দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-চার

0
269

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-চার
মাহাবুবা বিথী

পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে নানা জনের সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয়।আর এই গড়ে উঠা সম্পর্ক ভালবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

অবশেষে সম্পার কেমো দেওয়া শুরু হলো।জাহিদ সর্বক্ষণ সম্পার পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ছিলো।আসলে কেমোথেরাপীর পর রোগী কিছুদিন বেশ কষ্ট পায়।রক্তের মধ্যে বিস্তর গোলযোগ দেখা যায়।মাথা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত মারাত্মক যন্ত্রণা শুরু হয়।অনেক ব্যথার ওষুধেও এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলে না।সেই সময় হাতে পায়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিলে রুগী আরাম পায়।আমি মাঝে মাঝে হাসপাতালে সম্পাকে দেখতে যেতাম। তখন অবাক হয়ে দেখতাম,জাহিদ সম্পার হাতে ও পায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সম্পা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে।আমার ডাক্তারী জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি,অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে ফেলে রেখে স্বামী পালিয়ে যায়।

জীবনে পরিপূর্ণ সুখী হতে গেলে পারফেক্ট জীবন সঙ্গীর বড় প্রয়োজন।পারফেক্ট স্বামী স্ত্রী বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো।স্বামীর কাছে স্ত্রী আর স্ত্রীর কাছে স্বামীর মতো ভালো বন্ধু আর কেউ নয়।স্ত্রী যখন অসুস্থ হয় তাকে সুস্থ করার দায়িত্ব স্বামীর।কারণ স্বামীর কাছে স্ত্রী আল্লাহ পাকের দেওয়া আমানত।

একদিন কেমো দেওয়ার পর সম্পার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়।কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সম্পা বমি করে।জাহিদ আমাকে ফোন দেয়।
—-হ্যালো সারাহ্, তুমি কি একটু বাসায় আসতে পারবে।সম্পার শরীরটা বেশ খারাপ করেছে।
সারাহ্ বলে
—-আচ্ছা, আমি আসছি।
আধাঘন্টার মধ্যে আমি জাহিদের বাসায় চলে যাই।আমি বাসায় এসে দেখি জাহিদ বমি পরিস্কার করলো।তারপর ভেজা টাওয়েল দিয়ে সম্পার পুরো শরীর মুছে দিলো।সে সময় বাড়িতে ওদের ছেলে মেয়ে কাজের খালা কেউ বাসায় ছিলো না।সেদিন আমার কাছে সম্পাকে অনেক ভাগ্যবতী নারী মনে হয়।আমি জাহিদকে সম্পার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলি। আর প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে বাসায় চলে যাই।

পলাশের কারনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন পুরোপুরি হারিয়ে যায়। আজ জাহিদের সংস্পর্শে এসে আমার সে ধারণা পাল্টে যায়।আসলে জগতে সব মানুষ এক নয়।শয়তানরুপী কিছু মানুষ যেমন বসবাস করে তেমনি ফেরেস্তারুপী মানুষ ও এই পৃথিবীতে বাস করে।তাই তো পৃথিবী এতো সুন্দর।হাজার দুঃখ কষ্ট বেদনা অভিযোগ অবহেলার পরেও পৃথিবীলে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।

বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে সম্পা মারণ রোগের সাথে লড়াই করে যায়।ছেলে মেয়েরাও সর্বক্ষণ মায়ের পাশে থাকে।সম্পার বিত্তবৈভব ছিলো না তবে সংসারে অনেক সুখ ছিলো।মাঝে মাঝে আমার সম্পার সুখের ভাগ নিতে ইচ্ছে হতো।আবার আমি নিজেকেই সান্তনা দেই,
“যা পাইনি জীবনে তা আমার ছিল না কখনও
যে টুকু পেয়েছি তাতেই এ জীবন ধন্য”
আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত পরিবারের প্রিয়জনের
ভালবাসা মানসিক ও আর্থিক সাপোর্টে সম্পা সুস্থ জীবন ফিরে পায়।এই ছ,মাসে জাহিদের চোখের নীচে কালি পড়ে যায়। তারপরও সম্পা সুস্থ হওয়াতে ওকে অনেক ভারমুক্ত মনে হয়।

তবে সম্পার দিকে জাহিদ অনেক কেয়ারিং থাকে। অনেক সময় ভাগ্য খারাপ হলে ক্যান্সার পুনরায় ফিরে আসে।

সম্পা সুস্থ হওয়ার ছ,মাস পার হয়ে যায়।মাঝে মাঝে সম্পার সাথে আমার ফোনে কথা হয়।
সেদিন ছিল শুক্রবার।ছুটির দিন বিধায় চারিদিক নিরব নিস্তদ্ধ হয়ে আছে।ভোরের আলো আকাশের সীমানা পেরিয়ে মাটির পৃথিবীতে নেমে এসেছে।অন্ধকারের আঁচলটা এখনও সরে যায়নি।পুর্বদিগন্তের আলোয় চারিদিক আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে উঠে।ভোরের রক্তিম আলোর সবটুকু লালরঙ নিজের গায়ে মেখে মাঝে মাঝে জীবনটাকে রঙ্গিন করতে ইচ্ছে হয়।এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে।ফোনের স্ক্রীনে সম্পার নাম ভেসে উঠে।
—-হ্যালো সারাহ্, তুমি কি আজ বাসায় আছো?
সারাহ্ বলে,
—-হ্যা, বাসায় আছি।তোমার শরীর ভালো।
সম্পা বলে,
—–আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।আজ দুপুরে তোমার বাসায় লাঞ্চ করবো।
সারাহ্ বলে,
—ঠিক আছে।চলে আসো।আমার সময়টা অনেক ভালো কাটবে।
সারাহ্ আজ খুশীতে অনেক আইটেম নিজ হাতে রান্না করেছে।প্রতিদিন ও একাই লাঞ্চ করে।আজ সম্পার আগমনে সারাহ্ খুব আনন্দিত।

আজ সারাহ্ ভাত, ডাল, সবজি, শুটকি ভর্তা, মুরগির ঝাল মাংস, ইলিশ মাছ ভাজি,সামুদ্রিক মলা মাছের চচ্চড়ি রান্না করেছে।কাজের খালাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছে। দই বড়া আর ফিরনি ও রান্না করেছে।
রান্না শেষ করে সারাহ্ নামাজ পড়ে সম্পার জন্য অপেক্ষা করে।এমম সময় ডোর বেলটা বেজে উঠে।সারাহ্ দরজা খুলে দেয়।সম্পাকে দেখে বলে,
—-তুমি একা এসেছো, জাহিদ আসেনি?
সম্পা বলে,
—না,রে আজ তোমার ঘরে সম্পর্কের দাবি নিয়ে আমি একাই এসেছি। তোমার এখানে আসবো জাহিদকেও বলিনি।
সারাহ্ বলে,
—–ভালোই হয়েছে,দুই বান্ধবী নিজেদের মতো সময় কাটাবো।
দু,জনে লাঞ্চ শেষ করে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলো।
একটু রেস্ট নিয়ে সম্পা সারাহ্কে বলে,
—-তোমার মনে আছে,আমাকে তুমি কথা দিয়েছিলে যদি কোনদিন সম্পর্কের দাবি নিয়ে তোমার কাছে আসি তাহলে তুমি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবে না।
সারাহ্ বলে,
—-আমার স্মরণ শক্তি বেশ প্রবল।মনে আছে বন্ধু।
সম্পা কোন ভনিতা ছাড়াই সারাহ্কে বলে,
—-তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমি তোমাকে আমার পরিবারের সদস্য হিসেবে পেতে চাই।
সারাহ্ বলে
—-সম্পা আমি তো অনেক আগেই তোমার পরিবারের অংশ হয়ে আছি।
সম্পা বলে,
–সারাহ্ কৌশলে আমার কথাটা এড়িয়ে যেও না।আমি আসলেই এই ব্যাপারে অনেক সিরিয়াস।তোমার যদি অমত না থাকে তাহলে আমাদের ভালবাসার নীড়ে তোমাকে জাহিদের স্ত্রী হিসাবে পেতে চাই।তোমাকে এখনি মত দিতে হবে না।তুমি নিজের মতো করে ভাবো।তারপর সিদ্ধান্ত নাও।
সারাহ্ সম্পাকে বলে,
‌—-তুমি বুঝতে পারছো, তুমি কি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে?জীবন তো আবেগ দিয়ে চলে না।বাস্তবতা অনেক কঠিন।নারী সব দিতে পারে, কিন্তু স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না।
সম্পা বলে,
—-আমি তোমার সাথে সম্পূর্ন একমত।কিন্তু আমার যে রোগ হয়েছে বেঁচে থাকার কথা না।আল্লাহপাকের উপহার হিসাবে জীবনটা ফিরে পেয়েছি।
আর তুমি আমার আর জাহিদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু।বন্ধুত্বের বন্ধন মজবুত করতেই আমার এই উদ্যোগ।আর আমাকে তুমি স্বার্থপরও বলতে পারো।আমি এবং জাহিদ দুজনই অসুস্থ।আমাদের বিয়েটা নিজেদের পছন্দে ছিলো।এই বিয়েটা উভয় পরিবার ভালোভাবে মেনে নেয়নি।কিন্তু আমরা অনেক সুখী দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন পার করেছি।তুমি যদি আমাদের সংসারটাকে সাদরে গ্রহন করো আমার মনে হয় আমরা তিনটা মানুষ অনেক সুখী হবো।আর আমাদের ছেলেমেয়েরাও তোমাকে অনেক ভালবাসে।তুমি কবে থেকে কিভাবে আমার সংসারের একজন হয়েছো আমি বুঝতেই পারিনি।মাহিন আই ইউ টি থেকে ইন্জিনিয়ার হয়ে বের হয়েছে।জাইমাও বছরখানিকের মধ্যে ডাক্তারী পাশ করবে।দিহানও বুয়েট থেকে সামনে বের হয়ে যাবে।আমি জাহিদের সাথে এখনও এই বিষয়টা শেয়ার করিনি, তবে আমার ছেলে মেয়েরা তোমাকে সাদরে বরণ করে নিবে।বরং ওরা আমাকে বলেছে আন্টি রাজী হবে কিনা।
সবটা শুনে সারাহ্ মৃদু হেসে বলে,
—-কবির ভাষায় বলি,অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো বিড়ম্বনা আর নাই।
সম্পাও হেসে সারাহ্কে বলে,
—যাহা দিলাম তাহা উজার করিয়া দিলাম।(কবির ভাষায়)

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here