কাননবালা,১১,১২

0
581

#কাননবালা,১১,১২
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১১

নীতু তখন সবে কিশোরী। কিশোরী মেয়েদের মন হলো শরতের স্বচ্ছ আকাশের মত!নীতুর সেই স্বচ্ছ কিশোরী মনে কর্দমক্ত হলো এক গুচ্ছ মানুষের জন্য! নীতু সেই বয়সেই বুঝতে পারলো নীতুর গায়ের রঙটা নীতুর জন্য অভিশাপ।বুঝতে পারলো বললে ভুল হবে একদল লোক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতো।নীতুর কৃষ্ণ বর্ণ হাত পা দেখে কাজিনরা বলতো,”ডাহুকের মত হাত পা তোর। এই হাতে না মানাবে রেশমি চুড়ি, না মানাবে পায়ে রুপোর নুপুর! ” হাতে একগুচ্ছ রঙ বেরঙের রেশমি চুড়ি পরার শখ, পায়ে নুপুর পড়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে এঘর ওঘর দাপিয়ে বেড়ার শখ নীতু সেদিনই মাটি দিলো!
মামা-চাচা,ফুপি খালারা যেদিন থেকে নীতুর জন্য হালকা রঙের পোশাক উপহার দিতে শুরু করলো সেদিন থেকে খুব গোপনে নীতু রংধনুর রংকে তার জন্য নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত করলো!
কালো মুখশ্রীর কালো চোখে কাজল পড়া মানায় না জানলো যেদিন সেদিন থেকে নীতুর ড্রেসিং টেবিলে কাজলের কৌটা আর দেখা গেলো না!
আত্মীয় স্বজনের আড্ডায় যখন নীতু হতো চিন্তার টপ সাবজেক্ট সেদিন থেকে নীতু নিজেকে ঘরবন্দী করলো!

কালো জামায় কাকতাড়ুয়া, সাদায় ভূত,লাল রঙে বাইদ্যানি, নীলে যে বড়ই মলিন আর কমলায় ইয়াক থু থু! এই সব কমপ্লিমেন্টের পর নীতুর নিজেকেই নিজের বড় কুৎসিত মনে হতো!
কৃষ্ণবতীর অঙ্গে কারুকার্যময় সোনালী চকচকে অলংকার মানায় না!না মানায় কারো পাশে!বড় বেমানান কেন হয় কৃষ্ণবতীরা? নীতু তা ভেবে পায় না।

সকল গুন যেন মাটি চাপা পরে যেতো এই পাহাড় তুল্য কৃষ্ণ বর্ণের ভারে!কেউ কখনো সেই পাহাড় খুঁড়ে দেখলো না!মন পড়লো না! জানতে চাইলো না নীতুর ভিতরের অভিমানী নীতু কে!পদ্মদিঘির মত চোখে কেউ ডুবে মরলো না,লম্বা চুলে কেউ বাঁধা পড়লো না,টানা হাসিতে কারো চোখ হাসলো না!কৃষ্ণ বর্ণতেই সব ঢাকা পড়ে গেল!

নীতু হোস্টেলের বারান্দায় বসে এসবই আনমনে ভাবছিল।কত অপমান,অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য যে নীতু সয়েছে তা কেবল তার কৃষ্ণবর্ণ স্বত্তাটাই জানে!
নীতুর এই সব মনে হলে এখন হাসি পায়!বিষাক্ত সেই হাসিতে নীতুর সারা শরীর বিষিয়ে ওঠে।অন্যের জন্য নিজের যা কিছু পায়ে ঠেলে জলাঞ্জলী দিয়েছে নীতু, বেলাশেষে আজ বড় সাধ জাগে সেই হারানো শৈশব,উচ্ছল কৈশরের প্রতিটা স্বপ্ন-ইচ্ছা কুড়িয়ে শাড়ির আঁচলে স্থান দিতে!

**************
নীতু হা করে তাকিয়ে আছে রিশার দিকে।নীতুর হতভম্ব রুপ দেখে রিশা বলে,”নীতু ডার্লিং এমন হা করে আছো কেন?মশা ঢুকে যাবে তো!”
রিশা একগাদা শপিং করে এনেছে নীতুর জন্য। শাড়ি, কুর্তি, সালওয়ার কামিজ!সেগুলো রিশা ভাজ করে নীতুর লাগেজে রাখছে।নীতু বিরক্ত কন্ঠে বলে,”এতগুলো টাকা নষ্ট কেন করলি?আর এত পোশাক দিয়ে আমি কি করবো?”
“মুখ বন্ধ করো তো।অযথা প্যানপ্যান আমার পছন্দ নয়।”….রিশা ব্যস্ত হাতে কাপড় ভাজ করা অবস্থায় বললো।
কাপড় চোপড় ভাজ করা থামিয়ে দিয়ে নীতু হাত ধরে টেনে রিশাকে পাশে বসায়।রিশার হাতে একটা কুর্তি,নত মস্তকে অনবরত পা দিয়ে মেঝে ঘসছে।রিশার আসলে কান্না পাচ্ছে! কিন্তু রিশারা তো কখনো কাঁদে না।তাই রিশা কাঁদলো না। ছোটদার পরে এই মানুষটা নীতুর এতটা আপন হযে গিয়েছিল।
নীতু রিশার কাঁধে মাথা রেখে বলে,” আমি তোকে ভীষণ মিস করবো রিশা!ভীষণ! ”

ধরা কন্ঠে রিশা বলে,”ঢং কম করো ডার্লিং!”

“ঢং?তুই আমাকে মিস করবি না?”….. নীতু মাথা উঠিয়ে অবাক হয়ে রিশার দিকে তাকিয়ে বলে।

” মোটেই না।মিস করার কি আছে?এই রিশা কাউকে মিস টিস করে না!”একগুঁয়ে ভাবে বলে রিশা।

“আমার সাথে যাবি রিশা?চল না।দুবোন এক সাথে থাকবো।”

“আমি কোথাও যাবো না ডার্লিং।আমার যে নির্বাসন চলছে!ছোটদা ফিরুক তারপর যেথা যাবার যাবো।”

নীতু রাগ করে। এই মেয়েটাকে একা ফেলে যেতে মন চাইছে না তার।তাই রাগ নিয়ে উঠে চলে যেতে নেয়।রিশা খাটে বসেই নীতুর ওড়না হাতে মুঠো করে ধরে।নীতু দাঁড়িয়ে পড়ে।রিশা ধরা কন্ঠে বলে,”নীতু ডার্লিং রাগছো কেন?আমি তোমায় মিস না করলও আমার স্কুটিটা কিন্তু তোমায় ভীষণ মিস করবে।সত্যি বলছি!আমার সিগারেটের দিব্যি!”

নীতু হেসে ফেলে।পিছন ফিরে রিশার ববকাট চুল ধরে টান মারে।রিশাও হেসে দেয়।

****************

মহিমা বেগম কিছু শুকনো পিঠা তৈরি করে ইতুর হাতে দেয়। ইতু দেখলো মা শাড়ির আঁচলে বারবার চোখ মুছছে।ইতু দীর্ঘশ্বাস ফেলে! জগতের সব মা এমন কেন হয়?
মহিমা বেগম ফের চোখ মুছেন আঁচলে তারপর বলেন,”নীতুর পাকন পিঠা খুব পছন্দ। মনে করে দিস।”
ইতু পিঠা হাতে নিয়ে আফসোসের সুরে বলে,”মা পরের কথাকে পশ্রয় দিয়ে নিজের মেয়েকে যদি অবহেলা না করতে তবে আজ তোমায় এই আফসোসের কান্না কাঁদতে হতো না।”
মহিমা বেগম কিছু বললেন না।ইতু চলে গেলো।মহিমা বেগম দরজা আটকে ধীর পায়ে স্বামীর কাছে এসে বসলেন।স্বামীর অচল হাতে নিজের হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,”কেউ আমায় বুঝলো না মিতুর বাবা!কেউ আমায় বুঝলো না!”
স্বামী ব্যক্তিটি কিছুই বলতে পারলেন না।কেবল ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর মুখ পানে তাকিয়ে রইলেন।

******************
নীতু বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়।নীতুর পাশে যথাক্রমে জায়েদ, রিশা, ইতু -মিলন,শরীফুল কাকা দাঁড়িয়ে আছেন।ওরা সবাই নীতুকে বাসে উঠিয়ে দিতে এসেছে।জায়েদ যাবে নীতুর সঙ্গে। নীতুর হাজার বারণ স্বত্তেও সে টিকিট কেঁটেছে যা এখনো নীতুর অজ্ঞাত! শরীফুল কাকা একগাদা উপদেশ দিচ্ছে নীতুকে।নীতু মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুনছে পাশে রিশা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।তার এই উপদেশ বাণী অসহ্য লাগছে, তাই বলে উঠলো, “আহা কাকা এসব কি?এবার থামেন। নীতু ডার্লিং তো আর ছোট বাচ্চা না!”
শরীফুল কাকা মৃদু হেসে ফেললেন।ফের বললেন” আমার ভাগ্নীকে বলে রেখেছি তার কাছেই তুমি উঠবে।কোন সমস্যা আশা করি হবে না।তারপরও যদি হয় আমাকে বলতে দ্বিধা করো না। ” নীতুর কৃতজ্ঞতায় চোখ ভারি হয়ে উঠলো।নীতু হুট করেই কদমবুসি করে ফেললো শরীফুল কাকা কে।তিনি নীতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
ইতু বোনের গলা জরিয়ে কেঁদে ফেললো।মায়ের দেওয়া পিঠা আর দুটো শাড়ি দিলো।নীতু বোনের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেলো।এরপর রিশার পাশে এসে দাঁড়ালো। রিশা স্কুটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।স্বভাব সুলভ ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে। নীতু রিশার হাত দুটো ধরে সস্নেহে চুমু খেয়ে বললো,”আসছি।ওসব ছাইপাঁশ ছেড়ে দিস।”
রিশা ববকাট চুল দুলিয়ে মাথা নাড়লো।হ্যা বললো নাকি না বললো নীতু বুঝতে পারলো না।নীতুর চোখে জল এসে গেলো।রিশা বললো,”শুনো নীতু ডার্লিং এত ছিচকাঁদুনেপনা ভালো না।কখনো কাঁদবে না।অলটাইম স্মাইল জোনে থাকবে, বুঝেছো?এত সুন্দর হাসি তোমার, সারাক্ষণ কাঁদো বলেই তো আমরা কোন দুলাভাই পাচ্ছি না।”…..তারপর এক চোখ মেরে বললো,”ঢাকার ছেলেরা কিন্তু হেব্বি জোস!বুঝেছো? ”
নীতু অশ্রুসিক্ত চোখে রিশার গালে হাত রেখে বিদায় নিল।জায়েদকে গাড়িতে উঠতে দেখে নীতু বুঝতে পারলো দাদাভাই ওকে একা ছাড়ছে না।বাসে উঠে জানালা থেকে হাত নাড়লো নীতু।তার প্রতিত্তোরে সবাই হাত নাড়লেও রিশা নাড়লো না।স্কুটিতে স্টার্ট দিয়ে বাসস্টপ ছেড়ে আসলো।কেউ দেখলো না ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলা রিশার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট আর চোখে তার নিঃশব্দ অশ্রুরোদন! অনেক বছর পর রিশার চোখ থেকে আবার জল গড়ালো।রিশা চোখের জল মুছলো না।সবসময় চোখের জল মুছতে নেই!

***********
বাসটা যখন ছাড়লো নীতু জানালা গলে বাহিরে তাকিয়ে রইলো।এই খুলনা শহরে তার সাতাশ বছর কেটেছে।বড় আপন এই শহর ছেড়ে যেতে বুকের কোণে খাঁ খাঁ করতে লাগলো!জায়েদ পাশের সিটে চোখ বুজে মাথা এলিয়ে দিয়েছে।নীতু একটা সময় কেঁদে ফেললো বাবা মায়ের কথা মনে করে।জায়েদ কান্নার শব্দে ফিরে তাকালো। আহ্লাদী কন্ঠে বললো,”কাঁদিস না বোন।বাদাম খাবি?”
নীতু অশ্রু চোখেই ফিক করে হেসে দিল।জায়েদের ছেলে ভুলানো কথায় নীতু অবাক হলো না।নীতু চোখ মুছে বাদাম নিয়ে বললো,”দাদাভাই তুমি আর বদলালে না!”
জায়েদ আবার সিটে হেলান দিয়ে বললো,”কিছু মানুষের না বদলানোই ভালো।এখন চুপচাপ বাদাম খা!কান্নাটান্না করে আমাকে একটুও ডিস্টার্ব করবি না, এমনিতেই তোর বোনের যন্ত্রণায় কাল ঘুমাতে পারিনি।”
নীতু অবাক হলো।সে কখন ডিস্টার্ব করলো?বাদাম মুখে দিয়ে নীতু জানালা গলে উদাস দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে রইলো।নীতু জানে না সামনে কি আছে?কতটা মসৃণ হবে পথটা?তবুও নীতু লড়াই করে যাবে!নিজের ক্যারিয়ারের সাথে আর কোন কম্প্রোমাইজ করবে না!

জায়েদ চোখ বোজা অবস্থাই বললো,”এত ভাবিস না নীতু।যা হবে গোটা টাই ভালো হবে।নিজেকে নিজের ভালো রাখতে হয়।”…… জায়েদ এই কথা গুলো বলে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লো।নীতু ঘুমালো না।তার রিশার জন্য বড় চিন্তা হতে লাগলো।

***********

নীতুকে শরীফুল কাকার ভাগ্নীর ফ্লাটে নামিয়ে দিয়ে জায়েদ তার বন্ধুর বাসায় চলে গেলো।পরশু নীতুকে অফিসে দিয়ে জায়েদ খুলনা চলে যাবে।এই ফাঁকে নিজের দোকানের জন্যও কিছু কাপড় কিনে নিবে ভেবে রাখল জায়েদ। মিরপুরের এই বাড়িটা সাত তলা।চার তলায় থাকে শরীফুল কাকার ভাগ্নী।
নীতু এখন বসে আছে ফ্লাটের বারান্দায়। নীতু ভীষণ বিস্মিত হয়েছে সাথির ব্যবহারে।শরীফুল কাকার ভাগ্নীর নাম সাথি।চার রুমের এই ফ্লাটটিতে মেয়েটা একা থাকে। ছিপছিপে শরীরে লম্বা গড়নের মেয়ে সাথি।চোখ দুটো ছোট ছোট,নাক বোঁচা টাইপের দেখতে কিউট লাগে, উজ্জ্বল চাপা গায়ের রঙ আর ভীষণ ছটফটে একটা মেয়ে সাথি।পঁচিশ ছাব্বিশ বয়স। আসার পর থেকে খুবই আন্তরিক আচরণ করেছে।মনে হচ্ছে নীতু তার মায়ের পেটের বোন।তোয়ালে এগিয়ে দিছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য, ভাত খাওয়ার সময় পাশে বসে খুবই সুন্দর করে বেড়ে বেড়ে খাওয়াইছে।এটা ওটা পাতে তুলে দিয়েছে।
নীতু খাবার খেতে খেতে সাথির সম্পর্কে অর্ধেক জেনে গেছে। নীতু এতটুকু নিশ্চিত এই বাসায় তার বোর হতে হবে না।সাথি একাই একশ কথা বলাতে। সাথি সম্পর্কে খাবার খেতে খেতে যা জেনেছে তা হলো।সাথী অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে একটা এতিম ছেলের সাথে ফেইসবুকে বন্ধুত্ব করেছে।ছেলেটা তখন সিঙ্গাপুর থাকতো।ওখানের একটা কোম্পানিতে মালিকানাধীন কাজ করতো।সাথির ছেলেটার সাথে কথা বলতে বলতে ভালো লেগে গেলো।এরপর সাথি নিজেই প্রপোজ করলো।ছেলেটা দেশে আসলে সাথির মা বাবা বিয়ে দিতে চাইলো না,কেননা একে ছেলে এতিম তারউপর অল্প বেতনে বিদেশে কাজ করে।সাথি অসীম সাহসে তার সাথে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।কিন্তু পারলো না।সাথির কান্নাকাটিতে এরপর শরীফুল কাকা ছেলের সাথে কথা বললো নিজস্ব ভাবে। ছেলেটা কি বললো কে জানে শরীফুল কাকা নিজে দাঁড়িয়ে ওদের কাজি অফিসে বিয়ে দিলেন।সাথির বিয়ে হয়েছে আজ দু বছর।এখন পর্যন্ত পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি। সাথি এখন একটা স্কুলে চাকরি করে আর একা এই বাসায় থাকে!

নীতুকে বসে থাকতে দেখে সাথি এক মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসলো।মিষ্টি করে বললো,”আপু কফি নাও।” মেয়েটা এর মধ্যে তুমি বলা শুরু করেছে।
নীতু তাকালো সাথির দিকে।সাথির চোখ মুখ হাসছে।ছটফটে অঙ্গ ভঙ্গি! সাথির এই সহজ ব্যবহার নীতুর ভালো লাগল।নীতু কফিতে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,”ধন্যবাদ।!
সাথি আবার হাসলো।মেয়েটা হয়তো হাসতে পছন্দ করে।নীতুর হুট করেই রিশার কথা মনে পড়লো।
“আপু রিপনকে বলেছি তোমার কথা।সে আমাকে বলেছে, মামা যাকে পাঠিয়েছে তুমি তার কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নিবে না।”

“না না আমি এভাবে থাকবো না সাথি।শরীফুল কাকাকে আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি। তোমার প্রতি অনুরোধ টাকা না নিয়ে আমাকে ছোট করো না।”….. নীতু অনুনয় করে বলে।

সাথি কফির কাপে বিস্কিট ডুবিয়ে খাচ্ছে। চোখে মুখে শিশু সুলভ ছায়া।নীতু কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,” সাথি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এত ছটফট কেন করো?”

“তুমি কি করে বুঝলে আপু?”

নীতু উত্তরে কিছু না বলে কেবল হাসলো। সাথি কফির মগ রেখে মুহূর্তেই কেঁদে ফেললো। হাসি খুশি মেয়েটাকে আচানক কাঁদতে দেখে নীতু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
সাথি কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আপু চার মাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির তবুও মা বাবা মেনে নিচ্ছে না।কি হয় মেনে নিলে।এতিম একটা ছেলেকে ওরা আপন করে নিচ্ছে না অথচ রিপন বলে এই বেবির মুখ দেখলেই মা বাবা রাগ ভুলে যাবে।কিন্তু আমার তা মনে হয় না।বিয়ের পর রিপন যেদিন নতুন চাকরি পেলো ভালো বেতনের সেদিনও বাবা মাকে জানালে তারা বিচ্ছিরি গালি দিলো।এই সময় মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকে,কতকিছু করে খাওয়ায়।অথচ আপু আমার কপাল দেখো এত বড় ফ্লাটে আমি একা থাকি।রাতে ভয়ে ঘুম হয় না।”

নীতুর ভীষণ মায়া লাগলো সাথির জন্য। নীতু কান্নারত সাথিকে দু হাতে আগলে ধরলো।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।সাথির কান্না থেমে গেলো মুহূর্তেই, হাসি মুখে বলে উঠলো,”আপু আজ থেকে আমরা দুজন এক সাথে ঘুমাবো।তোমার সমস্যা হবে না তো?হলেও আমি ঘুমাবো।”

নীতু সাথির কথায় হেসে দিলো।নীতুর কেন জানি মনে হলো সাথি যেন রিশারই আর এক রুপ!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১২

পলাশ হাসান বসে আছে কোম্পানির চেয়ারম্যান তথা বড় স্যারের রুমে।কাঁচা পাকা ভ্রুর নিচে মোটা নাকের উপর হাই পাওয়ারের চশমা পরা বড় স্যার!টেবিলের উপর রাখা ফাইলে মনোযোগী দৃষ্টি! পলাশ ফাইলের ইন্সট্রাকশন বুঝিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষন আগে।বড় স্যার ফাইলটা পুনরায় রিচেক করলো।তারপর কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,” পলাশ নতুন এন্ট্রি নেয়া মেয়েটার কি খবর?পারফরম্যান্স কেমন?অভিজ্ঞতাহীন কর্মী কোম্পানির জন্য হুমকি।তবুও নিতে হলো অনুরোধ রক্ষাত্রে।তোমার আন্ডারেই তো মেয়েটির গ্রুমিং চলছে।পারফরম্যান্স ভালো না হলে জবে তো রাখা যাবে না।”
বত্রিশ বছর বয়সী অত্যান্ত যোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষ পলাশ।বর্তমানে কোম্পানির মিড টার্মে প্রোগ্রামিং সেকশনে আছে। সাথে নতুনদের গ্রুমিংটাও সে শিখিয়ে থাকে।পলাশ শিরদাঁড়া সোজা করে কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,” স্যার মিস নীতু এক আশ্চর্যজনক মেয়ে! সবকিছু এতটা পারফেক্টলি করে তা একদম অবিশ্বাস্য! মাত্র দেড় মাসেই অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে কোম্পানির। আমার আন্ডারে যত নতুন এন্ট্রি এসেছে তার মধ্যে মিস নীতু অন্যরকম।ভীষণ কর্মোঠ আর মনোযোগী!সাধারণ ডিপ্লোমা করা একজনের থেকে এটা আমি আশা করিনি।স্যার আপনাকে আমি শিওর করতে পারি মিস নীতু আমাদের কোম্পানির জন্য একদম পার্ফেক্ট!”
বড় স্যার মাথা নাড়িয়ে বলেন,”আই সি।তুমি এখন আসো পলাশ।আর ডাটা সেকশনের প্রজেক্ট গুলো একবার চেক করো।”
পলাশ বড় স্যারের কেবিন থেকে বেড়িয়ে পরে।নীতুকে নিয়ে সে যা এতক্ষণ বলেছে তা একটুও বাড়িয়ে বলেনি।মিস নীতুর কর্মদক্ষতা পলাশকে সত্যিই অবাক করেছে।

পলাশ অন্যান্য এন্ট্রির মত নীতুকেও সেই ভাবে ট্রিট করছিল।ওয়ার্ক স্পৃহা ভালো দেখে কাজ বাড়িয়ে দিত।দিন কয়েক আগ পর্যন্ত নীতু তার কাছে একজন সাধারন মেয়ে হিসেবেই গন্য হয়েছে কিন্তু পাঁচ দিন আগে নীতু সার্ভার প্রজেক্টে মারাত্মক রকম ভুল করে ফেলে।তা দেখে পলাশের মাথা গরম হয়ে।ভীষণ রাগারাগি করে। নীতু চুপচাপ রাগ হজম করে নেয়।পলাশ একটা ফাইল আনতে যেই না উঠে গেলো পাশের ডেস্কের মেয়েটা নীতুর সাথে পলাশের সম্বন্ধে আজেবাজে কথা বললো।মেন্টর হিসেবে পলাশ অযোগ্য তাও বুঝাতে চাইলো।পলাশ আড়ালে থেকেই শুনতে পেলো নীতু মেয়েটিকে হাসিমুখে বলছে,” আপু মেন্টর হিসেবে তিনি আমাকে বকা দিতেই পারেন।তাছাড়া এই সেকশনটা তিনি আমাকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন তারপরও আমি ভুল করেছি।তাই আমি মনে করিনা পলাশ স্যার এখানে কোন অন্যায় করেছেন।”

নীতুর এমন মন্তব্যই পলাশকে নীতু সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে।তার পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে মেন্টর হিসেবে অনেকের কাছ থেকেই অনেক তিক্ত মন্তব্য শুনেছেন।কাজ শিখে অমূল্যায়ন করতে দেখেছে।নীতু তার বিপরীত। মেয়েটা শ্যামবর্ণের।এভারেজ বাঙালি রুপ।নাক ঠোঁট সবকিছুই সাধারণ কেবল চোখ দুটো ভীষণ মায়াকারা।পলাশ সেদিনের পর থেকে নীতুকে পর্যবেক্ষণ করেছে।নীতুর বিহেভিয়ার সত্যিই তাকে মুগ্ধ করেছে।

লাঞ্চ টাইমে নীতু কেন্টিন এড়িয়ায় বসে খাবার খেতে শুরু করলো।একটু পরই পলাশ এসে নীতুর সামনের চেয়ারে বসলো।নীতু পলাশকে দেখে আড়ষ্টভাবে চেয়ে মৃদু হাসলো। পলাশ পাল্টা হাসি দিয়ে বললো,”রিল্যাক্স মিস নীতু।আমি এখনে তোমার বস নই তাই এমন ভয়ে জড়সড় হওয়া বন্ধ করো।নিজেকে কেমন স্কুলের রাগী মাস্টার মনে হচ্ছে। ”
নীতু পলাশের কথায় মাথা নত করে হেসে ফেললো।পরক্ষণেই বললো,”স্যার মাটন বিরিয়ানি খাবেন?”
পলাশ চেয়ে দেখলো নীতুর টেবিলের পাশে একটা বাটিতে অর্ধেক বিরিয়ানি রাখা। বাকিটা নীতু নিজে খাচ্ছে। পলাশ বললো,”আরে তোমার কম পড়ে যাবে।”

“মোটেই না।আমি এর বেশি এমনিতেই খেতাম না।”

“তুমি রেঁধোছো?”….কৌতুহলী কন্ঠে বলে পলাশ।

নীতু প্রতিত্তোরে মিষ্টি হেসে পলাশকে বাকি খাবার টুকু সার্ভ করে দেয়।পলাশ বুঝে যায় নীতুই রান্না করেছে।তাই খাওয়ার আগ্রহটা যেন মন ছেঁয়ে পাকস্থলীর সীমানা ছুঁয়ে হু হু করে বেড়ে গেলো!

**************
সেতু এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি জানালা গলে দূর আকাশে নিবদ্ধ! সদ্য বিবাহিত সেতুর মনে কালো গমগমে মেঘের ভেলা! কোথাও এক ফোটা ঝলমলে রোদ্দুর নেই।সেতু প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ে! ঠিক সেই মুহুর্তে রাবেয়া বেগম রুমে প্রবেশ করে।সেতু শাশুড়ীকে দেখেও উঠে বসে না।ওভাবেই পড়ে থাকে।রাবেয়া বেগম কপাল কুঁচকে বলেন,” বউ মা এই ভরদুপুরে না খেয়ে এভাবে শুয়ে আছো কেন?শরীর খারাপ নাকি?”… বলে সেতুর কপালে হাত রাখে।
সেতু কিছু বলে না।তার আসলে এই মহিলাকে ভালো লাগছে না সেদিনের পর থেকে।রাবেয়া বেগম আবার বলেন,”শরীর তো ভালোই আছে তবে এভাবে পড়ে আছো কেন?”
সেতু এবার উঠে বসে।নিজের কুঁচাকানো পড়নের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা আপনি কেন এই কাজটা করলেন?নিজ হাতে তিনটে জীবন ধ্বংস করে দিলেন।কি হতো উনার পছন্দের মানুষটাকে মেনে নিলে?মাঝখান থেকে আমার জীবনটাও তছনছ করে দিলেন।”

রাবেয়া বেগমের চোখের দৃষ্টি মুহুর্তেই কঠিন হয়ে গেলো।ঝামটা মেরে বলে উঠলো, “মুখ সামলে কথা বলো।বিয়ের আগে ওমন দু চারটা সম্পর্ক সব ছেলেদেরই থাকে।কেমন বউ তুমি? নিজের বরকে নিজের দিকে ফিরাতে পারো না।তিন কবুল পড়া বউ তুমি।তোমার অধিকার ওই কালীর থেকে বেশি।বরের মন থেকে কেমন করে অন্য মেয়ের ছবি মুছাইয়া ফেলতে হয় তাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে।”

সেতুর শরীর রাগে হিসহিসিয়ে ওঠে।নিজের ক্রোধ সামলে বলে,”মা কি করে বরকে নিজের দিকে ফিরাতে হয়? এই যৌবন ভরপুর শরীর দিয়ে? সব পুরুষ কি আকৃষ্ট হয় শরীরে? একই ঘরে একই বিছানায় থেকেও আপনার ছেলের মনে জায়গা করতে পারছিনা। আপনি কি তবুও বুঝতে পারছেন না সেই মেয়েটি আপনার ছেলের কতটা জুড়ে থেকে গেছে?”

রাবেয়া বেগম কি বলবেন ভেবে পেল না।সেতুর দু’চোখে জল টইটম্বুর হয়।শাশুড়ীর হাত খপ করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “মা আপনি জানেন?আপনার ছেলে রাত হলে ঘুমায় না।ঘুমাতে পারে না মানুষটা!সারারাত ছটফট করে!বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার দেখে।আপনি তো মা!আপনি কেমন করে এতটা কঠোর হলেন?আপনার ছেলের চোখের কোলে নির্ঘুম রাতের ছাপ পড়েছে।তা দেখে আপনার বুক কাঁপে না?সেই মেয়েটা এই ঘরে না এসেও আপনার ছেলেকে ঠিক জয় করে ফেলেছে।আপনি, আমি দুজনেই উনার ভালোবাসার কাছে হেরে গেছি!”

রাবেয়া বেগম বিস্মিত দৃষ্টিতে ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।বুকের উপর কেমন চাপ অনুভব করলেন ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিলেন।সেতু সেই শব্দে কেঁপে উঠলো।পরক্ষণেই দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো।

*************
সাথি অনবরত বকবক করে যাচ্ছে মোবাইলে রিপনের সাথে। নীতু তা দেখে আলতো হাসে।মেয়েটা এত কথা বলতে পারে?নীতু একটা বোলে আমড়ার আচার বানিয়ে সাথির সামনে রাখে। সাথি আচার দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠে নীতুর গালে চুমু দেয়। নীতু নিজেও কিছুটা আচার একটা পিরিজে নিয়ে বসে খাটে। সাথি কল কেটে আচার খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে।নীতু খেতে খেতেই বলে,”সাথি সবসময় দেখি আমাদের সামনের ফ্লাটটা তালা দেওয়া। ওখানে কেউ থাকে না?”

“আপু ওখানে একজন হ্যান্ডসাম পুরুষ থাকে।যাকে বলে চোখ ঝলসানো হ্যান্ডসাম!তিনি আপাতত বাসায় নেই।”

নীতু আচারের বাটি হাতে নিয়েই বারান্দায় গিয়ে বসে।যতদুর চোখ যায় সবখানে উঁচু উঁচু দালান । যেন এক একটা দালান ঐ আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে!
নীতু ভালো আছে।সারাদিন অফিস করে।রাতে টুকটাক রান্না করে।ইদানীং নিজের যত্ন অনেকটা নেয়া হয়।সাথি তো জোর করেই পার্লারে নিয়ে গিয়েছিল।মেনিকিওর,পেডিকিওর, ফেসিয়াল সব করে এসেছে।সকাল হলে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা নীতুর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে পুরোটা গুছিয়ে নেয়ার পরও কোথাও যেন একটা কিছুর শূন্যতা থেকে যায় নীতুর !চোখজুড়ে একজনকে দেখার তীব্র হাহাকার!একই শহরে বাস করা সেই মানুষটার জন্য বুকের কোণে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here