চলো_রোদ্দুরে,02,03

0
569

#চলো_রোদ্দুরে,02,03
#ফাতেমা_তুজ
#part_2

এই মধ্য রাতেই হেঁটে চলেছে দুজনে। এক মুহুর্তের মধ্যে সব কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। বিয়ে , সাজসজ্জা সব কেমন এলোমেলো। বিয়ের কথা ছিলো তবে সেটা তো অন্য একজনের সাথে। মৃদু ছন্দ তুলে দুজনে গ্রামের পথ পেরিয়ে আসে বড় সড়কে। চোখের পানি এখনো শুকোয় নি। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মনে হতেই বুকে ব্যাথা অনুভব হয়। মিনমিনিয়ে ভোর বলে
_কাজ টা ঠিক হলো না ডাক্তার সাহেব। আপনি হুট করে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহন করে নিলেন।

_কিছু বললে ভোর ? উফ স্যরি তুমি করে বলে ফেললাম।

_ সেটা ঠিক আছে। তবে বিয়ে টা করা উচিত হয় নি। আপনার পরিবার কখনোই এটা মেনে নিবে না।

উত্তর করে না রাদ। সে নিজে ও জানে কাজ টা ঠিক হয় নি। তবে সেই মুহূর্তে ভোর কে নিজের সাথে নিয়ে আসাই বেটার মনে হয়েছে। এমন অনৈতিকা সম্পূর্ন মানুষ দের কাছে মেয়েটা কে রেখে আসলেই অতি শীঘ্রই শোনা যেন আত্মহত্যা করেছে ভোর। কিংবা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষ হয়ে গেছে। সেই দৃশ্য কল্পনা হতেই গাঁয়ের প্রতি টা শিরা উপশিরা জেগে উঠে। এখনো কিছু মানুষ উক্ত কুসংস্কারের মেতে আছে। অবশ্য শুধু বাবা মা নয় ছেলে মেয়েরা ও একি পথের যাত্রী। বৃদ্ধ বাবা মা কে ঘরে না রেখে বৃদ্ধাশ্রম কে কাঁধে তুলে দেয়। এমন কিছু অনৈতিক মানুষের জন্য ই বাবা মা ও সন্তান সকলেই কলঙ্কিত হচ্ছে। দোষ একজন করলে ও এর প্রভাব পুরো জাতির উপর পরে।
মাথা নত করে আছে ভোর। দু চোখের কোনে এখনো মুক্ত দানার মতো চিক চিক করছে পানি। নিজের সিদ্ধান্ত যেমনি হোক মেয়েটা কে গড়ে তুলতে হবে এটাই রাদের উদ্দেশ্যে।
_ গাড়ি তে উঠো।

_আমি যাবো না ডাক্তার সাহেব।

_মানে !

_আপনি চলে যান। আমাকে নিয়ে অনেক সমস্যায় পরতে হবে। দয়া করে চলে যান।

_কিন্তু ভোর।

হাত দুটো এক সঙ্গে মিশিয়ে অনুনয়ের স্বরে ভোর বলল
_দয়া করে চলে যান আপনি। আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। প্লিজ ডাক্তার সাহেব প্লিজ।

দু বার নিশ্বাস ফেলে রাদ। ভোরের দিকে তাকিয়ে গাড়ি তে উঠে বসে। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ধোঁয়া উঠিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। যতো টা এগোয় ঠিক ততোটাই কষ্ট অনুভব হয়। নিজের বলা প্রতি টা কথা মনে পরে যায়। গাড়ি থামিয়ে দেয়। কোনো দিকে না তাকিয়ে পেছনে ছুট লাগায়। সিক্ত নয়নে সামনে আগাচ্ছে ভোর। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। পিছু ডাকে রাদ। চিৎকার করে বলে
_ভোর।

পেছন ফিরে তাকায় মেয়েটা। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে
_ডাক্তার সাহেব!

ভোরের কাছে এসে হাঁটু তে হাত দিয়ে হাঁফাতে থাকে। ভোর যেন আকাশ থেকে পরেছে। একটু থেমে নিয়ে ভোরের হাত ধরে রাদ বলে
_চলো

_কোথায় ?

_রোদ্দুরে।

_কিন্তু আপনার ফ্যামিলি।

_সব কিছু বাদ দাও। তোমাকে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে এসেছি আমি। সবাই কে দেখাতে হবে তো। আমি যে এই অন্ধকার থেকে তোমাকে রোদ্দুরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। আমার প্রতিশ্রুতি এটা।

_কিন্তু ডাক্তার সাহেব।

_আরে আসো তো।

ভোরের কথার তোয়াক্কা না করে ওর হাত ধরে নিয়ে যায় রাদ। নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। সত্যি ই কি অন্ধকার থেকে রোদ্দুরে নিয়ে যাচ্ছে রাদ। নাকি সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় কোনো অন্ধকার।

সামনের দিকে চোখ নিমজ্জিত রেখেই রাদ বলল
_কি হয়েছে?

_কিছু না।

_তুমি চিন্তাগ্রস্ত তাই না?

_কিছু টা।

_ডোন্ট ওরি। আমি তোমাকে সব ভাবে সাহায্য করবো। তোমার পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। শহরে গিয়ে তোমাকে হোস্টেলে ভর্তি করে দিবো। দুদিন পর আমার আরেক টা মেডিকেল ক্যাম্পিন আছে। দ্যান তোমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো।

_আচ্ছা।

গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দেয় ভোর। বিয়ে নিয়ে প্রতি টা মেয়ের কতো স্বপ্ন থাকে। ওর ও ছিলো। তবে সে স্বপ্নের প্রতি আজ আগ্রহ নেই। আছে শুধু সস্তার কিছু আবেগ আর দীর্ঘশ্বাস ।
.

_মরশুমি ম্যাম দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে।

_উফ নিতু আমার নাম মরশুমি না মৌশুমি।

_ঐ একি তো হলো।

_কি হয়েছে বলো।

_দেখুন এই শাড়ি টা আজ ই কিনেছি। ভালো দেখতে তাই না?

_হুম ভালো।

নিতুর অহেতুক কথা বার্তা একদম ই পছন্দ নয় মৌশুমির। মেয়েটা আস্ত এক গোবরে ঠাসা। যেখানেই যাবে নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে আসবে। আর তৎক্ষনাৎ পরে সেলফি শুরু করবে। নিজের প্রশংসা তো করবেই।

_মরশুমি ম্যাম।

_নিতু প্লিজ। কাজ করছি আমি। তোমার সাথে কেন যে ডিউটি পরে।

মুখ বাঁকায় নিতু। নিজেকে দেখতে থাকে এপাশ ওপাশ করে। সাত সকালে গোসল করেই নতুন শাড়ি পরেছে। বয়স টা একটু বেশি হলে ও সাজ সজ্জা একদম বাচ্চা দের মতো।
_নিতু এই ফাইল টা রেডি করো। স্যার এসেই আমাদের ইচ্ছে মতো ঝাড়বেন।

_উফফ মরশুমি ম্যাম আপনি অহেতুক চিন্তা করেন।

_ধ্যাত।

ফাইল নিয়ে চলে আসে মৌশুমি। তিন টে বছর ধরে নিতুর মরশুমি ম্যাম মরশুমি ম্যাম শুনতে হচ্ছে। বয়স নয় নয় করে ত্রিশ পেরোলে ও এখনো বিয়ে করে নি। এর পেছনে অদ্ভুত কারন রয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে বড় রকমের ছ্যাঁকা প্রাপ্ত হয়েছে। শপথ করেছিলো ঐ ছেলে কেই বিয়ে করবে। সেই শপথ রক্ষার্থে এখনো বিয়ের পিরিতে বসা হলো না নিতুর। হসপিটালের মেইন ডোর দিয়ে রাদ কে আসতে দেখে জড়োসড়ো হয়ে যায় মৌশুমি। সামান্য ঝুঁকে বলে
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং। ড্যাড এসেছে?

_নো স্যার। এম ডি স্যার তো দশটার আগে হসপিটালে আসেন না।

_ওহ তাই তো। এনি ওয়ে আমার কিছু টাকা লাগবে তাই হসপিটাল থেকে নিয়ে যাচ্ছি। ড্যাড আসলে বলবেন আমার কার্ড টা লক হয়ে গেছে।

_জি স্যার।

ম্যানেজার এর কাছে আসে রাদ। কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন তিনি। ভদ্রতার খাতিরে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করে। ইমরান বলেন
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং আঙ্কেল। একাউন্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিন আমায়। একটু আর্জেন্ট।

_ওকে। আপনি সাইন করে দিন আমি নিয়ে আসছি।

_জি

সাইন করে দেয় রাদ। ইমরান কিছু টা অবাক হোন। যতো দূর জানেন কাল রাতেই বাসায় ব্যাক করার কথা ছিলো। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে এখন আসলো। চমশা টা নাকের ডগায় চলে এসেছে। নিতু বলে
_একি স্যার আপনার চশমা নাকে চলে এসেছে কেন? আজকাল নাকে চশমা পরা কি স্টাইল।

_নিতু।

ইমরানের ধমকে চমকে যায় নিতু। তুতলে বলে
_জি স্যার।

_রাদ স্যার এসেছেন দ্রুত পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দাও। আর হ্যাঁ ফালতু কথা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দাও।

_ইয়েস স্যার।

পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল তুলে দেয় নিতু। ইমরান চলে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ড এখনো উঠা নামা করছে।

ইমরানের থেকে টাকা নিয়ে চলে আসে রাদ। গাড়ি তে বসে আছে ভোর। ওকে দেখেই মাথা টা উঁচু করে বসে। হোস্টেলে গিয়েছিলো , তবে কার্ড কাজ না করায় ভোর কে ভর্তি করাতে পারে নি। তাছাড়া এতো গুলো টাকা ক্যাশ ও ছিলো না ওর কাছে।
_আমার জন্য শুধু শুধু এতো গুলো টাকা খরচ করে যাচ্ছেন।

_আপনার মোহরানা দেওয়া হয় নি এখনো। আমি আপনার কাছে এক প্রকার ঋনগ্রস্ত।

_এই বিয়ে টার কোনো মানে নেই ডাক্তার সাহেব। অহেতুক আপনার জীবনে কাঁটা হয়ে গেলাম আমি।

_ভালো কাজ করা কোনো দোষের নয়। বিয়ের বিষয় টা পরে দেখা যাবে। আপাততো আপনাকে হোস্টেলে ভর্তি করানো টাই কাজ।

_কিন্তু এতো গুলো টাকা।

_মোহরানা তে বিশ লাখ টাকা। সেই টাকা দেওয়ার জন্য কিছু টা সময় দিতে হবে। আমার কার্ড টা লক হয়ে আছে ।

রাদের কথা তে ভ্রু কুঁচকে যায় ভোরের। মোহরানা তে বিশ লাখা টাকা লিখেছে। কথা টা শুনেই মাথা ভন ভন করে। এক লাখ টাকার জন্য ওর বিয়ে টা ভেঙে গেছে। আর এখানে মোহরানা বিশ লাখ টাকা। ভোরের দিকে তাকিয়ে রাদ বলে
_তুমি কি কোনো ভাবে আপসেট?

_আমার বিয়ে টা এক লাখ টাকার জন্য ভেঙে গেছে। আর আপনি মোহরানা তে বিশ লাখ টাকা দিয়েছেন।

_এটা বিষয় নয় ভোর। অতো গুলো মানুষের সামনে আমি আপনাকে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ করে এসেছি। এটাই ফেক্ট , বাকি সব কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা মাত্র।

_ আপনার এক বার ও মনে হচ্ছে না অজানা অচেনা মেয়ের প্রতি বেশিই সহানুভূতি হয়ে যাচ্ছে।

_তা একটু হচ্ছে। তবে অজানা অচেনা হলে ও ধর্ম মতে আপনি আমার স্ত্রী।

স্ত্রী শব্দ টি যেন ভোরের অস্তিত্ব নাড়িয়ে দেয়। সত্যি ই তো রাদ তো ওর স্বামী। বিয়ে টা যেই কারনেই হোক সম্পর্ক টা তো মিথ্যা নয়। গাড়ি থেমে যায়। সিটবেল খুলে বাইরে নেমে আসে রাদ। ভোর নামছে না দেখে রাদ বলে
_দ্রুত নেমে আসো।

_ হুমম।

হোস্টেলের ফি প্লাস এডভান্স দিয়ে দেয় রাদ। একটা ফর্ম পূরন করতে দেয় ওকে। পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিছু টা বিব্রত হয়ে যায় ছেলেটা। ভোরের পরিচয় কি দিবে সেই চিন্তা তেই থম মেরে থাকে। কাউন্টারের মেয়ে টার ডাকে ধ্যান ভাঙে। বলে
_স্যার ফর্ম টা এখনো পূরন হয় নি। আপনাদের সর্ম্পক দিতে হবে।

_সর্ম্পক।

_জি। ওনি আপনার কি হয়?

ভোরের দিকে তাকায় রাদ। কি লিখবে এখন। অনেক ভেবে চিন্তে বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পর্ক টা লিখে দেয়। ফর্ম দেখে মেয়েটা বলে
_আপনার স্ত্রী কে নিয়ে আসুন স্যার। আমি ওনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

_জি।

স্ত্রী শব্দ টি নেহাত ই মন্দ নয়। বেশ ভালোই লাগলো ওর কাছে। বেঞ্চে বসে আছে ভোর। গাঁ থেকে কাঁচা হলুদ মিশ্রিত ঘ্রান নাকে এসে লাগছে। সুভাস টা বেশ দারুন। হলুদ কাপড়ে ভোর কে সূর্যের সেই হলুদ রোদ্দুর ই মনে হয়। যেন তাকানো দায়। চোখ ঝলসানো রূপ।

চলবে

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_3

হোস্টেল এর বাইরের দিক টা যেমন সুন্দর তাঁর থেকে বেশি সুন্দর ভেতরে। কিছু টা থ্রি স্টার রেস্তারার রুমের মতোই। হবেই না কেন ? মান্থলি পনেরো হাজার টাকা ফি। যেন তেন রুম তো কোনো কালেই সম্ভব নয়। রুমের এক পাশে গুটিয়ে রাখা কম্বল দেখে রাদ বলল
_এক্স কিউজ মি।

_ইয়েস স্যার।

_কম্বল টা সরানোর ব্যবস্থা করুন প্রয়োজনীয় সব আমি এনে দিবো।

_ওকে স্যার।

মেয়েটা চলে যায়। ভোর বলে
_এটা না সরালে ও হতো।

_উহুহ ব্যবহার করা জিনিস গাঁয়ে তুলবে না। ফ্রেস টা এনে দিবো। তাছাড়া তোমার কস্টিউম ও লাগবে।

_ এতো ভাববেন না ডাক্তার সাহেব।

_এতো ভাবছি না ভোর। তোমাকে দায়িত্বের সাথে নিয়ে এসেছি। ভালো মন্দ দেখা আমার নৈতিকতার মধ্যে পরে। আর এস অ্যা ফিউচার ডক্টর আমি তোমার হাইজিন এর উপর পুরোপুরি খেয়াল রাখবো এটাই স্বাভাবিক। এন্ড এটার মানে একজন ডক্টর হওয়ার গুন আমার মাঝে একটু হলে ও রয়েছে।
জানো , বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক জনের ব্যবহার করা জিনিস অন্য জন ব্যবহার করা উচিত নয়। অনেকের অনেক রকম রোগ থাকে। আই নো দ্যাট ঐ টা ওয়াস করা তবে দরকার কি রিক্স নেওয়ার।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ভোর। রাদের বাচন ভঙ্গিমা ওকে মুগ্ধ করে। যে কোনো ফাংশনে বিনা প্রস্তুতি তে বক্তব্য করতে পারবে ছেলেটা। ভোর কে তাকাতে দেখে রাদ বলে
_ফ্রেস হয়ে আসো আমরা বের হবো।

_বেশি ভালো কিন্তু ভালো নয় ডাক্তার সাহেব।

_মানে।

_কিছু না।

ওয়াসরুমে চলে যায় ভোর। মেয়েটার বলা কথাতে কিছু একটা ছিলো। কিন্তু কি ছিলো?
কোনো ভাবে ভোর কি ওকে অবিশ্বাস করছে। গ্রামের মানুষের উটকো চিন্তা ধারনার মতোই কি ভোর ও চিন্তাগ্রস্ত। শীতের মাঝে ও চিকন ঘাম হয় ছেলেটার। ভোরের অবিশ্বাস মাখা কথা যেন কিছু তেই হজম হচ্ছে না। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আসে ভোর। মাথার ব্যান্ডেজ টা ভেদ করে রক্ত নেমেছে কিছু না। সেই রক্ত পরিলক্ষিত হতেই ব্যস্ত হয়ে পরে রাদ। কাবাড থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে সেটা থেকে তুলো আর মলম নিয়ে বসে। ভোরের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে যেন শ্বাস ফেলে। তাঁতে ও যেন বিশাল প্রশ্ন বাঁধায় ভোর। তাঁর চাহনি আবারো মনে করিয়ে দেয় ‘ ডাক্তার সাহেব বেশি ভালো কিন্তু ভালো নয় ‘

কিছু টা ছিটকেই সরে যায় রাদ। উন্মাদ পাগলের মতোই লাগছে নিজেকে। ভোরের একটা কথা যেন ওকে টেনে ধরে প্রতি পদক্ষেপে। কিছু তো আছে এই কথাতে। কিন্তু কি বোঝাতে চেয়েছে ভোর। এক বার কি জিজ্ঞেস করবে ওহ? না এই কথা টা টেনে হিঁচড়ে ধরে জিজ্ঞাসা করার বিষয় নয়। তবু ও কেন মনে শান্তি মিলছে না।

_আমরা কি এখন বের হবো?

_হুমম। তুমি রেডি হয়ে গেছো?

_আমার আর কি। চুল টা বেঁধে নিয়েছি শুধু।

_এই তুমি খোঁপা বেঁধেছো কেন?

_প্রচন্ড ঝট হয়ে আছে।

_ওহ আচ্ছা আসো তাহলে।

একটা শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে এসে বেশ বিপাকে পরে ভোর। এতো বড় শপিং মলে আসা তো থাক কখনো চোখেই দেখে নি। বছরে এক বার নিজের উপজেলার ছোট খাটো শপিং মলে আসা যাওয়া হতো। সেই শপিং মলে গেলে নিজেকে কার্টুন কার্টুন লাগতো। কেন না সেখানে ও বড় সড় মানুষ দের আসা যাওয়া। আর ওদের পরা কাপড় হতো মলিন আর অগোছালো। বছরে এক বার দু বার কাপড় আয়রন করতো সে। তা ও স্কুলের অনুদান থেকে ত্রিশ টাকা বাঁচিয়ে। বন্ধু দের সাথে নিয়ে বাজারে টাক্কু কাকার দোকান থেকে। সে যে কি অনুভূতি বোঝানো দায়। আসার পথে মাতব্বরের ভিটা থেকে তেঁতুল চুরি। সেই কাঁচা তেঁতুল নুন হলুদ দিয়ে মাখিয়ে সকলে সমান ভাগে ভাগ করে খেতো ওরা। ভাবতেই চোখ দুটো কেমন করে উঠে। আহা সে যে অন্য রকম স্বাদ।

কিছু টা এগিয়ে গিয়ে আবারো ফিরে আসে রাদ। ভোরের বাহু তে স্পর্শ করতেই তুতলিয়ে বলে
_ কে, কে?

_তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি বিকেলের মধ্যে বাসায় না গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

_কেন?

_কাল কে রাতেই ফেরার কথা ছিলো।ড্যাড আর মম বিকেলে এক সাথে নাস্তা করে। সেই সময়েই তাঁরা আমার কথা তুলবে। দ্যান কি যে হবে আল্লাহ জানেন।

রাদের ভয়ার্ত বিবরনের সাথে মুখের পাংশুটে ভঙ্গিমা হাসাতে বাধ্য করে। ফিক করে হেসে দেয় মেয়েটা। এই প্রথম ভোরের মুখের তৃপ্তিকর হাসি দেখে। কিছু টা থমকেই যায়। যখন ঘোর কাঁটে তখন বুঝতে পারে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় শপিং মলে। আবারো সেই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে ভোর। এই হাত ধরার মাঝে আলাদা অধিকার বোধ দেখতে পায়। কেন যেন মনে হয় রাদ ওর খুব আপন। সত্যি ই কি খুব আপন?

লিফ্ট এর ঝাঁকুনি হতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ভোর। রাদের ব্লেজারের হাতা টা খিচে ধরে। নখের দাগ লেগে যায় ব্লেজারে। হঠাৎ এমন অহেতুক ভয় পাওয়ার কারন বুঝে উঠে না রাদ। পরক্ষনেই মনে পরে ভোরের অবস্থান। গ্রামের শেষ প্রান্তে অবহেলায় বড় হওয়া মেয়ে টা শহরের সাথে কতো টা মানানসই। ভোর করে সঙ্গ দিতে ওর হাতে হালকা করে স্পর্শ করে। লিফ্ট ওপেন হতেই চোখ খুলে ভোর। নিজের অবস্থান ধারনা হয়। কিছু টা দূরে গিয়ে হয় জড়োসড়ো। মেয়েলি কস্টিউম সম্পর্কে একদম ই কাঁচা রাদ। কখনো কেনা হয় নি যে। মায়ের জন্মদিনে কিংবা ম্যারেজ এনিভার্সারি তে ও কখনো কস্টিউম গিফ্ট করে নি সে। এমন কি কখনো মেয়েলি কস্টিউম কেনার সময় ও ছিলো না সাথে। বলতে গেলে ভারে মা ভবানী। চিন্তা গ্রস্ত রাদ হঠাৎ নখ কামড়ে ধরে। ভোর বলে
_নখ কামড়ানো হাইজিনিং তাই না?

_হুম।

কয়েক সেকেন্ড পরেই চমকে যায় রাদ। নখ ছেড়ে তুতলিয়ে বলে
_আসলে হয়ে ছে কি, আমি মানে নখ কামড়ানো একটা বাজে হেবিট।

মুখ টিপে হাসে ভোর। এমন ভাবে চমকে যাবে ভাবে নি মেয়েটা। ভোর কে সাথে নিয়ে ফুড কর্নারে ঢুকে পরে। কিছু খাবার অর্ডার করে নেটে সার্চ করে। সেখানে অহরহ ডিজাইন করা কস্টিউম। তবে চুজিং এর বিষয় তো নিজেকেই করতে হবে। ভোরের উপর ও বিশ্বাস রাখতে পারে না ছেলেটা। গ্রামের মানুষ যেমন কস্টিউম পরে তাঁর একটা ও আশে পাশে নেই। সব টপস কিংবা কুর্তি অথবা জিন্স এর মডেলিং জামা কাপড়। যেগুলোর সাথে অভ্যস্ত নয় ভোর।

রনিত এর কথা মনে হতেই চোখ চকচক করে। বলে
_আমি ট্রেরেস এ আছি। তুমি খাও।

_আচ্ছা।

ট্রেরেস এ এসে রনিত কে কল করে। এক বার দু বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে রনিত। বলে
_কি রে তোর গ্রাম্য পরিবেশ দেখা হলো নাকি এখনো পরে আছিস।

_না হয়েছে। এখন শোন তুই তো ইনায়া কে মাঝে মাঝেই ড্রেস গিফ্ট করিস।

_হুম তো।

_একটা হেল্প লাগবে। ধর একদম সাধারন স্টাইলিশ না এমন মেয়ের জন্য কোন ধরনের কস্টিউম চুজ করা যায়।

_তুই হঠাৎ মেয়েদের কস্টিউম নিয়ে পরলি কেন? তা ও আবার সাধারন স্টাইলিশ না এমন মেয়ের কস্টিউম।তোর মতলব কি বল তো। গ্রামের পরিবেশের সাথে সাথে গ্রামের কোনো মেয়ে কে ও বিয়ে করে নিলি না তো?

_আশ্চর্য! তোকে যা বলছি তাই বল।

রাদের ধমকে মজা থেকে বেরিয়ে আসে রনিত। অনেক ভাবনা আসলে ও সেই সব পাত্তা দেয় না। বলে
_গার্লস কালেকশন এ যাবি দেখবি সেখানে মেয়ে আছে। তাঁদের থেকে হেল্প নিয়ে পছন্দ আর কমফর্টেবল মতো কিনে নিবি।

_ওহ ওকে।

ফোন রেখে স্বস্তির দম ফেলে। গার্লস কালেকশনে ভোর কে নিয়ে গেলেই মানা সই কিছু একটা কিনে নিবে। এতো প্যারা নিয়ে লাভ নেই।

লেডিস সাইটে এসে বাদে আরেক বিপত্তি রাদের ভাবনাই ঠিক। এখানে থাকা কোনো কস্টিউম ই ভোরের পছন্দ হয় না। পছন্দ নয় বলতে সে অভ্যস্ত নয় এমন পোশাকে। বেশ বিরক্ত হচ্ছে শপের মেয়েটা। এতো শত জামা কাপড় দেখানোর পর ও কোনো টা তেই সায় মিলে নি। কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় ভোর। এই সব কাপড়ের সাথে কোনো উড়না নেই। সে কি করে পরবে এসব ?

ভোরের অবস্থা কিছু টা আচঁ করতে পারে রাদ। সে নিজে ও বুঝতে পারে কেন না বোধক উত্তর করছে মেয়েটা। যদি ও কুর্তির সাথে মানিয়ে নিবে ভোর। তবে এর সাথে কিছু একটা লাগবে। ভারী সাজে সজ্জিত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে যেন অস্থির লাগে। তবু ও নরম কন্ঠে বলে
_মিস আপনি কুর্তি প্যাক করে দিন।

_ওকে স্যার।

_কিন্তু ডাক্তার সাহেব আমি তো

পুরো কথা বলতে পারে না ভোর। মাথা টা নিচু করে নেয়। আড়ষ্টতায় ধরেছে ওকে। রাদ বলে
_এটার সাথে দোপাট্টা তো যাবে না। বাট মাফলার যাবে।

_মাফলার?

_ঐ যে আছে না কি যেন। ওয়েট, এক্স কিউজ মি মিস।

_ইয়েস স্যার।

_লুক ঐ যে মেয়েটা জিন্স এর শার্ট এর সাথে গলায় ঐ টা কি পরেছে মাফলার এর মতো?

_স্কাফ স্যার।

_ইয়েস স্কাফ। কুর্তির সাথে মেচিং করে স্কাফ দিয়ে দিন। আর সাথে কিছু জিন্স টাওজার এন্ড লেডিস মডেলের প্যান্ট দিয়ে দিন। আই মিন কুর্তির সাথে মানান সই।

_ওকে স্যার।

_এবার কোনো অসুবিধা হবে না।

_থ্রি পিস নিলে হতো না?

_এই শপে থ্রি পিসের একটা পার্ট ও নেই। অন্য যেসব লোকাল শপ আছে সেগুলো তে দর করো, দ্যান ঠেলাঠেলি। আই জাস্ট হেট দ্যাট।

মেয়েটা প্যাক করে দেয়। কাউন্টারে এসে বিল পে করার পর কিছু মাথায় আসে। কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ভোর। কাউন্টারে গিয়ে রাদ বলে
_আপনি ওকে সাথে নিয়ে আর যা যা লাগবে প্যাক করে দিন।

বুদ্ধি সম্পূর্ন মেয়েটা চট করেই বুঝে যায়। ভোর কে সাথে করে নিয়ে যায় সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদ। একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কখনোই একা বাঁচা সম্ভব নয়। তাঁর প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু সে বলতে পারবে না আর এটাই স্বাভাবিক। যদি ও রাদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে তবে ওদের সম্পর্ক টা তো তেমন নয়। এই সম্পর্ক টা একটা চ্যালেঞ্জ, একটা দায়িত্ব। যাঁর ভবিষ্যত সম্পর্ক কোনো ধারনাই করতে পারে না দুজনে। নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনো হয়ে উঠে নি। থাকা না থাকা দুটোই আকাশ কুসুম কল্পনা। দুজনের জীবন একই রোদ্দুরে ছুটলে ও গতি পথ ভিন্ন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here