‘এলোকেশী’- [১২]

0
529

-‘এলোকেশী’-
[১২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

রোদকে পুনরায় ব্যস্ত শহরের কর্মচঞ্চল জীবনেই ফিরতে হচ্ছে। প্রকৃতির নির্মল বায়ু ছেড়ে, ওকে পূর্বের মতো আবার দূষিত বায়ু শরীরে মাখতে হবে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার বদলে যানজট আর হাজারও ব্যস্ততার ভিড়ে দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করতে হবে। সময়ের সংকটে হয়তো এভাবে আর বৃষ্টির নৃত্যও উপভোগ করতে পারবে না। হুম, ঢাকাতেও বৃষ্টি হয়।
তবে ঢাকার আর এখানকার বৃষ্টি দেখাতেও বেশ কিছুটা ভিন্নতা রয়েই যায়! মনে হয়, এখানকার বৃষ্টি প্রাণপূর্ণ। আর ঢাকার বৃষ্টি গুমোট ধরা। এমন খোলা আকাশ, পাহাড়, রক্তিম সূর্য, সবুজের সমারোহে আবার দেখা হবে কী না, তাও জানা নেই। আর, আর সেই সরল মনের মিষ্টি মেয়েটা! ওর সঙ্গে কী আদৌও দেখা হবে? আচ্ছা, সে কী ওদেরকে মনে রাখবে? এর উত্তর হয়তো হ্যাঁ, অথবা না! মানব জীবন চলতে থাকে তার আপন গতিতে। আর ছোট্ট এই জীবনে প্রতিনিয়ত কতশত মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কথা হয়, আবার সময় পেরোলে তাদের ভুলেও যায়। তেমনি আলোর নামের মেয়েটির কথা, সে ও কী ভুলে যাবে? সত্যিই কী ভোলা যাবে, তার স্বার্থত্যাগী সাহায্যের কথা? তার সরল মায়াবী মুখ আর মিষ্টি হাসির কথা? নাকি ওর কথা কারো স্মৃতির পাতায় বন্দী হয়ে মনের এক কোণে জমা থেকে যাবে? যদি এভাবেও থাকে তো থাকুক না, মন্দ কী তাতে!
রোদ গাড়িতে বসে এসব কথা ভেবে মেঘের দিকে তাকাল। মেঘ মন ভার করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হয়তো আলোকে খুঁজছে। তখন ওদের গাড়িটা চলতে শুরু করল নিদির্ষ্ট পথের উদ্দেশ্যে।
রিসোর্ট ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই ভিড়ের কারণে ওদের গাড়িটা থেমে গেল । অনেক গাড়ি আর এত মানুষের জটলায় রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে। রোদ ব্যাপারটা বোঝার জন্য জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরে তাকাল। হৈচৈর কারণে তেমন কিছু বোঝা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার খুব বিরক্ত হয়ে পাহাড়ি ভাষায় বললেন,
“এই চুতি* ছামনে তেকে সল! নাইলে তোদেল উপ্রে দিয়া গালি(গাড়ি) উতায়া দিমু নে।”
উনার গালি শুনে রোদ আড়চোখে একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে কথা বাড়াল না। এখন এই বিষয়ে কথা বাড়ালেই মেঘ গালিটা বুঝে ফেলবে। এবং জিজ্ঞাসা করবে এটার মানে কী! কিন্তু ড্রাইভারের গালি শুনে একজন পাহাড়ী যুবক তেড়ে এসে বলল,
“তুপ ছালা। বেছি কথা কইলে তোরে ওই পাহালের নিচে পুঁতি দিমু।”
“তুই চুপ হালামজাদা।”
এই নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে হতে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। রোদ কোনো রকম ওদের থামিয়ে ওই যুববকে সুন্দর করে জিজ্ঞাসা করল,
“ভাই, রাস্তায় জ্যাম কেন? আসলে হয়েছে টা কী?”
যুবকটা রোদকে ভালো ভাবে পরখ করে লুঙ্গিতে কাছা মেরে বলল,
“মেলা বিছতির কালণে পাহালের মাটি নলম হয়ে ঢসে গেচে। পাহালের নিচেল মানুচলা ছেই মাটিল নিচে চাপাও পলেছে। ওদেলই লাছ লিতে এছব গালি (গাড়ি) যাতেছে।”
যুবকটার একথা শুনে রোদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“কোন পাহাড়?”
“এই লাস্তা দরে খানিক হেঁতে ওই ছামনের (হিলক) নামেল মেলা উঁচু পাহালতা।”
(বিঃদ্র- এই নামের সেখানে কোনো পাহাড় নেই। কেউ আবার খুঁইজেন না। গল্পের স্বার্থে নামটা ব্যবহার করলাম)

আলোর বাড়ির পেছনের উঁচু পাহাড়টার নাম বলে যুবকটা স্থান ত্যাগ করল। একথা শুনে রোদ পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর সচল মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সে কিছুক্ষণ থম মেরে ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের সামনে যেতে বলল। রোদের আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে উনি আর কিছু বলার সাহস করলেন না। দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে রিসোর্টের সামনে চলে গেলেন। রোদ মেঘকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত হেঁটে রিসিপশনের সামনে চলে গেল। ওদের রুম এখনো বুক হয় নি। সে খোঁজ নিয়ে পুনরায় ওই রুমটা নিলো এবং পাখির খাঁচা আর ট্রলি ওয়েটারকে রুমে রাখতে বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কাউকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিলো না। অবুজ মেঘ এসবের কিছু বুঝতে পারছে। তবে আন্দাজ করতে পারছে কিছু একটা হয়েছে। নাহলে দাভাই এত তাড়াহুড়ো করত না। রোদ মেঘকে নিয়ে আলোর বাড়ির রাস্তা ধরে সাবধানে হাঁটতে লাগল। এখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে! প্রকৃতি কী কারণে আজ এত রুষ্ট কে জানে! আকাশেও ঘন কালো মেঘ জমেছে। যখন তখন বৃষ্টির গতি আরো বাড়তে পারে। বৃষ্টিতে কারণে কাদা পানিতে রাস্তার একাকার অবস্থা। হাঁটাও যাচ্ছে না ঠিকমতো। এত কাদার মধ্যে মেঘও রোদের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছে না। বার বার পা পিছলে যাচ্ছে। তাই মেঘ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
” দাভাই, আমি তোমার সাথে হাটতে পারছি না। একটু আস্তে চলো না, আমার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
একথা শুনে রোদ মেঘের কাদা মাখানো পায়েই কোলে তুলে হাঁটতে লাগল। চিন্তায় ওর পুরো শরীর ঘামে ভিজে জবজব অবস্থা। মেঘ এখনো বুঝতে পারছে না, কি হচ্ছে? আর দাভাই এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছে? রোদের চিন্তিত মুখ দেখে সে জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ আর না পেরে রোদকে জিজ্ঞাসা করল,
“দাভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রোদ মেঘের দিকে একবার এক পলক তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“যে পাহাড়ের নিচে তোমার বউমনির বাড়ি। সেই পাহাড় টা কালকে রাতে ঢসে গেছে। আর বাড়িগুলো পাহাড়ের মাটির নিচে চাপা পড়েছে।”
একথা শুনে মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে ঢোক গিলে কান্নারত কন্ঠে বলল,
“দাভাই, বউমনি কী তাহলে মরে গেছে?”
কথাটা বলে মেঘ রোদের গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রোদ ওকে কত কী বুঝিয়েও থামাতে পারছে না। এভাবে গেলে ওরা ওখানে পৌঁছাতে পারবে না। বউমনির খবরও জানা যাবে না। তাই মেঘ রোদের কোল থেকে নেমে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। তারপর কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা ওখানে পৌঁছে যা দেখল, তাতে রোদ আর মেঘ দুজনেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাহাড়ের একপাশ ঢসে ছোট্ট গ্রামটার উপর পড়েছে। যার কারণে গ্রামের মানুষদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অনেকে প্রান হারিয়ে।চারিদিকে অসহায় মানুষগুলো আত্মীয় স্বজন হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আত্মনার্দ করে কাঁদছে। কেউ কেউ প্রাণপনে চেষ্টা করছে তাদের আপন মানুষগুলো কে উদ্ধার করতে। কালকে রাতে অনেকজন পাহাড়ের ভেজা মাটির নিচে চাপা পড়ছে। এখন তাদের মৃত লাশ টেনে বের করা হচ্ছে। সারি সারি ভাবে অনেক লাশ শুয়ে রাখা হয়েছে।
উদ্ধার কর্মীরা মাটি সরিয়ে লাশ উদ্ধার করছে। কোদাল দিয়ে মাটিতে কোপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাশদের হাত, পা, মাথা, কেটে চলে আসছে। তখন লাশের রক্তে ভেজা মাটিটাও লালবর্ণ ধারণ করছে। গ্রামটা যেন এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে কান্নার আহাজারি, মৃত্যু, লাশ, আর রক্ত। উফ! রুদ্ধশ্বাস করা একটা পরিস্থিতি।
রোদ মেঘ আর না দাঁড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আলোর খোঁজ করতে লাগল। অজানা ভয়ে দু’জনেই তটস্থ হয়ে উঠেছে। অনেক খুঁজে আলোকে না পেয়ে ওরা ব্যর্থ হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। মেঘ তো কান্না করেই যাচ্ছে। ওদের বাবা মা মারা যাওয়ার পর, রোদ এই প্রথম মেঘকে এতটা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখছে। রোদ কোনোমতেই ওকে থামাতে পারছে না। খুব প্রিয় কাউকে হারিয়ে মানুষ যেমন পাগলের মতো কাঁদে। মেঘও ঠিক সেভাবেই কাঁদছে। যেন আলোই ছিল ওর বাঁচার শেষ অবলম্বন।
তারপর দু’জনে হাল না ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার খুঁজতে লাগল। সবাই যার যার আপন মানুষ নিয়ে ব্যস্ত। কাকেই বা জিজ্ঞাসা করবে! রোদ মেঘকে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে চারদিকে চোখ বুলালো। কিন্তু ওদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটা কোথাও নেই! কোথায় গেল সে? তাহলে কী মায়াবী মুখের মিষ্টি হাসিটা আর দেখা হবে না? মেঘের কথায় কী ঠিক হবে?
এসব ভেবে রোদ শুকনো একটা ঢোক গিলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। কেন যেন ওর দম আঁটকে আসছে। বুকের ভেরতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমন লাগার কারণটাও ওর অজানা।
হঠাৎ মেঘ বউমনি বলে চিৎকার করে ডেকে সামনের পথে দৌড় দিলো। রোদ মেঘের ডাক শুনে সেদিকে তাকিয়ে সেও
মেঘের পিছু গেল। আলো তিনটা লাশের সামনে থম মেরে বসে আছে। রোদ আলোর করুন অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে আগে নিজেকে শান্ত করল। আলোর সামনে মৃত তিন ব্যাক্তি মাটির নিচে চাপা পড়েছিল। উনাদের টেনে বের করার কারণে, উনাদের পুরো শরীরে কাদা মাটি লেপ্টে আছে। তাই মুখটাও অস্পষ্ট।
রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে তিনটে লাশকে ভালো করে দেখল। উনাদের মধ্যে একজন দাদীমা, মকবুল আর আরেকজন অচেনা মহিলা৷ অচেনা মহিলা হলেন মুনের মা।
রোদ উনাকে কখনো দেখে নি বিধায় চিনে না।
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে আলোর পাশে বসে যত্ন করে আলোর চোখের পানি মুছে দিলো। আলোর কান্নার কোনো শব্দ নেই! অথচ অঝরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। মেঘ আদুরে সুরে আলোকে বার বার কাঁদতে নিষেধ করছে। রোদ আলোর মনের অবস্থা বুঝে হাঁটু গেড়ে বসে আলোর মাথায় আলতো করে এক হাত রাখল। হঠাৎ মাথায় কারো ভরসার হাত পেয়ে আলো অশ্রুভেজা চোখে একবার তাকিয়ে, রোদকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। এই কান্নায় সে কষ্ট কমিয়ে বুকের দহন নেভাতে চাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে কই! কষ্ট তো বেড়েই চলেছে, অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলেই যাচ্ছে। আলোর কান্না দেখে মেঘও উঠে রোদের কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। শুধু রোদ পারছে না, ওদের কিছু বলতে আর না থামাতে। দু’জনেই ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে।
আলো কাঁদতে কাঁদতে রোদের শার্ট খামচে অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগল,
“আমার আর কেউ রইল না, কেউ না! দাদীমা, দাদীমা গো! আমাকে রেখে যেও না দাদীমা, আমি মরে যাব। সত্যিই মরে যাব। একা এই পৃথিবীতে আমি বাঁচতে পারব না? হে মাবুদ! তুমি আমার সব কেড়ে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে কেন, কেন? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না, কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব কষ্ট হচ্ছে। কষ্টে আমার দম আঁটকে যাচ্ছে। আমি কার জন্য বাঁচব গো আল্লাহ, কার জন্য!”
আলো এসব বলছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। ওর সাথে রোদ মেঘও নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ওরা খুব ভালো করে জানে কাছের মানুষগুলোকে হারানোর ব্যথা। এই অভিজ্ঞতা ওদের আছে বলেই, ওরা অনুভব করতে পারছে আলোর কষ্টটা। ওর বিলাপ করা আত্ননার্দের যন্ত্রণাটা। আলো কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে রোদের বুকের শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। রোদ তবুও কিছু বলছে না। শুধু আলতো করে আলোকে ওর বাহুডোরে আগলে রেখেছে।

To be continue…….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here