দেশলাই – ১৮ পর্ব
লাঠি হাতে ম্লান মুখে ইলি হাঁটছে৷ রাফসান ওর কাছাকাছি গিয়ে বলল,
– ‘জুতা পরে নে ইলি। খালা তোর হাঁটার সুবিধার জন্য পুরোনো বেল্টওয়ালা জুতা ব্যাগে ভরে দিয়েছেন।’
ইলির কাছ থেকে কোনো জবাব এলো না।
রাফসান খানিক্ষণ ওর পায়ে পায়ে হেঁটে মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
– ‘গোমড়ামুখে কি ভ্রমণ হয় রে ইলি?’
এবারও কোনো জবাব নেই। প্রতিক্রিয়া নেই। যেন সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। নিজের মতো গাইডের পিছু পিছু হাঁটছে। রাফসানের সঙ্গে তার কোনো পূর্ব পরিচয় নেই। অন্য আট-দশজন পর্যটকের মতো রাফসান কোথাকার ছেলে সে জানে না। জানার দরকারও নেই। এই মুহূর্তে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে গাইডের পিছু পিছু হাঁটা।
কিন্তু রাফসান নাছোড়বান্দা হয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে নানানভাবে ইলির মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। খানিক সামনে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে আবার হাসতে হাসতে বলল, ‘লাঠি হাতে তোকে কি যে ভয়ংকর লাগছে ইলি। দাঁড়া ছবি তুলে দেখাই।’
কিন্তু কে শুনে কার কথা। ইলি নিজস্ব গতিতে মুখ ভার করে হাঁটে। তবুও রাফসান হুটহাট ক্লিক মেরে কয়েকটি ছবি তুলে নেয়। গাইড ‘হেহে’ করে হাসে।
রাফসান ছবিগুলো দেখার আর সময় পেল না।
তারা হেঁটে হেঁটে লোকালয় পেরিয়ে জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এসেছে। এদিকে আর মানুষের বসতবাড়ি নেই। কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা।
গাইড তাদেরকে দু’টি রাস্তা দেখিয়ে বলল, – ‘এই যে দেখেন। এইটা হচ্ছে টিলা পথ আর এইটা ঝিরিপথ। এইবার কন কোনদিকে যাবেন।’
ইলি জবাব দিলো,
-‘ঝিরিপথ দিয়ে যাবো। টিলা পথে ফিরে আসবো।’
– ‘আইচ্ছা তাইলে চলেন।’
হাসানোর জন্য রাফসানের আবার বৃথা চেষ্টা করে বললো, ‘ঝিরিপথে আমরা যুদ্ধ করতে করতে যাবো আর টিলা পথে পালিয়ে আসবো, তাই নারে ইলি?’
ইলির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কেবল গাইড ভদ্রলোক ‘হেহে’ করে হেঁসে রাফসানকে সঙ্গ দিলেন।
খানিক এগুতেই জঙ্গলের সম্মুখ পথে দৃশ্যমান হলো একটি ছোট্ট খাল। সেখানে শুকনো গাছের একাংশ বিছিয়ে রাখা। ধরে যাবার জন্য কোনো হাতল নেই। গাইড ম্যান ওপারে চলে গেল। রাফসানও মোবাইল ব্যাগে পুরে লাঠি হাতে সাবধানে ওপারে গিয়ে ইলিকে বললো,
‘আয়।’
ইলি আমতা-আমতা করছে। হাতল ছাড়া কীভাবে পার হবে বুঝতে পারছে না। গাইড তাড়া দিয়ে বলল,
– ‘এইটা পার হইতে না পারলে যাইবেন কেমনে? এইটা তো মাত্র শুরু ম্যাডাম।’
রাফসান একটু এগিয়ে তার লাঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– ‘হাত বাড়িয়ে এটা নে। দু’টা লাঠি দিয়ে পার হতে সুবিধা হবে।’
লাঠির দিকে হাত না বাড়িয়ে ইলি সাহস করে গাছে পা দেয়। রাফসান আবার উপরে উঠে গেল। ইলি কাঁপতে কাঁপতে লাঠিতে ভারসাম্য রক্ষা করে উপরে এসে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাঁচে।
তারা এবার হাঁটতে থাকে নানান ধরনের গাছগাছালির মাঝখান দিয়ে। সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জারুল গাছ। রাফসান পকেট থেকে মোবাইল বের করে গ্যালারিতে গিয়ে ছবি দেখে পেছন থেকে একা একা হাসতে শুরু করে। উদ্দ্যেশ্যে ইলির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু ইলির কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। রাফসান এবার লাইনচ্যুত হয়ে কয়েকটি জারুল গাছের দিকে ঘুরে ইলির সামনে গিয়ে মোবাইল চোখের সামনে ধরে ঠাট্টা করে বললো, ‘দেখ দেখ তোকে কেমন লাগছে।’
ইলি তাকায় না। তাকালে দেখতো সত্যিই কত অদ্ভুত লাগছে। হাঁটার সময় ছবি তুললে যেমন হয়। ইলির এক হাতে লাঠি, এক পা মাটি থেকে উপরে। মাথা আকাশের দিকে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সেও জারুল গাছের দিকে গিয়ে রাফসানের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যায়।
রাফসানের এবার রাগই হলো, অস্ফুটে বলল,
– ‘ধুরো বাল, হুদাই রাইগা আছে।’
মেজাজ খারাপ হলে সিগারেট খাওয়া নিয়ম।
সে টান দিয়ে ব্যাগটা সামনে এনে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট বের করে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরাই। শব্দ শুনেই ইলি পিছু ফিরে তাকায়। তারপর আবার নিজের মতো হাঁটতে থাকে। রাফসান দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট ব্যাগে রেখে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
– ‘তাকানোর কি আছে? এতো বড়ো জঙ্গলে সিগারেট খেলে তো কারও সমস্যা হওয়ার কথা না।’
খানিক এগুতেই দেখা গেল জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে নানান রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে বহুদূরে উড়ে যাচ্ছে। ইলি সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো, ‘ওয়াও, কি সুন্দর। মনে হচ্ছে প্রজাতির ডানায় কোনো মানুষ নিজের হাতে রঙ করে দিয়েছে। এতো ঝকঝকে রঙিন। উফ।’
গাইড পেছন ফিরে বলল, ‘আগে আরও বেশি আছিল বুঝলেন, মানুষের চলাচল বাড়ায় সবকিছু কমে যাচ্ছে।’
রাফসান পিছু থেকে থেকে বলল,
– ‘শুনলাম প্রথমে না-কি এসব রাস্তায় বাঘ, সাপও পাওয়া যেতো।’
– ‘হ, এখনও মাঝেমধ্যে পাওন যায়।’
– ‘এখানে এসে কেউ কি কোনোভাবে দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে?’
– ‘হ, কত দূর্ঘটনা হয়। কিছুদিন আগেও একজন পাহাড় ঝর্ণার উপরে গিয়েছিল কেমনে, কোত্থেকে পানি আসে দেখতে। কিন্তু সেখান থেকে ঝর্ণার পানির সাথে নিচে পড়ে মারা যায়।’
– ‘মাই গড।’
খানিক এগুতেই গাইড বলল, ‘এখন বেতের বাগান শুরু হবে আপনেরা মাঝখান দিয়ে হাঁটবেন। না হইলে বেতের কাটায় কাপড় আটকাইব।’
মাথা নেড়ে সায় দেয় রাফসান। একটু পরেই লতানো চিরুনির মতন কাটা ওয়ালা বেতের বাগান দৃশ্যমান হয়। মাঝখান দিয়ে মানুষের তৈরি আঁকাবাকা পথ। ইলি ভার মুখে সাবধানে বেত বাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটে৷ বেত বাগান পেরিয়ে খানিক যেতেই দেখা যায় চারদিকে প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর। সেখানে নানান ধরনের বাঁশ লক্ষণীয়।
রাফসান গাইডকে বলল, ‘এখানে তো একই রকম বাঁশ মনে হচ্ছে না।’
– ‘না এখানে অনেক প্রজাতির বাঁশ আছে
ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি বাঁশ আছে।’
– ‘কি অদ্ভুত অদ্ভুত নাম। তবে দারুণ লাগছে দেখতে।’
আরেকটু সামনে গিয়ে ইলি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আরে এতো গহীন জঙ্গলে এসে কলাগাছ লাগালো কে?’
গাইড হলদে দাঁত বের করে হেঁসে বলল,
– ‘এগুলা বন্য কলাগাছ। কেউ লাগায়নি এমনিতেই হইছে।’
– ‘ওয়াও, এতো সুন্দর, সুশৃংখল সারিবদ্ধভাবে নিজ থেকে হয়ে গেছে?’
– ‘হ।’
রাফসান ইলি মুগ্ধ নয়নে চারদিকে তাকিয়ে হাঁটছে। কীসের একটা কড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঠিক ধরা যাচ্ছে না।
গাইড পেছনে তাকিয়ে বলল,
– ‘এখন একটা ছোট্ট সাঁকো পাইবেন। এইটা প্রথম সাঁকো। এরকম আরও সাতটা সাঁকো পাওন যাইব।’
ইলি ভয়ে আঁতকে উঠে বলল, ‘আল্লাহ এতো সাঁকো।’
– ‘সমস্যা নেই। ছোট্ট সাঁকো। উপরে হাতলও আছে।’
খানিক সামনে যেতেই সাঁকোটি দেখা গেল। আসলেই সমস্যা নেই। ছোট্ট এবং শক্ত হাতল দেয়া। গাইড যাওয়ার পর ইলিও সাচ্ছন্দ্য ভাবে পার হয়ে চলে গেল। তাদের পেছনে রাফসান।
হাঁটতে থাকে তারা। যেদিকে চোখ যায় নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফুলের গাছ পরম মমতায় কেউ সৃষ্টি করে রেখেছে মানুষকে বিস্মিত করার জন্য। অপরূপ সৌন্দর্য থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। কানে অবিরাম ভেসে আসছে নানান পোকা, পাখি, জন্তু জানোয়ারের ডাক।
আরও খানিক্ষণ হেঁটে যেতেই মাথা ধরে যাচ্ছিল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে।
– ‘কি মামা, এতো ঝিঁঝি পোকার ডাক কোত্থেকে আসছে?’
– ‘একটু সামনে গেলে পাইবেন চারদিকে শালগাছ আর এক টানা শুনবেন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রাজকান্দি ফরেস্টের পুরো রাস্তা মনে করেন এই শব্দ চলতে থাকবে।’
সত্যিই তাই হলো। একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকা। শালবন পেরিয়ে তারা পেল কিছু উঁচু-নীচু টিলা। যতই এগুচ্ছে তারা গহীন জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে যেসব স্থানে মানুষের পদচিহ্নও পড়েনি। পুরো জঙ্গল জুড়ে নানান প্রাণীর মিশ্র ডাক। হঠাৎ কিছু তীব্র শব্দ শুনে ইলি কেঁপে উঠে। হাত থেকে লাঠি পড়ে যায়। বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। রাফসানও কান পেতে চারদিকে তাকাচ্ছে। কি ভয়ংকর চিৎকার। জঙ্গল যেন কাঁপিয়ে তুলছে।
ইলি লাঠি হাতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গাইডকে বলল,
– ‘এরকম কি ডাকে?’
– ‘কতকিছু আছে জঙ্গলে। প্রত্যেকটা পোকা, পশু-পাখিরাই ডেকে যাচ্ছে অনবরত।’
– ‘কিন্তু ওইযে শোনা যাচ্ছে এটা কিসের?’
– ‘উল্লুকের ডাক শোনা যাচ্ছে।’
রাফসান ইলির কাছাকাছি এসে বলল,
– ‘কেমন ভূতের পরিবেশ তাই না? হরর সিনেমার মতো নানান শব্দ।’
ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান গাইডকে বলল, ‘আচ্ছা আর কোনো মানুষ দেখছি না যে?’
– ‘ঝর্ণায় গিয়ে পাইবেন। সামনে পেছনেও মানুষ আছে। কিন্তু গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়ের জন্য একটু দূরের কেউ কাউকে দেখতে পায় না বুঝছেন।’
– ‘হুম বুঝেছি।’
– ‘মাঝে মাঝে দূর থেকে বিপন্ন বনমানুষের ডাকও আসে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ। আরো কতকি আছে। আরে মিয়া বুঝেন না কেন। কলাবন থাইকা আর বাড়িঘর নাই। এক সময় মানুষ রাতে ভরা বর্ষায় শুধু ঝর্ণার পানির আমআম শব্দ শুনতে পাইতো। কারণ অনেক উপর থাইকা পানি পড়ে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারতো না কিসের ডাক। কোথা থেকে আসে। মানুষ আসতোই না এতো গভীরে। এই জঙ্গল গিয়ে লাগছে ভারতের ত্রিপুরা। সেখানের বাসিন্দারা আদিবাসী।’
– ‘ও আচ্ছা।’
এভাবেই তারা অদ্ভুত অদ্ভুত ডাক শুনে। অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে দেখতে ঝিরি পথের সামনে চলে আসে।
গাইড পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘সাবধানে হাঁটবেন। পড়লে কিন্তু ব্যাথা পাইবেন। পানিও একেক জায়গায় ব্যাপক।’
ইলি হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা হাপিয়ে উঠেছে। ঝিরি পথের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ছেড়ে ওড়নার মাথা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নেয়। তারপর আবার ওড়নাটা শক্ত করে বাঁধে। এতো ক্লান্তিতেও পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথ দেখে, সুমধুর পাখির কলরব এবং দূর থেকে ভেসে আসা উল্লুক, বিপন্ন বন মানুষের ডাক শুনে ভয়ের সঙ্গে ভালো লাগার অনুভূতিতে ভরে যায়।
রাফসান কান পেতে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পাখিরা শিস দিচ্ছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে কিচিরমিচির করছে। কখনও মনে হচ্ছে গান গাচ্ছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে পাখিরা তাদের দিকে গালি ছুড়ে দিচ্ছে। গাইডকে লক্ষ্য করে বলল, ‘কি মামা, ঝিরিপথে এতো পাখির ডাক কেন?’
– ‘হ, পুরা ঝিরি পথে এরকম শুনা যাবে। কিন্তু এর পর ঝর্ণার পানির শব্দে কিচ্ছু শুনা যাবে না।’
– ‘ও আচ্ছা।’
ধীরে ধীরে তারা সচ্ছ শীতল পানিতে লাঠি হাতে নেমে পড়ে। ঝিরি পাথরের ওপর হাঁটা খুবই কষ্টের মনে হচ্ছে ইলির কাছে। মাঝেমধ্যে কোমর অবধি পানি। কোথাও এতটাই শুকনো যে নিচ দেখা যায় সিমেন্টের ঢালাই করার মতো এবং খুবই পিচ্ছিল। ইলি লাঠিতে ভারসাম্য রক্ষা করে হাঁটছে খুব ধীরে ধীরে। গাইড চলে গেছে বহুদূর। রাফসান খানিক দূরে গিয়ে বারংবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। ইলি পেছনে পড়ে যাচ্ছে বারংবার। অসংখ্য পাখির ডাকের মাঝখানে হঠাৎ উল্লুকের ডাকে কাঁপন ধরে যায় তার বুকে। ঝিরিপথের চারপাশে ডুমুর গাছের সঙ্গে বাঁশঝাড় বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়াও নাম না জানা অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরপুর। প্রতিটি গাছের ডাল দু-দিক থেকে নুইয়ে ঝিরিপথকে কেমন বিচ্ছিন্ন করে ভয়ংকর রুপ দিয়েছে।
মাঝে মাঝে গোড়ালি সমান পানি দেখা যায়। নিচ সিমেন্টের ঢালাই এর মতো। রাফসান সেরকম একটি জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে ইলির জন্য অপেক্ষা করছে। ইলি তার কাছাকাছি চলে এসেছে হঠাৎ দেখে তার বাম পায়ের আঙুলের চিপায় জোকে ধরেছে। ইলিকে দেখানোর জন্য রাফসান ইচ্ছে করেই বললো, ‘ওমা গো জোক।’
ইলি রাফসানের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মতো লাঠি হাতে পানিতে চপচপ শব্দ তুলে সামনে চলে গেল।
রাফসান মাথা নুইয়ে এক টানে জোক হাতের মুঠোয় নেয়। আঙুল থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। তবুও সাবধানে দৌড়ে ইলির সামনে গিয়ে ভয় দেখানোর জন্য বলে,
– ‘মাথায় দিয়ে দেই। দেই…দেই..দিচ্ছি কিন্তু..দিচ্ছি।
ইলি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ভাবলেশহীনভাবে হাঁটছে। রাফসান এবার চেহারা দেখে বুঝতে পারে এই রাগ ঢং করে ভাঙানোর মতো না। তারও নিমিষেই মন খারাপ হয়ে গেল। পুরো ভ্রমণটাই যেন মাটি৷
ম্লান মুখে সেও হাঁটতে থাকে। ইলি আবারও পেছনে পড়েছে। রাফসান আর দাঁড়ায় না। তার রীতিমতো রাগ হচ্ছে৷
ইলি জোকের জন্য ভয়ে ভয়ে হাঁটছে৷ জোকে ধরলে সর্বনাশ। তাছাড়া আসার আগে বুঝেনি এতোটা ভয় লাগবে৷ এখন মনে হচ্ছে হরর বই কিংবা সিনেমা থেকে কম ভয়ংকর না জায়গাটা। এক বিচ্ছিন্ন জগতে চলে এসেছে মনে হচ্ছে। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত তারা জঙ্গলের পথে হাঁটছে।
আচমকা কাছাকাছি কিছু একটার ডাক শুনে মাথা তুলে তাকাতেই পা পিছলে সামনের দিকে পড়ে পুরোটাই ডুবে গেল ইলি। নিচে পাথরে হাঁটু লেগে ব্যাথা পায়। লাঠি ভেসে যায় পানিতে।
রাফসান শব্দ শুনে পিছু ফিরে তাকিয়ে দৌড়ে আসে।
তার ইন্ডিয়া যাবার অভিজ্ঞতার কাছে এখানকার সবকিছু খুবই তুচ্ছ। রাফাসান আসার আগেই ইলি উঠে গেল। লাঠি এনে হাতে দিতে যাবে তখনই ইলি বলল,
– ‘লাগবে না।’
তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে লাঠি নিয়ে এলো। গাইড দাঁড়িয়ে আছে দূরে। রাফসান ইশারা করলো যেতে। গাইড নিজের মতো আবার হাঁটতে থাকে। ইলি কিনারার কাছাকাছি গিয়ে হাঁটু থেকে রক্ত বেরুচ্ছে কি-না দেখতে যাবে তখনই চোখে পড়ে ডান পায়ের গোড়ালির সোজা উপরে একটা কালো তেলতেলে মোটা জোক দু’দিকে মুখ গেড়ে একদম পায়ে সেঁটে আছে।
ভয়ে চিৎকার করে জোক ছাড়ানোর জন্য ইলি ডান পা পানিতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার উল্টে পড়ে পেছনের দিকে। ব্যাথা পায় কনুইয়ে। রাফসান হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে যেয়ে নিজেও ব্যাগ সহ পড়তে পড়তে লাঠির কারণে আঁটকে যায়। ইলি কোনোভাবে মাথাটা তুলে কাশি দিতে দিতে আবার পড়ে গেল। রাফসান তাড়াতাড়ি গিয়ে টেনে খাঁড়া করে পিঠের দিকে হাত পেঁচিয়ে ধরে। ইলির নাকে-মুখে পানি ঢুকে যাওয়ায় কাশতে থাকে। কাশি খানিক কমতেই রাফসান বাম হাতে লাঠি সহ ইলিকে বুকের সঙ্গে চেপে রেখে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছে,
– ‘শান্ত হ, কিচ্ছু হবে না। শ্বাস নে ধীরে ধীরে। আমি আছি না। দেখিস জোক কীভাবে ছাড়াই।’
কিন্ত ইলি খানিকটা শাস্ত হবার পর মোচড়ামুচড়ি করে বলল,
– ‘ছাড়ো আমাকে। জোক ছাড়ানো লাগবে না আমার। রক্ত খাক। ছাড়ো।’
চলবে…