এল_এ_ডেইস পর্ব ৩৯

0
220

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৯
লেখনী মাহীরা ফারহীন

একের পর এক দিন গড়ালো। ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টালো। গরমটাও আরো বাড়ল। ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিগুলো আরোও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। টানা দুই সপ্তাহ ছেলে মেয়েরা ধুমসে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। কারোও আর স্কুলের আগে পরে ঘুরে বেরিয়ে, আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় থাকল না। পরীক্ষার ফারা কাটতেই এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সকলে। এখন জুলাই চলছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় জুলাই হলো বছরের সবচাইতে উষ্ণতম মাস। এই সময় পর্যটনদের আনাগোনা হ্রাস পায়। সাধারণ মানুষও কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হয় না। ছাত্র ছাত্রীরা স্কুল শেষেই ছুটতে ছুটতে সেই যে বাসায় যায় অনেকে একেবারে পরেরদিন স্কুলের জন্য বাড়ি ছাড়ে। সন্ধ্যার গরমের রেশ কমে যায়। তখন শহরতলী হয়ে ওঠে জমজমাট। যতক্ষণ অব্দি আকাশে অন্ধকার ততক্ষণ নিচের জমিনে আলোর বন্যা বয়। চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে সকলে সেপ্টেম্বরের। সেই সময়ের দিকেই প্রকৃতি ঠান্ডা হতে শুরু করে। সূর্যের উত্তাপ কমে যায়। প্রকৃতি নানান সাজে সাজতে শুরু করে। পর্যটকদের আনাগোনা আবারও বেরে যায় এই সবুজ পাহাড় ও নীল সমুদ্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়।

মাহীন রান্নাঘরের কাউন্টারের ওপর বসে আছে পা ঝুলিয়ে। বাইরের গোধূলির আলোর ছটা জানালা দিয়ে ভেতরে এসে পরছে। মাহীনের হাতে গরম গরম ধূয়া উঠা লালচে টার্কিশ চা। মিসেস রহমান মাত্র কেতলি থেকে ঢেলে ওকে এককাপ ধরিয়ে দিলেন। ট্রেতে আরোও তিনটে টার্কিশ কাপ রাখা। সেদিকে চেয়ে থেকে মাহীন ক্ষীণ হেসে ভাবল, বোধহয় একটা কাপ রায়েদের জন্য। বাহ!’
গত দুই মাসে প্রায়শই এ বাড়িতে আসত মাহীন। এ বাড়িতে কখন কী হয় সে সব সম্পর্কে এখন ওর জানা আছে। বিকেলের এই সময়টায় বাড়ির সকলেই চা খান এবং খোশগল্প করেন। মিসেস মাদির পায়ে ইদানীং ব্যথা বলে তিনি খুব একটা নিজ কামরা থেকে বের হন না। মিসেস রহমান তার চা টা কামরায় দিয়ে আসলেন। রাবিত বাসায় নেই। তবে রায়েদ নিজের কামরায় আছে। বোধহয় এখনো জানেই না মাহীনও ওর বাসায়ই আছে। মিসেস রহমান ফিরে আসতেই মাহীন চা টা রেখে, বারের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামল। তারপর বলল,
‘আন্টি রায়েদের চা টা আমি দিয়ে আসি?’ সামান্য তম দ্বিধা করলো না প্রশ্নটা করতে। কারণ ওর জানা আছে মিসেস রহমানের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। উনি হালকা হেসে বললেন,
‘কেন নয়। অবশ্যই যাও।’ মাহীন একটা চায়ের কাপ উঠিয়ে নিতেই উনি আবার বললেন,
‘না, না ওটা নয়। ও একটু কড়া চা খায়।’
মাহীন ওটা রেখে আরেকটা কাপ তুলে নিল। এই কাপের চায়ের রঙ তুলনা মূলক ভাবে গাঢ়। তারপর সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল, বাহ মিসেস রহমান কতটা সুক্ষ্ণ ভাবে খেয়াল রাখেন কার কোনটা পছন্দ। শুধু তার মনে পরিবর্তনটা তিনি ঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারছেন না। তাতে কী রায়েদ তো সবই দেখছে, বুঝতেও পারছে।’
মিসেস রহমানের চিকিৎসার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
নিয়মিত সেলির প্রেসক্রাইব করা ঔষধ খাচ্ছেন। সেলি ঘন ঘন কাউন্সিলিং করেন। রায়েদের সঙ্গে খুব একটা কথা তার এখনো হয় না। তবে মাহীনকে অনেক কথা বলেন। শুধু তাই নয় মিসেস মাদিহ এবং রাবিতকেও রায়েদের প্রতি তার মনোভাবের কথা খুলে বলেন। এখন রায়েদের জন্য তার চিন্তা হয়। ও কী করছে, কেমন আছে সেসবও যথাযথ ভাবেই পর্যবেক্ষণ করেন। তবে নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন, এক দন্ড সময় দিয়ে কথা বলবেন তা ঠিক হয়ে উঠছে না। তবে তিন বেলার খাবারের পাটে রায়েদ উপস্থিত থাকে। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা বলেন যেমন, আজ তারিখ কত, রাবিত কোথায় বা প্রায়শই চা, কফি কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করেন। রায়েদ নিজে থেকে মায়ের সাথে কথা বলবে তা ওর সাহসে কুলোয় না। সবসময়ই মনে হয় মায়ের এই সুমিষ্ট আচরণ এই বুঝি কর্পূরের মতো উড়ে গেল। এত বছরে তাদের মাঝে দূরত্বের এক অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছে। সে দেয়াল এত উঁচু যা সহজে টপকানো যায় না। রায়েদের ভালো থাকার খবর সাধারণত মাহীনের কাছ থেকেই নেন। রায়েদের পছন্দ অপছন্দগুলো মাহীন বোধহয় ওনার থেকে বেশিই জানে এখন।

মাহীন সন্তর্পণে ওপরে উঠে এলো। সামনের করিডোর আঁধারে ছাওয়া। এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। ততক্ষণাৎ ভেতর থেকে ভেসে এলো ভারি কন্ঠস্বর,
‘কাম ইন।’
মাহীন দরজাটা খুললো। এই তল্লাটে এক জিনিস দেখে মাহীন কখনোই অবাক না হয়ে পারেনি। তা হলো কোনো বাড়িতেই বেডরুমের দরজায় লক লাগানোর বাড়তি ঝামেলাটা কেউ করে না। এই দরজায়ও কোনো লক ছিলো না। মাহীন দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। অন্ধকার করিডরে ভেতর থেকে ম্লান আলো এসে পরল। রায়েদ নিজের বিছানায় বসে ছিলো। হাতে একটা বই। খোলা জানালা দিয়ে আকাশের কমলাটে মুখ দেখা যায়।মাহীন ভেতরে আসতেই ও বইয়ের দিক থেকে চোখ সরাল। মাহীনকে দেখেই এক গাল হেসে বলল,
‘তোমাকে যে আমার বাসায় কখন দেখতে পাবো তার কোনো ঠিক নেই। চাও দেখি আজকাল তুমিই আনছো।’
মাহীন মুখ টিপে হাসল। চা নিয়ে এগিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমি আজই প্রথম তোমার জন্য চা এনেছি। আজকাল কোথায় পেলা? আর হ্যা চা টা কিন্তু মিসেস রহমান বানিয়েছেন। ‘
রায়েদ চায়ের কাপ ওর হাত থেকে নিয়ে বলল,
‘তাই নাকি। কখন এলে?’
‘এই তো আধঘন্টা হলো।’
‘বসো না, দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
মাহীন বলল,
‘না, না আমার চা নিচে রয়েছে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। এবং মিসেস রহমানকেও তো কাম্পানি দিতে হবে।’
রায়েদ প্রমত্ত কন্ঠে বলল,
‘এবং আমাকে কে কাম্পানি দিবে?’
মাহীন হেসে ফেললো। বলল,
‘বাচ্চার মতো বলছো। স্যাডো এন্ড বোনস এবং এক কাপ চা মানেই অন ফ্লিক। আর কী চাই।’

রায়েদ চোখ ছোট করে বলল,
‘মায়ের সাথেই দেখা করতে আসো নাকি আমার সাথে?’
মাহীন দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘আন্টির সাথে।’ থেমে আবার ‘আসছি’ বলেই বেরিয়ে গেল। দরজাটা আবার চাপিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘এবং তোমাকে এক নজর দেখতে।’

নিচে নেমে এসে নিজের চা টা নিয়ে মিসেস রহমানের সঙ্গে বাগানে সাদা টেবিলে বসল। বিকেলের সুমিষ্ট সোনালি রোদে গোটা বাগান মেখে রয়েছে। বড় বড় হলুদ ও সাদা ড্যাফোডিল, ডালিয়া ও রঙবেরঙের পেতুনিয়ায় বর্ণিল আবহ। ক্লান্ত সূর্যর মরা আলোয় উত্তাপ নেই। বাতাস বইছে। বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে নানান ফুলের মিষ্টি সুবাস। মাহীন চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেই মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী করছে ও?’
‘বই পরছিল।’
‘ওহ আচ্ছা শুধু পড়তেই তো দেখি সারাদিন। আর কিছু করে না?’
বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম জব করার ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বলল,
‘কি আবার। পড়ে, ঘুরে বেড়ায়, প্রকৃতি দেখে আবার পড়ে।’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ওপরে রায়েদের কামরার জানালার দিকে চোখ গেল মাহীনের। ও যেখানে বসেছে সেখান থেকে সরাসরি জানালাটা দেখা যায়। জানালার উইন্ডোশীলে বসে রায়েদ এদিকেই তাকিয়ে আছে। না শুধু এদিকে নয় বরং বিরতিহীনভাবে আবিষ্ট নয়নে মাহীনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহীন কিছুটা বিব্রতবোধ করল। চোখ নামিয়ে নিল আবার। তবে রায়েদ সেখানেই এক যোগে বসে রয়েছে। নড়েই না। বারবার উপরের দিকে চোখ চলে যায় মাহীনের। চা-টা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আবার ওপরে জানালার দিকে চাইতেই রায়েদ বাম চোখ ব্লিঙ্ক করল। মাহীন হঠাৎ হেসে ফেললো। মিসেস রহমান অবাক হলেন। তিনি বোধহয় অন্য কথায় ব্যস্ত ছিলেন। মাহীন জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালেন। তবে রায়েদ আর সেখানে নেই। উনি এবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে মাহীন হঠাৎ করে এমন হাসছ যে?’
মাহীন হাসি থামিয়ে অপ্রতিভ ভাবে বলল,
‘আসলে ওই যে গাছের ডালে দুটো কাঠবিড়ালি ছিলো। তো ওরা হঠাৎ করেই একটা বাদাম না কী যেন নিয়ে কী সুন্দর মারামারি শুরু করল। ওটা দেখে হেসে ফেলেছি।’
মিসেস রহমান ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘এটা দেখে তুমি হেসে ফেলেছ?’ বলে তিনি হেসে উঠলেন। মাহীন দেখলো রায়েদ আবার জানালায় এসে দাড়িয়েছে। এবং হাসছে। মাহীন মনে মনে ভাবল, কী খারাপ। আমাকে কী অপ্রিতিকর, বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই না ফেললো। হুহ!’

অতি যত্নে ভাজ করা সাদা কাগজের একটি চিঠি নিয়ে এগিয়ে এসে আরেকজনকে হাত বদল করে দিল। সঙ্গে কিছু কথা বলল। এবার সে চিঠিটা নিয়ে একের পর এক কক্ষ অতিক্রম করে একটি বড়সড় ছাদ খোলা স্থানে এসে পৌঁছল। গোল গোল টেবিলগুলো জুড়ে বসে আছে ছেলেমেয়েরা। সে চিঠি হাতে একটি টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ের দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিল। হঠাৎ এমন একটা চিঠি পেয়ে অবাক হলো মাহীন। র‌্যবিট চিঠিটা দিয়েই অন্য দিকে চলে গেল। মাহীনের সঙ্গে সাইলোহ, নায়েল, জেনেট ও লিও বসে আছে। সকলেই হ্যামবার্গার খাচ্ছিল। মাহীন চিঠিটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল। খাম খুলে চিঠিটা বের করে পড়তে লাগল। পাশ থেকে জেনেট উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছিল। বাকি তিনজনও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাহীন সেসব কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিঠিটা পড়ছে। পড়তে পড়তে দুই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে মিষ্টি একখানা হাসি ছড়িয়ে গেল সারা মুখে। চিঠিটা পড়া শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে সেটা ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। এখনো আনন্দে আটখানা হয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে রয়েছে। সামনে যে চারজন মানুষ বসে অপেক্ষায় রয়েছে কিছু জানার জন্য সেদিকে হুঁশ নেই। অবশেষে জেনেটই অধৈর্য্য হয়ে বলল,’মাহীন কিসের চিঠি ছিলো ওটা?’
মাহীন চমকে উঠল। এতক্ষণে খেয়াল হলো সামনে কতগুলো মানুষ বসে আছে। নিজেকে সংযত করে বলল,’কী?’
‘না বলছি আমাদের কী বলা যাবে কিসের চিঠি ছিলো ওটা?’ জিজ্ঞেস করল সাইলোহ। হঠাৎ মাহীনের গাল দুটোয় হালকা লালচে আভা ফুটে উঠলো। লিও বলল,
‘এই এমন লজ্জা পাওয়ার মতো কী হলো?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। লজ্জা নামক অনুভূতিটার প্রতি বড্ড রাগ হলো। সেই অনুভূতি আছে তো থাক তার ফলে আবার গাল আরক্ত হয়ে উঠে কী করতে? সকল অনুভূতিগুলোই যেন মনের আঙ্গিনা থেকে বের করে এনে উগলে দেয় সকলের সামনে। নায়েল ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,
‘আহা ম্যাডাম কী লজ্জাটাই না পাচ্ছে। কেউ প্রপোজ টপোজ করল নাকি?’
বাকি তিনজন হেসে উঠল। মাহীনও হেসে উঠে বলল,
‘ধ্যাৎ! এমন কিছু না। আর তোমাদের অত জানা লাগবে কেন?’
জেনেট নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘ওহ ঠিক আছে। র‌্যবিট দিয়ে গেছে চিঠিটা। তাহলে ধরেই নেয়া যায় ব্যাপারটা রায়েদের সঙ্গে জড়িত।’
লিও বলল,
‘হ্যা র‌্যবিটকে জিজ্ঞেস করলেই তে জানা যাবে।’
মাহীনের সত্যি এবার রাবিতের প্রতি রাগ হলো। কোন কুক্ষণে যে সবার সামনে চিঠিটা দিতে হলো ওকে কে জানে!’
সাইলোহ হালকা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
‘হেই বলো না। এখন রায়েদকে আমারও খুব একটা খারাপ লাগে না। এবং তোমাদের কিন্তু সত্যি একসাথে বেশ মানায়। ওই চিঠিটা দিয়েছে তাই না।’
মাহীনের লজ্জায় মাটি ফুরে ভেতরে লুটিয়ে পরতে ভিষণ ইচ্ছে হলো। অবশেষে অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। রায়েদই চিঠিটা আমাকে দিয়েছে। কিন্তু আর কিছু বলবো না।’ বলেই উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল,
‘আমি এখানে থাকলে তোমরা নাছোড়বান্দার মতো পেছনে পরে থাকবা। তার থেকে বিদেয় হই।’ বলেই গেটের দিকে প্রায় ছুটে গেল।
.
.
.
.
‘আয়ায়ায়ায়ায়ায়া! ওহ আল্লাহ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’ প্রায় চিৎকার দিয়ে বলল মাহীন। বলেই আনন্দে নিজের বিছানায় ঝাপ দিয়ে উঠে বসল। ওর মনের মধ্যে একখানা চিঠি যেন তমসাচ্ছন্ন শীতের বুড়িকে উচ্ছেদ করে বর্ণিল ফুলের সুঘ্রাণ মিশ্রিত বসন্তের হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গেল। জানালার বাইরে স্যকামোর গাছের ঝাকড়া ডালের আড়ালে নাইটিংগেল পাখি সুর তুলে ডাকছে। এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে দুষ্টু অদুরে কাঠবিড়ালি। মাহীন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার উইন্ডোশীলে গিয়ে পা উঠিয়ে বসল। বুক ভরে বাগান থেকে হাওয়ার তোরে ছুটে আসা জুই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ শুষে নিল। আবার আনমনেই হেসে উঠল। ভাবতে লাগল, আহা অতি কাঙ্ক্ষিত কোনো জিনিস যেটা মুখে না করে আসলেও মনে চেয়ে এসেছি তা হঠাৎ করেই পেয়ে গেলে যে কতটা আনন্দ হয় তা এর চাইতে ভালো ভাবে এর আগে বুঝতে পারিনি। মুখে যেমন বলতাম মনে মনেও কিছুটা বিশ্বাস ছিলো যে রায়েদের আমার প্রতি কখনো অমন অনুভূতি হবে না যেমনটা আমার ওর জন্য হয়। আহা ওকে ভালো লাগার কথাটা কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। ওফ আমার মরার ট্রাস্ট ইশ্যু! সামান্য কথাটা কাউকে বিশ্বাস করে বলতেও পারি না। সে যাই হোক, অবশেষে আমার আশাটায় আলোড়ন ঘটতে শুরু করেছে দেখি!’ ভাবতে ভাবতেই জিনসের পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আবারও পড়তে লাগল।

“মাহীন! যাবে আমার সাথে লস এঞ্জেলস ঘুরতে? ডেট হিসেবে? নিজে থেকে ডেটের প্রস্তাব আগে কখনো কাউকে দিয়েছি বলে মনে পরে না। কেনো জানি তোমাকে দিতে খুব ইচ্ছে করল। কাল নয় তারিখ উইকএন্ডে দুপুর বারোটায় মেট্রোর সামনে দেখা হবে। লাঞ্চ আমরা একসাথেই করব এল এ তে পৌঁছে।”
রায়েদ।

চিঠিটা পড়ে আবারও গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পরল। তবে এখন সেটা দেখার মতো কেউ নেই কাছেপিঠে। আবার মনে মনে ভাবল, আহা ডেট! আমি কখনো ডেটে যাইনি। হ্যাংআউট এবং ডেটের মধ্যে কীই বা এমন পার্থক্য হয়? ডেটের মধ্যে বিশেষ কী রয়েছে? এটা কী শুধুই পশ্চিমাদের দেওয়া কাপলদের জন্য আলাদা একটা টার্ম না? চাইলেই আমাদের সূর্যদয় দেখা, নৌকা চড়া, ডিজনিল্যান্ড যাওয়া সবগুলোকেই ডেট বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে ডেট বললেও সেটা শুধু আর ঘুরতে যাওয়া থাকে না। ব্যাপারটা আসলেই কালের পরিক্রমায় অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। আহ তাহলে অবশেষে আমি এল এ তে যাচ্ছি? তাও ওর সাথে? কালকে নয় আগস্ট। কিন্তু ওতো আমাকে মুখেও বলতে পারতো। এনিওয়েজ চিঠিটাই বেশি এসথেটিক রোমান্টিক লাগছে। আর হ্যা বোধহয় সেই পিকনিকের ইনভিটেশনেরই প্রতিশোধ নিলো চিঠি দিয়ে। কিন্তু যাই হোক ও যে আমাকে ডেটের প্রস্তাব দিয়েছে এটাই তো বড় কথা।’ ভাবতে ভাবতেই বাইরে নীল আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইল। ধূয়া ধূয়া মেঘগুলোকে বাতাস ঠেলতে ঠেলতে পশ্চিমে নিয়ে চলেছে। ঈগল ডানা মেলে উড়ছে সবচেয়ে উঁচুতে। চোখের সম্মুখে স্যকামোর গাছের ডালে ছোট কমলা রঙের আদুরে এক ক্যানারি পাখির জুটি দেখা গেল। থেকে থেকে টুই টুই করে ডেকে উঠছে পালা করে। হঠাৎ অদ্ভুত এক চিন্তার আবির্ভাব ঘটলো মনের ভেতর। প্রশান্তির সঙ্গে গাছে বসে থাকা ক্যানারি পাখির দিক থেকে মনোযোগ সরে গেলো। ভ্রু সুচালো হলো। ভাবতে লাগল, আচ্ছা আসলেই কী রায়েদ কয়েকমাসেই একদম অপরিচিতা থেকে একজনকে পছন্দ করে ফেলতে পারে? ও কী সত্যিই আমাকে পছন্দ করে? নাকি আমি ওর জন্য এবং ওর মায়ের জন্য যা সব করেছি তার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এসব করছে? কিন্তু তাই বলে ডেটের প্রস্তাব দেয়া তো কৃতজ্ঞতা স্বরুপ করার মতো কাজ নয়। ওহ নাহ নাহ, আমি বেশিই ভাবছি। বেশি ভেবে জল ঘোলা করার চেয়ে কালকে আমি কী কী করব এল এ তে গিয়ে সেটা নিয়ে ভাবা উচিৎ।’
.
.
.
সাওয়ার নিয়ে মাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হলো মাহীন। এক স্নিগ্ধ সতেজতায় ভরে গিয়েছে মন। ও বেরিয়ে আসতেই সারা কামরায় ভুরভুর করে সাওয়ার জেলের সুবাস ছড়িয়ে গিয়েছে। হলদে কাজ করা কলাপাতা রঙের এক কুর্তি এবং হলুদ প্লাজো পরেছে। হঠাৎ নাইমকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দেখে থমকে দাঁড়ালো। নাইম অতি মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন প্রায় ছুটে গিয়ে কাগজটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল,
‘কী আশ্চর্য! তুই আমার কামরায় এসে আমার বিনা অনুমতিতে আমার জিনিস কিভাবে ধরিস!’
নাইম কোমরে দুই হাত রেখে টিটকারির কন্ঠে বলল,
‘ওহ তাই না? সেটা নিয়ে আমরা পরেও কথা বলতে পারব। এখন আগে আপনি বলেন। আপনি নাকি ডেটে যাচ্ছেন?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। অপ্রতিভ ভাবে চিঠিটা ভাজ করল। লজ্জায় মাটি ফুরে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল। আর কখনো বেরিয়ে আসবে না ও। তবে লম্বা শ্বাস নিয়ে বিব্রত কন্ঠে কোনোক্রমে আমতা আমতা করে বলল,
‘শুধু…একটা চিঠি দেখে তুই আজাইরা কথা বলতে পারিস না।’
বলে চিঠিটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে লোশনটা তুলে নিল। নাইম সিঙ্গেল সোফায় ধপ করে গিয়ে বসল। বলল,
‘তাই? তো তুই রায়েদের সঙ্গে ডেটে যাবি না?’
রায়েদের নামটা অতি উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করল। মাহীন এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
‘তোর এত নাক গলাতে হবে কেন?’
নাইম চোখ ছোট করে বলল,
‘এই কবে থেকে চলছে তোদের এই সম্পর্ক? আমাদের বাড়ি ঘুরে গিয়েছে রায়েদ তার আগে থেকে?’

‘ধ্যাৎ! আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু একটা ডেটের প্রস্তাব এসেছে মাত্র।’

নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’তোর বন্ধুদের ধোকা দিতে পারিস তবে আমাকে নয়। রায়েদকে যে তুই পছন্দ করিস এই ব্যপারে আমার আগে থেকে ঘোর সন্দেহ ছিলো। নাহলে ওর প্রতি শুধু না ওর পরিবারের প্রতিও তোর এতো টান কেন? আর কী যেনো?’ বলে একটু কিছু একটা ভাবার ভান করল। তারপর বলল,
‘ওহ হ্যা তোরা আগেও ডেটে গিয়েছিস। সানসেট, সানরাইজ, ডিজনিল্যান্ড ব্লাহ ব্লাহ.. মাহীন মাঝখান দিয়ে বলল,’ওইসব ডেট ছিলো না। হ্যাঙ্গআউট ছিলো।’

‘ওহ তাই তো কী হয়েছে রায়েদ তো তোকে পছন্দ করে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে রায়েদের ভাগ্য কিন্তু ভালোই বলতে হবে কিছু শুরু হওয়ার আগে থেকেই জামাই আদর পাওয়া শুরুও করে দিয়েছে মায়ের কাছ থেকে।’
মাহীনের গালে লালাভা ছড়িয়ে গেল। লজ্জায় অস্বস্তিতে কাঁদা হয়ে রইল। একই দিনে এতটা ইমব্যারেসমেন্টে আগে কখনো পরতে হয়নি। তবে একথায় ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
‘একটা ডেটের প্রস্তাব আসছে মাত্র। আর আমি এখনো এটাও বলিনি যে যাবো কি যাবো না। আর তুই ওকে জামাই বানায় দিলি। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।’ বলে বিছানা থেকে একটা ছোট কুশন তুলে ছুঁড়ে মারল নাইমের দিকে। নাইম হাসিখুশি মুখে কুশনটা ধরে ফেললো। বলল,’তাহলে তুই ডেটের প্রস্তাব বাতিল করে দিবি? আহারে রায়েদের মতো ভালো পাত্রকে রিজেক্ট করে দিবি?’
মাহীন জ্বলন্ত দৃষ্টি নাইমের দিকো তাকাল। এবার উঠে এসে এলোপাথাড়ি নাইমের ঘাড়ে কিল ঘুসি মারতে লাগল। নাইম কোনো ক্রমে ওকে থামিয়ে নিয়ে বলল,
‘বল না তুই যাবি না?’
মাহীন অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। মনে মনে ভাবল, আচ্ছা মুশকিলে পরা গেলো তো। নাইম তো বাসায়ই থাকবে। না বলেও উপায় নেই। যদি বলি যাবো না তাহলে সারাদিন আমার সাথে চিপকে থাকবে দেখার জন্য যে আমি আসলেই যাই কিনা।’ ভেবেই ফট করে বলল,
‘ধুর ছাই! ঠিক আছে আমি যাবো! একশোবার যাবো! আর তুই কোনো কথা বলবি না।’ নাইম এবার হেসে উঠে বলল,’এইতো লাইনে এসেছিস! আমি জানতাম তুই আবার এমন প্রস্তাব বুঝি নাকোচ করে দিবি।’

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here