দ্বিতীয় বিয়ে পর্ব-তিন

0
264

#ধারাবাহিকগল্প
#দ্বিতীয় বিয়ে
পর্ব-তিন
মাহাবুবা বিথী

আমার আত্মসম্মানবোধ একটু বেশী।তাই যখনই
আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে আমি সেই স্থান
থেকে নিজেকে সরিয়ে নেই।নিজের সম্মান আমি নিজেই রক্ষা করে চলি।
আমি বরাবরই একটু স্বাধীনচেতা মেয়ে।বাবা বলতেন,
—সারাহ্ তুমি স্রোতের বিপরীতে চলতে কি আনন্দ পাও?
বাবা আরও বলতেন,
“তুমি নির্বোধের মতো আচরণ কর। অযতা জেদ করে কষ্ট পাও,লড়াইও করে যাও, তাও কারোকাছে পরামর্শ নাও না। আমার আপনজনেরা বলে, জীবনে
এতটা struggle কি আমার প্রাপ্য ছিলো?আমি ছোটো বেলা থেকে ছাত্রী ভালো লেখাপড়া খুব মনোযোগ দিয়ে করি, রেজাল্ট ও ভালো হয়।ওদের মতে,হয়তো নিজের মতো চলেছি বিধায় এতটা লড়াই জীবনে করতে হয়েছে।তারপর আমার কোন আক্ষেপ নেই।মাঝে মাঝে আমি আমার লড়াইটাকে এনজয় করি।বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে,অন্যের বুদ্ধিতে আমীর হওয়ার চেয়ে নিজের বুদ্ধিতে ফকির হওয়া ভালো। আমি দ্বিতীয় অপশন টা গ্রহন করি।
এটা আমার একান্তই ব্যাক্তিগত নিজস্ব ধারনা।
আমার বাবা আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন।কারন আমি তো ওনার রক্তের।আমাকে চিনতে ওনার একটুও ভুল হয়নি।
বাবা কথাটা বলছিলেন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে,
আমি তখন কলেজে পড়ি।একদিন বাসে করে কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।এমন সময় ভিড়ের মধ্যে একটা শয়তান আমার স্পর্শ কাতর জায়গায় হাত দেয়।অপমানে ক্ষোভে আমার মেজাজটা চড়ে গেলো।আমি আমার পায়ের জুতো খুলে ওকে মারলাম।তখন বাসের অপদার্থ লোকগুলো বলছে,
“ওতো ইচ্ছে করে হাত দেয়নি, ভিড়ের মধ্যে ওরকম একটু হতেই পারে।তাই বলে তুমি মেয়ে মানুষ হয়ে বেটা ছেলেকে এভাবে পেটাবে।যাওনা তোমার বাপকে বলো একটা ট্যাক্সি কিনে দিতে।ট্যাক্সিতে চড়ে কলেজে আসা যাওয়া করবে।তখন কারো হাত তোমার শরীরে লাগবে না।
কোথায় ওরা প্রতিবাদ করবে তা,না করে আমি মেয়ে বলে আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে।সেদিন অপমানিত হয়েছি তবে মুখ লুকিয়ে কাঁদিনি।আমি আমার অপমানের জবাব দিয়ে দিয়েছি।সেদিন বাড়ি এসে আমি আমার স্কলাশিপের টাকা দিয়ে একটা সাইকেল কিনে নিয়েছি।
এখনকার সময়ে মেয়েরা হরহামেশাই সাইকেল চড়ে।তবে আমাদের ঐ সময়ে এই ধরনের কার্যকলাপে অনেক সমালোচনার শিকার হতে হয়।
আমরা যে পাড়ায় থাকতাম আন্টিরা মাকে কথায় শুনিয়ে বলতো আপনার মেয়েটার চলাফেরা ঠিক করেন।কেমন বেটা ছেলের মতো সাইকেলে চড়ে বেড়ায়।পরে পস্তাতে হবে।

মা বাড়ি এসে বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করতো। বাবা জানতেন আমাকে রাগ করে কোনো কথা বললে আমি সেটা নিতে চাই না।তাই বাবা আমাকে বুঝিয়ে বললেন,
—-সারাহ্ বাসে তুমি একটু সাবধানে থাকলে তো এই ঘটনা আর ঘটতো না।অথচ তুমি জিদ করে সাইকেল চালিয়ে রোদের মধ্যে কলেজে যাও তোমার তো কষ্ট হয় লোকেও নিন্দে করে।
আমি বাবাকে মুখে কিছু বললাম না।আসলে এটা তো জিদের বিষয় নয়।এটা আমার সম্মানের বিষয়।

আমার পরিচিতজনের পরিধি খুব কম।কিছুটা নিজেকে ভালো রাখার জন্য আমি আমার পৃথিবীটাকে ছোটো করে ফেলেছি।
তবে ডিভোর্সের পর থেকেই জাহিদ আর ওর বউ সম্পার সাথে আমার ঘনিষ্টতা হয়।ওরা আমার বিষয়টা জানে বিধায় ঢাকায় আসলে আমার খোঁজ খবর করে যেতো।আমিও ওদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলি।

জাহেদ আর সম্পার তিন ছেলেমেয়ে।করোনার আগেই ওরা ঢাকায় থিতু হয়।ওদের বড় ছেলে গাজিপুরে আই ইউ টিতে ভর্তি হয়।মেয়েটা একটা প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হয়।আর ছোটো ছেলেটা তখন সেন্টজোসেফ কলেজে ভর্তি হয়।

জাহিদ মিরপুরে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নেয়।বিশেষ করে আমার করোনার সময়ে ওদের অবদানের কথা ভুলবো না।ওরা দুজনেই খুব পরোপকারী।পরপকারী হতে হলে খুব ধন সম্পদের মালিক হতে হবে এমন নয়।প্রত্যেক মানুষকেই তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরপকারী হতে পারে।পরপকারী মানুষ আল্লাহপাকের সন্তষ্টুির জন্য আল্লাহর বান্দাদের উপকার করে।

আমি করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পর সম্পার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়।ওর পিরিয়ডের সময় প্রচুর বিল্ডিং হতে থাকে।জাহিদ সম্পাকে নিয়ে
আমার চেম্বারে আসে।আমি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝলাম ওর জরায়ুতে টিউমার হয়েছে।তবে সেটা খুব বাজে অবস্থায় আছে।

আমার খুব ভালো লাগলো সম্পার প্রতি জাহিদের কেয়ারিং দেখে।জাহিদের নিজের শরীর খারাপ হলে হয়ত এতটা টেনশন করতো না যতটা টেনশন ও সম্পাকে নিয়ে করছে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি পলাশের মতো পুরুষ মানুষের কাছে নারী মানেই যেন শুধুমাত্র জরায়ু।আমার তখন আত্মসম্মানে খুব লেগেছিলো।আমি নিজের অস্তিত্বকে অপমান করতে পারিনি।পলাশকে মুক্তি দিয়ে নিজের পথ আলাদা করে নিয়েছিলাম।মানুষের ভবিতব্য আগে থেকেই লেখা থাকে তা,না হলে এত অল্প বয়সে আমার জরায়ু ফেলে দিতে হবে কেন?

এখন থাক ওসব কথা।আমি অপারেশন করে সম্পার জরায়ুটা ফেলে দিলাম।তারপর টিউমার বায়োপসি করে জানা গেল ওর ক্যান্সার হয়েছে। ওকে খুব তাড়াতাড়ি কেমো দিতে হবে।ঐ সময়টা করোনাকালীন সময়।জাহিদের বিল সব মন্ত্রনালয়ে আটকে আছে।তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ বাসা ভাড়া দিয়ে এমনিতেই ওদের অবস্থা সঙ্গীন। করোনা আর শারীরিক অসুস্থতার কারনে ওর ঠিকাদারী কাজ বন্ধ রয়েছে।তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ বাড়িভাড়া সংসারের আনুষঙ্গিক খরচে জাহিদের বেশামাল অবস্থা। জাহিদ টাকার জন্য এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বন্ধুত্বের দাবিতে আমি সম্পার চিকিৎসার পুরোটা খরচ বহন করতে চেয়েছি।আমরাতো মানুষ।আমরা নেগেটিভ কথা বলতে পছন্দ করি।ঐ সময় আমার পরিচিত মহলের অনেকেই আমাকে বলেছে আমার টাকার উপর জাহিদ আর সম্পার লোভ আছে।

আমি জানি এই পৃথিবীতে নিন্দুকেরা নিন্দা করতে ভালবাসে।সেটা যদি ভালো কাজ হয় তাও নিন্দা করে।আসল ঘটনাটা তো আমি জানি।
আমি যখন সম্পাকে বলেছিলাম
—-আমি তোমার চিকিৎসার খরচটা বহন করতে চাই।
সম্পা বলেছিলো,
—-এক শর্তে নিতে পারি যদি তুমি টাকাটা ফেরত নাও।জাহিদের টাকাগুলো মন্ত্রনালয়ে আটকে আছে।টাকাগুলো পেলেই আমি তোমাকে দিয়ে দিবো।
আমি বললাম,
—-আমি যদি আমার বোনের জন্য খরচ করতাম তাহলে কি টাকাটা ফেরত নিতাম?আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। আমি যেমন আমার বাবা মা ভাইবোনের পিছনে খরচ করি তেমনি আমার প্রতি আমার বন্ধু বান্ধবদের হক আছে।হক আদায় করলে আল্লাহপাক খুশী হন।সেই দৃষ্টিকোন থেকে আমি এই কাজটা করতে চাই।সম্পা আমাকে বলে,
—-তবে তোমাকে কথা দিতে হবে সম্পর্কের দাবি নিয়ে যেদিন তোমার কাছে আসবো আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবে না।যদি আমার এই শর্ত গ্রহন কর তাহলে আমি তোমার এই উপকার গ্রহন করবো।
আমিও সম্পা তোমাকে কথা দিলাম,
— যদি কোনদিন সম্পর্কের দাবি করে আমার কাছে আসো তাহলে আমিও তোমার প্রস্তাব মেনে নিবো।

আসলে এই পৃথিবীতে কারো কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here