সুদর্শন শঙ্খচিল’ [১৯]

0
352

সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

মাত্র পঁচিশ মিনিটে তুয়ারা ঢাকা থেকে রাজশাহীতে পৌঁছে গেল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে মেসেজ করল,” আমরা পৌঁছে গেছি।”

পাঁচজন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অটোতে উঠে বসল। প্রত্যয়ের আব্বু অটো ওয়ালার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। চাঁদ আর তুয়া রাজশাহীর রাতের সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। শিক্ষার নগরী রাজশাহীর রাস্তা গুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে, যদিও তারা নিজ নিজ কাজের ব্যস্ত। লাইটের ঝলকানিতে পরিষ্কার পরিছন্ন রাজশাহী দেখতে বেশ লাগছে।
প্রত্যয়ের আব্বু তুয়া চাঁদকে ইশারা করে এটা ওটা দেখাচ্ছেন। প্রায় পনেরো মিনিট পর প্রিয়মরা ওদের বাড়ির গলিতে ঢুকল। এটা প্রিয়মদের নিজস্ব বাড়ি আর পাশের টা ওর ছোট চাচার বাড়ি। ওর চাচি ওদের বাড়িটা খুব সুন্দর গুছিয়ে পরিপাটি করে ওদের জন্য রান্নাও করে রেখেছেন।

প্রিয়মদের কে বাড়ির দরজায় ঢুকতে দেখে পাশের ছাদ থেকে এক ভাবি বললেন, “কি গো প্রত্যয়ের আম্মু মেয়ে দুইটা কে?” প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “আমার পুত্রবধূ।” ভাবিটা আর একটু ঝুঁকে তুয়া আর চাঁদকে পরখ করে বললেন, “লালডা নাকি কালোডা?”

উনার কথাটা শুনে তুয়া আর চাঁদ একে অপরের দিকে তাকাল। প্রিয়ম হাতের ট্রলি টা রেখে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওই ভাবিটা উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, “লালডা প্রত্যয়ের নাকি কালোডা?” প্রত্যয়ের আম্মু উনার কথা বুঝতে না পেরে তুয়াদের দিকে তাকালেন। তুয়া কালো রংয়ের ড্রেস পরিহিত আর চাঁদ লাল রংয়ের। এবার উনি ব্যাপারটা বুঝে হেসে বললেন, “কালোডা প্রত্যয়ের আর লালডা প্রিয়মের।”

প্রত্যয়ের আব্বু আর প্রিয়ম হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু ওই ভাবির সঙ্গে কথা বলছেন। উনাদের কথা শুনে চাঁদ তুয়াকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল, “এতকিছু থাকতে অবশেষে গরুর সঙ্গে তুলনা করল।”

তুয়া বিরবির করে বলল,” চাঁদ, আমরা যদি সত্যি গরু হতাম। তাহলে উনারা বলতেন কালো গরুটা প্রত্যয়ের আর লাল গরুটা প্রিয়মের। এখন গরুর খেতাব পেলাম তবে গরু হয়নি আমাদের ভাগ্য ভাল।”

কথাটা শুনে চাঁদ করুণ চোখে তুয়ার দিকে তাকাল। ওরা ভাবিটাকে কিছু বলতে পারল না। শুধু জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

প্রত্যয়ের চাচি তুয়া আর চাঁদকে রুম দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। তুয়া প্রত্যয়ের রুমে ঢুকে ট্রলি রেখে পুরো রুমে চোখ বুলালো। রুমে প্রত্যয়ের বেশ কয়েকটা ছবি টানানো আছে। তন্মধ্যে ডান দেওয়ালে ডক্টরের এপ্রোণ পড়ে গলায় থ্রোথোস্কোপ ঝুলিয়ে, দুই হাত বুকে আড়াআড়ি ভাবে রেখে প্রত্যয়ের একটা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখা। তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মুচকি হাসি। তুয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, “জনাব আপনাকে দেখতে বেশ লাগছে।”
ছবিটাতে প্রত্যয় মুচকি হেসে যেন তুয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।

তুয়া হিজাব খুলে রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। এটা যে কোনো ডক্টরের রুম বোঝাই যাচ্ছে। রুমের এক কোণে ইউনিক ডিজাইনের বইয়ের তাকে ইয়া মোটা মোটা বই সাজানো। ডাক্তারী সব জিনিসপত্রসহ পরিপাটি করে রুমটা সাজানো গুছানো। তুয়া ফ্রেশ হয়ে এসে ওর আম্মু সঙ্গে কথা বলল। তারপর প্রত্যয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি বলল, “পঁচা ছেলে হ্যাংলার মত তাকাবেন না।”

একটুপরে, প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদ তুয়াকে ডেকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখালেন। প্রিয়মের চাচীর সঙ্গে অনেক গল্প করে
রাতে খেয়ে যে যার রুমে শুতে চলে গেল।

**!!

প্রত্যয় যথাসময়ে প্যারিসে পৌঁছে রেস্ট নেওয়ার সময়টুকুও নিল না। ওর এক টিচারের চিকিৎসা করতেই সে মূলত এখানে এসেছে। উনার অবস্থাও এখন খুব একটা ভাল নয়। হার্ট ব্লক হয়ে যে কোনো মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। উনি আপাতত হসপিটালেই ভর্তি আছেন আর প্রত্যয় নিজে এসেছে উনার সঙ্গে দেখা করতে। প্রত্যয়ের উনার সব রিপোর্ট দেখে উনার দিকে তাকালেন। উনিও একজন কার্ডিওলজিষ্ট উনার থেকে কিছু লুকানো সম্ভব নয়। প্রত্যয়কে তাকাতে দেখে উনি প্যারিসের ভাষায় মৃদু হেসে বললেন, “ওয়াসিক, আমার অপারেশনটা তুমি নিজে করো। হতাশার কিছু নেই মৃত্যু তো আমাদের সৃষ্টিকর্তার হাতে।”

হার্ট ব্লকের প্রাথমিক অবস্থায় উনি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। মাঝখানে কয়েক বছর ভালোই ছিলেন কিন্তু গত ছয়মাস ধরে আবার সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবং বুঝেছে উনার হার্টে ব্লকের সংখ্যা বেশি হওয়াই রিং বসানোটা সুবিধাজনক হবে না। আর এক্ষেত্রে উনাকে বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। উনি প্রত্যয়কে এটাও জানালেন, সার্জারিটা রিস্কি তাই কেউ রাজি হচ্ছে না। অনেকে ভাবছে, বয়স বেড়েছে ধকলটা উনি সামলে উঠতে পারবেনা।

প্রত্যয় আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ওর লক্ষ্য স্থির করল। এবং জানাল কালকে সকাল ছয়টায় উনার অপারেশনটা সে করবে। একথা শুনে এর স্যার খুব খুশি হলেন। প্রত্যয় উনার থেকে বিদায় নিয়ে কালকে ওটি রেডি রাখার কথা জানিয়ে কেবিনে আসল। এই হসপিটালেই প্রত্যয়ের জন্য স্পেশাল কেবিন বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রত্যয়ের যে টেনশন হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। সকল টেনশনকে দূর করে প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে খেয়ে টানা কয়েক ঘন্টা নিশ্চিন্তে ঘুমাবে বলে ঠিক করল। তারপর কালকে সকালে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সার্জারি করতে যাবে।

পরেরদিন সকালে প্রত্যয় ওটির ড্রেস পড়ে ওটিতে ঢুকল। কয়েকজন ডক্টর আর নার্স আগেই সব রেডি করে রেখেছিলেন। প্রত্যয় নার্সকে ইশারায় কিছু বলল। তারপর ওর স্যারের সামনে বসে উনার হাতটা শক্ত করে ধরে মুচকি হেসে বললেন, “স্যার, দোয়া করবেন যেন সফল হতে পারি।”

স্যার প্রত্যয়ের গালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন, “আমার গর্ব হচ্ছে যে আমার ছাত্র আমার হার্ট অপারেশন করছে। আর হ্যাঁ ফল যেটাই আসুক ভাববে সৃষ্টিকর্তার মর্জি।”

কথাটা বলে উনি ধীরে ধীরে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলেন।অঙ্গানের ইনজেকশন পুশ করায় উনি অঙ্গান হয়ে গেলেন। উনার চোখের কার্ণিশ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, আর প্রত্যয়ের হাত থেকে উনার হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। প্রত্যয় উনার হাতটা সাইডে রেখে উনার মুখের দিকে তাকাল। তারপর সবাইকে কাজ শুরু করার ইশারা করল। ওটিতে অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা সম্পূৃর্ণ নিষেধ, এখানে মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে হাতের কাজ করতে হয়। প্রত্যয় হাতে গ্লোভস আর মুখে মাস্ক পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করে কাজ শুরু করল।

ওর স্যারের বাড়ির লোকেরা অশ্রু ঝরিয়ে ওটির বাইরে অপেক্ষা করছে। প্রত্যয় জানেনা উনাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারবে কি না। তবে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

**!!

ইচ্ছে সুস্থ হয়ে আজকে সকালে প্রত্যয়ের বাসায় এসেছে। ওর ছোট ছোট হাতে ফ্ল্যাটের দরজায় বারি মেরে ডাকছে, “প্রত্তুয়! প্রিউুম! দলজা খুলছ না কেনু? আমি বাসায় ঢুকব দলজা খুলে দাও। তুয়া আপু, তাঁদ আপু দরজা খুলে দাও। প্রত্তুয়ের আম্মু দলজা খুলে দাও।”

ইচ্ছের গলা শুনে তুরাগ বেরিয়ে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিলে। প্রত্যয়রা দরজা খুলছেনা দেখে ইচ্ছে কেঁদেও দিয়েছে। তুরাগ ইচ্ছের চোখ মুছে দিয়ে বলল, “ওরা কেউ বাসায় নেই।” ইচ্ছে ঠোঁটে ফুলিয়ে একহাত দিয়ে চোখ ডলে হেঁচকি তুলে বলল, “ওলা সব্বাই কুথায়?” তুরাগ ইচ্ছেকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে যেতে বলল,” ওরা সবাই রাজশাহীতে বেড়াতে গেছে কিছুদিন পর ফিরবে।” ইচ্ছে শব্দ করে কেঁদে বলল, “আমি লাজসাইতে বেলাতে যাব।”

তুরাগ ইচ্ছেকে ওর ফোনে টকিং টম বের করে দিল। কিন্তু সে ফোনটা নিচ্ছে বরং একমনে কেঁদেই যাচ্ছে। তুরাগ আর না পেরে ইচ্ছেকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে বের হল। আশেপাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে তুরাগ ইচ্ছেকে বলল, “ইচ্ছে আমি রাজশাহীর রাস্তা চিনতে পারছিনা। আমরাও মনে হয় এখন হারিয়ে গেছি।”

ইচ্ছে চমকে উঠে তুরাগের দিকে তাকিয়ে চুপ থেকে বলল, “প্রিউুমকে ফুন দাও।” এবার তুরাগ আড়চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বোকা সেজে দাঁড়িয়ে রইল। ইচ্ছে প্রচুর টাউট একটা বাচ্চা ওকে সহজে ঘোল খাওয়ানো যায় না। তুরাগ ফোন বের করে ওরই একটা বন্ধ সিমে কল দিয়ে ইচ্ছেকে ধরিয়ে দিল। ইচ্ছে ফোন বন্ধ পেয়ে মন খারাপ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “ওদের সাতে আল কথা বলব না। ওলা আমাকে মেলা দুঃখু দিসে।”

তুরাগ ইচ্ছেকে বুঝিয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে দু’জনে মিলে বাসায় ফিরল। ইচ্ছে পেছনে ফিরে তাকাও নি সোজা ওর বাসায় ঢুকে গেছে।

**!!

দুইদিন পর তুয়া মন ভার করে রুমে বসে আছে। এই দুইদিনে প্রত্যয়ের সঙ্গে ওর কোনো কথা হয়নি। প্রত্যয় ওর আম্মুকে শুধু ফোন করে শুধু জানিয়ে, সে খুব ব্যস্ত ফ্রি হয়ে ফোন দিবে। এতটুকু তাছাড়া প্রত্যয়ের কোনো খবরই তুয়া জানেনা। তুয়া প্রত্যয়ের ছবির দিকে অভিমান নিয়ে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরাল। ওর মনে প্রত্যয়ের প্রতি এক পাহাড় সমান অভিমান এসে জমেছে।

প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদকে নিয়ে পাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। তুয়া দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিল তাই আর ওকে ডাকেনি। প্রিয়ম এসে রুমের দরজায় নক করল, তুয়া শরীরে ওড়না জড়িয়ে প্রিয়মকে ভেতরে আসতে বলল। প্রিয়ম মুচকি হেসে তুয়াকে বলল, “দ্রুত রেডি হও আমরা দু’জন ঘুরতে যাব।” তুয়া চাঁদকে ডাকার কথা বললে প্রিয়ম নিষেধ করে দেয়। এবং প্রিয়মের জোরাজুরিতে তুয়া প্রিয়মের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়।

প্রিয়ম রাজশাহীর টি বাঁধে তুয়াকে ঘুরতে নিয়ে গেল। শান্তির নগরী রাজশাহীতে নিমিষেই মন ভাল হওয়ার মত এই জায়গাটি। অনেক মানুষ ঘুরতে এসেছে একটা বাচ্চা ছেলে খিলখিল করে হেসে, ওর বোনকে ধরার চেষ্টা করছে। ওর বোনটা ফোকলা দাঁতে হেসে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। পদ্মা নদীর পাড়ে টি বাঁধটি তৈরী করা হয়েছে। প্রিয়ম তুয়াকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় বসল। বিকেলের মৃদু বাতাসে এসে শরীরে লেগে মনটাও ঠান্ডা করে দিচ্ছে। নদীর ছোট ছোট ঢেউ এসে তীরে বারি খেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে।
তুয়ার চোখ বন্ধ করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “বাতাসের সঙ্গে মিষ্টি একটা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।”

নদীর ছলাৎ ছলাৎ পানি শব্দে দমকা বাতাস এসে তুয়া চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। প্রিয়ম তুয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তুয়া উঠে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটাহাটি করছে আর ওর উড়ন্ত চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে উঠছে। প্রিয়ম ওর ফোন বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তুয়া প্রিয়মকে ছবি তুলতে দেখে বলল, “পরে ছবিগুলো আমাকে দিয়ে দিবেন।”

প্রিয়ম হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে হাসল। প্রিয়ম তুয়ার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে সেও তুয়া সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত কন্ঠে বলল, “তুমি তো ধর্ষিতা নয় তুমিও জানো। তাহলে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলে কেন? আমার কাছে শেয়ার করতে পারো।”

তুয়া হাঁটা থামিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল। প্রিয়ম এর আগেও এই কথাটা বলেছে সেদিন তুয়া কিছু বলতে পারেনি। তাই আজকে কিছু বলার জন্য আগের স্থানে এসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বলল, “আপনি জানলেন কিভাবে?” প্রিয়ম দ্বিধাহীন ভাবে অকপটে বলল,” ভাইয়া বলেছে।”

প্রত্যয় প্রিয়মকে বলেছে কথাটা শুনে তুয়া অবাক হল। প্রত্যয়েরও তো জানার কথা না সে বা জানল কিভাবে? তুয়ার ভ্রু কুঁচকানো দেখে প্রিয়ম বলল, “যেদিন হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলে সেদিনই ভাইয়া তোমার সব রিপোর্ট দেখেছিল। একজন ধর্ষিতাকে বেশ কয়েকটা টেষ্ট করা হয় আর তাতে প্রমানও মিলে ধর্ষণ হওয়ার। কিন্তু তোমার বেলায় রিপোর্টে এসেছে,” সি ইজ নট রেপড।” অর্থাৎ তুমি কারো কাছে ধর্ষিতা হতে যাচ্ছিলে কিন্তু হওনি।”

তুয়া এই মুহূর্তে স্বীকার করল সে ধর্ষিতা নয়। আর ওই ছেলেগুলোর এটাই মূল লক্ষ্য ছিল। যে তাকে ধর্ষণ না করেও তার শরীরে ধর্ষিতার কলিমা লাগানো। এজন্যই তারা তাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে, জামা ছিঁড়ে দিয়েছে, ওকে থাপ্পড় মেরে ঠোঁটে কেটে দিয়েছে, ওর গলায় ইচ্ছেমত নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে, বিশ্রী ভাবে হেসে ওর হাত বেঁধে ওর কাঁধে,গালে, গলায় কামড় বসিয়েছে। তারপর রাস্তায় স্বজোরে ধাক্কা মেরে বলেছে,” এবার প্রমান কর তুই ধর্ষিতা নয়।”

তুয়া ওই অবস্থায় বাসায় ফিরার সময় অনেকজন কটু কথা বলেছে। কেউ কেউ ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে বলেছে, মরে যেতে। রাস্তার পথচারীরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। দুইজন ছেলে ওর পাশাপাশি হেঁটে বিশ্রীভাবে হেসে বলেছে, “আমাদের সঙ্গে আর একবার যাবি?” তুয়া কেঁদে কেঁদে ছেলে গুলোকে চিৎকার করে বলেছে, ”সে ধর্ষিতা নয়।”

কিন্তু তুয়ার কথা শুনে ছেলেগুলো নোংরা ভাবে হেসে বলেছে , ‘চোর মার খেয়ে বলে সে চোর নয় চুরি করেনি। তুইও দেখি এখনও একই বুলি আওড়াচ্ছিস। সে যাই হোক খাওয়া মাল খাওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই।”

কথাটা বলে ছেলে দুইটা হাসতে হাসতে চলে গেছে। তুয়ার মস্তিষ্কে তখন এটাই ঘুরছিল ধর্ষিতা না হয়েও তাকে শাস্তি পেতে হবে। সে কাউকে বোঝাতেও পারবেনা সে ধর্ষিতা নয়। শুধু নিজে সত্যি জেনে তো আর সবাইকে বিশ্বাস করানো যাবে না। এসব ভেবে একপর্যায়ে সেও মেনে নিয়েছিল, সে ধর্ষিতা। হাস্যকর ব্যাপার হলেও সত্যি ধর্ষিতা প্রমান করা সহজ হলেও, ধর্ষিতা নয় প্রমান করা সহজ নয়। শরীরে এত দাগ নিয়ে সে যদি বলত সে ধর্ষিতা না, তাহলে সবাই বলত সে মিথ্যা বলছে। জোর করে ধর্ষিতার কলিমা শরীরে লেপ্টে দিত। তাই অন্যের থেকে না নিয়ে তুয়া নিজেই মেনে নিয়েছিল সে ধর্ষিতা। আর প্রত্যয় সব জেনেও চুপ ছিল কারণ তখন কিছু বললে কেউ বিশ্বাস করত না। বরং সবাই বলত মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়ে সত্যিটা আড়াল করছে। মূলত এজন্যই প্রত্যয় বোকার মত জল ঘোলা না করে চুপ ছিল।

কথাগুলো বলতে বলতে তুয়া নিঃশব্দে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। প্রিয়ম বোঝাতে পারছেনা ওর বুকে তখন কেমন তোড়পাড় হচ্ছিল আর এখন কেমন হচ্ছে। চাঁদকে বাসায় নিয়ে আসার দিন রাতে প্রত্যয় ছাদে প্রিয়মকে শুধু এতটুকুই জানিয়েছিল, তুয়া ধর্ষিতা নয়। আর একথা মাত্র তিনজন জানে তুয়া, প্রত্যয় আর প্রিয়ম।

তুয়া দুরে দৃষ্টি রেখে কান্নারত কন্ঠে বলল,”প্রত্যয়ের প্রতি আমার ভালবাসাটা না ঠুনকো ছিল আর না আছে। মনের গহীনে ওকে হারানোর ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। জানিনা কেন মনে হচ্ছে প্রত্যয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আজকে দুইদিন ওর সঙ্গে কথা হয়নি। সে কবে ফিরবে? আর আদৌও ফিরবে কি না তাও জানিনা।”

তুয়ার বলা শেষ কথাটা শুনে প্রিয়ম আঁতকে উঠল। প্রত্যয় তো ওর মনের সব কথাও জানে, তাহলে কি প্রত্যয় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল? নাকি প্রিয়মের উপর রাগ করে এমন সিধান্ত নিল? এসব প্রশ্ন প্রিয়মের মাথায় এসে ভর করল। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে ওদেরকে কঠিন ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে। এসব ভেবে অজানা এক ভয়ে প্রিয়মের বুকটা কেঁপে উঠছে। প্রিয়ম সন্ধ্যায় পর পরই তুয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার চলে গেল।

প্রিয়ম ভাবছে সে সরাসরি প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলবে। তুয়াকে সে পায়নি ঠিক আছে, তারমানে এই না প্রত্যয়ের থেকে তুয়াকে কেড়ে নিবে। আর মূল কথা তুয়া জানেও না প্রিয়ম ওকে ভালবাসে। চিন্তিত হয়ে প্রিয়ম বেশ কয়েকবার প্রত্যয়কে ফোন দিল কিন্তু ফোন বন্ধ পেল। টেনশনে প্রিয়ম ঘামতে শুরু করেছে। প্রত্যয়ের সঙ্গে কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে না পেরে, প্রিয়ম ওর চুল মুঠো করে ধরে বিরবির করে বলল, “এমন ধ্বংস লীলা শুরু করো না, ভাইয়া। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।”

To be continue….!!
(আমি অনেক বড় করে গল্প দিলাম। তোমরাও অনেক বড় করে কমেন্ট করবা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here