্ঞেস কর‍তে না। জানো না বলেই জিজ্ঞেস করছো।”

ওর কথা শুনে সবাই দমে গেল। দর্শন ঠোঁট চেপে মৃদু হাসল। তারপর অপেক্ষায় রইল পরের ঘটনা দেখার।
অর্পা ক্ষেপে গেল। ওদের দুজনের ভাব-ভঙ্গিমা নিতে পারছে না। ওরা সরাসরি কিছু কেন বলছে না। ওর যে আর ধৈর্যে কুলাচ্ছে না।
“অর্ষা!! দেখ আমার কিন্তু প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বল। নয়তো এখন মার খাবি।”

অর্ষা এমন কথা শুনে ভরকে গেল। এতগুলো মানুষের সামনে ওকে মারার কথা বলছে। কি লজ্জা, কি লজ্জা!

দর্শন সামনে এসে উচ্চস্বরে হেসে দিল। তারপর নিজের দিকে সবার মনোযোগ নিয়ে বলল,
“গাইস! প্লিজ এদিকে। তোরা সবাই জানতে চাস অর্ষার সাথে আমার কী চলছে? এটাই তো? না বলতে চাস অর্ষার সাথে আমার প্রেম-ট্রেম চলছে? ওকে তাহলে শোন, ইয়েস! ওই আর ইন এ রিলেশনশিপ। আর সেটা গতকাল থেকে। সবাই হ্যাপি?”

সবাই চোখ বড়বড় করে ওর দিকে তাকাল যেন কি এমন অদ্ভুত আজগুবি কথা বলে ফেলেছে।
“তুমি তলে তলে টেম্পু চালাবা আর আমরা বললেই দোষ?”
রুশান চোখ ছোট ছোট করে বলল।

দর্শন ওর কথা শুনে বলল,
“ছিহ! এসব কী ল্যাংগুয়েজ?”

“ল্যাংগুয়েজ? তোকে তো আজ আমি আমার হাতের সব ল্যাংগুয়েজ বুঝাব। সেই কবে থেকে আমি আর অর্পা চেষ্টা করে যাচ্ছি তোকে বলে যাচ্ছি তখন ক্ষেপে গেলি। আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবি না হেন তেন আর গতকাল নিজে গিয়ে নাচতে নাচতে রিলেশন করে আসতে লজ্জা করল না?”

দর্শন স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“না লাগেনি। কেন লাগবে?”

অর্ষা অবাক হয়ে ওর কথা শুনছে, ওকে দেখছে। তাহলে আর থেকে সবাই জানবে ও দর্শনের গার্লফ্রেন্ড। ওদের রিলেশনটা পাবলিকলি চলে এসেছে। অর্ষার কিন্তু ভালো লাগছে বিষয়টা।

“লজ্জা লাগেনি সমস্যা নাই। তবে ট্রিট চাই।”
সবাই ট্রিট ট্রিট বলে হৈচৈ শুরু করে দিল।

….

আলিশা ক্লাসে যাচ্ছে আর তখনই অর্পা ওকে পেছনে থেকে ডাকল।
“আলিশা, শোন।”
আলিশা ওর কথা শুনে দাঁড়াল।

“দর্শন আমাদের আজ ট্রিট দিচ্ছে। তোকেও আসতে বলেছে। ক্লাস শেষে চলে আসিস।”

আলিশা খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“সত্যি! অবশ্যই আসব।”
আলিশা মনে মনে বেশ খুশি। ওর ভেতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। দর্শন ওকেও যেতে বলেছে তার মানে ওকে নিজেদের একজন ভাবছে।

খাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। সবাই যে যার মত গল্প করছে। নিজেদের মত ব্যস্ত। কিন্তু আলিশার চোখ দর্শনকে খুঁজছে। অর্পা বলেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। তাই ও রেস্টুরেন্টের প্রবেশ পথে চেয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরে দর্শনকে আসতে দেখল। ওকে আসতে দেখে আলিশার চোখ মুখে খুশির ঝলকানি দেখতে পেল। কিন্তু তারপর ওর পেছনে চোখ যেতেই মুখের রং পালটে যায়। খুশিটাকে বিভৎস লাগছে। অর্ষা আর প্রিয়া ওর সাথে। দর্শন অর্ষার সাথে আসবে সেটা কল্পনার বাইরে। ভেবেছিল কখনো অর্ষার মুখ দেখবে না দর্শন কিন্তু ট্রিটে ওকে বলেছে আর ওরা এক সাথে আসছে। হঠাৎ করে অর্ষার চোখ ওর দিকে গেল। ওকে দেখে অর্ষা ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি দিল। হাসিটার মধ্যে তাচ্ছিল্যও ছিল।
দর্শন অর্ষাকে নিয়ে একই টেবিলে বসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমার পক্ষ থেকে ট্রিট দেওয়ার একমাত্র কারণ অর্ষা৷ গতকাল আমি ওকে প্রপোজ করেছি আর ও একসেপ্ট করেছে সো আমরা এখন গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড তাই সবাইকে ট্রিট দিচ্ছি। গাইস ইঞ্জয় করো ট্রিটটা।”

ওর কথা শুনে আলিশা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওরা প্রেমের সম্পর্কে চলে গেছে আর সে ট্রিট ও নাচতে নাচতে খেতে চলে এসেছে। না জেনেই কি করে চলে এল। আর ওরা কী করে, কিভাবে? আলিশা রাগে ফেঁটে পড়ছে। অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা আবারও বিজয়ী হাসি দিল। আলিশা রাগে ফুসফুস করতে করতে বের হয়ে গেল। ও যেতেই দর্শন অর্ষাকে বলল,
“যে তোমাকে অপমান করবে,,কষ্ট দিবে আমি তাকে ঠিক এভাবেই ফিরিয়ে দেব।”

অর্ষা ওর চোখের দিকে মৃদু হেসে ছলছল চোখে চেয়ে রইল।

…..

অর্ষা ফেসবুক স্ক্রল করছে। দর্শনের আইডিতে গিয়ে ওর প্রতিটি পিক দেখছে আর এক ধ্যানে দেখছে। ওর খুব ইচ্ছে করছে দর্শনের সাথে কথা বলতে। অর্ষা ঘড়ির দিকে চেয়ে হতাশ হলো। দর্শন আগেই বলেছে বিকাল চারটা থেকে ছয়টা আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত এগারোটা। এই সময় যেন ওকে কল না দেয়। বিকাল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত স্যারের কাছে পড়ে আর সাতটা থেকে রাত এগারোটা কলেজ, প্রাইভেটের পড়া শেষ করে। এই সময় যেন ওকে ডিস্টার্ব না করা হয় সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অর্ষার খুব ইচ্ছে করছে ওর সাথে কথা বলতে। তাই ওর নাম্বারে কল দিল। কল বেজে কেটে গেল। তারপর আবার দিল। এইবার বিপরীত পাশে থাকা মানুষটি কল কেটে দিল। অর্ষা বুঝতে পারল দর্শন কথা বলতে চায় না।

দর্শন মোবাইলটা বইয়ের নিচে রেখে খাতায় অংক করছে৷ তখনই মেসেজ আসল অর্ষার নাম্বার থেকে। দর্শন না চাইতেও মন আনচান করছে অর্ষা কি লিখেছে জানার জন্য। মেসেজ দেখবে কিন্তু রিপ্লাই করবে না মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল। অর্ষা তো আর জানবে না। তাই দর্শন মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করল।
“দর্শন, প্লিজ আমার কল রিসিভ করো অথবা তুমি কল দেও। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। প্লিজ।”

দর্শন মেসেজ দেখে বিচলিত হয়ে গেল। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠল। অর্ষার এত রাতে কি এমন হলো? ওর কোনো বিপদ হলো না তো। দর্শন দ্রুত ওর নাম্বারে কল দিল। কল ধরেই অর্ষা বলল,
“আচ্ছা তুমি এত কিউট কেন? একটু বেশিই কিউট। এত কিউট হতে কে বলেছে? নজর পড়ে যাবে তো। এখন থেকে এত কিউট কিউট পিক ফেসবুকে দিবা না। ওকে বায়।”
অর্ষা খট করে কল কেটে দিল। দর্শন কানের কাছে মোবাইল নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখের পলকও পড়ছে না। এই কথা বলার জন্য মেসেজ দিল। আর ও কি ভয়টাই না পেয়ে গিয়েছিল। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসতেই কি যেন ভেবে হেসে ফেলল। ফোনের স্কিনে চোখ রেখে মিটমিট করে একা একাই হাসছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here