আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ৯ম পর্ব .

0
153

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৯ম পর্ব
.
মা-বাবাকে নিয়ে অন্তরার সকল স্মৃতিই কেমন মেঘাচ্ছন্ন, সন্ধ্যার মতন আবছা। তবে শেষের দিনগুলো প্রায়ই মনে পড়ে অন্তরার। স্মৃতির পাতা উল্টে বলতে শুরু করল,

— ‘আমি তখন খুবই ছোট৷ বয়স বছর পাঁচেক হবে। মা-বাবার কি যেন ঝামেলা হচ্ছে ঠিক জানি না। তবে এখন বুঝি, মা বোধহয় ডিভোর্স চাইছিলেন। বাবা মুসলমান, মা ছিলেন হিন্দু। কীভাবে জানি তাদের সম্পর্ক হয়। পালিয়ে বিয়ে করেন। বাবাকে দাদারা গ্রহণ করেননি। মাকে করেননি নানারা৷ তাদের আলাদা বাসা নিয়ে শহরে থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক সংকটে জর্জরিত সংসার।
আমার জন্মের পরেই নানার সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ করেই কি যে হল নানা মা’কে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবেন। মাও রাজি। সবকিছু ঠিকঠাক। আমাদের ছেড়ে মা চলে গেলেন নানার কাছে। বাবাকে একদিন ডাকা হল। আমাকে নিয়ে গেলেন বাবা। নানাদের আলিশান বাসা। খুবই বড়লোক বুঝাই যাচ্ছিল।
মইন সাহেব এলেন কাগজপত্র নিয়ে। বাবা নির্দ্বিধায় ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলেন। দিনটার কথা পুরোপুরি মনে আছে আমার৷ ডিভোর্স পেপারে সই করেই বাবা বেলকনিতে চলে গেলেন। আমি বাবার পেছনে। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। কেমন যেন অস্থিরতা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি। বাবা আমাকে বললেন, ‘তোমার মা’কে বলো একটু আসতে।’
ছোট্ট আমি মা’কে গিয়ে বললাম বাবা ডাকে। আমার সুন্দরী বড়লোক মা বাবার সামনে গেলেন। বাবা চোখ তুলে তাকালেন। জলে ভরা চোখ।
তারপর বললেন, ‘খুব খুশি হয়েছি দিশা। তোমার ভালো একটা পরিবারে বিয়ে হচ্ছে। দীর্ঘ আট বছর আমার সঙ্গে থেকে তোমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নতুন জায়গায় শুনেছি মেয়ের কথা জানাতে চাচ্ছ না। তুমি অন্তরাকে একটু আদর করে দাও৷ তাকে নিয়ে আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাব। আর দেখা হবে না আমাদের। আমাকে মা কোলে নিলেন। খানিক্ষণ আদর করে বাবার কাছে দিয়ে দিলেন। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। মা ফিরেও তাকালেন না। বাবা সেদিনই অন্য কোথাও চলে এলেন। কি জানি কাজ করতেন। বাইরে গেলে আমাকে পাশের বাসার এক আপুর কাছে রেখে যেতেন। তিনিও সারাক্ষণ বাসায় একা থাকেন। স্বামী অফিসে চলে যান। আপু সারাদিন বই পড়ে সময় কাটান। গান কবিতার প্রতি ছিল উনার অসীম আগ্রহ। আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। অবিকল উনার সঙ্গে আবৃত্তি করতে বলতেন। এভাবে আমিও আবৃত্তি করা শিখে যাই৷ সেই আপুটি বাচ্চা জন্ম দেবার সময় মারা গিয়েছিলেন। আমি সেদিনও অনেক কেঁদেছিলাম। ছাদে আপুর ফুল বাগানের মাঝখানে বসে একা একা কাঁদতাম। এর কিছুদিন পর বাবাও গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে আমি এ বাড়িতেই আছি।’

জিসানের মাথায় অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। তবুও সে বিছানা থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভোরের স্নিগ্ধ আকাশ। সুপারি গাছের মাথায় সূর্যের উঁকিঝুঁকি। পাশের বাড়ির হাঁস মুরগির ঘর বোধহয় খোলা হল৷ প্রতিযোগিতা করে মুরগীরা জোরসে ডাকছে। একপাল হাঁস প্যাকপ্যাক করে কি বিলের দিকে গেল?

জিসান খানিকটা আনমনেই বলল,

— ‘আজ চলে যাও অন্তরা।’

অন্তরা বই হাতে পা টিপে টিপে রোজকার রুটিনের দিকে ধাবিত হল। প্রথমে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে সবার জন্য নাস্তা বানাতে হবে। রাশেদা বেগমকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে পেসাব করিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে দিতে হবে।
সায়মা ঘুম থেকে উঠে রাতে স্যারকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছে সেটা দাঁত ব্রাশ করতে করতে বলবে, অন্তরা মনযোগী শ্রোতা হয়ে তা গিলতে হবে।

রোজকার মতো সন্ধ্যায় সাজগোজ করে সায়মা পড়তে গেল। দরজা খুলে দেখল এই অবেলায় জিসান ঘুমোচ্ছে। পরনে কালো সেন্টু গেঞ্জি। বিমোহিত হয়ে খানিক্ষণ সায়মা তাকিয়ে রইল। পাশ ফিরে এক হাতের উপর মাথা আর এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে ঘুমিয়েছে৷ মাথায় ঠাসা ঘন কালো চুল এলোমেলো হয়ে আছে। সায়মার ভেতরকার সমস্ত অলিগলিতে কিসের যেন মিছিল শুরু হয়ে গেল। সে বই টেবিলে রেখে চুপিচুপি মেঝেতে পা ভাজ করে বসে গেল। তারপর ইচ্ছে হল চুলে একটি বার সে আঙুল ডোবাবে৷ ঘোর লাগানো ঘ্রাণ আসছে চুল থেকে৷ কিন্তু বুকে কেমন ভয়। সে নিজের ইচ্ছাকে কবর দিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ চোখ গেল ভাজ করা হাতের সাদা রক্তাভ পেশিতে। সায়মা যেন আর পারে না। ভীষণ ইচ্ছে হল একটিবার ছুঁয়ে দিতে৷ পেশিতে আঙুল দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে সে ডাকল,
–‘জিসান উঠ।’ সঙ্গে সঙ্গে নিজের জিভ কামড়ে ধরল। সে আড়ালে জিসান ডাকলেও সরাসরি স্যার ডাকে।
আবার পেশিতে আঙুল ডুবিয়ে ডাকল,
— ‘স্যার উঠেন পড়তে এসেছি।’

জিসান ঘুম ঘুম গলায় বলল,
–‘মাথা ব্যথা করছে সায়মা। আজ পড়াব না চলে যাও।’

সায়মা অস্ফুটে ‘উফ’ করে উঠল। ঘুম ঘুম গলার স্বর এতো মিষ্টি হয় কেন? খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

সায়মা গলায় এক সমুদ্র মায়া নিয়ে বলল,
— ‘মাথা টিপে দেই স্যার।’

জিসান কোনো জবাব দিল না। সে আবার ঘুমিয়ে গেছে। সায়মা মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে একেবারে জিসানের মাথার কাছে গিয়ে পরম মমতায় চুলে আঙুল ডুবিয়ে আরেক হাতে কপালে ঘষতে লাগল। সায়মার এতো ভালো লাগছে৷ সে ঘোর লাগায় মাথা নুইয়ে বারংবার জিসানের মুখের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ইচ্ছে হল জিসানের মাথা নিজের কোলে এনে আদর করে টিপে দেবে৷ তারই তো ব্যক্তিগত পুরুষ। সেবার শাড়ী পরেছিল জিসান তো নিজ মুখেই বলেছে প্রেমে পড়ে গেছি সায়মা। মানুষটা আর কীভাবে বলবে। সায়মা বিছানায় আরাম করে জিসানের মাথা কোলে নিতে যাচ্ছিল। তখনই জিসানের ঘুম ভেঙে গেল৷ লাফ দিয়ে উঠলো সে বিছানা থেকে।
— ‘আরে কি করছো তুমি?’

আচমকা যেন সায়মার ঘোর কাটলো। সে কি বলবে ভেবে পেল না।

তারপর আমতা আমতা করে বলল,

— ‘আপনার মাথা ব্যথা করছে বললেন তাই ভাবলাম টিপে দেই।’

— ‘বোকা না-কি তুমি। কেউ দেখলে কি হবে জানো? বসো, পড়তে বসো।’

সায়মার আর পড়ায় মন বসল না৷ অমনোযোগী হয়ে সারাক্ষণ জিসানের কথার সঙ্গে কেবল মাথা নাড়িয়ে গেল।

বছর খানেক আগের কথা। একমাত্র ছেলে পিয়াসের সর্বকর্মে আনাড়িপনা দেখে অভ্যস্ত সেতারা বেগম। সেই ছেলে যদি শহরে গিয়ে বছরের মাথায় একটি মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে তাতে একই সঙ্গে আহত এবং বিস্মিত হলে সেতারা বেগমের অপরাধ হবে না। তাও আবার কন্যার চেহারায় বড়লোকী মার্কা সেঁটে আছে। নাম সিক্তা জান্নাত। আঙুলের নখ লম্বা। সেখানে একটুও ময়লা নেই। সিল্কি কালো চুল। রক্তে লাল টসটসে ঠোঁট। ঠুনকা দিলে রক্ত আসার প্রবল সম্ভবনা আছে। সেতারা বেগম মেয়ের পায়ের দিকে তাকালেন।
না, এই পা কখনও মাটিতে পড়েছে বলে মনে হয় না।
বড়ই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। এই ইস্তিরি দেওয়া মেয়েকে ছেলের বউ করে তিনি করবেনটা কি? সে কি উঠোনে ধান নাড়তে পারবে? পায়ের যা অবস্থা ধানে পা পড়লে রক্ত বের হয়ে যাবে না তো আবার!
নানান আগডুম-বাগডুম চিন্তা করলেও মানব মন সুন্দরের পূজারী। তাছাড়া পাড়ার চাচী-টাচীরা চোখ উল্টে ফেলবে বউ দেখে। সেতারা বেগমের মনটা নিমিষেই গর্বে ভরে উঠলো।
–চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here