কাননবালা,পর্বঃ ৪০

0
428

#কাননবালা,পর্বঃ ৪০
#আয়েশা_সিদ্দিকা

সকাল দশটা।নীতুর গাঢ় ঘুমটা হালকা হতে শুরু করেছে।হাতে পায়ে উত্তপ্ত রোদের ছোঁয়া!কিন্তু সূর্যের আলোটা নীতুর কৃষ্ণমুখশ্রী ছুঁয়ে দিতে পারছে না।ঢাল হয়ে ঢেকে রেখেছে প্রশস্ত বুকের পুরুষটা মায়াবী মুখের মেয়েটিকে। নীতু নড়ে ওঠে।অভীক তাকায়। বুকের ভিতর আদুরে বিড়ালের মত গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা!
নৌকার দুলুনি আর অভীকের প্রশস্ত বুকে নীতুর চোখে খুব ভালো ভাবেই ঘুমটা ঝেঁকে বসেছিলো।কখন ঘুমিয়ে পরেছে নিজেই বুঝতে পারে নি।
পিটপিট করে তাকাতেই নীতু দেখতে পায় কারো বুকে খুব যত্ন করে ঘুমাচ্ছে সে।নীতু চমকে উঠে চট করে তাকায়। অভীকের পৌরষালী সুদর্শন অবয়বটা চোখের তারায় ফুটে উঠতেই চমকিত দৃষ্টি সম্মোহনী দৃষ্টিতে রুপ নেয়।নীতু সম্মোহনী স্বরে বিড়বিড় করে বলে,”মাশাল্লাহ! ”

অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে ।তার বউটা যে দিনদিন তার দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই এই অপ্রতিরোধ্য হাসি!

নীতু যখন বুঝতে পারে পুরো ব্যপারটা মুহুর্তেই ছিটকে সরে পরে।অভীক হাত টেনে ধরে ধমকে বলে,”কি করছো?পরে যাবে তো নীতু!”

নীতু রাগে লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে।নিজেকে অষ্টাদশী প্রেমিকার মত নির্লজ্জ আর বেহায়া মনে হচ্ছে! কি করে এই দিন দুপুরে নৌকার উপর অভীকের বুকে ঘুমিয়ে পরলো?কি করে? মুহুর্তেই রাগটা এসে পরে অভীকের অসহ্য চাহনির উপর।মানুষটার বেহায়া,বেসামাল দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরেই তো অভীকের বুকে লুকানোর স্থান নিয়ে ছিল।শেষে কিনা ঘুমিয়ে পড়লো।ছি!ছি!

নীতু রাগে কিড়মিড় করে বলে,”আমি বাসায় যাবো।এখুনি,এই মুহুর্তে! ”

অভীক আর কথা বাড়ায় না।হেসে সম্মতি প্রকাশ করে। কিন্তু সারাপথে মিটিমিটি হেসে নীতুর রাগ আর লজ্জার পারদ বাড়িয়ে দিগুণ করে তুলে।

*********
বাসার সামনে রিকশাটা থামতেই নীতু অসহায় কন্ঠে বলে,”এবার তো হাতটা ছাড়ুন?”

অভীক হাতটা ছাড়েনা। বরং আরো একটু শক্ত করে ধরে।জায়েদ আর ইতুকে এগিয়ে আসতে দেখে নীতু অসহায় চোখে তাকায়! অভীক সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নীতুকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামায়।অভীক রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নীতুর পাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে পুনরায় হাত ধরে। নীতু বিব্রত বোধ করে।জায়েদ কপট অভিনয় করে বলে,”ভায়রা ভাই এভাবে আমাদের নাকানিচুবানি খাওয়ালে। আমরা তো ভয় পেয়ে গেছিলাম নীতুকে না পেয়ে। এভাবে আমার বোনকে কিডন্যাপ করার মানে কি?ঘুম থেকে উঠে দেখি যার বিয়ে সে ঘরে নেই।কি একটা অবস্থা! ”

ইতু সম্মতি প্রকাশ করে বলে, “হু তাই তো।আপাকে না পেয়ে একটুর জন্য হার্ট অ্যাটাক করিনি।”

নীতু পারে না লজ্জায় মরে যায়।অভীক ফিঁচলে হেসে বলে,”আমার বউ।আমি আমানত রেখেছিলাম আপনাদের কাছে।আর আপনারা আমাকে রীতিমত ঘোরাচ্ছিলেন। দিবো দিবো করে বউ আটকে রেখেছেন। তাই এই ব্যবস্থা। ছোট খাটো থ্রেট দিলাম।বউ দ্রুত আমার নিকট ট্রান্সফার না হলে এভাবেই কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো।বুঝেছেন দাদাভাই?”

ইতু খিলখিল করে হেসে দেয়। সাথে জায়েদ,অভীকও। শুধু নীতু হাসতে পারেনা।লজ্জায় কেবল আরক্ত হয়! জায়েদ বলে ওঠে, “মুখ দেখেতো মনে হচ্ছে কিছুই খাওনি তোমরা।খিচুড়ি রান্না হয়েছে।অভীক তুমিও জয়েন করো।”

নীতু মনে মনে চায় অভীক না বলুক।কিন্তু নীতুকে পুরো হতাশ করে অভীক মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।ইতু সাদরে বোন জামাইকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।

জায়েদ চোখ বড় বড় করে নীতুকে বলে,”পোলা তো পুরাই শেষ !বউয়ের প্রেমে পড়ে লজ্জা শরম সব গিলে খেয়েছে।”

নীতুও অসহায় চোখে তাকিয়ে নিজেও সম্মতি প্রকাশ করে।নীতুর মুখ দেখে জায়েদ হা হা করে হেসে ফেলে!

************
নীতু ফিরেছে শুনে মুরব্বি গোত্রীয় মামি চাচিরা ভেবেছিল কয়টা কথা শুনাবে।বিয়ের বাকি মাত্র ক’দিন এখনই মাঝ রাতে নির্লজ্জের মত ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে পাড়া বেরানোর জন্য কয়টা কথা শুনাবে!কিন্ত অভীক যেন তাদের আশায় এক বস্তা বালি ঢেলে দিলো।অভীককে দেখে সবাই চুপসে গেলো।কেউ তো আর ভুলেনি নীতুর বাবার মিলাদের দিনের সেই ভয়ংকর রুপ! অভীক কিন্তু সবার সঙ্গেই হাসি মুখে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। নিখিল, মহিমা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।নতুন জামাইকে কি আর শুধু খিচুড়ি পরিবেশন করা যায়?অল্প সময়ের মধ্যেই মাছ ভাজি করা হলো।ডিম ভূনা হলো।সালাদ কাটা হলো। কোক আনা হলো।

অভীকের শত বারণ কেউ শুনলো না।মিলন আর জায়েদ জয়েন করলো তাদের সাথে। তাজ বেড়িয়ে গেলো তার কাজ আছে বলে।মূলত তার সবকিছু চক্ষুশূল লাগছিলো!
নীতু চাইছিলো না অভীকের সাথে বসে একসঙ্গে খেতে।এমনিতেই অনেকেই এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন নীতু তার বর নয় পরপুরুষের সাথে দাঁড়িয়ে আছে।

অভীক মুহুর্তেই বুঝে ফেললো নীতুর সঙ্কোচ।নিজে চেয়ারে বসে পাশের চেয়ারটা টেনে দিয়ে আদেশের সুরে বললো,”খেতে বসো।”

এই দুটো শব্দ এমন ভাবে বললো নিখিল, জায়েদ মুখ টিপে হেসে ফেললো। সাথে খুশিও হলো।স্বামী নামক সঙ্গীটা যদি সঠিক হয় তবে একজন স্ত্রীর জন্য সবকিছু সহজ ও সুন্দর হয়।নীতু বুঝলো ‘খেতে বসো’ বলা মানে অভীক তাকে ছাড়া খাবে না।নীতু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে খেতে বসলো।ইতু ব্যাঙাচির মত লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার পরিবেশন করছে।
সেতু হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িং রুমে আসলো।অভীককে দেখে অবাক স্বরে বললো,”সে কি ভাইয়া আপনি?নতুন বর বিয়ের আগে শশুড় বাড়ি কি করে?”

অভীক তার প্লেটে রাখা আস্ত ডিমটা সেতুর হা করা মুখের ভিতর পুরে দিয়ে বলে,”যখন শেরওয়ানিতে আসবো তখনই আমি নতুন জামাই। এ ছাড়া অলওয়েজ এ বাড়ির ছেলে।তাই না মা?”……শাশুড়ীর দিকে ফিরে শেষের প্রশ্নটা করে অভীক।
মহিমা বেগম ছলছল চোখে সম্মতি জানায়। সেতু ঝোলমাখা ডিম মুখে নিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।মেহেদি সোফায় বসে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সেতু রাগ করে সোফার কুশন ছুড়ে মারে মেহেদির দিকে। তারপর রুমে চলে যায়।

নীতুর বড় মামা খাবার রুমে হাজির হলে নীতু চেয়ার ছেড়ে উঠতে নেয়।বসতে দিবে বলে।কিন্তু উঠতে পারে না।অনুভব করে তার শাড়ির কুঁচি কিছুটা নীচে নেমে পরেছে টান খেয়ে। নীতু পুনরায় বসে পড়ে।অভীক পা দিয়ে নীতুর কুঁচির নীচের অংশ চেপে ধরেছে।নীতু চোখ মটকিয়ে তাকায়। কি অসভ্য পুরুষ! কেমন ভেজা বিড়ালের মত খাচ্ছে অথচ নীতুকে উঠতে দিচ্ছে না।নিখিল আর একটা চেয়ার এনে মামাকে বসতে দেয়। নীতু থম মেরে বসে আছে।অভীক আলতো হেসে বলে,”কি ব্যাপার নীতু?খাচ্ছো না কেন?”….. বলে অভীক পায়ের আঙুল দিয়ে আরো একটু শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে শাড়ি।নীতু সুপ্ত শ্বাস ছাড়ে!অভীক নামক পুরুষটাকে আঁড়চোখে দেখে।অভীকও তাকায়। নীতু কেঁপে ওঠে! কি ভয়ংকর প্রগাঢ় চাহনি!নীতু হাসফাস করে।অভীক পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। নীতু ঢকঢক করে পানি পান করে বড়সড় দম নেয়। অভীক কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে বলে,”এত অল্প তে কি তৃষ্ণা মিটবে কাননবউ? তুমি না হয় আরো একটু তৃষ্ণার্ত হও!একটু বেশিই….!”

নীতু বিষম খায়! অভীক ঈষৎ হাসে!তার ভালো লাগছে।হুট করেই ভীষণ ভালো লাগছে! এই মেয়েটাকে আকুল তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত করতে পেরে মনটা খুশিতে বাক-বাকুম করছে।

************
পুরো বাড়ি মেহমানে ভর্তি।যত মানুষ তত কাজ।সবাই ভীষণ ব্যস্ত।বিকেলে অনীক- রুমি আর ক’জন রিলেটিভ এসে নীতুর বিয়ের সকল সরঞ্জাম দিয়ে গেছে।এত এত শাড়ি গহনা দেখে পুরো আত্মীয় মহল বিস্মিত।কালো মেয়েটার এমনতর সুখে কিছুটা ঈর্ষান্বিতও। রুমি যাওয়ার সময় নীতুর হাতে একটা কাগজ গুজে দিয়ে গেছে। নীতু কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ মেলেই দেখতে পায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “আমি অপেক্ষা করবো কাননবালা,তৃষ্ণার্ত চাতকের মত অপেক্ষা! তোমাকে বধূ সাজে বরণ করতে আমার বুকের জমিনটুক সাজিয়ে রেখেছি।তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো তো কাননবউ! আমার যে ভীষণ তাড়া তোমাকে আঁখি ভরে দেখবার!”

নীতু চিরকুটটা পরে লজ্জায় আরক্ত হয়।এত সুখ কেন চারপাশে?

*********
রাতে ভালো ঘুম হয়নি মেহেদির।নতুন জায়গা বলেই হয়তো।তাই একটা চেয়ারে বসে ঝিমচ্ছিল। তখনই সেতু এসে ধাক্কা দেয়। মেহেদি বিরক্ত চোখে তাকায়। সেতু সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে আদুরে স্বরে বলে,”মেদু, রাস্তার মোড়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে।”

“তো?”

“খাবো।”…. সেতু আহ্লাদী করে বলে।

” তোর মুখ, তা দিয়ে তুই ঝালমুড়ি না খেয়ে পাথর চিবিয়ে খা তা আমার কাছে বলছিস কেন?”

“কারণ তুই এনে দিবি।”

“বিরক্ত করিস না সেতুমন্ত্রী। তোর আস্ত ভাবওয়ালা জামাই থাকতে আমাকে বলছিস কোন আক্কেলে?জামাই থাকতে বন্ধুকে খাটাচ্ছিস।ছি!তুইতো বন্ধু নামের কলঙ্ক! “…. মেহেদি আয়েশ করে চোখ বুজে বলে।

” এনে দে না মেদু।বড্ড খেতে ইচ্ছে করছে।বেশি করে মরিচ দিতে বলবি কিন্তু। ”

মেহেদি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”তুই দিনদিন রাক্ষস হয়ে যাচ্ছিস সেতু!”

“আর তুই কিপ্টুস!”

“হ আমারে তো টাকা তোর জামাই এসে দিয়ে যায়। তাই আত্মা খুলে তার বউর জন্য খরচ করবো।বলদ পাইছোস আমারে?”

সেতু কিছু বলে না।মেহেদি খ্যাচর খ্যাচর করতে করতে পাঞ্জাবি ঝাড়া মেরে উঠে পরে।সেতু নিশ্চিন্ত মনে ঘরে চলে যায়।
মেহেদি দুহাতে দুটো ঝালমুড়ির ঠোঙা নিয়ে ফিরছিল ডানদিকে দিয়ে। চোখের দৃষ্টি বেখায়ালী।বামদিক দিয়ে যে আসছিল সেও দ্রুত পায়ে বাড়ির ভিতর ঢুকছিল।কেউ কাউকে খেয়াল করলো না।ফলে ধাক্কা খেয়ে দুজনেই চিৎপটাং রাস্তায়।আর সমস্ত ঝালমুড়ি দুজনের মাথায়! অপর মানুষটা বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলে,”কোন আবালে ফেললো আমায়।”
মেহেদি নিজেও ঝাড়ি মেরে উঠলো।তার চল্লিশ টাকার শ্রাদ্ধ তো হলোই তারউপর ব্যথাও পেলো। মেহেদি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে,”চোখের মাথা খেয়েছেন?”

অপর পাশের মানুষটি সমান ঝাড়ি দিয়ে বললো,”মেয়ে দেখেই ধাক্কা দিতে মন চাইলো।সিনেমা দেখাও আমারে পোলা?”
মেহেদি এবার মনোযোগ দিয়ে দেখে।নীল জিন্স, কালো গেঞ্জি তার উপর এ্যাশ রঙের শার্টের বাটন খোলা।হাতে ব্যাচ পড়া।চুলগুলো ববকাট।চোখের দৃষ্টিতে মারমুখী ভঙ্গি!

মেহেদি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”হাউ ফানি! এখানে মেয়েটা কে?”
রিশা তেতে ওঠে। তাকে কিনা বলছে এখানে মেয়ে কে?কতবড় বেয়াদব? কেডস পড়া পা দিয়ে মেহেদির পায়ের উপর বাড়ি মেরে বলে,”তুমি হইলা হেয়ার প্রজাতি,আর তুমি মেয়ে চেনো না?দেখ এখন কেমন লাগে?একদম মেরে মর্গে ফেলে রেখে আসবো।”
মেহেদি ব্যথা পেয়ে ককিয়ে ওঠে।রিশার দিকে একদলা রাগ ছুড়ে বলে,”আমি কি বসে থাকবো নাকি।একদম থোবড়া চেঞ্জ করে দিব বদ মেয়ে!”

“কি করবি? একবার কাছে আয়। একদম মেরে ফেলবো!ইদুর ছানা কোথাকার!”

“আর তুমি একটা খাইশটা মেয়ে।দেখলেই বমি আসে”

‘কি’ বলে রিশা চিৎকার করে ওঠে। দুজনের মধ্যে লেগে যায় তুমুল ঝগড়া। কেউ কাউকে এক চুল ছাড়তে রাজি নয়।তাদের চিৎকর চেঁচামেচিতে বাড়ির সবাই বাহিরে এসে দেখে একজন আর একজনকে মুখের অকথ্য ভাষায় ধুঁয়ে দিচ্ছে।সেতু আর নীতু দৌড়ে আসে।রিশাকে দেখে নীতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে। রিশু বলে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে। রিশার ঝগড়া থেমে যায়। সেও জড়িয়ে ধরে।নীতু খুশিতে চটাস চটাস করে রিশার গালে চুমু দেয়। রিশা মৃদু হেসে বলে,”ডার্লিং তোমাকে খুব মিস করেছি।”

নীতু ফের জড়িয়ে ধরে। রিশা মেহেদির দিকে তাকিয়ে বলে,”এই বদ পোলা কি হয় তোমাদের?” মেহেদি পুনরায় তেতে ওঠে। নীতু রিশাকে টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। মেহেদি কোমড়ে দুই হাত রেখে সেতুকে বলে,”এই মেয়ে তোদের আত্মীয়? এমন ডাইনি মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি।”

“আহা আস্তে বল।আপি শুনলে কষ্ট পাবে।তাছাড়া রিশা আপু খুবই ভালো মেয়ে।”

“এই মেয়ে ভালো হলে আমি আমার কান কেঁটে কুত্তা রে খাওয়াবো।বল কি করবো?”

” কান কেঁটে কুত্তারে খাওয়াবি।” …… বলে সেতু মৃদু হাসে।

“হাসছিস কেন?” মেহেদি বিস্মিত কন্ঠে বলে।

“ভাবছি তোকে কান ছাড়া কেমন লাগবে?”
মেহেদি বিস্মিত থেকে অতি বিস্মিত দৃষ্টিতে সেতুর দিকে তাকায়। মুহুর্তেই মেজাজ গরম হয়ে যায়।মেহেদির উত্বপ্ত চাহনি দেখে সেতু হাসতে হাসতে মেহেদির গায়ে ঢলে পরে ।

***********
সেতু দুহাত ভরে মেহেদি দিয়েছে। হাতের মেহেদি এখনো শুকায়নি। অথচ তেষ্টা পেয়েছে। কলিজাটা খা খা করছে একটু পানির জন্য। খাটের উপর বসে তাই বার বার টেবিলে রাখা পানির দিকে তাকাচ্ছে।কাউকে যে ডাক দিয়ে বলবে তারো উপায় নেই।শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে।উঠতে ইচ্ছে করছে না।আপির মেহেদি অনুষ্ঠানে ছোটাছুটি করার ফল সব। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে যেই না উঠতে যাবে তখনই তাজ সেতুর মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরে।সেতু থমকায়!আঁড়চোখে তাজকে দেখে। তাজ স্মিত হেসে বলে,”হা করো।”
সেতু হা করে,ঢকঢক করে পানি টুকু গিলে ফেলে।তাজ সন্তর্পনে গ্লাসটা টেবিলে রাখে।সেতুর হাতের মেহেদির দিকে একবার তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” তোমার চাওয়া অনুযায়ী হয়তো আমি পারফেক্ট বর হতে পারিনি, তাই বলে আমি পাষণ্ড নই সেতু।মায়া নামক অনুভূতিটা আমারো খানিকটা আছে।”

বলে তাজ হনহনিয়ে রুম থেকে চলে যায়।সেতু বোকার মত তাকিয়ে থাকে। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে গেলো।

********
কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি। হাতে, কানে, গলায়, কপালে ফুলের গহনা।হালকা সাজ আর দু-হাত ভর্তি মেহেদিতে অপরুপ লাগছে নীতুকে। রাত দুটো। নীতু হাতভর্তি মেহেদি নিয়েই ঘুমিয়ে পরেছে। মেহেদি শুকানোর জন্য বসেছিল কখন যেন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছে।কোন কিছুই চেঞ্জ করা হয়নি।রিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো।শেষ টানটা দিয়ে রুমে আসে।নীতুকে গুটিশুটি ভাবে ঘুমাতে দেখে আলতো হাসে।পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ফটাফট কয়টা ছবি তুলে অভীককে সেন্ড করে।

অভীক কেবল ঘুমের মত পরেছে তখনই মেসেজের টোনে ঘুম ছুটে যায়, মোবাইল হাতে তুলে নেয়। টাচ করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা পদ্মফুল যেন! কচি কলাপাতা পাতা রঙের শাড়ি, ফুলের গহনায় সজ্জিত এক নারী বিছানায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।যার হাত ভর্তি মেহেদি।নাকের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে!ঠোঁটের কোণে মৃদু সুখের আভাস ।অভীক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।কেমন ঘোর ঘোর লাগে।মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন যেন সকল অনুভূতি!

অভীক ভিডিও কল দেয়। রিশা হেসে রিসিভ করে বলে,”বকশিস চাই বস,এত রাতে আপনার বউয়ের ছবি তুলতে কষ্ট হয়েছ। ”

“একটু নীতুকে দেখাবে প্লিজ?”..অভীকের কন্ঠে অনুরোধ।

রিশা ব্যাক ক্যামেরা ওপেন করে।অভীকের হার্টবিট মিস হয়।মেয়েটা এত মিষ্টি করে ঘুমাচ্ছে কেন?ইশ!এখন যে মেয়েটাকে ইচ্ছে করছে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে! তার বেলা?
অভীক মোহাচ্ছন্ন, নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে ভেজা স্বরে বলে,”রিশা কে বেশি সুন্দর? এই পৃথিবী নাকি আমার নীতু?”

রিশা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে থাকা পাগল পুরুষের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসে।তারপর বিড়বিড় করে বলে,”আপনার নীতু!”

অভীকও হাসে।সাথে হাসে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ দুটো চোখ!

*********
শেষ রাতে নীতুর ঘুম ভেঙে যায়। ধীর পায়ে উঠে ওয়াশরুমে যায়। হাতের মেহেদি উঠিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়।বিছানায় রিশা হাত পা ছড়িয়ে রেখেছে,একটা পা সাথির গায়ের উপর।নীতু মৃদু হেসে রিশাকে ঠিক করে গায়ে কাঁথা দিয়ে দেয়। আলতো হাতে ববকাট করা চুলে হাত বুলিয়ে সাথির দিকে তাকায়। সাথি হা করে ঘুমাচ্ছে। হালকা ভাবে সাথিকে ধাক্কা দেয় নীতু।সাথি নড়ে আবার ঘুমিয়ে পরে। এবার আর মুখ হা করে নেই।
ঘুটঘুট শব্দ শুনে নীতু রুম থেকে বের হয়।রান্নাঘরে যেতেই দেখতে পায় মা রান্না করছে। নীতু মৃদুস্বরে বলে, “মা এত ভোরে রান্না কিসের?”

মহিমা বেগম মেয়ের আচানক কথায় চমকে পেছনে ফিরে। নীতুকে দেখে বলে,”তুই এত ভোরে উঠছিস কেন?”
নীতুর মেজাজ খারাপ হয়।গ্যাসের চুলাটা বন্ধ করে মায়ের দিকে বিরক্ত চোখে তাকায়। মহিমা ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে,”আরে করছিস কি?”

নীতু মাকে টেনে নিয়ে সোফার উপর বসায়। মহিমা বেগম মেয়েকে বাঁধা দিতে গিয়েও পারছে না।মেয়েটা কেন বুঝতে চাইছেনা?সকালে অভীকদের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে আসবে তাদের জন্য ভালো মন্দ কিছু রান্না না করে রাখলে তখন কি দিবে? ওতো সময় তো তখন পাবে না। নীতু মায়ের কোলে মাথা রেখে আদুরে স্বরে বলে, “মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো মা।”
মহিমা বেগম মাথায় হাত বুলান।চোখ দুটো হটাৎই জলে ছলছল করে। নীতু পরম আদরে চোখ বুঁজে। মায়েদের শরীরের ঘ্রাণ অন্যরকম হয়!একদম অন্যরকম!
মহিমা বেগম বিড়বিড় করে বলে,”আমাকে ক্ষমা করিস মা।আমি মা হয়ে তোকে বুঝতে পারিনি।তোর আগে ছোট মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়ে তোকে অপমান করেছি।সমাজের কাছে তোকে আরো নীচু করেছি।আমি মা হয়ে তোর শক্তি হতে পারিনি।বরং তোকে আরো দূর্বল করে দিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করিস।”

নীতু উঠে বসে।মায়ের কপালে চুমু দিয়ে মায়ের মাথাটা নিজের কোলে রাখে।চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”সবটা ভাগ্য মা।তোমার এতে কোন দোষ নেই।তবে কষ্ট কোথায় জানো মা?সবাই যখন কালো বলে তাচ্ছিল্য করতো তখন তোমার মুখটা ছোট হয়ে যেতো।ওখানেই কষ্ট আমার মা! কালো রঙের জন্য নিজের মায়ের ওমন গোমড়া মুখ আমায় বড় কষ্ট দিতো! তবে কি জানো?দেরিতে হলেও ভাগ্য আমাকে সুখের মুখ দেখিয়েছে।এই ভাগ্যই কয়টা কালো মেয়ের হয় বলো তো?”

মহিমা বেগম নীতুর হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বলে,”দেখিস অভীক তোকে একটুও কষ্ট পেতে দেবে না।”

নীতু জানে অভীক তার কষ্ট সহ্য করতে পারে না।তবুও ভয় হয়।এত সুখের যোগ্য কি সে?যদি কখনো অভীকের তার রঙ নিয়ে মনখারাপ হয়? তবে সহ্য করতে পারবে তো?

মহিমা বেগম নীতুর কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরেন।মা ঘুমিয়ে যেতেই নীতু রান্নাঘরে গিয়ে অসমাপ্ত কাজগুলো করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর নিখিল পানি খেতে এসে দেখে নীতু রান্না করছে। নিখিল প্রশ্ন করার আগেই নীতু বলে,”আস্তে ভাইয়া শব্দ করিস না মা উঠে যাবে।”

নিখিল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”আমি সাহায্য করি?”

“তুই পারবি না ভাইয়া।”

নিখিল চলে যায়।একটু পর ইতু, মিতু,সেতু তিনজনকেই ঘুম থেকে জাগিয়ে নিয়ে আসে রান্নাঘরে।সেতু হাই তুলতে তুলতে বলে, “আপি তুই রান্না করছিস কেন?পানির ছোঁয়ায় মেহেদির রং ভালো আসবে না তো?”

নীতু জবাব দেয় না।কেবল আলতো হাসে।সময় টা যেন পাঁচ ভাই বোনের।সবাই মৃদুস্বরে গল্প করছে আর রান্নার কাজ করছে। সবাই যখন নাক ডেকে আদুরে ঘুমে ব্যস্ত তখন পাঁচ ভাই বোন তাদের সুখ দুঃখের গল্প ভাগ করে নিতে ব্যস্ত।মিতু ফিসফিস করে বলে,”এতু সুন্দর মুহুর্ত আমি অনেকদিন পাইনি।”
সবার চোখ ছলছল করে ওঠে।রক্তের বন্ধন বুঝি একেই বলে!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here