এলোকেশী’- [১৩]

0
536

-‘এলোকেশী’-
[১৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আলো কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে রোদের বুকে লুটিয়ে পড়ল। এত ধকল ওর শরীরেও আর কুলাচ্ছে না। রোদ আলোকে বুক থেকে সরিয়ে ওর গালে আস্তে করে টোকা দিয়ে ডাকতে লাগল। কিন্তু সাড়াশব্দ নেই! অতিরিক্ত কান্নার ফলে ওর ফর্সা মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে, মায়াবী চোখ দু’টোও বেশ ফুলে গেছে।
আলোর চোখ বন্ধ দেখে মেঘ শুকনো ঢোক গিলে এক পা পিছিয়ে গেলো৷ ওর আম্মুও এভাবে চোখ বন্ধ করে আর ফিরে আসে নি। ওকে একা ফেলে মাটির নিচে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। তাহলে বউমনিও আর ফিরবে না। মেঘ এসব ভেবে ভেজা চোখে পরপর কয়েকবার পলক ফেলে ঢোক গিলে বলল,
“দাভাই, বউমনি কী আমাদের সঙ্গে আর কথা বলবে না? মেলা রাগ করেছে? অনেক কষ্ট পেয়ে বউমনি আম্মুর কাছে চলে গেল?”
মেঘের একথা শুনে রোদ কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেলো না। অবুজ বাচ্চাটা কত কী ভেবে বসে আছে। যদিও সে নিজের চোখে ওর আম্মুর চলে যাওয়া দেখেছে, তাই হয়তো! রোদ মৃদু হেসে মেঘকে কাছে ডেকে সুন্দর করে বোঝাল, ‘বেশি কান্নার ফলে আলো জ্ঞান হারিয়েছে। একটুপরে আবার ঠিক হয়ে যাবে।’
রোদের কথা শুনে মেঘ শান্ত হয়ে বসে আলোর মুখের দিকে তাকাল। বউমনি সুস্থ হলে সে অনেক ভালোবাসবে৷ কখনো আর কষ্ট কষ্ট দিবে না, ভুলেও না! ওর আম্মু ওকে ফাঁকি দিয়েছে। বউমনিকে সে ফাঁকি দিতে দিবে না, কিছুতেই না। তারপর রোদ মেঘ বসিয়ে রেখে পানি এনে আলোর জ্ঞান ফিরালো। কালকে রাত থেকে কান্নার ফলে ওর দু’চোখের পাতা ফুলে ব্যাথায় টনটন করছে। পরনের হলুদ রংয়ের থামি কাদা পানিতে ভিজে শরীরেই শুকিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি থেমে একচিলতে রোদের দেখা মিলেছে। অদ্ভুত সুন্দর কাঁচা মিষ্টি রোদ! সেই রোদে না আছে তেজ আর না রুক্ষতা। প্রকৃতি যেন রাগ সামলে কেবল ক্ষান্ত হয়েছে। এখনো লাশ উদ্ধারের কাজ চলছে৷ ইত্যিমধ্যে অনেকের দাফন কার্যও সম্পূর্ণ করা হয়েছে। গত কাল রাত থেকে অতিরিক্ত কান্না আর অনাহারে থাকার ফলে ওর শরীরে কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। রোদ ব্যাপারটা বুঝে আলোকে একটু পানি খাইয়ে উঠে দাঁড় করাল। এবং তখনই পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেলো। পায়ের দিক থেকে প্যান্ট কিছুটা উপরে জড়ানোর কারণে ঠান্ডা কিছু সে খুব সহজে অনুভব করতে পেরেছে। তাই সে আলোকে ধরেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। আলোর কাদা লেপ্টানো ভেজা চুল ওর পায়ে ঠেকেছে। আর রোদ আলোকে খোঁপা করা অবস্থায় বেশি দেখছে। তাই ওর চুল এবং খোঁপা দেখে লম্বা কতটুকু অনুমান করা যায় নি। আর রোদ চেষ্টাও করে নি। কারণ একটা মেয়েকে খুঁটিয়ে দেখা মানে মনে নিষিদ্ধ অনুভূতিকে প্রশয় দেওয়া। তাছাড়া নারী লম্বা কেশই তো বেশ! এটা নিয়ে এত মত্ত হওয়ার কিছু নেই। আর হলেই সর্বনাশ! আলোর ভেজা খোলা চুল ওর হাঁটুর অনেকটা নিচে পড়ছে। ঘনত্বটা ভেজা চুলের জন্য তেমন বোঝা যাচ্ছে না।রোদ আপাতত সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আলোকে একটা গাছে নিচে বসিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেল। মেঘ চুপটি করে আলোর পাশে বসে আলোর হাতটা ওর হাতের মুঠোয় নিলো। আলোর ওর ছোট ছোট হাতে আদর দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে আবার কাঁদতে লাগল। এই হাত দু’টোও যেন ভরসার হাত, ওর পাশে থাকার নিদারুণ এক আহ্বান।

এখন সকাল পেরিয়ে দুপুর। লাশ দাফন করতে হবে। রোদ বেশ কয়েকজনের সাহায্যে তিনটে লাশের গোসল সম্পূর্ণ করল। আলো ওদের তিনজনকে কাফনে মোড়ানো দেখে আবার কাঁদতে লাগল। এদিকে লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। রোদ দুইজন মাঝবয়সী মহিলাকে ডেকে বিনয়ীভাবে আলোর খেয়াল রাখতে বলে মেঘকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আলো চিৎকার করে নিষেধ করছে উনাদের নিয়ে না যেতে। সে একা হয়ে যাবে। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর একরাশ নিঃসঙ্গতা ওকে গিলে খাবে। আলোকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সে ব্যাকুল হয়ে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। কার জন্যই বা কাঁদবে দরদের দাদীমা, বড় ভাইয়ের মতো মকবুল, নাকি মায়ের মতো বান্ধবীর মায়ের জন্য! তিনজনেই তো ওর খুব কাছের। তিনজনের শোকে জর্জরিত হয়ে ওর দমটা যেন আঁটকে আসছে। মস্তিষ্কটা একটু বিশ্রাম পেতে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। চোখ দু’টোও অবাধ্য হয়ে বুজে আসছে। একপর্যায়ে আলোর শরীরটা সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
এই নির্মম পরিস্থিতিতে সে বুঝতে অক্ষম, মানব দেহে প্রাণ না থাকলে শরীরের কোনো মূল্য থাকে না। প্রাণহীন সুন্দর শরীরটা তখন জমা পড়ে বাতিলের খাতায়। অবশেষে ঠাঁই মিলে তিন হাত মাটির নিচে অন্ধকার এক ঘরে। সেই ঘরেই শরীরের পঁচন ধরে পোকাদের খাদ্য হয়ে ধীরে ধীরে মিশে যায় মাটির সঙ্গে। আর এই কঠিন সত্য থেকে না কেউ বাঁচতে পারে, আর না কাউকে বাঁচাতে পারে। অথচ জীবিত থাকতে এই শরীর নিয়েই কত্ত বড়াই, কত্ত অহংকার!
বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগল তিনজনের দাফন কার্য সম্পূর্ন করতে। পরিস্থিতি মোতাবেক কখন কাকে প্রয়োজন হয় কেউ বলতে পারে না। উদাহরণস্বরুপ, দাদীমা একদিন বিপদের দিন রোদকে অাশ্রয় দিয়েছিলেন। আর আজ উনার কবরে প্রথম মাটি পড়ল রোদের হাত থেকে। কে জানত, এমন হবে!
তবুও তো হলো!
রোদ মেঘ ওইদিকের সব কাজ সেরে ফিরে এলো আলোর কাছে৷ আর এসে দেখে আলো জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর আশেপাশে কেউ নেই। যাদের রেখে গিয়েছিল তাদের চিহ্নটুকুও নেই। রোদ মহিলা দু’টোকে বিশ্রী একটা গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। পৃথিবীতে এতটা নিম্ন অমানবিক মানুষও তাহলে আছে, ছিঃ! মেঘ দৌড়ে গিয়ে আলোর গালে হাত দিয়ে আদুরে সুরে ডাকছে,
“বউমনি! ওহ্ বউমনি! আমরা ফিরে এসেছি, বউমনি!”
রোদ আলোর দিকে এক পা বাড়াতেই কয়েকজন লোক ওর পথ আটকে দাঁড়াল। সকাল থেকেই উনারা রোদকে লক্ষ্য করছিলেন। এই ছেলে কে? এর আগে তাকে কখনো দেখে নি, তাহলে? আর আলোর সাথে ওর কী সম্পর্ক? মূলত এসব জানতেই এই পরিস্থিতিতে ছুটে এসেছেন। উনাদের এভাবে পথ আটকানো দেখে রোদ ভ্রু কুঁচকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই ঝামেলা সৃষ্টি করবে। তাই রোদ আলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে মুচকি হেসে বলল,
” কিছু বলবেন?”
“আপনে কেদা? আলো আপনের কে হয়?”
“তেমন কেউ না। আর কিছু?”
কথাটা শুনে উনারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। রোদের কথাটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেউ না হলে ওর জন্য এতকিছু করছে কেন? নিশ্চয়ই কোনো কাহিনী আছে। তখন গ্রামের প্রধান বিচারক ওখানে উপস্থিত হলেন। এবং সুদর্শন একটা যুবককে দেখে পুরো ঘটনা বিস্তারিত জানলেন। তারপর সব শুনে অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“আপনে এহনই চইলা যান। এখানে আল কুনুদিন আছবেন না। তাছালা আমাদেল গেলামে বাইলেল মানুচ থাকতে পালে না। আল আলোল তো কঠিন শাছ্তি পাওনা আচে। ওলে আল ছাহায়্য করলে আপনেও শাছ্তি পাবেন।”
একথা শুনে রোদের কপালে সূক্ষ্ম ভাবে একটা চিন্তার ছাপ পড়ল। তবে সে কৌতূহল থামাতে না পেরে কথার ছলে জিজ্ঞাসা করল,
“শাস্তি কেন? ওর অপরাধ কী?”
“ওই কাইল লাইতে মকবুল্যালে নাকি ছাইলা দিছে। এজন্যি কঠিন শাছ্তি ছে পাবেই।”
কথাটা বলে উনি রেগে হনহন করে স্থান ত্যাগ করলে। এখন পুরো গ্রাম ঘুরে দেখে তারপর নাকি আলোর শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। রোদ ভ্রু কুঁচকে উনার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে, পুনরায় এক পা বাড়াবে তখন একজন মহিলা ওর পিছু ডাকলেন। রোদ উনাকে দেখে চট জলদি বলল,
“আন্টি ওই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে৷ আমি একটু পরে আপনার সঙ্গে কথা বলি?”
”না আব্বাজান, তুমি ছুদু আমাল এক্কখান কথা শুইনা যাও।”
“জি বলুন।”
“মাতবরের ব্যাডার লগে(বিচারক) আলোল নাকি বিয়া দিয়া দিবো। ওই ব্যাডা পাক্কা একখান জানুয়ার। শরীলে মানুচের ওক্ত নাই। বেডির মানুচের শরীলেল পুকা সে। তাছালা এই গেরামেও মেলা খারাপ খারাপ ছব নিয়ম-কানুম আছে বাপ, ছেছব তোমালে এহন কওয়া যাইবে না। তুমি আলোলে নিইয়া যাও বাজান। নাহলে এই ফুলেল মুতন বেডির কপালে মেলা কস্ত আছে। নিয়া যাও বাপ, তাড়াতাড়ি নিয়া যাও।”
কথাটা বলে উনি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অন্য রাস্তায় চলে গেলেন। রোদ দ্রুত পায়ে হেঁটে অনেক খুঁজে পানি এনে আলোর জ্ঞান ফেরাল। এই জায়গা এখন বেশ ফাঁকা। রোদ আলোকে ধরে উঠিয়ে বসাল। তারপর ওর দুই গালে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তাকাও, আর আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। তোমার আবেগকে সাইডে রেখে এখন মস্তিষ্ক খাটিয়ে কথাগুলো ভাবো। তুমি এখন একা! আর তোমাকে নিয়ে এখানকার অনেকে নোংরা পরিকল্পনা করছে। আমরা চলে গেলেই তারা তোমার উপরে হামলে পড়বে। তাছাড়া সবাই জেনে গেছে তুমি মকবুলের বাঁধন খুলেছো। ওরা এখন তোমাকে কঠিন শাস্তি দিতে চাচ্ছে।”
আলো একথা শুনে জোরপূর্বক হেসে বলল, “ভালোই তো হবে মরে যাব।”
রোদ নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে আলোর চোখে চোখ রেখে বলল,”ভীতুর মতো কথা বলো না। দাদীমা মারা গেছেন। আর উনার মাগফেরাত কামনা করার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে। এত বছর উনি তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এখন এটা করা তোমার মুখ্য দায়িত্ব। আলো এখন ব্যথিত হয়ে হাল ছেড়ে বিপদ ডেকো এনো না।”
“তাহলে কী করব?
“আমাদের সঙ্গে চলো। কথা দিচ্ছি, আমার দেহে প্রান থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিব না।”
রোদের একথা শুনে আলো ফ্যাল ফ্যাল ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। ওকে কিছু বলার সুযোগটুকু না দিয়ে রোদ মেঘকে বলল, আলোকে নিয়ে দ্রুত সামনে এগোতে। রোদের কথা শুনে মেঘ চট করে উঠে আলোকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
রোদও উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওই মহিলার দিকে একবার তাকাল। উনি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছেন। রোদকে তাকাতে দেখে উনি হাতের ইশারায় দ্রুত সরে যেতে বললেন। তাই রোদ আর দাঁড়াল না মেঘদের নিয়ে
রিসোর্টের পথে হাঁটা ধরল। এখানে এক সেকেন্ড থাকা মানে নিজেদের বিপদে ডেকে আনা।
এই গ্রামে অহরহ বিশ্রী নিয়ম-কানুন প্রচলিত আছে। সুন্দরী অল্প বয়সী কোনো মেয়ের স্বামী মারা গেলে, জোরপূর্বক হলেও মাতবর তাকে বিয়ে করেন। এবং তার সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়টুকু উনার কাছেই রাখেন। তারপর সেই সন্তান মেয়ে হলে তাকে বিশ্রীভাবে অপয়া খেতাব দেন। এবং ছেলে হলে উনার মর্জি মোতাবের উনার কাছেই রেখে দেন। অথবা সেই মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। এছাড়াও, এই গ্রামে সুন্দরী কোনো যুবতী থাকলে উনার ছেলে সিংহের মতো থাবা বসাতে দেরী করে না। সে ইজ্জত নিয়ে খোলায় বেশ পটু! রাতের আঁধারে এমনও হয় বাবা মাকে হুমকি দিয়ে সে যুবতিকে তুলে নিয়ে যায়। এবং ভোরের আজানের পর পর সেই মেয়েকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। আর এখানে অসহায় বাবা মায়ের কিছু করার থাকে না। শুধু নিরবে চোখের অশ্রু ফেলা ছাড়া। তবে আলো নজরকাড়া সুন্দরী হলেও কেউ কখনো ওর দিকে তাকানোর সাহস করে নি। কারণ কারো শক্তপোক্ত ছায়া অদৃশ্য ভাবে সর্বদা ওকে মায়াজালের মতো
ঘিরে রেখেছে। চুম্বকের মতো ওর সব বিপদ শুষে নিয়েছে।

To be continue……..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here