আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ৮ম পর্ব

0
157

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৮ম পর্ব
.
স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় সায়মার চটিজুতা ছিঁড়ে গেল৷ পুরোটা পথ কি যে লজ্জা করছিল। পা টেনে টেনে তাকে হাঁটতে হয়েছে। ছেলেরা তাকিয়ে রহস্য করে হেসেছে। ন্যাকা মেয়েরা মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে যেন পড়ে যাচ্ছে। ফ্যাসফ্যাস করে কান্না পাচ্ছিল সায়মার। লোকজন দেখে ফেলবে তাই আঁটকে রেখেছে। খেয়া নৌকায় বসে তো একটুর জন্য কাঁদেনি। বাড়িতে ঢোকার সময় দেখল পূবের ঘরের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন বাবা। দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট জ্বলছে। পাশের চেয়ারে বসা আগামীতে মেম্বার পদপ্রার্থী আখলাছুর রহমান।
সায়মা বই রেখে খালি পায়ে পূবের ঘরের বারান্দায় গেল। বাবাকে জুতোর কথা বলতে হবে। না হলে কাল স্কুলে যেতে পারবে না।
তাছাড়া সন্ধ্যায় স্যারও জিজ্ঞেস করতে পারেন অন্তরার পড়ার ব্যাপারে বাবাকে বলেছে কি-না৷

সায়মা আমতা আমতা করে বলল,

— ‘বাবা অন্তরা আপুকে কাল থেকে পড়তে পাঠাব স্যারের কাছে। আর আজকে বাজার থেকে আমার জন্য জুতা আনতে হবে৷ আগের জোড়া ছিঁড়ে গেছে।

— ‘আচ্ছা যা এখন।’ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বিদায় করে সম্ভাব্য মেম্বারের সঙ্গে আবার আলাপ শুরু করলেন। পুরো ইউনিয়নের গাঁজার ব্যবসা সম্পর্কে জরুরী আলাপ। সায়মা চলে গেল অন্তরার খুঁজে।

অন্তরা লাকড়ি ঘর থেকে মুইট্টা টেনে বের করছে৷

— ‘আপু আমার কাছেও দাও তো মুইট্টা।’

— ‘তুই ফারতে নায়। আমি নিরাম।’

— ‘না, আপু দাও পারব।’

সত্যিই দু’জন মিলে মুইট্টা আনল রান্নাঘরে। সায়মার কাপড়ে ময়লা লেগে হুলুস্থুল কারবার৷ অন্তরা ঝেড়েজুড়ে দিচ্ছে।

সায়মা টেনে তুলে গাল ফুলিয়ে বলল,

-‘আপু জড়িয়ে ধরবো সোজা হয়ে দাঁড়াও।’

অন্তরা ফিক করে হেঁসে বলল,

–‘আমার বইনের আসকে কিতা অইল।’

— ‘কিচ্ছু না’ বলেই শক্ত করে ধরল সায়মা।

খানিক্ষণ পর অন্তরা মুচকি হেঁসে বলল,

— ‘এবলা তো ছাড়। মুয়া বন্ধ অইযার আমার।’ ( ছাড় এবার, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে)

সায়মা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

–‘তুমি ভাবছো তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি?’

— ‘তে খারে ধরছত?’

— ‘কানে কানে বলি।’

— ‘আচ্ছা খ।’

–…।

অন্তরা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,

–‘ছি ছি সায়মা। তোর শরম লজ্জা এখেবারে গেছেগি।’

সায়মা হাসতে হাসতে বারংবার নুইয়ে পড়ছে। অন্তরা মাটির চুলোয় আগুন ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সায়মা খাট নিয়ে পাশে বসে রাস্তায় জুতো ছিঁড়ার বিড়ম্বনার গল্প করে একপর্যায়ে বলল,

–‘আপু আব্বাকে বলেছি আমি। কাল থেকে তুমি স্যারের কাছে পড়তে যাবে।’

অন্তরা অবাক হয়ে বলল,

–‘কিতা?’

— ‘কাল থেকে পড়তে যাবে। স্যার নিজে বলেছেন।’

— ‘আমি কুস্তা জানি না কিতা ফরমু গিয়া।’

— ‘স্যার জানেন কীভাবে পড়াবেন। তুমি শুধু কখন যাবে সেটা ঠিক করো। আমার সঙ্গে সন্ধ্যায় না-কি ফজরের বাদে।’

— ‘হাঞ্জাবালা তো খাম থাখে।’ ( সন্ধ্যায় তো কাজ থাকে)

— ‘তাহলে ফজরের বাদে যাও।’

— ‘আইচ্ছা।’

— ‘তোমাকে না বললাম শুদ্ধ করে কথা বলতে। এখন থেকে শুদ্ধ করে কথা বলতে হবে। বক্কর ভাইও শুদ্ধ করে কথা বলা শিখে ফেলছে।’

— ‘আইচ্ছা সিকমু।’

রাতে আর অন্তরার চোখে ঘুম এলো না। কতকিছু যে সে ভাবল। রাত দু’টার দিকে খানিকটা ঘুম এলো৷ ফজরের আজান শুনে আবার ধড়ফড়িয়ে উঠলো। কল থেকে অযু করে এসে নামাজ পড়ে নিল। রুমের জানালা খুলে অপেক্ষায় রইল কখন স্যার নামাজ পড়ে আসেন। দেখতে দেখতে রাতের আবছা অন্ধকার কেটে ফুরফুরে মেজাজের ভোর৷ খানিক পরই দেখতে পেল স্যার এবং চাচা একসঙ্গে ফিরছেন। অন্তরা ঠিক করে নিল চাচার সামনে দিয়ে সে পড়তে যাবে না৷ তাতে অস্বস্তি লাগবে। এর চাইতে তিনি এসে ঘুমিয়ে গেলে যাবে।
যেরকম ভাবনা সেরকমই হল। খানিক্ষণ পর সে বিব্রত ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভেঙে যেতে লাগল। যেন চুরি করতে যাচ্ছে। কেমন অপরাধী অপরাধী লাগছে নিজেকে৷ দরজার সামনে গিয়ে কি করবে। কীভাবে ঢুকবে খুঁজে পাচ্ছিল না।

— ‘ভেতরে আসুন।’

চমকে গেল অন্তরা, আশ্চর্য! লোকটি দেখে ফেলল কীভাবে?

— ‘ভেতরে আসুন। কাজের মেয়েদের এতো লজ্জা থাকে না-কি?’

কি অপমান! জলে চোখ ভরে এলো অন্তরার। লোকটি তার সঙ্গে এতো খারাপ আচরণ করে কেন? একবার ইচ্ছে হল চলে যায়। আবার মনে হল সায়মা জানলে রেগে যেতে পারে। মাথা নীচু করে প্রবেশ করল অন্তরা।

— ‘চেহারা দেখেও কাজের মেয়ে লাগে’ এটুকু বলে থামে, রহস্য করে অন্তরার দিকে তাকায়।
অন্তরা আহত চোখে মাথা তুললে চার চোখের মিলন হয়। তখনই জিসান বাক্যের শেষ শব্দটি সম্পূর্ণ করল, -‘না। মানে বলতে চাইছি চেহারা দেখে কাজের মেয়ে লাগে না। আরবীয়ান কোনো সুন্দরী রমনী মনে হয়।’

লোকটি কি রসিকতা করার চেষ্টা করছে? অন্তরা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে দাঁড়িয়েই রইল।

— ‘আমরা চেয়ার-টেবিলে না বসে বিছানায় বসলে ভালো হবে। কারণ আপনার হাত ধরে স্লেটে লেখা শেখাতে হবে।’

অন্তরার বুক কেঁপে উঠলো। ধুকপুক করছে। ভেতর বসে যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। লোকটি আবার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না তো? হঠাৎ যদি বলে ফেলে এই মেয়ে তোমার বুকের ভেতর ইট ভাঙে কে?

জিসান পলিথিনের ব্যাগ থেকে ইংলিশ বাংলার রঙিন বর্ণমালা বই এবং চক-স্লেট বের করে বিছানায় রেখে বলল,

— ‘আসুন।’

লজ্জা, দ্বিধা, আগ্রহ এমন অনেক রকম মিশ্র অনূভুতি নিয়ে অন্তরা রঙিন বইটির দিকে তাকিয়ে পা টিপে টিপে বিছানায় গিয়ে বসে।
জিসান প্রথমে বাংলা বর্ণমালা বের করে পড়াতে লাগে। অন্তরার অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়।

বেশ কয়েক মাস ভালোই কেটে গেল। অন্তরা ততদিনে জিসানের নির্দেশে শুদ্ধ করে কথা বলাও ধরতে হয়েছে। পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের টুকটাক কথাবার্তাও হয়। অন্তরাও ততদিনে জিসানের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক হয়েছে। অবশ্য তাতে জিসানের কলা-কৌশলেরই অবদান বেশি। ফজরের নামাজ পড়ে এসে চেয়ারম্যান সাহেব ঘুমিয়ে যান। সায়মা এমনিতেই দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। এসবের সুযোগে এই ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ক এক জটিল জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার একটি নমুনা নিচের কথোপকথনেই ধরা পড়বে।

জিসান সেদিন জিজ্ঞেস করল,

— ‘আচ্ছা অন্তরা। তোমার কি মা-বাবার কথা কিছু মনে-টনে আছে?’

— ‘আবছা মনে আছে স্যার।’

— ‘আবার স্যার! একদিন না বললাম আড়ালে-আবডালে আমাকে জিসান বলে ডাকবে। আমি তোমার একমাত্র বন্ধু। ঠিকাছে? না-কি আরও বন্ধু-টন্ধু আছে তোমার।’

— ‘এহ, আমার বন্ধু কোত্থেকে আসবে?’

— ‘তোমাকে পরপুরুষ দেখলে ঠিকই বন্ধু হওয়ার জন্য কুকুরের মতো ঘুরে বেড়াত।’

অন্তরা মুখে হাত দিয়ে প্রথমে ফিক করে হেঁসে ফেলে, তারপর সিরিয়াস মুখে বলল,

–‘ছি ছি মুখে ভালা কথা নাই। কুকুরের মতো ঘুরে বেড়াবে বলতে হয় না-কি।’

জিসান আচমকা অপ্রাসঙ্গিকভাবে রহস্য করে বলল,

— ‘কখনও কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনেছো।’

— ‘ওমা শুনব না কেন?’

— ‘একটু আগে যে মুখে হাত দিয়ে মিষ্টি করে হাসলে। দয়া করে এভাবে হেঁসো না। কারও হৃদয় কাচের মতো ভেঙে খানখান হয়ে যায়৷ তোমার হাসি হচ্ছে এক অদ্ভুত মারণাস্ত্র। কেউ একজন সেই হাসিতে জীবন্ত খুন হয়ে যায়।’

অন্তরা দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল,

— ‘আপনি এরকম কথা বললে কিন্তু আমি আর পড়তে আসব না।’

জিসান ভালো করেই জানে। নারীর হৃদয় আর মুখের কথার মিল কোনো কালেই ছিল না। সে আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে বলল,

— ‘না এসে থাকতে পারলে আসবে না। তবে যতক্ষণ আছো মুখ থেকে হাত সরিয়ে বসো।’

— ‘মুখ থেকে কীভাবে হাত সরাব। আপনি এমন এমন কথা বলেন আমার শরম লাগে।’

— ‘আমি কেমন কেমন কথা বলি?’

— ‘কেমন যেন।’

— ‘কেমন যেনটা কি?’

— ‘পঁচা পঁচা কথা।’

— ‘আচ্ছা পঁচা কথা আর বলছি না।’ তারপর টেবিলের উপর থেকে একটা কাগজ এনে বলল, ‘এটা পড়।’

অন্তরা ততদিনে পুরোপুরি রিডিং পড়া শিখে ফেলেছে। সে শব্দ করে পড়ল,
‘প্রিয় অন্তরা, তুমি নারী হবার পর থেকে হৃদয়ে দাউদাউ করা যে ফাগুনের আগুন টের পাও,
সেই আগুন নেভানোর জন্য আমি বুকে এক সমুদ্র প্রণয় নিয়ে ঘুরি।
তুমি ওম বালিশে মাথা পেতে আপন মনে যৌবনের শুরু থেকে আজ অবধি যতপ্রকার চক্রান্তের আয়োজন এঁটে রেখেছো আমি স্বেচ্ছায় সেই চক্রান্তে আক্রান্ত হতে চাই।’

অন্তরা পড়ার পর বলল,

— ‘এসব কি?’

— ‘কি সেটা তো লেখাই আছে। বুঝনি তুমি?’

— ‘বুঝিনি, কিন্তু পঁচা পঁচা কথা বুঝাই যাচ্ছে।’

— ‘এইটার লেখক নিজেই একটা পঁচা।’

— ‘লেখকটা আবার কে?’

— ‘এক লেখক বন্ধু আছে আমার। নাম বললে চিনবে না। চেনার মতো কিছু হয়েও যায়নি। হুদাহুদি লেখক ভাব নেয় আরকি। গতকাল ফোন করে বললাম, ‘দোস্ত একটা মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেব। কিছু একটা লিখে ফেইসবুকে মেসেজ দিয়ে পাঠা।’ সে এই লাইনগুলো পাঠাল। এখানে না-কি প্রেমের প্রস্তাব আছে। এখন বুঝলাম শালার ব্যাটা কোনো কাজেরই না।’

অন্তরা আঁতকে উঠে বলল,

— ‘প্রেমের প্রস্তাব মানে!’

— ‘মানে-টানে বাদ দাও। তোমার মা-বাবার স্মৃতি কি যেন বললে আবছা মনে আছে।’

— ‘হ্যাঁ অল্প অল্প মনে আছে।’

— ‘তাহলে বল শুনি।’

অন্তরা স্মৃতির পাতা উল্টে বলতে শুরু করল…
–চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here