দেশলাই – ১৬ পর্ব
বাস শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। দু’জন ব্যাগ কোলে নিয়ে বসা। ইলি জানালার পাশটায়। রাফসান একবার ওর দিকে তাকায়, খুব বেশি সাজগোজ নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। ঘন কালো ভ্রু। রোজকার মতো একাপাশের চুল কানে গুঁজে অন্যপাশের চুল কপাল বেয়ে বুকে এসে পড়েছে৷ চটপটে স্বভাব, কিছুতেই জড়তা নেই। কৃত্রিমতা নেই।
– ‘কি রে চুপচাপ বসে আছিস যে?’
– ‘কি কথা বলবো?’
– ‘সারাক্ষণ বকবক করা তো তোর অভ্যাস। এখন কথা খুঁজে পাচ্ছিস না?’
– ‘আমার বকবকানির অভ্যাস আছে জানি বলতে হবে না।’
– ‘আচ্ছা আমি চলে যাওয়ার পর কি হয়েছিল সেদিন?’
– ‘বুঝিনি কথাটা।’
– ‘আমি বিয়ের রাতে চলে যাওয়ার পর নববধূকে কীভাবে বিদায় করা হলো? কোনো ঝামেলা হয়নি?’
– ‘বিয়ের রাতেই বর যদি বধূকে গ্রহণ না করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে কীসের ঝামেলাটাই হবে?’
– ‘এভাবে কথা বলছিস কেন?’
– ‘তুমিই বা এই কথাগুলো বাসে জিজ্ঞেস করছো কেন? বাড়িতে তো জিজ্ঞেস করোনি?’
– ‘আমি মাত্র গত কাল এলাম। তোকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হয়নি। আচ্ছা এগুলো এখন থাক পরে জানা যাবে। এখন বল তো হুট করে তোর মেজাজ খারাপ হলো কেন?’
– ‘কেন খারাপ হয়েছে বলবো?’
– ‘বল।’
– ‘আমাকে বাসে বসিয়ে তুমি বাইরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টেনে এসেছো। এখন গন্ধে আমার বসতে অসুবিধা হচ্ছে তাই মেজাজ খারাপ।’
– ‘ওরে আল্লাহ। তুই এতো খেয়াল করিস কেন সবকিছু?’
– ‘তার আগে বলো তোমার যদি সিগারেট খেতেই হয় বুঝেশুনে খেলে না কেন? তুমি তো জানো সিগারেট টেনেই আরেকজনের পাশে গিয়ে বসবে।’
রাফসান আর কোনো কথা না বলে ম্লান মুখে বসে রইল।
ইলি তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রাগ করোনি আমি জানি। রাগ করলে সীট ছেড়ে চলে যেতে। কি বলবে খুঁজে না পেয়ে ভারি মুখ করে বসে আছো।’
– ‘আমি অযথা রাগ করবো কেন? আচ্ছা যা, আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। তবে রাগ করে না। এমনিই।’
– ‘না, বসো। তোমার বউয়ের কথা জানতে চাইছিলে।’
– ‘আমার বউ মানে?’
– ‘ওমা এখনও তো সে তোমার বউ।’
– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলবি না তো।’
– ‘আচ্ছা শোনো কি হয়েছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর ফুপু অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। তিনিও বউ রাখবেন না। কিন্তু মুরব্বিরা তোমার অপেক্ষায় ছিলেন। তুমি এলে কনেপক্ষকে ডেকে আলোচনা করে কিছু করা যাবে। কিন্তু তুমি আসছিলে না। বধূও লজ্জা-অপমানে নিজ থেকে বলে ওর অবিভাবকদের ডাকতে সে চলে যাবে। তারপর আর কি। আব্বা ঘটকের মাধ্যমে ওর অভিভাবকদের ডেকে জানালেন মেয়ের অসুখ গোপন রেখে বিয়ে দেওয়ায় বর কনেকে মেনে নিচ্ছে না। বাড়ি থেকেও কোথায় চলে গেছে খোঁজ-খবর নেই। ওরা অবশ্য নানান কথা তুলেছিল। আইন-কানুন দেখাচ্ছিল। কিন্তু কনে পরিষ্কার ভাষায় বলেছে থাকবে না। তারপর ওরা নিয়ে গেল।’
– ‘বুঝেছি। মা শেষদিকে অনেক ভেঙে পড়েছিলেন তাই না?’
– ‘হুম। তোমার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করতেন।’
দু’জন অনেক্ষণ চুপচাপ থাকে। খানিক্ষণ পর ইলি নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আচ্ছা রাফসান ভাই। আমি না-কি ফুপুর মতো হয়েছি?’
– ‘কোন ফুপু?
– তোমার আম্মা।
– আমার কাছে লাগে না তো।
– বাবা বলেন।
– ও আচ্ছা।
– যেদিন ফুপু মারা গেলেন তার আগেরদিন আমি রাতে স্বপ্নে দেখলাম সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে বাঁশ কাটছে। কেউ কেউ মাটি খুঁড়ছে।
– তাই না-কি?
– হ্যাঁ। আমি এরকম দেখি। যেমন তোমার মৃত্যুর আগেও স্বপ্নে দেখতাম কত কি।
– আমার মৃত্যুর আগে মানে? তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস না-কি।
– তুমি জীবিত?
– কি বুঝাতে চাচ্ছিস?
– কিছু না।
– তোর একটা অভ্যাস কি জানিস?
– কি?
– ছোট থেকেই তোর অভ্যাস ছিল খালি বড়দের মতো ভাব নেয়া। যেমন ছোট বেলায় শাড়ি পরে মামীর মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করা। কথা বলা।
– মিথ্যে।
– সত্য। গিয়ে জিজ্ঞেস করিস মামীকে।
– তার মানে কি দাঁড়াল। আমি এখন মুরব্বিয়ানা করছি। তাইতো?
– সব সময়ই করিস।
– করতেই পারি। ফোর্থ ইয়ারে পড়ি৷ দু’দিন পর গ্রাজুয়েশন কম্পেলেট হবে। মুরব্বিয়ানা করলে বেমানান লাগার কিছু নাই।
– বাবা।
ইলি ম্লান মুখে বাইরে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল, ‘আমার মুরব্বিয়ানায় তুমি বিরক্ত তাই না?’
– ‘সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমি এমনিতেই বললাম।’
– ‘বিরক্ত হলেও মুরব্বিয়ানা করবো।’
রাফসান হেঁসে বলল, ‘আচ্ছা করিস।’
– ‘শ্রীমঙ্গল টাউনে নেমে অনেক মুরব্বিয়ানা করবো। সব বাধ্য ছেলের মতো শুনতে হবে।’
– ‘কি করবি?’
– ‘নামার পর দেখা যাবে।’
– ‘আচ্ছা।’
তারপর আবার দু’জন নীরব। ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই তারা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেল। ব্যস্ত শহর। ব্যস্ত মানুষ। রিকশার টুংটাং শব্দ। গাড়ির সাইরেন। তারা বাস থেকে নেমে গেল।
ইলি চারদিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘হোটেল একটা দেখা যাচ্ছে। চলো চা খেতে খেতে বলি।’
– ‘কি এতো বলবি? শুধু ঢংই করছিস।’
দু’জন হোটেলের ক্যাবিনে গিয়ে বসে। ওয়েটার চা দিলো।
ইলি চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা কথা রাখবে তো?’
– ‘কি?’
– ‘সেলুনে চলো। তুমি সিলেট থাকতে যেভাবে চুল আর দাড়ি কাটছাঁট দিয়ে রেখেছিলে সেরকম কাটবে।’
– ‘ও বাবা কতবার কতভাবে কেটেছি মনেই তো নাই।’
– ‘ওই যে একদিন আমি পড়ার টেবিলে ছিলাম। তুমি এলে। গালে কাটছাঁট মেরে রাখা দাড়ি। চুল স্টেইট করা। বাম হাতে কালো ঘড়ি। পরনে পানপাতা রঙের গেঞ্জি। কালো ট্রাউজার।’
– ‘সব মনে আছে তোর? কিন্তু এখন চুল স্ট্রেইট দেবার সময় নাই।’
– ‘স্ট্রেইট লাগবে না, সামনের চুল লম্বা রেখে সেরকম কাটবে। তারপর বাজার থেকে ঘড়ি, গেঞ্জি কিনবো।’
– ‘এতো টাকা তো নেই আমার কাছে।’
– ‘আমার কাছে আছে।’
– ‘কই পেলি?’
– ‘আমি তো করোনা আসার আগে লাগাতার টিউশনি করিয়েছি। কিন্তু টাকা খরচ হয় না কিছুই। পড়ালেখা সহ সব খরচ তো খালারা পাঠিয়ে দেন।’
– ‘তাহলে টিউশনি কষ্ট করে করতে যাস ক্যান?’
– ‘আমার ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে।’
রাফসান খানিক হেঁসে বলল,
– ‘ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে এটা কেমন কথা?’
– ‘থাকুক কেমন কথা। এখন চা খেয়ে সেলুনে চলো।’
– ‘বাদ দে। পরে কাটবো। তোর টাকা খরচা করার দরকার নাই।’
– ‘শোন রাফসান ভাই, ঘাড়ত্যাড়ামি অভ্যাসটা ছাড়ো। তুমি কিন্তু নিজের ভুলে লাইফটা নষ্ট করেছো। পড়ালেখা সবকিছু বাদ গেছে। ইন্ডিয়া গিয়েও এক বছর নষ্ট হয়েছে। বিধবা মাও তোমার চিন্তায় তিলে তিলে শেষ হয়েছেন। বিয়ে একটা করেও ঝামেলা হলো। লোকে এখন তোমাকে পাগল বলে জানো সেটা? এই অবস্থায় তুমি মেহমান বাড়ি গেলে সবাই দেখে কি বলবে? আমার কথা শোন। শ্রীমঙ্গল এসেছো, এখন রিফ্রেশ হও। আমারও বেড়ানোর ইচ্ছা৷ এই কয়দিন তুমি আমার কথামতো চলতে পারবে না? আমি শ্রীমঙ্গলে সব জায়গা তোমাকে নিয়ে ঘুরবো। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে।’
– ‘তারপর কি হবে? রিফ্রেশ হয়ে গেলে আমার সবকিছু কি ফিরে আসবে?’
– ‘না, কিন্তু নতুন করে ভাবতে হবে তো তোমাকে। মনটা সতেজ হোক। তাছাড়া হঠাৎ করে এসে শুনেছো ফুপু মারা গেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তোমার কিছু ভালো মুহূর্ত কাটুক। চুল-দাড়ি কেটে সেলুনে মাথা ধুয়ে-মুছে নেবে। তারপর শপিং করে ট্রায়াল রুমে গিয়ে সব পরে নিবে।’
– ‘তুই নিজেই ঘাড়ত্যাড়া। আমাকে উল্টো বলিস।’
– ‘তোমার মাথা। উঠো। আর এই টাকাগুলো তোমার কাছে নাও। সব জায়গায় তুমিই বিল দেবে।’
চা বিল চুকিয়ে তারা সেলুনে যায়। ইলি সেলুনের বাইরের সোফায় বসে মোবাইল টিপে। কোনো বিব্রতবোধ নেই। চুল-দাড়ি কেটে রাফসান বেরুল। ইলি তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
– ‘এবার অনেকটা ভালো লাগছে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হুম। আচ্ছা চলো। তোমার শপিং করবে।’
তাদের কেনা-কাটা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতের কারণে ইলি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো শপিংমলে গিয়ে। গেঞ্জি না কিনে শার্ট নিল। রাফসানের ব্যাগেই ছিল গোল গলার কালো গেঞ্জি। সেটির উপর শার্ট। বাম হাতে ঘড়ি। শার্টের হাত গুটানো। প্যান্ট আগেরটাই চলার মতো আছে। কিন্তু টাকায় টান পড়তে পারে ভেবে কেডস পরিবর্তন করা হলো না। তারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো। শহরজুড়ে নানান রঙের বাতি জ্বলছে। ইলি তাকিয়ে রসিকতা করে বলল,
– ‘পুরাই হিরো লাগছে।’
– ‘পাম দিস না।’
– ‘সত্যি বলছি। তোমার নিজেকে ফ্রেশ লাগছে না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘চলো মেহমান বাড়ির জন্য কিছু নিই।’
দু’জন গেল একটি দোকানে। এরমধ্যেই হৃদ কল দেয় ইলিকে। ফুপুর বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে বলে রেখে দেয় ইলি।
দোকান থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে তারা চললো বাসার দিকে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি।
– ‘যা শালা। সীম তোলা হয়নি।’
– ‘কাল বেরুলে তুলে নেয়া যাবে। আমারও মনে পড়েনি।’
– ‘হ্যাঁ কাল তুলতে হবে।’
মিনিট বিশেক পরেই তারা পৌঁছে গেল। ব্যাগ-প্যাক নামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে তারা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ইলি তাকিয়ে দেখলো গাড়ির শব্দ শুনেই ফুপু আর ফুফা উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তারা যেতেই রোগাটে ফুপু দু’জনকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘সেই কখন লতিফ মিয়া কল দিয়ে বললো তোরা বেরিয়েছিস। এতো দেরি হলো কেন রে? চলো ঘরে চলো।’
ঘরে গেল। তাদের দেখে পর্দার আড়ালে লুকোচুরি করছে বাচ্চা একটি মেয়ে। ইলি এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে বের করে কাছে নিয়ে বলল, ‘ফুপু ও মিনহাজ ভাইয়ের মেয়ে তাই না?’
– ‘চিনবি কেমনে? এসে দেখেছিস ওর জন্মের পর?’
– ‘পড়ালেখার জন্য আসা হয়নি। আব্বা তো এসেছিলেন। ওর নাম লিজা তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমার এক বান্ধবীর নামও লিজা। আচ্ছা মিনহাজ ভাই কোথায়?’
– ‘দোকানে আছে। দশটার পর চলে আসবে।’
লিজার মা এলেন। তাদের সঙ্গে কথা হলো।
মিনহাজের সঙ্গে রাতের খাবার টেবিলে দেখা হয়।
ভদ্রতার বাক্য বিনিময়ের পর ইলি জিজ্ঞেস করল, ‘মিনহাজ ভাই, হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা এখন কেমন?’
– ‘ওদিকের রাস্তা সব সময়ই খারাপ। এখন কিছুটা ভালো আছে। তবে বর্ষাকালে জায়গাটা বেশি ভালো লাগে। যাবি না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, কালই যাবো।’
চলবে…