দেশলাই – ১৪

0
265

দেশলাই – ১৪

সকাল ছয়টা পয়তাল্লিশে ইলির ঘুম ভেঙে গেল। সচরাচর এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না সে৷ বাঁ হাতে ব্রাশ করতে করতে দরজা খুলে বাইরে যায়। প্রতিদিন ডান হাতেই ব্রাশ করে। আজ ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ আছে। কাল একটা বইয়ে পড়েছে ঘুম থেকে উঠে ব্যতিক্রমভাবে দাঁত ব্রাশ করলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে। তাই আজ বাঁ হাতে ব্রাশ করা। বাইরে কুয়াশা অনেক। শীতের আগমন ঘটেছে। ইলি বাড়ির উত্তরে গেল। সেখানে ফুলের বাগান। পাতায় পাতায় শিশির চিকচিক করছে। আঙুলের ডগা দিয়ে শিশির ছুঁয়ে চারদিকে তাকায় ইলি। আজ কোনো পাখির নড়াচড়া নেই। ঘটনা কি? পাখিরা হরতাল ডেকেছে না-কি? অন্যদিন চড়ুই পাখির কিচিরমিচির ছাড়াও নানান পাখিদের ডাক শোনা যায়। শীতে বোধহয় তারা গৃহ ত্যাগ করে বের হয় না। ‘উফ’ করে আর্তনাদ করলো ইলি। বাঁ হাতে ব্রাশ করতে যেয়ে মাড়িতে লেগেছে। রক্ত বেরুল কি-না কে জানে। ইলি পুকুরে চলে গেল। শানবাঁধানো পুকুরে পরিষ্কার পানি। চারপাশে সারি সারি সুপারি আর নারিকেল গাছ। আচ্ছা, প্রায় সকল পুকুর পারে এই দুই ধরনের গাছ থাকবেই কেন? পুকুরের কোণায় বাঁশঝাড়। কয়েকটা সাদা বক সেখান থেকে উড়ে গেল। ইলির ভালো লাগছে। ভোরে ঘুম থেকে এর আগে একদিন উঠে পুরো দিন মেজাজ খিটখিটে ছিল। কিন্তু আজ ফুরফুরে লাগছে। মুখ ধুয়ে ইলি উঠে দাঁড়ায়। বাউন্ডারিতে এখন একটা কাক দেখা যাচ্ছে। মন খারাপ করে বসা সে। কাক হচ্ছে পুরুষ মানুষদের মতো গুমরা মুখো প্রাণী৷ সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থাকবে। ইলি ঘরে ফিরে এলো। রাফসান ভাই আজ শ্রীমঙ্গল যাবে তো? কে জানে। মোবাইল বের করে রোজকার মতো একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে তাল মিলিয়ে গুনগুন শুরু করল। রবীন্দ্র সঙ্গীত হচ্ছে মন প্রশান্তি আর শীতল করার এন্টিবায়োটিক ওষুধ। স্রষ্টা প্রথমে পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়ালেন চাঁদ, বৃষ্টি, পাখি, পাহাড়, গাছগাছালি আর নদী দিয়ে। তারপর মানুষের মধ্যে দিলেন কবি-সাহিত্যিক আর গায়ক। যারা মানুষকে মূল জিনিসটাই দিয়ে দেয়। সেটা হচ্ছে, মনের শান্তি, আনন্দ। কারণ মানুষ পৃথিবীতে যতকিছুই করে সবই এই চিত্তের জন্য। সুখ, শান্তি আর আনন্দের জন্য। টাকা-পয়সা সকল কিছুর প্রয়োজন এই মনের জন্য। দেহের জন্য।
তবে চিত্ত বিনোদনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার লেখকরা। তাদের উপর সকল চিত্ত বিনোদন নির্ভরশীল। সিনেমা, নাটক, গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস সবকিছুর পেছনে একজন লেখক থাকেন। ইলির ধারণা লেখক এবং গায়করা আল্লাহর এক অপরুপ সৃষ্টি। এরা এই পৃথিবীকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছেন। দুঃখ-কষ্ট আর ব্যস্ততার চাপাকলে খানিক শান্তির জন্য মানুষ যেমন ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে। ছুটে যায় কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সিলেট। বিশ্বাসীরা ছুটে যায় মসজিদ, মন্দির, গির্জায়। তেমনই মনের খোরাকের জন্য ছুটে যায় লেখকের কাছে, লেখকেরই গল্পের সিনেমা, নাটকের কাছে। ডুব দেয় কবিতা, গল্প, উপন্যাসে। কবির কথায়, গায়কের সুরে গান শুনে ক্ষনিকের জন্য হলেও সবকিছু ভুলে হারিয়ে যায় সুখ শান্তির এক বিচ্ছিন্ন ভুবনে।
ইলি উত্তরের জানালাটা খুলে দিলো। ঘরে মৃদু সাউন্ডে চলছে, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে…।’

ইলি হঠাৎ গানটি বন্ধ করে দেয়। এখন ঘড়ি সাতটা ছাব্বিশ। রান্নাঘরে চলে যায় সে। নাস্তা কি বানাবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ রাধুনি সাজতে গেলে যা হয়। চা বসালো একপাশে। বয়ামে নুডলস আর ডিম পাওয়া গেল। কুচিকুচি করে কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ কেটে নেয়। টমেটো দরকার। কিন্তু কোথাও টমেটো পাওয়া গেল না। এক মিনিট হাঁটলে সবজি ক্ষেত আছে। উঠে গেল ইলি। সবুজ ঘাসে শিশির জমেছে। চটিজুতোর উপর দিয়ে পা ভিজে পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে গেছে। লাল টকটকে কয়েকটি টমেটো নিয়ে এলো। ক্ষেতে শসাও আছে। কিন্তু নুডলসে শসা দেয়া যায় কি-না মনে করতে পারছে না। টমেটো নিয়ে চলে এলো ইলি। খুব যত্ন করে নুডলস বানিয়ে মা-বাবাকে ডেকে চা-নাস্তা দিল। বাকি সব টিফিনে ভরে ফ্ল্যাক্সে চা নিয়ে কালো পলিথিনে ভরে
মা’কে গিয়ে বলল, ‘রাফসান ভাইদের বাড়িতে যাচ্ছি। রাগ করে বসে আছে কি-না দেখি। শ্রীমঙ্গলও যাবে বলেছিল।’

– ‘তোর অশান্তি শুরু হইছে কেন বলতো?’

– ‘নুডলস কেমন হইছে?’

– ‘লবণ কম।’

– ‘কম বেশি যাইহোক। এমনিতেই যেতাম তাই নিচ্ছি।’

ইলি হাঁটতে লাগল। বাচ্চারা মক্তব থেকে ফিরছে। বাড়ির সামনে গিয়ে ইলি বিব্রতবোধ করছে। চাচিরা কি বলবে কে জানে! বলতে হবে মা নুডলস পাঠিয়েছে।
কিন্তু তার কিছুই হলো না৷ বাইরে কেউ নেই। রাফসান ভাইয়েরও দরজা বন্ধ। দরজায় কয়েক বার ডাক দিলো। ছোট চাচি তাদের ঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘ইলি না-কি রে?’

– ‘হ্যাঁ।’

হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দিলো রাফসান।

– ‘কিরে ইলি তুই?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘ভেতরে আয়।’

ইলি ভেতরে গেল। কেমন একটা গন্ধ। পলিথিনের ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘মা পাঠিয়েছেন।’

– ‘কি এটা?’

– ‘খুলে দেখো।’ কথাটি বলে ইলি ঘরের জানালাটি খুলে দিলো।

– ‘ঝাড়ু কোথায় রাফসান ভাই?’

– ‘কেন, তুই ঝাড়ু দিবি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তুই না কোনো কাজ-কাম পারিস না৷ মামী একা একা সব করেন।’

– ‘এখন অল্প অল্প পারি।’

– ‘শ্বশুর বাড়ির জন্য প্রস্তুতি না-কি?’

– ‘কচু, ঝাড়ু কোথায় বলো।’

– ‘জানি না। চাচিকে জিজ্ঞেস কর।’

– ‘লাগবে না।’

– ‘কেন?

– ‘মানে চাচিকে গিয়ে আমি যদি বলি ঝাড়ুটা দাও রাফসান ভাইয়ের ঘর ঝাড়ু দেবো তাতে চাচি অপমানবোধ করবেন।’

– ‘কেন?’

– ‘এসব বুঝবে না। এখন তুমি দাঁত ব্রাশ করে আসো। আমি প্লেট আর কাপ আনি। আমিও খেয়ে আসিনি দেরি হবে ভেবে।’

– ‘ও আচ্ছা।’

রাফসান ব্রাশ হাতে বাইরে গেল। ইলি বিছানা বালিশ খানিক ঝেড়েঝুড়ে আলনার কাপড় গুছিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দু’টা কাপ আর প্লেট ধুয়ে নিয়ে এলো। গতকাল যা ভেবেছিল সেরকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাফসান ভাই খুব বেশি রাগ করেনি। করলেও ভুলে গেছে।
প্লেটে নুডলস আর কাপ দু’টাতে চা ঢেলে নেয়। রাফসান এসে আলনায় রাখা লুঙ্গিতে মুখ-হাত মুছে নিচ্ছে দেখে ইলি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলতে যেয়েও আঁটকে যায়৷ সন্ধ্যার মতো আবার রাগারাগি হোক সে চায় না। ইলি চা নিয়ে পালঙ্কে বসে বলল, ‘তুমি টেবিলেই বসো। টিফিনে আরও নুডলস আছে তুমি না নিলে পিচ্চিকে ডেকে দিয়ে দাও।’

– ‘না আমার আর লাগবে না৷ দাঁড়া দিয়ে আসি।’

রাফসান বাইরে গিয়ে খানিক পর আবার ফিরে এলো।
ইলি চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলল,
– ‘কখন বেরুবে?’

– ‘আমি রেডি হয়ে আসছি তোদের বাড়ি। তারপর তোর যতক্ষণ লাগবে।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘মামা কি আমার উপর রেগে আছেন রে?’

– ‘থাকারই কথা।’

– ‘কেন?’

– ‘বললে তোমার অযথাই মন খারাপ হবে। কিছু মানুষ আছে নিজের ভুল দেখতে পায় না। তুমিও তার মাঝে একজন।’

– ‘হুম, ঠিকই বলেছিস। তবে এখন একটু মনে হয় বুঝি।’

– ‘সেই বোঝাটা ভুলের তুলনায় খুব কম।’

– ‘তুইও আমার উপর রেগে আছিস মনে হয়।’

– ‘দুঃখজনক হলেও সত্য। মামাতো বোন হিসেবে তোমার অবনতি দেখে তো আমার রাগ হতেই পারে।’

– ‘রাগ হবে কেন। দুঃখ হতে পারে।’

– ‘তুমি নিজেই নিজের অবনতির কারণ তাই রাগ হয়, দুঃখ না।’

– ‘তুই সত্যিই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস ইলি। এখন ‘তুই’ করে বলতেও নিজের মুখে বাঁধে।’

ইলি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘তাইলে তুমি করেই বলবে। আপু ডাকবে।’

– ‘ভালোই তো। তোর বরকে দুলাভাই ডাকবো।’

– ‘আচ্ছা।’

ইলি নিজের খাবার শেষ করে রাফসানের চাচির ঘরে গেল। দু’জন চাচি রান্নাঘরে বসে গল্প করছেন।
ইলি যেতেই বড়ো চাচি নাহেরা বেগম বললেন, ‘কি গো ইলি। পাগলের অবস্থা দেখেছো?’

পাগল শুনে ইলির মেজাজ খারাপ হলেও স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘এখন তো পাগল না৷ ভালোই আছে দেখলাম।’

– ‘পাগল থেকে ভালো হয়ে গেছে দেখে তো চাচারা বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু হলো কি? বউ রেখে কোথায় গেল খুঁজ-খবর নাই। বলি সে কি মরে গেছিল বলো? একটা দিন তো ফোন দিয়েও মায়ের লগে ভালো-খারাপ কথা বলতে পারতো, বলো পারতো না?’

– ‘হ্যাঁ তা ঠিক।’

– ‘এইখানে বসো। দুই-একটা কথা বলি। দুঃখ লাগে বঝছো ইলি? দুঃখ লাগে৷ এই পোলার জন্য চাচারা কি না করলো, বলো? এই অভাবের সংসারে তাকে সিলেট রেখে পড়তে দেয়া হলো। এই অঞ্চলের কলেজে নবাবজাদার ভালো লাগে না। কথামতো চাচারাও দিলেন সিলেট। দুইটা বছর প্রতি মাসে সাত হাজার করে টাকা দিতেন। থাকা-খাওয়া আর কত কি লাগে। কিন্তু ওই পোলা করলো কি? কোন এক মাগীর লগ পাইয়া পড়ালেখা ছাইড়া পাগল হয়ে গেলো। সবই আমরা বুঝি মা। বাতাসে চুল পাকেনি। মাও মরছে পোলার যন্ত্রণায় বুঝলে? বাপ নাই ছেলে সে কি বুঝবে না চাচারা টাকা দিয়ে পড়াইচ্ছে মনযোগ দিয়া পড়ি। চাচারা বিয়ে করাইছে। এখন বউয়ের বাচ্চা হবে না। কি করা যায় মুরব্বিরা দেখবে৷ সে বাড়ি ছেড়ে যাবে কেন?’

ইলি কি বলবে ভেবে পেল না৷ এসব কথায় কি বলতে হয় সে জানে না৷ তবে এটা ঠিক, চাচি সবই সত্য বলেছেন।

ছোট চাচি মারিয়া বেগম বললেন, ‘বাদ দাও ভাবী৷ সে কি করবে। তাকে শুনিয়ে লাভ নাই।’

– ‘এমনিতেই বললাম। পোলারে গিয়ে তো বলা যায় না৷ আবার যদি পাগল হয়ে যায়৷ আচ্ছা ইলি মা, তুমি কিছু মনে করো না।’

– ‘না চাচি৷ ঠিক আছে। আচ্ছা আমি যাচ্ছি।’

ইলি বাইরে এলো। তার খারাপ লাগছে। সে জানে রাফসান ভাইয়ের এই ছোট্ট জীবনটা ভুলে ভরা। তবুও কেউ তাকে কিছু বললে ইলির ভালো লাগে না। টিফিন আনতে আর রাফসানের রুমে গেল না ইলি। বাড়ি থেকে নেমে মাঠের দিকে হাঁটতে লাগল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here