-‘এলোকেশী কন্যা’-
[১৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
রোদের কথা শুনে আলোর মুখটা আরো মলিন হয়ে গেলো। সত্যিই তো, একা সামলাতে না পারলে চুল কেটে ফেলায় শ্রেয়। এতদিন নাহয় দাদীমা সব করে দিতো। এখন তো আর দাদীমা নেই! কে বা চুল পরিষ্কার করে যত্ন করে তেল লাগিয়ে বেঁধে দিয়ে বলবে,”হইল শান্তি? বাপ রে বাপ আমার জানডা শ্যাষ কইরা দিলো। খালি চুল, চুল,আর চুল!”
দাদীমা এসব নিয়ে রাগারাগি করে একটুপরে আদর করে আর ডাকবে না। সবচেয়ে সুন্দর থামিটা ওর জন্য তুলে রাখবে না। ওর পছন্দের খাবার কেউ দিলে না খেয়ে ওকে এনে দিবে না। জ্বর আসলে ঝাল করে আর মুড়ি মাখিয়ে দিবে না। এসব করার মানুষটাই তো চিরতরে হারিয়ে গেলো। কে বা করবে? এখন তো সে এতিম!
আর বরাবরই চুল হচ্ছে আলোর দূর্বল পয়েন্ট। দাদীমার মতো করে সে কখনোই যত্ন করতে পারবে না। তাই হয়তো চুলগুলোও আর থাকবে না। অযত্নে দিন দিন ঝরে পড়ে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া আপন মানুষ গুলোই তো স্বার্থপরের মতো ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, আর চুল তো চুলই!
এদিকে রোদ মুখে ওই কথাটা বললেও আলোর চুলে হাত দিয়ে বেশ অবাক হয়েছে। কারণ আলোর চুল যেমন ঘন তেমনি কুচকুচে কালো। রোদ নিজেই হাঁপিয়ে গেছে এত লম্বা চুলের কাদা ছুটাতে গিয়ে। কোনো রকম সে কাদা ধুয়ে আলোর চুলে শ্যাম্পু দিয়ে দিলো। আলো এর আগে কখনো চুলে শ্যাম্পু ব্যবহারে করে নি। এক ধরনের মাটি ব্যবহার করত। এখন রোদকে নিষেধ করার মন-মানসিকতা ওর নেই। তাই যা হচ্ছে চুপ করে সায় দিচ্ছে। হঠাৎ আলোর চোখে শ্যাম্পুর ফেনা ঢুকে চোখ জ্বলতে শুরু করল। রোদ ওর ছটফটানি খেয়াল করে চোখে পানির ঝাপটা দিতে বলল। আলো তাই করল। পরপর কয়েকবার শ্যাম্পু করিয়ে রোদ বাকিটুকু সম্পূর্ণ করতে বলে স্থান ত্যাগ করল। ওর যতটুকু করার চোখ সংযত রেখে করে দিয়েছে।
মেঘ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে শুয়ে রোদের ফোনে গেম খেলছে। ওর ট্যাবে চার্জ নেই, বন্ধ হয়ে ট্রলিতে পড়ে আছে। রোদ মেঘকে উঠে বসিয়ে তোয়ালে এনে মেঘের মাথা মুছিয়ে দিলো। তারপর উলট-পালট করে লাগানো মেঘের শার্টের বোতাম ঠিক করে দিলো। এলোমেলো চুল গুলোও আঁচড়ে দিলো। এর বিনিময়ে মেঘ রোদকে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো। রোদও প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে ওর রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার ওর্ডার করল।
একটুপরে, আলো গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সে কাঁচা হলুদ আর লাল রঙের সংমিশ্রণের একটা কামিজ পড়ছে। দেখতে বেশ লাগছে! থামিতে সে এতদিন অভ্যস্ত ছিলো। পূর্বে কখনো কামিজ না পড়াতে ওর একটু অস্বস্তি লাগছে। তবে ব্যাপারটা বুঝতে দিচ্ছে না। এদিকে ওর ভেজা চুলের পানি ঝরে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে ওর কোনো খেয়ালই নেই।
মেঘ আলোকে দেখে খেলা বন্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। থামির বদলে কামিজে আলোকে একটু অন্যরকম লাগছে। ঠিক শহরের মেয়েদের মতো। মেঘের তো আলোকে এভাবে দেখতে বেশ লাগছে। তখন রোদের সঙ্গে দুইজন ওয়েটার খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। রোদ সেগুলো রাখতে বললে ওয়েটার রেখে চলে গেলো। মেঘ কেন জানি মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে। মেঝেতে এত পানি দেখে রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোয়ালে এনে আলোর চুল মুছে দিলো। আগে মেঘকে নিয়ে হিমশিম খেতো এখন আরেকজন এসে জুটেছে। মেঘ মাথাটা আরো নিচু করে মুখে হাত দিয়ে হাসি আঁটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। ওকে এভাবে হাসতে দেখে আলো করুণ দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকাল। অর্থাৎ আমি মুছে নিতে পারব।
রোদ জবাব না দিয়ে চুল মুছে তোয়ালে নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। কে জানত, কারো চুল তাকে যত্ন করে মুছে দিতে হবে। তবুও হচ্ছে, একেই মনে হয় বলে ভাগ্য! তবে রোদ এতে মোটেও বিরক্ত হচ্ছে না। কারণ সে জানে, ওরা তিনজনেই এখন পরিস্থিতির শিকার। আর মেয়েটা তো কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ প্রায়। সেই সাথে ওর শরীরের কাঁপুনি তো আছেই।এমতাবস্থায় কীভাবেই বা মেয়েটাকে দায়িত্বহীনের মতো একা ছেড়ে দিবে। সে তো পারবে না। এসব ভেবে রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল। মেঘ আলোর মন খারাপ দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বউমনি, তোমার চুলগুলো কেটে আমাকে দিবা? আমার রুমের দোলনাটা না ছিঁড়ে গেছে। ওটা বাঁধতে নাকি মেলা মজবুত কিছুর দরকার। তোমার চুল দিয়ে বাঁধলে মনে হয় ভালোই হবে।”
মেঘের একথা শুনে আলো মলিন মুখে জোরপূর্বক হাসল। আলোকে হাসানোর জন্য মেঘ এরকম কতশত কথা বলছে, তার হিসাব নেই। মেঘের কাহিনী বুঝতে পেরে রোদও মুচকি হাসল। তারপর ওদের খেতে ডাকল। মেঘ লাফিয়ে গেলেও আলো উঠল না। দাদীমাকে ছাড়া সে কখনো খায় নি। আজ তো দাদীমা ওকে ছেড়ে চিরতরের জন্য চলে গেছে। তাছাড়া কষ্টগুলোও বেহায়ার মতো গলার কাছে এসে জটলা বেঁধে আছে। সে না চাইলেও, বার বার অশ্রুকণাগুলো অঝরে
ঝরে যাচ্ছে। আলোকে উঠতে না দেখে রোদের এবার খুব রাগ হলো। সে উঠে আলোকে টেনে দাঁড় করিয়ে খাবারের সামনে বসিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“প্রায় সাড়ে তিনঘন্টায় তোমাকে নিয়ে কীভাবে রাঙামাটিতে পৌঁছালাম তোমার ধারণা আছে? আমাদের জীবনের রিস্ক নিয়ে তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। এইটুকুন কী বুঝতে পারছ? এত দৌড় ঝাপের মধ্যে মেঘ সারাদিন কিচ্ছু খায়নি।তুমি না খেলে এখন সেও জেদ ধরবে! তাই বলছি, জেদটা না দেখলেই নয়?”
“দাভাই, বউমনিকে বকছো কেন?”
“মেঘ, আমি এখন প্রচন্ড রেগে আছি! তাই কথা না বাড়িয়ে দু’জনে খাওয়া শুরু করো।”
রোদের গম্ভীর কন্ঠ শুনে কেউ আর টু শব্দ করার সাহস করল না। মাথা নিচু করে নিজেদের প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করল। অহেতুক কথা বলে কেউ আপাতত ধমক খেতে রাজি না। রোদ শব্দহীন ভাবে মেঘের প্লেট নিয়ে ওকে খাইয়ে দিতে লাগল। নাহলে ড্রেস নষ্ট করতে মেঘের দুই মিনিট লাগবে না। খেতে না চাইলে সে মূলত এই কাজটাই বেশি করে। আলোর নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে খেতে গিয়ে একপর্যায়ে হেঁচকি উঠে গেলো। রোদ মেঘের মুখে খাবার দিয়ে দ্রুত আলোর দিকে পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে আলো মুখ তুলে দেখে রোদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কিছুটা ভয় নিয়েই পানি দিয়ে কয়েকবার খাবার গিলে খেলো। তাছাড়া গলা দিয়ে খাবার নামছে না। ওর অবস্থা দেখে রোদ শান্ত কন্ঠে খেতে নিষেধ করে কয়েকটা ওষুধ এগিয়ে দিলো। মাথাব্যথা, গ্যাস্টিক, আর জ্বরের ওষুধ। আলো সেগুলো হাতে নিয়ে বিনাবাক্যে খেয়ে উঠে পড়ল। মেঘেরও ততক্ষণে খাওয়া শেষ। রোদ খাবার নিয়ে কেবল খেতে যাবে, তখন কেউ এসে দরজায় স্বজোরে আঘাত করল। দরজার বাইরে অনেক জনের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। আলো আর মেঘ ভয় পেয়ে রোদের পেছনে লুকিয়ে ওর টি-শার্ট আঁকড়ে ধরল। কেউ বিশ্রীভাবে ওদের গালাগাল করছে। রোদ উঠতে গেলে আলো কাঁপতে কাঁপতে ওকে আঁকড়ে ধরে নিষেধ করছে। দরজা খুললেই ওদের ঘোর বিপদ। মাতবররা এখানকার খোঁজ পেলো কীভাবে? তাহলে কী ওদের কেউ ফলো করছিলো? এসব ভেবে রোদের কপালে চিন্তায় ভাঁজ ফুটে উঠল। ওদের এত কষ্ট তাহলে বিফলে গেল? আলো দরজার বাইরের চেচাঁমেচি শুনে ভয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রোদ ওকে কাঁদতে নিষেধ করলে শুনছে না, আবার ওকে ছাড়ছেও না। ভয়ে তো মেঘের অবস্থাও খুব খারাপ। তখন কেউ একজন স্বজোরে দরজায় লাথি মেরে পাহাড়ি ভাষায় বলল,
“দলজা খুল ছালা। আমাল বউলে নিয়ে ফুলতি (ফুর্তি) কলা। আইজ তোরে মেলে পুঁতে দিবো মা**।”
“বছ দলজা তাইলে ভাঙ্গি ফেলি? ওই কুত্তাল বাচ্চালে আইজ তাজা কবল(কবর) দিবো.”
“হুম, তাই কল।”
দরজা কয়েকজন মিলে ধাক্কা দিতেই রোদ সাইডে সরে আস্তে করে দরজা খুলে দিলো। তখন হুড়মুড় করে ছেলে গুলো রুমের মেঝেতে গিয়ে পড়ল। ব্যথা পেয়ে তাৎক্ষণিক উঠতে উঠতে একজন গিয়ে রোদের কলার চেপে ধরল। ওদের গলা ফাটানো চিৎকারে রিসোর্টেের সবাই ছুটে এসেছে। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। মেঘ সোফার পেছনে লুকিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। এদেরকে জঙ্গি ভেবে মেঘের অবস্থা আরো খারাপ। এরা দাভাইকে বকছে। তাহলে তাকেও খুব
কষ্ট দিবে। ওইদিনের মতো চড় মারবে, হাত কেটে দিবে, মুখে পাতা গুঁজে নাক চেপে ধরবে। ব্যথা পেয়ে কাঁদলে আবার চড় মারবে। এবার মনে হয় একেবারে মেরেই ফেলতে এসেছে। মেঘ মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে করুণ চোখে আলোর দিকে তাকাল। রোদের কলার চেপে ধরা দেখে আলো অতিরিক্ত টেনশনে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। মাতবরের লোকেরা অবশেষে ওর খোঁজ পেয়েই গেছে। অর্থাৎ ওর জীবনে আয়ূ এখানেই শেষ। আর যাই হোক, মাতববর ওকে সুন্দর ভাবে কখনোই বাঁচতে দিবে না। হয় ওকে খুবলে খাবে, নয়তো মৃত্যুদন্ড!
এদিকে রোদের সঙ্গে ছেলেগুলোর হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। অকারণে ওরা বিশ্রীভাবে গালাগালি করছে। রুমের জিনিস ভাংচুর করছে। দু’জনের হঠাৎ চোখ পড়ল মেঝেতে পড়া থাকা এক সুন্দরী যুবতীর দিকে। আলোকে দেখে দু’জন হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল। মেঘ ওদের দেখে ভয়ে আলোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
”না ,না, বউমনি! বউমনি বাঁচাও! যাব না, যাব না বউমনিই! আমি ভয় পাচ্ছি, তোমরা এদিকে এসো না। এসো না প্লিজ, দাভাই! দাভাই বাঁচাও!”
ছেলে দু’টো মেঘের কথায় খুব বিরক্ত হয়ে মেঘকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। মেঘ ছিঁটকে গিয়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। মূলত সোফার সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে মাথায় আঘাত পেয়েছে। হঠাৎ মেঘের কান্নার শব্দ শুনে রোদ সেদিকে তাকাতেই, একজন রোদের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিলো। রোদ এক পা পিছিয়ে নিজেকে সামলে স্ট্যাম্প কেড়ে নিয়ে সেই ছেলেকে পরপর দু’টো বসিয়ে দিলো। অন্যজন বাহাদুরি দেখিয়ে এগিয়ে এলে তাকেও দিলো।
রোদ ওদের বার বার বলছিলো, বসে নাহয় ঠান্ডা মাথায় কথা বলুক। এভাবে তো কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। কিন্তু ছেলেগুলো ওর কোনো কথায় শুনছিলো না। অহেতুক চেচাঁমেচি করে আরো ঝামেলা সৃষ্টি করছিলো। রোদ ওর শরীরের অসংখ্য আঘাত সহ্য করলেও, মেঘের কান্না সহ্য করতে পারে না। আর কেন জানি বার বার মেঘের উপরেই আঘাতগুলো এসে পড়ে। বাচ্চাটা এমনিতেই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। তার উপরে এদের অহেতুক চেচাঁমেচিতে মেঘ আরো ভয় পেয়ে চুপসে গেছে।
রোদের এভাবে মারাতে ব্যাপারটা আরো গোলমেলে হয়ে গেলো। পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে হাতের বাইরে চলে যেতে লাগল।
To be continue………!!