সৎ_মা লেখা: #মাহাবুবা_মিতু পর্ব: ৩০

0
300

#সৎ_মা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
পর্ব: ৩০

সেদিন আমি নাশতা খাই আর প্রসূনের ব্যাস্ততা দেখি। হালকা আসমানী রঙের সুতার কাজ করা একটা জামা পড়া খোলা চুলের ছোট্ট প্রসূন কত্ত বড় হয়ে গেছে আজকাল৷

রান্নাঘরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নতুন তেলের বোতলের ছিপি খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আমি ওর আর ছিপির যুদ্ধ দেখলাম কিছু সময়, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম দেখি তো….

ও মনভোলানো একটা হাসি দিয়ে বোতলটা আমার হাতে দিয়ে দিলো। ওর হাসি দেখে মনে হচ্ছিলো তেলের বোতলের ছিপি না খুলতে পারায় ও ভীষণ লজ্জিত।

নাশতা শেষ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে আমি ভাবতে লাগলাম প্রসূনের কথা, কতটা আগলে রেখেছে পিচ্চি এই মেয়েটা।সেই প্রথম থেকে- সারাদিন পর যখন ক্লান্ত আমি বাসায় ফিরতাম ও দড়জা ধরে দাড়িয়ে থাকতো, আমি রুমে ঢোকা মাত্র দড়জা লক না করেই আমাকে জড়িয়ে ধরতো পেছন থেকে, আমি খেয়াল করে দেখেছি তখন ওর চুলগুলো খোলা থাকতো। আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো ওর ভালোবাসার আলিঙ্গনে। যে আলিঙ্গনে কোন মোহ কিংবা কামনা থাকতো না থাকতো নিখাদ ভালোবাসা।

আপনি যখন কাওকে ঘৃণা করবেন জীবণেও তাকে আলিঙ্গন করতে পারবেন না, আর এজন্যই হয়তো ছোটবেলায় কোথাও ঝগড়া কিংবা মারামারি করলে সব মিটমাট করে দেওয়ার পর দুজনের কোলাকুলি করিয়ে দিতো, যার শেষ হতো একজোড়া অকৃত্রিম হাসি দিয়ে।

আর মিমো আসার পর- গল্পটা একটু বদলেছে।
ও ঘুমিয়ে না থাকলে ওকে কোলে করে দুজন আসে গেইট খুলতে। সারা দুনিয়া ঘুরে রাজ্যের চিন্তার ফেরিওয়ালা আমি নিমেষেই সব চিন্তা,কষ্ট, হতাশা, দুঃখ সব বিক্রি করে ফেলি এই সুখের বিনিময়ে।
তখন মনে হয় – জীবণ আসলেই সুন্দর।

এসব ভাবতেই ফোন আসে…
রিসিভ করতেই আমি থমকে যাই, পুরো দেড় মিনিট কোন কথা বলছিনা দেখে ড্রাইভার পিছনে ফিরে তাকালো বার বার, আমার চেহারা পড়ার ব্যার্থ চেষ্টা, পাছে কোন দুঃসংবাদ কিনা।
কথা বলা শেষ হলো- আচ্ছা আমি ভেবে জানাবো আপনাকে… এ কথাটা দিয়ে।

অপ্রত্যাশিত কল…
আমার বড় মায়ের। তিনি পরোক্ষভাবে আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইছেন। আমি কেমন দ্বিধা দ্বন্ধে পরে গেলাম। সহায্য নিবো কি না…
কিন্তু এই মুহূর্তে টাকার ভীষণ দরকার আমার। হাতে সময় কম। সময় মতো ডেলিভারি না দিলে লস তো হবেই, সাথে তাদের কাজও আর পাবো না ভবিষ্যতে। বর্তমানে ব্যাবসায় টিকে থাকা ভীষণ টাফ। কম্পিটেটর অনেক তাই।

দোটানায় ভুগলাম সারাটাদিন৷ বাসায় ফিরে শুনি বৌ আমার বিয়ের দুটি আংটি বাদে সতেরো ভরি সোনা সহ সব অলংকার বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি পাগলের মতো জিজ্ঞেস করলাম প্লাটিনামের সর্টার আর দুলগুলো কোথায়। ও খুবই সহজভাবে বললো
” ওগুলো ও বিক্রি করে দিয়েছি…, আমাদের দিন ঘুরলে কত কেনা যাবে এসব….

কেন যেন আমার মাথাটা হঠৎ গরম হয়ে গেলো, রাগান্বিত আমি প্রসূনের উপর প্রথমবারের মতো চড়াও হলাম। আমার এমন রূপ দেখে অনভ্যস্ত বেচারি ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

শেষে না খেয়ে শুয়ে পরে ও, আমি তখন বারান্দায়। রাতে আমারও খাওয়া হলো না, আমি বারান্দায় বসে আছি, নিজেকে এত হোপ লেস মনে হচ্ছিলো বলার মতো না। মনে হচ্ছিলো মরে যাই, আজ নিজের জন্য বৌর গহনা বিক্রি করতে হলো…. কতটা অপদার্থ আমি।

মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম কাজটা ঠিক করিনি আমি, একটা মেয়ের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে অলংকার। আর ও এই মোহ ত্যাগ করেছে দুর্দিনে আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আর আমি নিজের ব্যার্থতাটকে ঢাকতে…..

কাজটা একেবারেই ঠিক করিনি…
কিন্তু তখন আমি এত বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলাম যে এখন ওর কাছে যেতেই লজ্জা করছে।

সেই রাত কাটলো দুজনের দুইদিকে মুখ করে। পরদিন সকালে আমি ও উঠার আগেই বেরিয়ে গেলাম….

মাল কিনতে যখন মার্কেটে গেলাম তখন ফোনে ম্যাসেজ আসলো একটা৷ আমার একাউন্টে টাকা ঢুকেছে। আমি ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে তা খরচ করলাম। কিন্তু একটা বারও বৌটাকে ফোন দিয়ে সরি বলতে পারলাম না। ভিতরটা পুরে যাচ্ছে, ফোনটা দিলেই সব যন্ত্রণার অবসান হয়, তবুও মনে হচ্ছিলো ফোনটা দেওয়ার চেয়ে যন্ত্রণা ভোগ কম কঠিন ।

রাতে আমি বাড়ি এলেই তার দুনিয়ার ব্যাস্ততা। এমন ভাব যেন কাজগুলো জমিয়ে রাখে আমার আসার অপেক্ষায়। এসব আসলে আমার কাছ থেকে দূরে থাকার পায়তারা। এমনি করে কেটে গেলো দুজনের কথা না বলার দুইদিন। তৃতীয় দিন রাতে আমি ওকে ডাকলাম, অন্য দিকে তাকিয়ে বলে
– কি বলবেন জলদি বলেন, কাজ আছে আমার…
আমি ওর হাবভাব দেখে হাসি,এরপর বললাম
– বসো তুমি, কথা আছে তোমার সাথে…
ও অন্য দিকে মুখ করে বসে,
এরপর আমি ওর হাতটা ধরে বললাম
-রাগ করেছো আমার সাথে……
মুহূর্তেই রাজ্যের কান্না জুড়ে ব্যাস্ত তিনি, কথা বলার সময় একদমই নেই তার , আমি আর অপেক্ষা না করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। কানে কানে বললাম
– আমি সরি….
অনেক পরে থামলো তার কান্না, মেয়ের কান্নার শব্দে। প্রথম বারের মতো মেয়ের কান্না শুনে মনে হচ্ছিলো কান্না শুনতে অতটাও বিদখুটে নয়। যদিও মিমো কান্নার গলা মাশাল্লাহ।

ও মেয়েকে ঘুম পারিয়ে আবার উঠে বসলো তখন আমি
ওর হাতে সেই সর্টার আর দুলের বাক্স দিয়ে বললাম এটা আমার জন্য ভীষণ স্পেশাল। এটাকে কখনো হাতছাড়া করবে না।

ও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে….

বিয়ের বেশ কিছুদিন পর। এই বক্সটা আমি ওকে দিয়ে বলেছিলাম এক আত্মীয়ের দেয়া উপহার, তাই বেচারী এর মর্ম বিচার করেছে অর্থ দিয়ে, কিন্তু এটা প্লটিনামের গহনার চেয়ে অনেক বেশী কিছু আমার কাছে সেই মর্ম হয়তো কোন দিনও উদ্ধার করা হবে না ওর….

চলবে…

Previous :
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=923972678063924&id=659404701187391
next :
https://www.facebook.com/659404701187391/posts/925402517920940/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here