#কাননবালা,০৪,০৫,০৬
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৪
সময়ের রেলগাড়ী কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে না! দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেলো।এই ছয় মাসে নীতুর জীবনে অনেক পরিবর্তন না হলেও কিছুটা হয়েছে।এখনো নীতু টিউশনি করায়,রোজ নিয়ম করে রান্না করে,ঘর ঘুছায়।নিত্য নতুন পাত্রের সামনে সঙ সেজে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।বিকট ভুঁড়িওয়ালা পাত্র নীতুকে মোটা বলে রিজেক্ট করে। বা এস এস সি পাশের মুদি দোকানি পাত্র নীতুকে বয়স বেশি! কালো বলে রিজেক্ট করে।এসবের কিছুই পরিবর্তন হয়নি।এই তো গতকাল পাশের বাসার আন্টি উপহাসের সুরে নীতুকে নিয়ে ভীষণ আফসোস করলো। তাছাড়া সোনাডাঙ্গায় থাকে যে মামী সেও প্রায় দিন মাকে কল করে বলে”হ্যারে, নীতুর কোন গতি হলো?বেচারি ঐ কালো রঙেই নিজের কপাল পুড়ালো!বয়স তো আর বসে নেই যৌতুক টৌতুক দিয়ে বিদায় কর মহিমা!সেতুকেও তো বিয়ে দিতে হবে!”
পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের নীতুকে নিয়ে বড়ই চিন্তা। বিবাহ যোগ্য মেয়েকে ঘরে রাখা মানে পাপ!গুরুতর পাপ! এসব শুনে নীতুর এখন আর মন খারাপ হয় না! মন খারাপ হয় না মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে।এমনকি ভাবির কটু কথা, ভাইয়ার নির্লিপ্ততা কোন কিছুই নীতুকে আগের মত আঘাত করে না।
একটা মানুষের আবির্ভাব নীতুর জীবনটা বদলে দিয়েছে পুরোপুরি ভাবে।মানুষটা দূরে থেকেও সবসময়ে ছায়ার মত বিচরণ করে! সেই মানুষটা আর কেউ নয়, তাজ। ছয় মাসে সম্পর্কের ক্ষেত্রটা বদলে গেছে।দুজন দুজনকে ভালোবাসি কথাটা না বললেও এক অদৃশ্য অধিকার বোধ জন্ম নিয়েছে। তাজ যেন একটু বেশিই নীতুর খেয়াল রাখে।নীতুর প্রতি এই প্রগাঢ় টান কে কি বলা যায়? ভালোবাসা নাকি প্রেম?তা নীতু জানে না।নীতু কেবল এতটুকু জানে তাজ তার ভিতরের সত্বাকে অজান্তেই জয় করেছে। দিনে অন্তত দশবার কল করে নীতুর খোঁজ নেয়া তাজের রুটিন হয়ে গেছে।ফোন ধরতে দেরি হলেই কখনো বা ভীষণ রাগারাগি করে!নীতুর মন খারাপ থাকা মানে তাজের বুকের বাম পাশে ভীষণ অস্থিরতা! নীতু আর তাজ দূরে থেকেও অদৃশ্য সংসার পেতেছে!ফোনে কথা বলতে বলতে দুজনের নাস্তা খাওয়া, তাজের শার্টের রঙ পছন্দ করে দেয়া,দুপুরের খাবারটাও খাওয়া হয় দুজনের কথা বলতে বলতে!রাতের ঘুমটাও নামে দুজনের একইসাথে!আগের মত নির্ঘুম রাত কাটে না।নীতু আপন মনেই হেসে ওঠে! তাজ পাগল, ভীষণ পাগল।সেদিন ফোন করে হুট করেই বললো,” নীতু বাসার জন্য কি বাজার নিবো?”
নীতু একথা শুনে তো ভীষণ অবাক। তাজের নিঃসঙ্কোচ কথা! যেন কতদিনের সংসার তাদের!
নীতু উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না।ওপাশ থেকে তাজই তাড়া দিয়ে বললো,”আহা! নীতু বলনা?চুপ করে আছো কেন?করল্লা আর পালংশাক উঠেছে বাজারে, নিয়ে নেই কি বলো?
নীতু চট করে বলে ফেললো,”আমি তো করল্লা খাই না!তুমি বরংচ পালংশাক নেও।”
তাজ ফোনের ওপাশেই মিষ্টি করে হেসে ফেললো নীতুর বোকা বোকা কথায়।কথাটা বলে নীতুও যেন খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে গেলো।তবুও বলতে পেরে ভালো লাগলো নীতুর। তাজ দ্রুত কন্ঠে বললো,” ইলিশ না চিংড়ী,? ”
“ইলিশ। ”
“মুরগী না হাঁস?”
“মুরগী। ”
“গরু না খাসি?”
“খাসি!”
“মিনিকেট নাকি বালাম?”
“মিনিকেট।”
“প্রেম নাকি ভালোবাসা?”
“প্রেম!”…… বলেই নীতু ভীষণ লজ্জা পেলো।তাজ তখন হো হো করে হেসে দিলো।
দুজনের আলাপনের মাধ্যমটা যান্ত্রিক যন্ত্র হলেও সম্পর্কের গভীরতা দিন দিন বাড়তেই থাকলো।
***********
চিত্রালী থেকে নিউমার্কেট যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না।টিউশন শেষ করে নীতু নিউমার্কেটে যাওয়ার জন্য অটোতে উঠলো।টুকটাক ব্যক্তিগত কিছু সামগ্রী কিনে ভাবলো বড় আপার বাসায় যাবে।দাদাভাইর নাকি জ্বর এসেছে বললো গতকাল বড় আপা।অটোতে বসতেই পানখাওয়া মধ্য বয়স্ক এক পুরুষ এসে বসলো নীতুর পাশে।নীতু খানিকটা চেপে বসলো জানালার দিকে।কিন্তু লোকটা যেন সুযোগ পেয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিন্দাস করে বসলো।নীতুর গা গুলিয়ে উঠলো! লোকটার গা থেকে কেমন ভোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। কতক্ষণ পরই নীতু অনুভব করলো লোকটা তার কনুই দিয়ে নীতুর বগলের নিচে ইচ্ছা কৃত ভাবে ধাক্কা লাগানো চেষ্টা করছে।আতঙ্কে নীতুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো!কি বিশ্রী লোক।নীতু এসব কর্মকান্ড ভীষণ ভয় পায়।নীতুর স্থানে ইতু থাকলে সটান করে থাপ্পড় বসিয়ে দিতো।নীতু তা পারলো না।সে চিৎকার করে অটো থামাতে বলে অটো থেকে নেমে গেলো।নীতু যখন নেমে যাচ্ছিল তখনও লোকটা পান খাওয়া ঠোঁটে বিশ্রী ভাবে হাসছিল।নীতু রাস্তার পাশেই বমি করে দিলো।
নীতুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো অনেক বছর আগের একটা ঘটনা।তখন নীতুর বয়স ছয়।সেজ ফুফা আদর করার নাম করে নীতুর স্পর্শকাতর স্থান গুলোতে বিশ্রী ভাবে ছুঁয়ে দিতো।নীতু তখন ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও ভালো লাগতো না ঐ সব ছুঁয়ে দেয়া।গা মুচড়িয়ে নীতু প্রতিবাদ করতো!কোল থেকে নেমে যেতে চাইতো কিন্তু ফুফা শক্ত করে ধরতো ফলে নীতু ব্যথা পেয়ে কান্না করতো।এরপর থেকে ফুফা বাড়িতে এলে নীতু তার কাছে যেতো না কিন্তু সেই ঘটনা টা এখনো মনে কোণে দাগ কেঁটে বসে গেছে।
নীতু রাস্তার পাশে বসে পড়েই হু হু করে কেঁদে উঠলো।কেন তার সাথেই এসব হয়?নীতু তো সুন্দর নয়?তবুও কেন লালসার হাত থেকে বাঁচতে পারে না।পরক্ষণেই নীতুর মনে হলো,কুৎসিত লালসা কখনো সুন্দর বা অসুন্দর বিবেচনা করে না!তাদের কেবল নারী শরীরের উঁচু নিচু বাঁকের প্রয়োজন!
নীতুর ফোন বাজছে। চোখ মুছে নীতু কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তাজ বলে উঠলো,” নীতু কাঁদছো কেন?কি হয়েছে নীতু?”
তাজের কথায় নীতু আবার কেঁদে উঠলো।তাজ ব্যগ্রকন্ঠে বলে ওঠে, “টেল মি নীতু?আমার কিন্তু ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। ”
নীতু তখনও ফুপিয়ে কাঁদছে।তাজ উচ্চস্বরে বলে উঠলো, ” এই নীতু আমি ভয় পাচ্ছি তো। প্লিজ,নীতু আমাকে বল কি হয়েছে?আবার পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে?”
নীতু এবার সবটা খুলে বললো।সবটা শুনে তাজের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো।চিৎকার করে বলে উঠলো,”কুত্তারবাচ্চারে ছেড়ে দিলা কে?থাপ্পড় মারতে পারো নাই?হাত নেই তোমার?কেউ তোমার শরীরে হাত কি করে দেয়? কি করে হাত দেয় নীতু?কষিয়ে থাপ্পড় কেন মারো নাই?”…..শেষের কথাটা তাজ জোড়ে ধমকে বলে উঠলো।
নীতু ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো। তাজের এই রুপ সম্পর্কে নীতুর জানা ছিল না।
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৫
নিশুতি রাত।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।ঝিঁঝি পোকার অনবরত আওয়াজ আর বেলি ফুলের গন্ধে চারপাশ মোঁ মোঁ করছে।হুট করে গোলির মোড় থেকে তিন চারটে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠে।নীতু কান্নারত অবস্থায়ই কেঁপে ওঠে। নীতুর কুকুর ফোবিয়া আছে! কিন্তু আজ কুকুরের ডাকের থেকেও মানুষের বুলিকে ভয়ংকর লাগছে! নীতু দ ভঙ্গিতে বসে আছে ছাদের রেলিং ঘেসে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নীতু।পড়নের জামা ঘামে ভিজে গেছে,হাতে পায়ে বসেছে মশার কামড়!তবুও কোন দিকে লক্ষ্য নেই মেয়েটার।নিজেকে ভেঙে চুড়ে কাঁদছে নীতু। এ কান্না অপমানের, লজ্জার! নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় নীতুর।বিধাতার কাছে করে বসে অভিযোগ। চামড়ার রঙই যদি গুরুত্ব পায় মানুষের কাছে তবে কেন এই ভিন্নতা? কেন সবাইকে এক রঙে পাঠালো না?নীতু অত্যাধিক মোটা নয়।কিছুটা ভরাট সাস্থ্য!তাতেই সে হাতি উপাধি পেয়ে বসে আছে! আবারো ডুকরে কেঁদে ওঠে নীতু! উন্মাদের মত নিজের জর্জেট ওড়না দিয়ে হাতে পায়ের চামড়া ঘসতে থাকে।যেন মুছিয়ে ফেলতে চায় নিজের কালো রঙ। জর্জেট ওড়না দিয়ে জোরে জোরে ঘসার কারণে হাতের নরম চামড়া জ্বলে ওঠে।কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই মেয়েটার!আজ সে নিজের কাছে নিজে পরাজিত!
“কি করছিস নীতু?নিজেকে সামলা বোন।”….. বলে চেঁচিয়ে ওঠে জায়েদ।
নীতুর হাত থেমে যায়। কিন্তু বুকের ভিতরের রক্তক্ষরণ কি থামে? থামে না।জায়েদ পরম ভরসায় নীতুর পাশে বসে হাত মুঠো করে ধরে।যেন বলতে চায়,আর কেউ পাশে না থাকুক আমি আছি তো!
নীতু বিড়বিড় করে বলে,” দাদাভাই? ও দাদাভাই, আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে বলো তো?ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, দাদাভাই!কলিজাটা পুড়ছে!মনে হচ্ছে কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছে!তুমি গন্ধ পাচ্ছো দাদাভাই?মন পুড়ার গন্ধ!শরীরটা কেন পুড়ে না? দাদাভাই এই কুৎসিত শরীরটা কেন জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায় না?বল তো?আমার কপালে কি ভালোবাসা বলতে কিছু নেই?এতটা কপাল পোড়া করে কেন পাঠালো আল্লাহ?”
জায়েদ অনুভব করে তার বুকের ভিতরটা জ্বলছে।এই মেয়েটা এত অসহায় কেন?
নীতু ফের বলে,”দাদাভাই, সবার কাছে এতটা তুচ্ছ কেন আমি?গাঁয়ের রঙই কি আসল?মানুষের মন বলে কিছু থাকতে নেই?পাত্রস্থ মেয়ে ঘরে থাকা পাপ!পরিবারের বোঝা কমাতে আল্লাহ কি আমার জন্য একটা পুরুষ পাঠাতে পারে না?এতবড় দুনিয়াতে কি আমার জন্য একটা পুরুষ নির্বাচিত হয়নি?আমি এতটাই কি জঘন্য? এতটাই কুৎসিত? ”
“চুপ কর নীতু।নাহলে থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিবো।তুই জঘন্য নস।জঘন্য ওরা যারা তোকে মানুষ বলে বিবেচনা করেনা।”…… বলতে বলতে জায়েদ কেঁদে দেয়।
” তুমি কাঁদছো দাদাভাই?ছিঃ পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই, জানো না?আমার মত একটা কালো মেয়ের জন্য তুমি কাঁদছো এ কথা লোকে জানলে হাসবে দাদাভাই!আমাকে নিয়ে উপহাস করা যায়।কাঁদা যায় না!”…..বলতে বলতে নীতু জায়েদের কাঁধে মাথা রাখে।দু-চোখ বন্ধ করতেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।কালো মেয়ের চোখের জল কেমন হয়?তাও কি কালো?নাকি অন্য কোন রঙ সেই জলের?
নীতুর কানে অনবরত বাজতে থাকে তাজের মায়ের বলা ঐসব তিক্ত কথা!যা সে সহজ ভাবে বলে গেলেও একবারো চিন্তা করেনি নীতু সে সব কথা সহ্য করতে পারবে কিনা?
” এই পাতিলের তলার মত রুপ নিয়ে এসেছো আমার ছেলের বউ হতে?লজ্জাও করলো না।কোনদিন নিজেকে আয়নায় দেখেছো মেয়ে?এই তো রুপ তারপর তো বয়সেও আমার ছেলের বয়সী! কি বেল্লালপনা?ছিঃ ছিঃ! বুড়ি একটা মেয়ে হয়ে পটিয়ে পাটিয়ে আমার ছেলের মাথা খেয়ে বসে আছো।ভালোই তো চতুর!আজ পর্যন্ত কটা ছেলের মাথা খেয়েছো মেয়ে?কালো হলে কি হবে হাতির মত শরীর দিয়ে পুরুষ পটাতে তো ভালোই পারো। “…..এত গুলা কথা ঐ মহিলা খুবই সহজ ভঙ্গিতে বলে গেলো।
নীতু তখন বিস্ফোরিত নেত্রে তার কথা শুনছিল।নীতুর মনে হলো দিনে দুপুরে তার মাথায় বজ্রপাত পড়েছে!নীতুর বিশ্বাস হচ্ছিল না এরকম কথাও মানুষ বলতে পারে! নীতুর শিক্ষা, যোগ্যতা,মার্জিত ব্যবহার কোনোকিছুই তাজের মায়ের চোখে বিঁধলো না।বিঁধলো শুধু শরীরের রঙটা!
এক সপ্তাহ আগে তাজ কল করে বলেছিল, ” নীতু তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।কাল আম্মা তোমার সাথে দেখা করতে যাবে।”
নীতু তখন ভীষণ অবাক হয়ে বলেছিল, “কেন?”
তাজ প্রতিত্তোরে হেসে বলেছিল,”আমার মায়ের একমাত্র ছেলের ইদানীং এই শহরে মন টিকে না।তাই ছেলের মন ফিরানোর ব্যবস্থা করতে যাবে!”
নীতু ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছিল।তাজ আসবে নাকি দুদিন পড়ে।তার আগে তার মা দেখা করতে চায়।নীতু ভীষণ ভয় পাচ্ছিল।তাজ সে কথা শুনে কেবল হেসেছিলো।বলেছিলো,”আমার সাথে তোমার দেখা একটু অন্যরকম ভাবেই না হয় হোক! আমি দেখতে অতোটাও খারাপ নই।এই বন্ধুর উপর ভরসা করতে পারো।”
ভরসা তো নীতু করেছিলোই।একরাশ নার্ভাস নেস নিয়েই বেছে বেছে আলমিরার সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পড়েছিলো।চোখে যত্ন করে কাজল দিয়েছিলো।ঠোঁটে হালকা রঙের আঁচ দিয়েছিল।লম্বা চুলগুলো শ্যাম্পু করে ছেড়ে দিয়েছিলো পিঠ জুড়ে!কানে গলায় সেতুর অর্নামেন্টস থেকে বেছে বেছে ঝুমকো, পাতলা চেন পড়েছিলো।
নীতুকে সেদিন দেখে ভাবি পর্যন্ত প্রশংসা করলো! এই এত সজ্জা তাজের মায়ের চোখে পড়লো না।নীতুর বিশ্বাস,ভরসায় পরিপূর্ণ চোখদুটো তার নজর কাড়লো না! তার নজরে বিঁধলো কেবল,নীতুর গায়ের রঙ!
তাজের মা নীতুকে প্রথমে দেখে কোন কথাই বলেনি।নীতুর মা একজন অপরিচিত মহিলা দেখে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পড়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিলো।যার ঘরে দু দু’টো অবিবাহিত মেয়ে আছে তার ঘরে মানুষ আসতেই পারে।তাই সে খুব পরিচিত ব্যবহার করলো।ঘরে যা আছে তা দিয়েই সাধ্যমত আপ্যায়ন করলো।তাজের মাও নিজের পরিবারের সকল আদ্যোপন্ত বলে গেলেন হাসি মুখে।নীতু পাশে দাঁড়িয়ে তা চুপচাপ শুনে গেলো। যাওয়ার সময় নীতুর মায়ের কাছে থেকে ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে গেলো।নীতু যখন গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলো তখন তাজের মা ঐসব কটু কথা গুলো বলে গেলো।নীতুকে হতভম্ব অবস্থায় রেখেই তিনি বেড়িয়ে গেলেন। রাতে তাজ ফোন করলো না।এমনকি পরদিনো না।তার পরদিন বিকেল বেলা কল করে নীতুকে রুপসা ব্রিজের কাছে আসতে বললো।নীতু কোথাও একটা ছোট্ট আশা নিয়ে তাজের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।কিন্তু সেখানে গিয়ে তাজকে বিধ্বস্ত রুপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।তাজ বারবার শুধু নিজের চুল টানছিল। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলো।নীতুর মায়া লাগলো।তাজকে সেদিন প্রথম দেখেও নীতুর মনে হলে কত চেনা মানুষটা।তাজ সেদিন কোন কথাই বলতে পারলো না,শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো।নীতু ঘন্টাদুয়েক পর যখন চলে আসছিলো তখনও তাজ কিছু বললো না।নীতুর বারবার মনে হলো,এই বুঝি তাকে তাজ ডাকবে!তাকে ফিরাবে!বলবে, “দেখো আমি সবটা সামলে নিবো!” কিন্তু কিছুই বললো না।ভরসা দিয়ে যারা কথা বলে একসময় তারাই নির্ভরসার কাজ করে!
সেদিনের পর আজ বিকেলে তাজের মা এসে সেতুকে আংটি পড়িয়ে নিজের পুত্রবধু হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষনা করে গেলো!নীতু সবটা অবাক চোখে দেখছিলো।তার মাথা কাজ করছিল না।এত কিছু কখন হলো।মা কিছুই তাকে জানালো না?এতটা অবহেলিত, অযাচিত এই পরিবারে সে? নীতু অবাক নেত্রে তাকিয়ে দেখছিলো তার মায়ের, ভাইয়ের বউয়ের মেয়ে বিদায়ের তৎপরতা! এতটা খুশি তারা ঘার থেকে বোঝা নামাতে। আর সেতুও সবটা হাসিমুখে মানছিলো!লজ্জানেত্রে পাটভাঙা শাড়ি পড়ে বসেছিলো!ফর্সা শরীরে টকটকে লাল শাড়ি,সত্যিই ভীষণ সুন্দর! আচ্ছা নীতুকে কি এই লাল শাড়িতে মানাতো?নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে।
নীতু একছুটে নিজের রুমে গিয়ে তাজকে কল করেছিলো।জিজ্ঞেস করেছিলো, “এসবের মানে কি?”
উত্তরে তাজ ঠান্ডা কন্ঠে বললো,” অনেক চেষ্টা করলাম নীতু।মা শুনলো না।মা কিছুতেই তোমাকে আমার পাশে চায় না।সে মরে যাবার হুমকি দিলো।আমি চিল্লাফাল্লা করলাম।সে কাল থেকে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলো।আমি কিছুই করতে পারলাম না নীতু!তাদের একমাত্র ছেলে আমি।আমি তাদের কি করে কষ্ট দিবো নীতু?”
“আমাকে ঠিকই কষ্ট দিতে পারলেন, তাজ!আজ আমার বোনের হাতে আপনার নামের আংটি উঠলো।আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ হলো না। ভালো কথা কিন্তু আমার বোনকে পছন্দ করে কেন আমাকে অপমানিত করলেন?”
“আমি চেষ্টা করেছি নীতু।মা শুনলো না।রাগ করে বলেছি,যা খুশি করো।তাই করছে। নীতু,মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই ভীষণ অসহায় হয়!কিছু মুহূর্তের কোন সঠিক ব্যাখ্যা থাকে না!”
নীতু শ্লেষ কন্ঠে হেসে বলেছিলো,”আজ আবারো স্বীকার করলাম,আপনি খুবই সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। আমাকে অপমান করতে একটুও বাধলো না।সত্যিই কি চেষ্টা করেছিলেন নাকি আপনার মায়ের মত আঠারোর যৌবন দেখে নিজেকে সামলাতে পারেন নি।”
নীতুর কথা শুনে তাজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠেই তাজ বলে উঠলো,”আমার মনে পড়ে না আমি তোমাকে কখনো ভালোবাসি কথাটি বলেছি।বা কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।যে তুমি এভাবে বলছো।আমরা দুজন বন্ধু ছিলাম নীতু।সেখান থেকেই সম্পর্কটা আগাতে চেয়েছি তাও আমি একক ভাবে।তারপরও কিভাবে তুমি আমাকে দোষ দাও।আমি তোমারই জন্য যা কখনো করিনি তাই করেছি।ঢাকা থেকে খুলনা ছুটে এসেছি।মায়ের বিরুদ্ধে গেছি।”
নীতুর বুকের ভিতর খা খা করে উঠলো।কত সহজেই না সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।কিন্তু মায়া কি শেষ হয়? এতই সহজ প্রত্যাখ্যান? নীতু ধীর কন্ঠে বললো,”আপনার সাথে আজ থেকে আমার বোনের সুখ জড়িয়ে গেলো।তাই দোয়া করি সবসময় সুখী থাকুন।নীতুর কালো ছায়া কখনোই আর পড়বে না আপনাদের মাঝে। আপনি একবার বলেছিলেন, নিজের ভালো থাকা নিজেকেই দেখতে হয়।আমি না হয় তাই করবো।ভালো থাকুন।
“তুমিও নীতু!”
এরপরে সবকিছু সহজ হয়ে গেলো।তাজের মা নীতুরই চোখের সামনে অষ্টাদশী সেতুকে আংটি পড়িয়ে গেলেন। হাসিমুখে পানচিনি খেলেন।মা ব্যাংকার জামাই পাবে সেই খুশিতে নিজের মুখ থেকে হাসিই সরাতে পারলেন না।পাটভাঙা শাড়ি পড়ে লক্ষীমন্ত বউয়ের রুপে সুরভী ভাবি সবার মেহমানদারী করলো।শুধু জায়েদ ক্ষেপে উঠেছিল।অপমানিত করতে চাইলো কিন্তু নীতু বাধ সাধলো। যে সুখ অন্যের তা কখনো জোর করে পাওয়া যায় না।নিজের প্রাপ্তি একসময় না একসময় ধরা দিবেই!তা কখনো কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
সবাই চলে যাবার পর থেকেই নীতু ছাদে বসে কান্না করছে। আগাছা সাদৃশ্য নীতুর দিকে কারোরই খেয়াল নেই!একমাত্র দাদাভাই ব্যতীত।
জায়েদের কথায় নীতুর ধ্যান ভাঙে,”একটা সময় দেখিস সব হবে তোর।সব!”
“দাদাভাই বেশি কিছু তো চাই না আমার।শুধু এ বাড়ি থেকে মুক্তি চাই।আজ রাতের পর আর এই বাড়িতে আমি থাকবো না।কোন পুরুষ চাই না আমার জীবনে। কোন মিলন বা তাজ নামের পুরুষ আমার সুখের মূল কেন্দ্র বিন্দু হবে না!আবার শেষ থেকে শুরু করবো দাদাভাই!আমার নিজের সুখের কলকাঠি এখন থেকে আমার হাতেই থাকবে।তা অন্যকেউ আর নির্ধারণ করতে পারবে না।পুতুল নাচ তো অনেক হলো।এবার নিজের মত বাঁচা হোক!”
জায়েদ আৎকে উঠে বলে,”কি করবি তুই?কোথায় যাবি?”
“জানি না দাদাভাই।শুধু জানি এই বাড়ি, এই মানুষগুলোর নিঃশ্বাসে আমার দমবন্ধ লাগছে।আমি এখানে থাকলে মরে যাবো দাদাভাই!আমাকে বাঁচতে হবে!”
জায়েদ অন্ধকারেও স্পষ্ট যেন নীতুর জ্বলে ওঠা আগুন দেখতে পেলো।এই নীতুকে জায়েদ আগে কখনো দেখেনি।এতটা শক্ত,কঠোর করে কথা কখনো নীতু বলেনি।এই রাতের শেষে নতুন সূর্য উঠুক তা জায়েদ নিজেও চায়।সেই সূর্য কেবল নীতুর জন্যই উঠুক।নীতুকে রাঙিয়ে দিতে উঠুক!
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৬
ইতু বসে আছে একটা দু,তলা ভবনে।ভবনটা স্কুল ঘরের মত।নিচের সেকশনে ছয়টা রুম একটা বাথরুম একটা গোসলখানা আর উপরের সেকশনেও সেম।ইতু চোখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সবটা।প্রতিটা ঘর খুব বেশি একটা বড় নয়।এক একটা ঘরে পাঁচটা সিঙ্গেল বেড।কারো কারো বেডে দুজনও শেয়ার করে থাকে। ছয়টা রুমের সামনেই একটা লম্বা করিডোর সিস্টেম বারান্দা! সেখানে মেয়েদের ভিজা কাপড়,পাপস,চাদর শুকা দেয়া।করিডোরে দাঁড়িয়েই ইতু দেখে সামনে একটা এক তলা বাড়ি।ওটায় সম্ভবত বাড়িওয়ালা থাকে।বাড়িওয়ালা মহিলা কিছুটা কটকটা স্বভাবের। ইতু একটু কথা বলেই বুঝতে পেরেছে।স্বল্প খরচে ইট সিমেন্ট আর সাদা রঙ ঘসে ভালোই পয়সা ইনকামের ব্যবস্থা।এই দু’তলা ভবনটার নাম রাদিয়া মহিলা হোস্টেল।এখানে সব চাকুরীজিবী মহিলারা থাকে।নীতু গত পাঁচদিন ধরে এখানেই আছে।এ বিষয়টা ইতু জানতো না।প্রথমে যখন শুনেছে তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে।নীতু আপার মত শান্ত শিষ্ট একটা মানুষ ঘর ছেড়ে চলে আসতে পারে এটা স্যালুট দেওয়ার মতই বিষয়। যেখানে আপা মুখ ফুটে দুটো কথা বলে না সেখানে আপা সবার বাঁধা অতিক্রম করে এই কষ্টকর হোস্টেল জীবনে দিনযাপন করছে এটা ভাবারই বিষয়!
ফর্সামত, শুকনা ছিপছিপে শরীরের একটি মেয়ে বলে ওঠে, “আপনি রুমে গিয়ে বসুন।আপনার বোন গোসলখানায় আছে।”
সময় বিকেল চারটা দশ।তারমানে গোসলের সিরিয়াল পেয়েছে এখন আপা।শুক্রবার বলেই সবাই আছে তাই ভীরও বেশি।ইতু রুমের ভিতরে যেয়ে বসে।রুমের অবস্থা জঘন্য। এখানে ওখানে কাপড় চোপড় ছড়ানো ছিটানো।রশিতে ব্রা, পেন্টি জামা, সালওয়ার সব টাঙানো। একটা মেয়ে ডিম আলু মেখে ভাত খাচ্ছে খাটে বসে।তরকারিতে যে হলুদ বেশি হয়েছে তা ইতু দূর থেকেই দেখে বুঝেছে। আর একটা খাটো মত মেয়ে অনবরত মোবাইলে কথা বলছে আর সিগারেট টানছে।ইতুর চোখ কপালে ওঠার দশা।মেয়েমানুষ ছেলেদের মত সিগারেট টানছে।আশ্চর্য! মেয়েটা কিসব কুৎসিত ভাষায় কাকে যেন গালি দিচ্ছে। ইতুর দমবন্ধ লাগছে।এখানে নীতু আপা কি করে থাকে?
নীতু রুমে এসে দেখে ইতু চোখমুখ কুঁচকে বসে আছে। নীতু ইতুকে দেখে অবাক হলো না।খুবই স্বাভাবিক স্বরে বললো,” ইতু একটু অপেক্ষা কর।আমি তৈরি হয়ে নেই। তারপর একসাথে বের হবো।”
ইতু এবারো অবাক হলো নীতুর আচরণে।কেন আসলো? বা কেমন আছি কিছুই জিজ্ঞেস করলো না।নীতু একটা লাল সালওয়ার কামিজ পড়া।এটা দেখেও ইতু অবাক হলো।নীতু সবসময় হালকা রঙের পোশাক পড়ে! নীতু
দু’বেল্টের একটা ফ্লাট জুতো পড়লো।ভিজা চুল যত্ন নিয়ে আচঁড়ালো।চোখে কাজল দিলো।মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে হাতে পার্স নিয়ে ইতুকে চোখের ইশারা দিলো বের হওয়ার জন্য! একটু আগের মেয়েটা নীতুকে বের হতে দেখে প্রশ্ন করলে,”আপনি খাবেন না?”
“না।রাতের বেলা আমার জন্য রাঁধতে নিষেধ করো।”….. বলে নীতু বের হওয়ার সময় যে মেয়েটা সিগারেট টানছিল তার ঠোঁট থেকে সিগারেট টান দিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো।মেয়েটা রক্তচক্ষু চোখে নীতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে নীতু গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে গেলো।ইতু সবটাই অবাক চোখে দেখলো।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নীতু বললো,” দাদাভাইর আসার কথা ছিল। আসলো কিনা?”
ইতু ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললো,”জায়েদ ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।আমার সাথেই সে এসেছে।”
নীতু আর কিছুই বললো না।জায়েদ ওদের দেখে এগিয়ে আসলো।নীতুকে লাল জামায় দেখে জায়েদের কপালও খানিকটা কুঞ্চিত হলো।নীতু জায়েদকে বললো,”দাদাভাই একটা খাবার হোটেলে চলুন তো খুব খিদে পেয়েছে।”
সামনেই খুব নিম্নমানের একটা হোটেল পেয়ে নীতু সেটাতেই ঢুকে পড়লো।জায়েদ আর ইতু হতভম্ব।জায়েদ ভালো কোন রেস্টুরেন্টে নিতে চাইলো।নীতু তা শুনলো না। এতটা গম্ভীর নীতু কখনোই ছিল না।জায়েদ আর ইতু কিছুই খেলো না।টিনের ছাপড়া দেয়া একটা ছোট খাটো হোটেল।দুপরের তরকারি সব শেষ। শুধু ভাত আছে।আর সকালের কিছু পেপে ভাজি। নীতু তা দিয়েই খুবই আয়েশ করে ভাত খেলো।পুরোটা সময় ইতু হতভম্ব চোখে তাকিয়ে নীতুকে দেখছিল।এই নীতুকে সে চিনতে পারছে না।ইতু হুট করেই অনুভব করলো তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে!
খাওয়া শেষে সেখানেই বসে রইলো ওরা।দুপুরের শেষ এখন দোকানে কোন কাষ্টমার নেই।দোকানিও এক কোণের চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে! নীতু শান্ত কন্ঠে বললো,”দাদাভাই, তোমাকে বলেছিলাম আমার চাকরির ব্যপারে খোঁজ নিতে।নিয়েছিলে? দুটো টিউশনি দিয়ে হবে না আমার।যে কোন রকমের একটা চাকরি আপাতত হলেই হয়।”
জায়েদ ধীর কন্ঠে বললো,”এই হাহাকারের বাজারে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন।হুট করে কোন কিছুই সম্ভব না।আর যাও ছোট মোট কাজ আছে তা তুই পারবি না।আমার এক বন্ধুকে বলেছিলম।সে আজ দুটো কাজের কথা বলেছে।তা তুই করতে পারবি না।ওসব ছেলেদের কাজ।”
নীতু আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, “কি রকম কাজ?তুমিই বলো।আমি করবো।”
“একটা প্রাণ কম্পানির পণ্য দোকানে দোকানে ঘুরে বিক্রি করা।আর একটা হলো হক টাওয়ারের যে বড় শপিং মলটা আছে ওটায় সেলসম্যানের কাজ!”
“আমার কোন আপত্তি নেই দাদাভাই।সেলসগার্ল হতে কোন সমস্যা নেই।তুমি কথা বলো।আমার বসে থাকার কোন স্কোপ নেই।এই কাজটা করলাম পাশাপাশি ভালো কোন জবও খুঁজলাম।”
জায়েদ অধৈর্যের সাথে বলে,”তুই ওসব পারবি না নীতু।সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কাজ।শার্ট প্যান্ট পড়তে হবে।অনবরত দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে।জেদ করিস না।সব কাজ সবার জন্য নয়।”
নীতু শক্ত কন্ঠে বলে,”আমি পারবো দাদাভাই।আমি পারবো।ওসব তুমি ভেবো না।তুমি সব কিছুর ব্যবস্থা করো।”
ইতু এতক্ষণ সবটা শুনলেও এবার মুখ ফুটে বলে উঠলো,” এসব কেন করছো আপা?এত কষ্ট কেন? তুমি তো এতটা কঠোর ছিলে না?”
“এতটা কাল যা করেছি সবটা অন্যের কথা ভেবে করেছি। কে কি মনে করবে?কি রকম ভাবে চললে লোকে পছন্দ করবে?কিভাবে হাসলে লোকে মন্দ বলবে না?কোন কাজটা করলে লোকে নিন্দে বলবে না? অনেক তো হলো। আর কত?আজ থেকে যা করবো একমাত্র নিজের কথা ভেবে। ”
ইতু কেঁদে ফেললো, “আপা ঘরে ফিরে চলো। মা চিন্তা করছে।”
নীতু থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে ইতুর দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর পার্স হাতে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার সময় বলে গেলো,” মা আমার জন্য চিন্তা করছে না।সে চিন্তা করছে সমাজের। বিয়ের যোগ্য মেয়ে কোথায় না কোথায় থাকছে লোকে জানলে আর কোন গতি হবে না তার কালো মেয়ের।আত্মীয় স্বজন ছি! ছি! করবে মা সেই চিন্তা করছে। আর কিচ্ছু না।মাকে বলে দিস,আর কারো ভয় নীতু করে না।টিপিকাল সমাজ আমার কালো রঙ ধুয়ে মুছে উঠিয়ে ফেলতে পারবে না।”
নীতুর হাত খপ করে ধরে বসলো ইতু।নীতু দাঁড়িয়ে পড়লো।” আপা আর পনেরো দিন পড়ে সেতুর বিয়ে ঠিক হয়েছে।তুমি কি যাবে না?”
“দোয়া রইলো নতুন দম্পতির জন্য। আমার কালো ছায়া ওদের উপর না পড়াই ভালো।আসি, ভালো থাকিস।”
ইতু অনুভব করলো শেষের কথাটা বলার সময় নীতু আপার কন্ঠটা সামন্য কেঁপে ওঠেছে।ইতু আহত দৃষ্টিতে নীতুর চলে যাওয়া দেখলো।এরপরই হু হু করে কেঁদে উঠলো।জায়েদ ইতুর মাথায় হাত রেখে বললো,”নীতুকে কিছুতে বাঁধা দিসনা ইতু।ওকে ওর মত চলতে দে।ওর ভিতরের আগুনটা যতদিন থাকবে ততদিন নীতু ভালো থাকবে।তোদের চোখের জলে সে আগুন নেভাতে যাস না।তাহলে ওকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না!”
**************
অভীক এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।অফিস থেকে ছয় মাসের জন্য সে জার্মান যাচ্ছে। আর এ খবর শুনেই অভীকের মা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। গত তিনটা দিন চোখের জলে ভাসিয়েছে।এখন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।নাকের জলে চোখের জলে অভীকের শার্ট একাকার!অভীক অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে,”আহা মা, কি করছো বলতো?এভাবে কান্নার কি আছে?কাজ শেষ হলে তো চলেই আসবো।আমি দ্রুত ফিরার ব্যবস্থা করবো।এখন কান্না থামাও।”
“কচু ফিরবি।এ চাকরি করার কোন দরকার নেই তোর।আমাদের যা আছে তাতেই হবে।ওত দূরে যাস না।আমার মন কেমন করছে।তোকে না দেখে এতদিন কি করে থাকবো?”….. বলে অভীকের মা আবার কাঁদতে শুরু করে।
অভীক হাত দিয়ে নিজের কপাল চাপড়ায়।অনিক আর রুমিও এসেছে ঢাকা।অভীক চলে গেলে তারা মাকে নিয়ে খুলনা ফিরবে।অনিকও এসে মাকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়।রুমি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রেখেছে।এসব টিপিকাল কান্নাকাটি পর্ব তার ভালো লাগছে না।প্রচন্ড বিরক্ত সে!
অভীক মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,” শুনো মা এত চিন্তা কেন করছো?বড়ো আছে তো তোমার কাছে।আমিই খুব দ্রুতই চলে আসবো।আর এতদিনে আমার জন্য বউ খুঁজে রেখো তুমি।বুঝেছো?এসেই ব্যাচেলর লাইফের কোরবানি দিবো!এবার একটু হাসি মুখে বিদায় দাও তো।”
অভীকের মা অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামান।অভীক মায়ের কপালে চুমু খায়।মাও ছেলের কপালে চুমু দিয়ে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে দেন।অভীক অনিককে মায়ের দিকে বারবার খেয়াল রাখতে বলে। এরপর রুমির উদ্দেশ্যে বলে,” আসি ভাবি।সবাই মিলেমিশে ভালো থেকো।”
রুমি বলে,”তুমিও। আর যা লিষ্ট দিয়েছি মনে করে এনো।”
“অবশ্যই।!” বলে অভীক বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢুকে পড়ে।
অভীক চলে যেতেই অভীকের মা কান্নারত অবস্থায় মনে মনে নিজের পুত্রবধুকে গালাগালি দিতে থাকেন।রুমি জীবনও আসতো না তাকে নিতে।অভীক জার্মান যাচ্ছে শুনে এসেছে।মূলত তার কসমেটিক আর বিলাসী পন্যের লিষ্ট দিতে আসা।নতুবা কখনো তাকে নিতে আসতো না। বউ শাশুড়ী দুজনেই দুজনকে ভেংচি কেটে গাড়িতে উঠে বসলে।আর তা দেখে অনিক নিজের কপাল চাপড়ালো।এই ছয়টা মাস তার জীবন তেজপাতা! এটা নিশ্চিত!
************
রাত তিনটা। নীতু হোস্টেলের খোলা বারান্দায় বসে আছে।দৃষ্টি অন্ধকার আকাশের দিকে।রিশা বাদে পুরো হোস্টেল ঘুমিয়ে আছে।নীতু অন্ধকারেই বুঝতে পারে করিডোর বারান্দার শেষ মাথায় রিশা বসে আছে।সিগারেটের আগুনের অনবরত ওঠানামা দেখে বুঝতে পারলো।নীতু ভেবে পায় না কি এমন কষ্ট মেয়েটার?যে তাকে অনবরত সিগারেট খেতে হয়।ছোট ছোট চুল কেটে,জিন্স শার্ট পড়ে ঘুরে সারাদিন মেয়েটা।অনেকটা পাগল টাইপের!
হাতের মুঠোয় ফোনের ভাইব্রেটের শব্দে নীতুর ধ্যান ভাঙে। স্ক্রিনে তাজ লেখা নামটা জ্বলজ্বল করছে।এত রাতে কেন কল করছে জানতে মন চাইলো না নীতুর।শুধু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে।কল আসতেই রইলো।একটা, দুটো,তিনটা করতে করতে বাজতে থাকলো।নীতু কল ধরলো না। শুধু বিড়বিড় করে তাজ নামটা একবার উচ্চারণ করলো।
দূর থেকেই রিশা দেখতে পেলো ফোনের লাইটের আলোয় নীতু নামের মেয়েটার চোখে জল।নিঃশব্দ রোদন! রিশার মনে হলো,এই পৃথিবীতে কোন মেয়েই কষ্ট ছাড়া নেই।প্রতিটা মেয়েরই নিজস্ব দুঃখ, কষ্ট থাকে।ছোট বড় সকল কষ্ট মেয়েরা আজন্ম বুকে লালন করে গুপ্তধনের মত!
রিশা বিড়বিড় করে বলে,”বালের জীবন!খ্যাতা পুড়ি এই জীবনের!ওয়াক থু!”
চলবে,