কাননবালা,০৭,০৮

0
369

#কাননবালা,০৭,০৮
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৭

নীতু হক টাওয়ারে সেলসগার্লের কাজে যোগ দিলো দুদিন পরই।জায়েদের নিষেধ শুনলো না।কালো জিন্স, হাটুর একটু উপরে কুর্তি আর তার উপরের হক টাওয়ারের লোগো দেয়া শার্ট পড়ে নীতু কাজে যোগ দিলো।লম্বা চুলগুলো ঝুটি করে পিঠে ছড়িয়ে পড়তো। সে এক অন্য নীতু!ভেঙে চুড়ে গড়ে ওঠা অন্য নীতু!
মহিমা বেগম ফোন দিয়ে অনেক গালাগালি করলো নীতুকে।একেতো গায়ের রঙের জন্য বিয়ে হয় না তারউপর কাজ নিয়েছে ছেলেদের এখন তো এই মেয়েকে পার করা কঠিন হয়ে যাবে!সেই ক্ষোবে চিল্লাপাল্লা করলো।নীতু চুপচাপ শুনলো কোন প্রতিত্তোর করলো না। কারো কোন কথা নীতু পরোয়া করলো না। যে বড় ভাই দিনের পর দিন নীতুকে অপমানিত হতে দেখেছে কখনো প্রতিবাদ করেনি,কখনো পাশে বসে জিজ্ঞেস করেনি কি প্রয়োজন নীতুর সেই ভাই আজ কল করে নীতুকে বেয়াদব,অসভ্য বলে আখ্যায়িত করলো।বড় আপা কল করে কাঁদল! কোন কিছুই নীতুকে ফিরাতে পারলো না!নীতু অটুট তার কথায় চিন্তায় চেতনায়! তাজ রোজ কল করে নীতু কখনো কল ধরে আবার কখনো ধরে না।নীতু কল রিসিভ করলে তাজ কিছুই বলে না।শুধু চুপ থাকে।কখনো বা তপ্ত নিঃশ্বাসে মুঠোফোন ভারি হয়ে ওঠে!

আর এক সপ্তাহ পরে সেতুর বিয়ে।সেতু খুশিতে আটখানা!পড়াশোনা কোন কালেই সেতুর ততটা ভালো লাগতো না। বর দেখতে ভালো, পরিবারও ছোট,কোন ঝামেলা নেই। তারউপর ঢাকা নিয়ে রাখবে।সেতু সেই খুশিতে উড়তে লাগলো।নীতুর এই পরিবারে না থাকা নিয়ে একটু মন খারাপ হলেও তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালো না। সে ফুলফর্মে বিয়ের মার্কেটে মন দিলো, বান্ধবীদের দাওয়াত দিলো।

তাজ অফিস থেকে ফিরেই দেখে মা রুমে বসে আছে, সামনে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ।তাজ কোন কথা বললো না।চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলো।ফ্রেশ হয়ে ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে বের হলো।তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করলো।রাবেয়া বেগম এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামলা গাত্রের!চোখ দুটো বড় না হলেও ভীষণ চঞ্চল চোখের দৃষ্টি।আজ সেই চোখে বিষন্নতা।নাক মুখ লাল!ছেলেটা কি কেঁদেছে?ভাবতেই বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠলো রাবেয়া বেগমের।
তাজ মোবাইল হাতে নিয়ে বেডে বসে বললো,”কিছু বলবে মা?”
রাবেয়া বেগম নিজেকে সামলে নিলেন।ছেলের মায়ায় পড়লে ঐ কালী তাড়িনীকে আনতে হবে।তারপর নাতি পুতি সব কালো হোক।তা হবে না কিছুতেই।তাই শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,”তোর কি সমস্যা? মার্কেটে যেতে বললাম গেলি না।নিজের শেরওয়ানীটা পর্যন্ত কিনলি না।সেটাও আমাকে কিনতে হলো।তারউপর যার সাথে দুদিন পর বিয়ে তাকে একটা কল করিস নি।কি চাস তুই?দেবদাস হতে?আর তোর পাগলামো দেখে আমি ঐ কালিকে ঘরে তুলি।এটাই চাস তুই? আমার ঘরে বসে তুমি কালীর তপস্যা করবে তা আমাকে দেখতে হবে।”

তাজ বিস্মিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।এই মাকে তার অচেনা লাগছে। যে মা ছোট বেলা থেকে শিক্ষা দিয়েছে।টাকা পয়সা,রঙ, বংশ কোন কিছু মানুষকে বড় করে তুলে না।মানুষ বড় হয় তার মানসিকতায়! সেই মা আজ এসব কথা বলছে।তাজ গুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে!মুখে অনেক কিছুই বলা যায় কিন্তু কাজের বেলা তার মাহাত্ম্য দেখা যায় না।
তাজ নিজের রাগ চেপে রাখতে চাইলেও তা পারলো না।রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো,” স্টপ মা।তুমি বিয়ে করতো বলেছো আমি করছি।আমি কোন কিছুতেই বাধা দেয় নি।এখন আমাকে হাসতে বলছো হাসবো।যেভাবে বলবে সেভাবেই করবো কিন্তু নীতুকে নিয়ে একটা খারাপ কথাও বলবে না। নীতুকে নিয়ে কিছু বলার রাইট তোমার নাই!”

“একটা দুদিনের পরিচিত মেয়ের জন্য তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস?সেই মেয়ে তোর কাছে বড় হয়ে গেলো।আমাদের এত বছরের ভালোবাসা কিছুই না।একমাত্র ছেলের জন্য বউ পছন্দ করার অধিকার আমার নেই?বল নেই? ”

“আছে মা।কিন্তু সংসারটা তো আমাকেই করতে হবে।”…. এই পর্যন্ত বলেই তাজ মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে।দুহাতে পা আঁকড়ে ধরে বলে,” মা নীতু খুবই ভালো মেয়ে।দেখো ওকে নিয়ে আমি ভালো থাকবো।তুমি একবার হ্যা বলো মা।তোমার ছেলেটা নীতু নামের মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসে মা!ভীষণ ভালোবাসে! ঐ রঙে আমার কোন সমস্যা নেই মা তবে তোমাদের এত আপত্তি কিসে?”…..তাজের চোখ ছলছল করে ওঠে,কন্ঠে ভেজা ভাব!

“কখনো না।আজ তুমি মোহে পড়ে এমন করছো যখন দেখবে তোমার বন্ধুরা সুন্দর বউ নিয়ে ঘুরছে তখন তোমার কষ্ট হবেই।যখন দেখবে নিজের সন্তানটা কালো তখন তোমার মন খারাপ হবেই।একটা মেয়ের বাচ্চা হলেই শরীর ভেঙে যায়।তখন তোমার নীতুর সাথে সংসার করতে ঝামেলা হবে।তাই তোমার কথা আমি শুনছি না।হয় নীতু না হয় মা।একটা তুমি বেছে নাও?….রাবেয়া বেগম অতি রাগ হলে ছেলেকে তুমি করে বলেন।

তাজ হেসে উঠলো।বড় ব্যথিত সে হাসি! পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,” মা আজ মনে হচ্ছে একমাত্র সন্তান হওয়া পাপ!বড় পাপ!একমাত্র সন্তান হলে মা বাবার ইচ্ছার বলি হতে হয়! প্রতিমুহূর্তে সবার ইচ্ছার দাম দিতে হয়,কখনো মা-বাবার কখনো স্ত্রীর। নিজের ইচ্ছা বলতে কিচ্ছু থাকে না তাদের!”

রাবেয়া বেগম আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। তাজ ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময় খাটের উপরে রাখা শপিং ব্যাগ গুলো ফ্লোরে ছুড়ে মারলো।লাল টুকটুকে বেনারসিটা ছিটকে পরলো সাদা টাইলসের মেঝেতে!সাদার উপরে লাল রংটা যেন মুহুর্তেই আরো সুন্দর করে ফুটে উঠলো চোখের সামনে। সেদিকে তাকিয়ে তাজ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।যে রং নীতুর জন্য নয় সে রংয়ের কোন স্থান নেই তাজের জীবনে!

************
ইতু মুখ অন্ধকার করে বসে আছে।পাশে বসে তুতুন কাঁদছে সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই।মিলন অফিস থেকে ফিরে এ দৃশ্য দেখে অনেকটা অবাক হলো কিন্তু ইতুকে কিচ্ছু বললো না।তুতুনের কান্না থামিয়ে মায়ের কাছে রেখে এসে ইতুর পাশে বসলো।ইতু তখনও নির্বিকার। চোখ মুখ বসে গেছে। মিলন বাহিরের পোশাক চেঞ্জ করলো না।ঘর্মাক্ত শরীরেই স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে।চেনা স্পর্শ পেয়েই ইতু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”নীতু আপার কি হবে মিলন?নীতু আপার কি হবে?আপার ছোট হয়েও আমাদের দু’বোনের বিয়ে হয়ে হচ্ছে অথচ আপা সবার লাথি গুঁতো খাচ্ছে। কেন আপার সাথেই এমনটা হয়?”

মিলন স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে থাকে।ইতু অনবরত কাঁদছে। একসময় মিলন বলে,”শোনো ইতু সবসময় মনে রাখবে যা হয় ভালোর জন্যই হয়!”

মিলনের কথায় ইতুর কান্না থামে না বরং আরো বাড়তে থাকে!

**********
রোজ সকালে আটটার মধ্যে নীতুকে হক টাওয়ারে পৌঁছাতে হয়।শপিং মল খোলার আগে অনেক কাজ থাকে সেগুলো সবাইকে করতে হয় তারপর রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটি। মাঝে মাঝে রাত এগারোটা বেজে যায় আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করতে করতে।একটু পরিশ্রম হয় বেশি এই আরকি।দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক আর বিকেলে চা-নাস্তা খাওয়ার ব্রেক পায়।এছাড়া সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়।কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে হয় অনবরত! বাহিরের দেশ থেকে যে প্রোডাক্ট গুলো আসে সেগুলো আলাদা করে রাখতে হয়, দেশীয় পন্যে নতুন করে প্রাইস ট্যাগ বসাতে হয়।অনেক কাজ।কিন্তু নিরলস ভাবে নীতু কাজ করে যায়।সবসময় মুখে এক চিলতে হাসি থাকে নীতুর।নীতু যতক্ষণ কাজে থাকে ততক্ষণ নীতু ভালো থাকে কিন্তু রাত গুলো নীতুর পার হতে চায় না।বড় দীর্ঘ মনে হয় প্রতিটা রাত।তবুও নীতু ভালো আছে।কারো কটু কথা শুনতে হয় না।শপিংমলের সবার সাথেই নীতুর ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।হক টাওয়ারের দায়িত্বে যে আছে শরীফুল কাকা। সেও নীতুর কাজে সন্তুষ্ট।মেয়েটা কাজে ফাঁকি দেয় না।অযথা গল্প করে না।বরং কাস্টমারের সাথে এমন ভাবে কথা বলে তারা পোশাক বা অর্নামেন্টস কিনতে বাধ্য হয়!

নীতুর যেদিন বেশি রাত হয় সেদিনই ঝামেলা বাজে।নীতুর হোস্টেলে ফিরতে যে গলিটা পড়ে সেটা বড় অন্ধকার আর নিরব!তাই রিকশাও বেশি যেতে চায় না।তবুও নীতু সাহস করে এগিয়ে যায়।কিন্তু দু’দিন ধরে কাকতালীয় ভাবে রিশার সাথে দেখা হয়ে যায় হক টাওয়ারের সামনে।রিশার একটা স্কুটি আছে! দেখা হলেই বলে,”চলো নীতু ডার্লিং। একসাথে ফেরা যাক।যেহুতো গন্তব্য একটাই!”
নীতু যখনই জিজ্ঞেস করে,”তুমি এখানে কেন?”
তখনই রিশা হেসে বলে,”একটা কাজে এসেছিলাম।” এর বাহিরে কোন কথা রিশা বলে না। আজও রিশার সাথে দেখা হয়ে গেলো।নীতুর কেন জানি মনে হলো,রিশা ইচ্ছা করেই এখানে দাঁড়িয়ে থাকে।তাকে নিয়ে ফিরবার জন্য। আজও নীতুকে দেখেই রিশা হেসে বলে,”কাম ডার্লিং।”
নীতু চোখা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আজও কি কাজ ছিল এদিকে?”
“এত প্যাচাল পারো কেন?গেলে চলো না হলে দাঁড়িয়ে থাকো।”….. বলেই রিশা জিন্সের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়।নীতুর মেজাজ খারাপ হয়।মেয়েটা এত সিগারেট কিভাবে খায়?স্কুটি চালানো অবস্থায় রিশার ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট থাকে। কিসের এত দুঃখ মেয়েটার?

নীতু রিশার ঠোঁট থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দেয়।এরপর স্কুটিতে উঠে বসে।রিশা কতক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নীতুর দিকে।তারপর স্কুটিতে স্টার্ট দেয়।রিশার ছোট ছোট চুলগুলো উড়ছে।সাথে উড়ছে নীতুর ঝুটির করা লম্বা চুলও। চারপাশ থেকে শো শো করে গাড়ি যাচ্ছে। নীতুর ভীষণ ভালো লাগছে। একসময় নীতু বলে ওঠে, ” রিশা আমাকে স্কুটি চালানো শিখাবে?”
রিশা কোন জবাব দেয় না।কিন্তু লুকিং গ্লাসে নীতুর শান্ত মুখখানা দেখে। আবার নীতু বলে ওঠে, “রিশা রোজ তুমি হক টাওয়ারের সামনে আমাকেই নিতে আসো,তাই না? এদিকে তোমার কোন কাজ থাকে না।”

রিশা শান্ত স্বরে বলে,”রাতের শহর বড় ভয়ংকর হয় ডার্লিং! কখন যে কাকে খুবলে খাবলে খাবে বুঝতেই পারবে না!”

নীতুর হুট করে মনে হলো রিশা মেয়েটা যতটা খারাপ ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে ততটা খারাপ সে নয়!

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৮

আজ সেতুর বিয়ে।বড় করে অনুষ্ঠান না হলেও পরিচিত আত্মীয় স্বজনের মেলা বসেছে বাড়িটিতে।ছাদের পাটাতনে প্যান্ডেল করা হয়েছে বরপক্ষের সবাইকে খাওয়ানোর জন্য। এক কোণায় বাবুর্চিরা রান্না করছে।মুরব্বিরা পানের থালা সাজাচ্ছে।খুলনার বিখ্যাত মিষ্টির সমাহার পুরো টেবিল জুড়ে।সকাল এগারোটা! সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত।মিলন, নিখিল পাঞ্জাবি পড়ে ব্যস্ত হাতে কাজ করছে।ঘামে ভিজে আছে পুরো শরীর! সেতু পার্লারে গেছে।সঙ্গে মামাতো চাচাতো ভাই বোন।মিতু বাড়িতে আসা মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যস্ত।সুরভি নতুন শাড়ি আর একগাদা গহনা পড়ে বরপক্ষের সাথে দেওয়ার জন্য পিঠা তৈরি করছে। শুধু অলস ভঙ্গিতে বসে আছে মহিমা বেগম। চোখে পানি টলমল করছে। চোখের এ জল মেয়ে বিদায়ের জন্য নয়, বরং কৃষ্ণ বর্ণ মেয়েটির জন্য। সবাই আছে পুরো বাড়ি জুড়ে তবুও কেমন খা খা করছে বাড়িটা!।মহিমা বেগম জানে,নীতু অভিমান করেছে মায়ের সাথে কিন্তু তিনিও বা কি করবেন?ছেলে আর ছেলে বউয়ের উপর থেকে চাপ কমাতেই তো তিনি সেতুকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। মা হয়ে এই কাজ করতে তার কি খারাপ লাগেনি?লেগেছে. রাতের অন্ধকারে মুখে আঁচল চেপে কেঁদেছেনও কিন্তু মুখ ফুটে বের হয়নি হৃদয়ের সুপ্ত আহাজারি!
নীতুর বাবাও গত দু’রাত ধরেই ছটফট করেছেন বিছানায় শুয়ে।মানুষটা নড়তে, বলতে না পারলেও অস্থিরতা দিয়ে বুঝিয়েছেন তার মনের কষ্ট!

সোনাডাঙায় থাকে যে মামি সে নীতুর চাচিদের সাথে নীতুর পোড়াকপাল বলে অহেতুক চিন্তার কথা বলে নিজেকে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আত্মীয় মহলে জাহির করছেন। মুখ দিয়ে চো চো শব্দ করে বল উঠলেন “আহা!নীতুর যে কি হবে?মেয়েটা একটুও পয়মন্ত নয়।নাহলে কালো রঙের মেয়েদের কি বিয়ে হয় না? ছোট দু বোনের বিয়ে হয়ে গেলো এরপর কে নিবে নীতুকে? কত করে বললাম আমার ভাইয়ের ছেলের জন্য নেই নীতুকে।দুই বাচ্চার বাপ তো কি হয়েছে?পুরুষের কাঁটাও কথা বলে! নীতুর মা শুনলো না!”
ইতু তখন সেখান থেকেই যাচ্ছিল।মামির কথা শুনে গা জলে উঠলো ইতুর।তাতানো স্বরে বলে উঠলো,”আপনার ভাইয়ের ছেলের আগের বউটা মরেছে কেন তা বুঝি আমরা জানি না মামি?লোকে বলে গরুর মত বউ পিটায় সে।আপনি কোন সাহসে নীতু আপার জন্য তাকে ভাবছেন?আমার বোন আইবুড়ো থাকবে তবুও ওই কুলাঙ্গারের কাছে বিয়ে দিবো না।বিয়েতে এসেছেন রোষ্ট পোলাও, পান খেয়ে বিদায় হোন।আমাদের জন্য আপনার চিন্তা করতে হবে না।আপনার ঘরের চাল আমরা খাই না।বুঝেছেন?”

জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত মামি চুপসে গেলেন।ইতু সেখান থেকে সরে যেতেই তিনি মুখ ভেঙাচালেন।দেখে নিবো ঐ কালিকে কোথায় দিস? বলে খিস্তি দিলেন। ইতু ত্রস্ত পায়ে জাহিদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো।জাহিদ মাথা ধরার অজুহাতে কোণার এক রুমে শুয়েছিলো। ইতু রুমে প্রবেশ করেই সরাসরি জাহিদকে বললো, “আপনার মনে আছে ভাইয়া? ভাইয়ার যখন বিয়ে হলো তখন আপনার খুব জ্বর তবুও আপনি বিয়ে বাড়ির সব কাজ নিজ হাতে সামলিয়েছেন।আমাদের সকল কাজে আপনি কখনো নিজেকে জামাই বলে হাত গুটিয়ে থাকেন নি।তবে আজ কেন মাথা ধরার অজুহাতে ঘরের এক কোণে বসে আছেন?আমাকে মিথ্যে বলে কাজ হবে না।কি লুকাচ্ছেন বলুন?

ইতুর অগ্নিমূর্তি দেখে জাহিদ সব বলতে বাধ্য হলো।ইতুর মনে হলো পুরো পৃথিবী তার মাথায় ভেঙে পড়েছে।তার নীতু আপার ভালোবাসার মানুষটার সাথে আজ ছোটবোনের বিয়ে হচ্ছে শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো বলে।ইতু হু হু করে কেঁদে উঠলো।এই বিয়ে সে কিছুতেই হতে দিবে না।ছুটে বেড়িয়ে যেতে নিলে জাহিদ শক্ত করে ধরে আটকালো। ধীরস্বরে বলে উঠলো,” বোন ঝামেলা করিস না।নীতু চায় এ বিয়েটা হোক!এখন ঝামেলা করলে নীতুকেই এই সমাজ খারাপ বলবে।সেতুর বিয়েটা ভেঙে গেলে যত সুন্দরই হোক অন্য কোথাও বিয়ে দিতে কষ্ট হবে।”
ইতু জাহিদের হাত ধরে আবার হু হু করে কেঁদে উঠলো। জাহিদের চোখেও জল এসে জমলো।প্রথমে মিলন পড়ে তাজ দুটো পুরুষের প্রত্যাখ্যান কি করে সইছে নীতু? মেয়েটা কি আদৌও বেঁচে আছে?নাকি না থাকার মত শরীর বয়ে যাচ্ছে এ পৃথিবীতে?

*************
আজ শুক্রবার। সেতুর বিয়ে।আপন ছোটবোনের বিয়ে অথচ নীতু সেখানে উপস্থিত থাকতে পারছে না।নীতুর কষ্ট হচ্ছে! ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! চোখ জ্বালা করছে।চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে কিন্তু নীতু ঠিক করেছে আজ সে কাঁদবে না।অন্য কারো জন্য এক ফোঁটা চোখের জল সে ফেলবে না! তাজ নিজে এসে তার দ্বারে কড়া নেড়েছিলো! শিখিয়েছিলো,সবার আগে কি করে নিজেকে ভালোবাসতে হয়?আজ সেই মানুষটাই সবথেকে নীতুকে বেশি কষ্ট দিলো! “”মানুষের মন হলো পোষা পাখির মত!কেউ একটু যত্ন করলে,ভালোবাসলে মায়া পড়ে যায়!তখন উন্মুক্ত আকাশ পেলেও বদ্ধ খাঁচা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না!”
নীতুরও মায়া পড়ে গেছে তাজ নামক মানুষটার প্রতি। কিন্তু নীতু এ মায়া কাটিয়ে উঠতে চায়।খোলা আকাশে প্রাণ খুলে উড়তে চায়!
আজ শুক্রবার বলেই মেসে সব মেয়েরা আছে।সবাই যার যার মত পুরো সপ্তাহের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে! রিশা নিজের সবকটা জিন্স ফতুয়ায় গোটা একটা পারফিউম স্প্রে করতাছে।নীতু সেদিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,”এসব কি করছো রিশা?”

রিশা নিজের ববকাট চুলগুলো দুহাতে পিছনে ঠেলে বিরক্তির সাথে বলে উঠলো,”কাপড় চোপড় ধোয়াও একটা প্যারা ডার্লিং।তাই এই শর্টকার্ট ব্যবস্থা।পারফিউমের ঘ্রাণে ঘামের গন্ধ দূর হয় যাবে!আর কোন প্যারা রইলো না।”
পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো,”ছিঃ!”

রিশা ঝামটা মেরে বলে ওঠে, “ছিঃ কস কেন?তোর সমস্যা হইলে ধুইয়া দে, না হলে তোর বালের ছিঃ ছিঃ গিয়া তোর প্রেমিক রে শুনা!”
মেয়েটা রিশার এমন কথায় মুখ গোমড়া করে ফেললো। রিশার ব্যবহার এমনই।তাই হোস্টেলের মেয়েরা রিশার সাথে কম কথা বলে!নীতু হালকা হেসে গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে হোস্টেল থেকে বেড়িয়ে আসে। সামনের মোড়ের ঔষধের ফার্মেসি থেকে ঘুমের ঔষধ কেনে এক পাতা। রুমে ফিরে গোটা দুটো ঔষধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।নীতু ঠিক করেছে আজ সারা দিন ঘুমিয়েই কাটাবে।একদম মড়ার মত ঘুম যাকে বলে! সাথে সকল মন খারাপও ঘুমাবে!
একটা সময় নীতুর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে যায়।যেন কোন নেশা করেছ নীতু! ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগে নীতুর মোবাইলে বিপ বিপ শব্দ করে ওঠে।নীতু চোখ বুজেই কল রিসিভ করে।ওপাশ থেকে তাজ ভাঙা স্বরে বলে ওঠে,”আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি নীতু।আমিই তোমাকে একদিন বলেছিলাম, আমার সকল সাফল্যে তুমি দোয়া করবে।আজ বরং তুমি একটু বদদোয়া করে দাও!তুমিহীন সকল সুখ আমার হারাম হয়ে যাক!আমার শহরের অলিগলিতে দুঃখের বৃষ্টি নামুক!”
নীতু ঘুমঘোরেই খিল খিল করে হেসে ওঠে।পরক্ষণেই বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”আপনি সুখী হোন তাজ বাবু!ভীষণ সুখী!যতটুকু সুখ পেলে এই কৃষ্ণ তনয়াকে ভুলে থাকা যায় ততটুকু সুখী হোন!”
এরপরই নীতু কলটা কেঁটে দিয়ে নম্বরটা ব্লক লিষ্টে ফেলে রাখে।যতটা সহজে নম্বরটা ব্লক লিষ্টে ফেলানো যায় ততটা সহজে কি আস্ত একটা মানুষকে ব্লক করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর নীতুর জানা হলো না।তার আগেই নীতু ঘুমিয়ে পরলো।
রিশা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো নীতু এই দিনের বেলা এত কোলাহলের মাঝেও উদ্ভ্রান্তের মত ঘুমাচ্ছে। নীতুর বেডের পাশে গিয়ে ক’বার নীতুকে ডাকলো। রিশা কোন সাড়া না পেয়ে চলে আসার সময় একটা কাথা দিয়ে নীতুর শরীর ঢেকে দিলো! নীতু ঘুমের ঘোরেই কাথাটা পরম আবেশে আঁকড়ে ধরলো!

ঝামেলাহীন ভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো তাজ আর সেতুর।বিয়ের পুরোটা সময়ে তাজ গম্ভীর মুখে বসেছিল।কবুল বলার সময় তাজ বিভ্রান্তের মত এদিক ওদিক চোখ বুলালো।বিশেষ কিছু খোঁজার বৃথা চেষ্টা!একটা সময় রোবটের মত কবুল বলে দিলো।কেউ লক্ষ্য করলো না তাজের অস্থিরতা। বিয়েটা হয়ে যেতেই রাবেয়া বেগম মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন।ছেলেকে ফেরাতে পেরেছেন এই খুশিতে চোখে পানি এসে গেলো তার! কিছু নিকট আত্মীয় নিয়ে রাবেয়া বেগম একটা হোটেলে রুম বুকিং করে থেকেছিল গতদিন।আজ একেবারে বউ নিয়ে ঢাকা যাবেন।তাই সবাইকে তাড়া দিতে লাগলেন।
সেতু আঁড়চোখে বারবার তাজের দিকে তাকাচ্ছে।তাজ মুখ পাথরের মত শক্ত করে বসে আছে।মুখে নেই কোন হাসি!নেই কোন কৌতুহল।ছেলের এমন অবস্থা দেখে রাবেয়া বেগম আরো দ্রুত এখান থেকে প্রস্থান করতে চাইলেন।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো কতক্ষণ পরেই।আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো।সাথে বৈশাখী ঝড়ের মত দমকা হাওয়া আর বজ্রপাত। বউ নিয়ে ফেরা হলো না। ঠিক হলো রাতের খাবারের পর আবার সবাই হোটেলেই ফিরে যাবেন।
মহিমা বেগম নতুন জামাইকে আর বেয়ানকে যেতে দিলেন না।নীতুর ঘরে বাসর সাজানো হলো। তাজ কলের পুতুলের মত যে যা বলছে তাই করছে।নতুন জামাইকে গম্ভীর ভাবে থাকতে দেখে মহিমা বেগমের বুকের ভিতর কু ডাকতে শুরু করলো।তিনি মিতুকে বললেন সব দিকে খেয়াল রাখতে।

********
জার্মানির অফিস রুমে যখন অভীক ভীষণ ব্যস্ত হাতে কী বোর্ডে হাত চালাচ্ছে তখন অভীকের মা ফোন করলেন।আদুরে স্বরে ছেলের সাস্থ্য কেমন আছে জানতে চাইলেন। পরক্ষণেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,বিদেশে কোন মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা? অভীক মায়ের কথা শুনে হাসলো। অভীকের কোন ব্যক্তিগত পছন্দ নেই কিন্তু মনের কোণে জীবনসঙ্গিনীর একটা ছবি আঁকা আছে!অনিক কে দেখে বুঝেছে লাইফ পার্টনার যথাযথ না হলে জীবনে শান্তি নেই! মায়ের সাথে কথা বলে অভীক এক মগ কফি নিয়ে অফিস রুম সংলগ্ন কাঁচের দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়! এ জীবনটা খুবই ছোট!মৃত্যুর মত একটা স্নিগ্ধ অধ্যায় প্রতি নিঃশ্বাসে জানান দেয়,আমি তোমার সাথেই অবস্থান করি! একটা সময় হৈ হুল্লোড় অভীকও করেছে!ভার্সিটিতে অভীক ছিল প্রাণবন্ত এক যুবক।ছোট খাটো দু একটা প্রেমও করেছে কিন্তু কোথাও গিয়ে সম্পর্কের সুতো কেটে যেতো তবুও অভীক ছিল সদা নবীন! কিন্তু যেদিন বাবার লাশ নিজ হাতে দাফন করলো সেদিন থেকে অভীক বদলে গেলো!নিজেকে নিজের মাঝেই যেন দাফন করেছে অভীক।মা আর ভাইয়ের মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে!নিজের স্বত্বাকে হারিয়ে ফেলেছে।অভীকের নিজস্ব একজন মানুষ চাই!পুরোপুরি নিজস্ব!যে বউ রুপে না সোলমেট রুপে এসে হাজির হবে তার সামনে!আদৌ কি পাবে তাকে?

*************
তাজ যখন বাসর ঘরে ঢুকলো তখন এগারোটা বাজে ঘড়িতে।সেতু দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলো।বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো তাজের দিকে।এরকম রাজপুত্রের মত বর!ভাবতেই সেতু শিহরিত হলো।সেতুর শরীরে টকটকে লাল শাড়ি।হাতে কানে গলায় ভারি গহনা!তাজ সেদিকে একবার তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে ফেললো।নিজেকে কেমন কাপুরষ লাগছে তাজের!সেতু ভারি বেনারসি সামলে খাট থেকে নেমে ফট করে তাজকে সালাম করতে নিলো।তাজ দু’পা পিছিয়ে গেলো।বিরক্তি নিয়ে বললো,” সালাম করতে হবে না।প্লিজ তুমি এসব ঝকমকি পোশাক চেঞ্জ করে এসো!”

সেতু চরম আশ্চর্য নিয়ে বললো,”কেন আমাকে ভালো লাগছে না?”
তাজ সে কথার কোন উত্তর দিল না।সেতু চুপচাপ ওয়াশ রুমে চলে গেলো।পুরো একঘন্টা লাগলো ভারি সাজ ওঠাতে।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো তাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।সেতু আস্তে ধীরে বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,” সেতু এঘরটা কি তোমার?”

সেতু এবারো অবাক হলো।এ কেমন বর?না তার দিকে তাকাচ্ছে না কোন রোমান্টিক কথা বলছে!আজব! প্রশ্ন গুলো মনেই কবর দিয়ে বললো,
“এটা নীতু আপির ঘর!”

“অন্যের ঘরের অধিকারী তুমি!”

সেতু এবার পাশে এসে দাঁড়ালো তাজের।তাজের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “মানে?”

“কিছুনা। এ ঘরে দুটো পেইন্টিং দেখলাম।এ গুলো কে একেঁছে?”

“নীতু আপি!”

“তোমার নীতু আপি দারুণ ছবি আঁকে।তাকে বলো আমাকে একটা ছবি একেঁ দিতে।”

“বলবো। আপনি ঘুমাবেন না?”….. সেতুর কন্ঠে হতাশা।বাসর রাতের রোমাঞ্চকর অনুভূতির করুণ দশায় সে হতাশ।

” ঘুম আসছেনা।তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

সেতু রুমের দিকে চলে যেতে নিলেই তাজ আবার প্রশ্ন করে,”তোমার নীতু আপি এ বিয়েতে ছিল না।তাই না?”

“হুম।আপনি এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকবেন আমিও থাকি?”…. সেতু অবুঝ কন্ঠে বলে ওঠে।

তাজ শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে, ” অহেতুক কথা বলবে না সেতু।আজ বলে দিচ্ছি, আমি এসব পছন্দ করি না।যাও এখন গিয়ে ঘুমাও!”
শেষের কথাটা ধমকের মত শুনায়।সেতু কেঁপে ওঠে।দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে সেতু।বিছানায় মাথা রাখতেই চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে! তাজ বারান্দায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার বুকের ভিতর শূন্যতা!চোখ দুটো জ্বলে ওঠে।এই ঘরটা নীতুর।এই ঘরে প্রতিটা বস্তুতে নীতুর স্পর্শ! শুধু তাজই অন্য কারোর!তাজ অনুভব করে এই ঘরে তার দমবন্ধ লাগছে!বাতাসে নীতুর হাহাকার!

************
রাত দশটায় নীতুর ঘুম ভাঙলো।ঘুম ভাঙতেই মনে হলো সাড়া শরীর ঝিমঝিম করছে।নিজেকে ধাতস্থ করে নীতু হাত মুখে পানি দিলো।সবাই যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন নীতুর ঘুম ভাঙলো।নীতুকে জাগ্রত দেখেই রিশা বলে উঠলো,”কোন হাইডোজের নেশা করেছিলে নাকি ডার্লি? বাপরে কি ঘুম!খেতে হবে নাকি ঘুমিয়েই পেট ভরেছে?”
নীতু মৃদু হাসলো।নীচে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো।ভাত সাথে বয়লার মুরগীর ঝোল তরকারি।গোছের থেকে ঝোলের পরিমাণ বেশি।তারউপরে গোছের চেহারা মুরগীর মত সাদা দেখাচ্ছে। হলুদ মরিচ সবই কম হয়েছে।নীতুর বমি আসলো! কোন রকমে খাবার খেলো নীতু।নীতুর মনে হলো তার জীবনের সব থেকে জঘন্যতম খাবার হলো এটা!
বাহিরে ঠান্ডা বাতাস।খুব বৃষ্টি হয়েছে নাকি বিকেল থেকে নীতু কিছুই টের পায়নি।ঠান্ডা আবহাওয়া পেয়ে সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নীতু এলোমেলো বেশে হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখ মুখ ফুলে গেছে অধিক ঘুমানোর ফলে।বাতাসে লম্বা চুলগুলো উড়ছে।কেমন ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে নীতুর!সাড়া শরীরে অসাড়তা! বাতাসে অক্সিজেনের অভাব। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে! এই দীর্ঘ রাত কি করে পার করবে ভেবে পায় না নীতু? পরক্ষণেই আবার ঘুমের ঔষধ খাওয়ার চিন্তা আসে মাথায়!তখনই রিশা এসে পাশে দাঁড়ায়।হাতে জ্বলন্ত সিগারেট! বিড়বিড় করে বলে,”চলো নীতু ডার্লিং একটা লং ড্রাইভ দিয়ে আসি।”
নীতু হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে।রিশা হাতে স্কুটির চাবি নিয়ে দুলতে দুলতে বের হয়।নীতু তখনও দাঁড়িয়ে থাকে।সেখান থেকেই দেখতে পায় রিশা বাড়িওয়ালা মহিলার সাথে ঝগড়া করছে। দশমিনিট পর রিশাকে স্কুটির উপর বসতে দেখে বুঝে যায় ঝগড়ায় রিশার জয় হয়েছে।নীতু চঞ্চল পায়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচে নেমে আসে চুলে হাত খোপা করতে করতে। দৌড়ে গেট পার হয়!দৌড়ানোর সময় নীতুর ওড়না বাতাসে ওড়ে!রিশা হাসে।নীতু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তো। এ অবস্থায় আমরা কোথায় যাবো?”

“দু চোখ যেখানে যায়।উফ!নীতু ডার্লিং আজ বড় আফসোস হচ্ছে কেন ছেলে হলাম না?তোমার এই বৈরাগী রুপ আমায় পাগল করেছে!”…..বলে রিশা চোখ মেরে বসে।

নীতু স্কুটিতে উঠতেই রিশা স্কুটিতে দ্রুত টান দেয়।রাতের অন্ধকার, সোডিয়ামের নিয়ন আলো, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর ভেজা বাতাস মুহুর্তেই নীতুর মন ভালো করে দেয়।নীতু মনে মনে রিশাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়।নীতুর মনে হলো রাতটা আরো দীর্ঘ হোক।আর এভাবেই নীতু ভেসে বেড়াক!নীতুর উচ্ছাসিত রুপ দেখে রিশা হাসে। স্কুটিটা এসে থামে রুপসা ব্রিজের কাছে।চারপাশে শুনশান নিরবতা।পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে। ঠিক সেই সময় দুটো মেয়ে রুপসা ব্রিজের উপর হেঁটে বেড়াচ্ছে আলতো পায়ে।রিশা সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বলে,” নীতু ডার্লিং, তোমার সকল মন খারাপের গল্প আজ এই নদীর জলে ভাসিয়ে দাও!নদীর বুকে তোমার দুঃখের গল্প জমে জল হয়ে যাক!”

রাতের নিস্তব্ধতায় নীতু চিৎকার করে বলে ওঠে, “শুনছো নদী?আমি কৃষ্ণবতী বলছি!আমার সকল দুঃখ আজ তোমার বুকে ভাসিয়ে দিয়ে গেলাম আর তোমার ভাগের সুখটুকু আমি ধার নিলাম।যদি কখনো প্রাপ্ত সুখ মেলে তবে তোমার ধার আমি শোধ করে দিবো!এটা এই কৃষ্ণবতীর ওয়াদা!”
নীতু চোখে টলমল জল আর মুখে হাসি নিয়ে রিশার দিকে ফিরে তাকালো।রিশার ঠোঁটে তখনও জ্বলন্ত সিগারেট।নীতু একটান মেরে সিগারেট পানিতে ফেলে দিলো।রিশা কটমট করে তাকালো।রিশার তাকানো দেখে নীতু অশ্রুসিক্ত চোখেই খিলখিল করে হেসে উঠলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here